#শুকতারা ( পর্ব-১৪)
#হালিমা রহমান
ক্লাস টেনে জুলিয়াস সিজার সম্পর্কে একটা আনসিন প্যাসেজ পড়েছিল সূচি।জুলিয়াস সিজারের লম্বা-চওড়া কথাঃ” এলাম,দেখলাম,জয় করলাম”, পড়ে মুখ ভেঙিয়ে রত্নাকে বলেছিল, সিজার একজন অহংকারী লোক।এতো বড় কথা কীভাবে বলতে পারে? দেখামাত্র কোনোকিছু জয় করা সম্ভব? এতো তাড়াতাড়ি কিছু হয়? অসম্ভব।আজকাল বই-খাতায়ও মিথ্যা কথা বলে।
আজকের সন্ধ্যাটা না দেখলে হয়তো সূচি বিশ্বাসই করতো না চোখের পলকে অসম্ভব কিছু ঘটে যাওয়া সম্ভব। সেই ক্লাস টেনের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে,মনে পড়ছে জুলিয়াস সিজারের সেই বিখ্যাত কথা।” এলাম,দেখলাম,জয় করলাম।”
ফয়সাল এলো,দেখলো,বিয়ে করলো।কত তাড়াতাড়ি ঘটলো সব!চোখের পলকে বিয়েটা হয়ে গেল।সূচি ঠিকমতো বুঝতেও পারলো না।এখানে বিকাল শেষে সন্ধ্যা যেমন ঝুপ করে নামে,দিনের আলো হটিয়ে একমুঠো কালো অন্ধকার যেমন হুট করে ভর করে চারপাশে,ঠিক তেমনই হুট করেই সূচির বিয়েটা হয়ে গেল।সূচির বহুদিনের স্বপ্ন পূরণ হলো একদম অনাড়ম্বরভাবে।আয়োজনের ছিটেফোঁটাও ছিল না। মনির থেকে ধার করা কলাপাতা রঙের শাড়ি গায়ে দিয়েই সূচির বিয়ে হলো।বিয়ের স্মৃতি হিসেবে সযত্নে আলমারিতে তুলে রাখার মতো নিজের একটা শাড়িও ছিল না শরীরে।সে না থাক,সূচির দুঃখ নেই।ফয়সালকে পেয়েছে এই তো অনেক।কতদিনের আশা,আকাঙ্ক্ষা, ভালোবাসা! ফয়সাল যদি এর একটুও অনুভব করতে পারতো!
ইংরেজি ত্রিশে ডিসেম্বর,বাংলা পনেরোই পৌষ,আরবিতে জমাদিউল আউয়াল মাসের পঁচিশ তারিখ।সূচির বিয়ের তারিখ।ঘরের খুঁটির সাথে টাঙানো একুশ সালের পুরোনো ক্যালেন্ডারটা খুলে নেয় সূচি।এ বছরের আর মাত্র একদিন বাকি।ক্যালেন্ডারের আর প্রয়োজন নেই।লাল-সাদা রেক্সিন বিছানো কাঠের টেবিলের উপর তন্নতন্ন করে খোঁজে সূচি।বই-খাতার এক ফাঁকে টকটকে লাল কালির কলমটা দেখা যাচ্ছে।সূচি হাত বাড়িয়ে কলম নেয়।খাটের কোনে বসে ক্যালেন্ডারের নির্দিষ্ট তারিখে গোল দাগ দেয়।তারিখের উপরে গাঢ় করে লিখেঃ”আলহামদুলিল্লাহ।” এইচএসসি পরীক্ষার পর আর লেখা হয়নি।লেখাটা ত্যাড়াব্যাকা হয়।সূচি চোখে পানি ও ঠোঁটের কোনে হাসি নিয়ে ক্যালেন্ডারের তারিখে আলতোভাবে হাত বুলিয়ে দেয়।এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না বিয়েটা হয়ে গেছে।আধঘন্টা আগে এই খাটে বসেই, কপাল পর্যন্ত ঘোমটা দিয়ে তিনবার কবুল বলেছে সূচি। কাজী সাহেব দরজার বাইরে চেয়ার পেতে বসেছিলেন।এ ঘরে মা,জয়া ভাবি,মনি ভাবি,চম্পা ভাবি,হুমায়রা,আলেয়া দাদি,রত্না– সবাই সূচিকে ঘিরে বসেছিল।দরজার উপরের দড়ির সাথে লম্বা পর্দা টাঙানো।পর্দার আড়ালে বসে কাজী সাহেব যখন কবুল বলতে বললো, তখন সূচির সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠলো।বসন্ত বাতাসে আমের কচি পাতা যেমন থরথর করে কাঁপে,ঠিক তেমন করে সূচিও কাঁপছিলো।থরথর,থরথর।আশেপাশে সবাই গুনগুন করছিলো।মা কাঁদতে কাঁদতে সূচির পিঠে আলতো ধাক্কা দিয়ে বলেছিলোঃ” কবুল ক, সূচি।বিয়া তো একদিন হইতোই।এখন একটু আগে হইতাছে।কান্দিছ না।কবুল ক।”
সূচি সত্যিই কাঁদছিলো।হেঁচকি তুলে কাঁদছিলো।হাপুস নয়নে কেন কেঁদেছে তা এখনো বুঝতে পারছে না।এতোদিনের আশা পূরণ হয়েছে,এতো কান্নাকাটির দরকার ছিল না।তবুও কেঁদেছে সূচি।হয়তো আবেগে কেঁদেছে।বহুদিনের লালিত স্বপ্ন পূরণ হওয়ার আবেগ যা-তা নয়।মানুষ শুধু কষ্ট পেলেই কাঁদে? না, কখনো কখনো মাত্রাতিরিক্ত আনন্দেও কাঁদে।সূচির হয়েছে সেই দশা।মেয়েটা কাঁদে আর কাঁদে।ওদিকে কাজী সাহেবও খানিক অধৈর্য্য হয়ে গিয়েছিলেন বোধহয়। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মমিন শেখকে ইশারা দিয়ে প্রশ্ন করলেনঃ” মেয়ে রাজি না?”
মমিন শেখ ব্যস্ত হয়ে মেয়ের ঘরে ঢুকলেন।স্ত্রীকে চোখের ইশারায় প্রশ্ন করলেনঃ” সূচির কী হইছে? কবুল কয় না কেন?”
পাশ থেকে জয়া,মনি,চম্পা সূচির হাত-পায়ে টিপে দেয়।নিচু গলায় প্রশ্ন করেঃ” কিরে,কবুল বলবি না? বিয়ে করবি না? ফয়সালরে চইলা যাইতে বলুম?”
সূচির ধ্যান ভাঙলো।এতোক্ষণের বোকামির জন্য মনে মনে চড় মারতে ইচ্ছে করলো নিজের গালে।সবাই কতো বিরক্ত হয়ে গেছে! আলগোছে চোখের পানি মুছে মিনমিন করে বললোঃ” কবুল,কবুল,কবুল।”
তিনটি জাদুকরী শব্দ।সূচির প্রাণ জুড়িয়ে যায়।কবুল বলার পরেও রেশ কাটে না।মনে মনে আরো দশবার কবুল বলে।এই তিন অক্ষরের একটা শব্দ বলতে কতো কাল অপেক্ষা করলো সূচি! সেই মানুষটাকে পাওয়ার জন্য এই ভারী শব্দটাই তো দরকার।এটাই তো ফয়সালকে পাওয়ার চাবিকাঠি।আজ থেকে সূচি ফয়সালের।না,না,ফয়সাল সূচির।সূচি তো সেই কবে থেকে ফয়সালের ছিল।আজ ফয়সাল সূচির হলো।চিরদিনের অধিকার পেয়ে গেল সূচি। পৃথিবীতে কোটি কোটি পুরুষ।তার মাঝে এই একটি পুরুষ সূচির।সূচির একান্ত ব্যাক্তিগত পুরুষ। এখানে অন্য কারো অধিকার নেই,অন্য কোনো ভাগীদার নেই। সব অধিকার একমাত্র সূচির।সারা পৃথিবীর সামনে দাঁড়িয়ে সূচি একমাত্র এই মানুষটার দিকেই আঙুল তুলে বলতে পারবেঃ
” এ আমার পুরুষ।একমাত্র আমার ব্যক্তিগত পুরুষ।”
সূচির বুক ফুলে উঠে গর্বে।অস্ফুটে আরেকবার কবুল শব্দটা বেরিয়ে পড়ে মুখ দিয়ে।
ভাবি মহল চাপা হাসিতে ফেটে পড়ে।চম্পা ভাবি হাসতে হাসতে বলেই ফেললোঃ” কিরে, বেশি খুশি? বিয়ে তো শেষ।আরো দুইবার কবুল বল। এইখানেই তোগো দ্বিতীয় বিয়ে হোক।বলবি? আমি যায়া ফয়সালরেও তিনবার কবুল বলতে বলি? আজকেই বউ তুইল্লা নিয়া যাক।”
মনিও সায় দেয় চম্পার কথায়।ইচ্ছে করে সূচির গায়ে হেলান দিয়ে বলেঃ” হ, ভাবি যাও।ঢঙ্গী পোলাপাইন আমার দেখতে মন চায় না।এতোক্ষণ কবুল কয় না,আর এখন তিনবারের উপরে চাইরবার কয়।ঢঙ দেখলে বাঁচি না।”
ভাবি মহলের কথার উপযুক্ত উত্তর ছিল সূচির কাছে।দুষ্টুমি করে সে নিজেও কিছু একটা বলে ফেলতে পারতো।কিন্তু বলেনি। পাশেই বরপক্ষের মানুষ,হুমায়রা বসেছিল।পাছে নির্লজ্জ অপবাদ গায়ে ঝুলিয়ে দেয়।এই ভয়েই চুপ করেছিল ঠোঁটকাটা সূচি।
ছোটদের ছেলেমানুষী কথায় মুরুব্বিদের কান দেওয়া চলে না। সাহিদা বেগম চোখ মুছতে মুছতে উঠে পড়লেন। বুকের মাঝে কেমন রক্তক্ষরণ হচ্ছে।মনে হচ্ছে কোনো এক ভয়াল জীব শক্ত করে কামড়ে ধরে আছে। ভিতরের অশান্তি বড় অশান্তি।ছোট মেয়েটা চোখের সামনে দিয়ে কতো বড় হয়ে গেল! আজ তার বিয়েও হল! ভাবতে পারেন না সাহিদা বেগম।খুব অশান্তি লাগছে শরীরে।দুনিয়া ভাসিয়ে কাঁদতে ইচ্ছা করছে।তবে মন ভরে কাঁদার সময়-সুযোগ নেই এখন।বহু কাজ বাকি।পোলাওটা চুলায়।একটু আগে রুই মাছ ভিজিয়ে রেখেছিলেন।সেগুলো কড়কড়া করে ভাজতে হবে। খোঁপের দুটো হাঁস ও রোস্টের জন্য একহালি মুরগী জবাই দিয়েছেন।এবার এই কনকনে শীতেও দশটা মুরগী বেঁচেছিল।সেখান থেকেই চারটে কাজে লেগে গেল।হাঁস-মুরগী রান্না করতে হবে।ডিমের ব্যবস্থা এখনো হয়নি।জয়ার স্বামী লতিফ বাজারে গেছে ডিম ও দই আনতে।সূচির হঠাৎ বিয়ে উপলক্ষে সবাই খাটছে। জয়া বলেছে, ও নিজেই রান্না করবে ডিমটা।এছাড়া সালাদের জন্য শসা,লেবু,পেঁয়াজ, মরিচ কাটতে হবে।কত কাজ এখনো! মায়েদের কি সুখ-দুঃখে বসে বসে কাঁদলে চলে? তাদের দু-হাতে দশটা কাজ সামলানো লাগে।কাজ-টাজ ফেলে,একটু নিরিবিলি বসে,সাধ মিটিয়ে কান্নাকাটি করা তাদের জন্য বিলাসিতা মাত্র।তারা কাজের সন্তান। ওতো বিলাসিতা তাদের মানায় না।
____________________________
নরম তোষকের নিচে একুশ সালের ক্যালেন্ডারটা যত্ন করে রেখে দিলো সূচি। হঠাৎ বিয়ের স্মৃতি হিসেবে শুধু এই একটা জিনিসই তুলে রাখার মতো আছে। শাড়িটা মনির,ব্লাউজটা চম্পার।একটু আফসোস হচ্ছে সূচির।মায়ের শাড়ি পরলেই ভালো হতো।শাড়িটা সূচি নিয়ে যেতে পারতো।
ঘরে আর কেউ নেই।সবাই কাজে ব্যস্ত।সূচিকে ধরে বসে থাকলে চলবে না।হাতেহাতে কাজ করতে হবে।এ বাড়ির মানুষগুলো একটু বেশি ভালো।অবশ্য সূচির বিষয়ে এরা একটু বেশি বেশি ভালো।
সূচি জুতো পায়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়।একটু নুয়ে শাড়ির কুঁচি ঠিক করে।মাটির মেঝেতে চটি জুতো পড়ে শব্দহীন পায়ে হাঁটে। গায়ে কালো-সবুজ শালটা আরেকটু ভালোভাবে জড়িয়ে নেয়।ঘরের সামনেই পর্দা টাঙানো। একটু উঁকি দিতে ইচ্ছা করে সূচির।কিন্তু দেয় না।মাঝের ঘরে হয়তো সবাই বসে আছে অথবা হাঁটা-চলা করছে।সূচি নিজের ছোট্ট ঘরেই এদিক-ওদিক হাঁটে।একটু বাইরে যেতে ইচ্ছা করছে। কেউ আসছেও না এদিকে।একা একা থাকতে ভালো লাগে না।সূচি খাটের কাছের খুঁটির সাথে টাঙানো ছোট আয়নার সামনে দাঁড়ায়।ছোট একটা আয়না,মুখ ছাড়া কিছুই দেখা যায় না।আয়নায় নিজের চেহারা দেখে আঁতকে উঠে সূচি।খুব বিশ্রি দেখাচ্ছে। চোখের কাজল লেপ্টে একাকার।চোখের পানির সাথে কিছু কিছু জায়গার ফেসপাউডার মুছে গেছে,কিছু কিছু জায়গায় আছে।ঘোমটার বাইরে সিল্কি চুলগুলো বেড়িয়ে আছে। শ্যাম্পু করা চুল একদম পছন্দ না সূচির।এদেরকে কিছুতেই বেঁধে রাখা যায় না।এদিক-ওদিক দিয়ে ঠিকই বেরিয়ে যায়।সূচির ভালো লাগে তেল দেওয়া চুল।চুল যেভাবেই রাখুক না কেন সবসময় পরিপাটি থাকে। ঠোঁটের লিপস্টিকটাও উঠে গেছে জায়গায় জায়গায়। সূচি হাতের তালুতে বাকি লিপস্টিকটুকু তুলে নেয়। ডানহাত ঠোঁটে ঘসতেই থাকে,ঘসতেই থাকে।
” ওই ঢঙ্গী,ওইখানে কী করছ?”
রত্না এসেছে ঘরে।সূচি একপলক তাকায় বান্ধবীর দিকে। নিজের কাজ করতে করতে প্রশ্ন করেঃ” ঢঙ্গী কে?”
” তুই।”
” কেন?”
” ফয়সাল ভাইরে সেই ল্যাদা কালের থেকা পছন্দ করছ। আজকে বিয়ের সময় এতো কাঁনলি ক্যান? আমার ইচ্ছা করছিলো ঠাস ঠাস কইরা দুইটা থাপ্পড় দেই।এতো বিরক্ত লাগছে তখন।”
” তুই কী বুঝবি? আজকে একটা জিনিস বুঝলাম রে রত্ন।না পাওয়ার চাইতে পাওয়ার কষ্ট বেশি।দেখলি না আমি কত কাঁদলাম? এখনো কান্না পাচ্ছে।এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না ফয়সাল তোদের ভাই আর আমার জামাই। কত তাড়াতাড়ি সব হয়ে গেল তাই না? এখনো বিশ্বাস হয় না। সবটা এতো সহজ! ”
” হ সহজ।তুই উঠতে-বইতে যেমনে দোয়া করছোছ,যেমনে দুলাভাইরে চাইছোছ,পাবি না কেন? আমি তো এইএসসিতে পাশের লেগাও এমনে দোয়া করি না। ভাইরে তোর ধৈর্য আছে।রাতুলের লেগা এতো পাগল হইলে আমার বিয়াটাও এতোদিনে হইতো। তুই একটা নমুনা।আমি এতো পাগল হইতে আর কাউরে দেখি নাই।”
” তুই বুঝবি না, রত্না। আমি যে তাকে কত ভালোবাসি, তা আমি জানি আর আমার আল্লাহ জানে। কি করব বল? সে আমার বাল্যকালের প্রেম।আমি কী আর এমনি এমনি পাগল? প্রথম প্রেম বলে কথা।পাগল না হওয়াটাই অস্বাভাবিক।”
” এগুলি ফয়সাল ভাইরে কইছ।প্যানপ্যানানি আমার ভাল্লাগে না।”
খাটের উপর থেকে বালিশ নিয়ে বান্ধবীর দিকে ছুঁড়ে মারে সূচি।বিরবির করে বলেঃ” বদমায়েশ, দূর হ এখান থেকে।”
রত্না খিটখিট করে হাসে। সূচির কাছে এসে হাত ধরে টেনে বসায় খাটে। খাটের পাশের টেবিল থেকে ফেসপাউডার,লিপস্টিক নেয় হাতে।আরেকটু সাজগোজ দরকার।বরপক্ষ এখনো যায়নি।কাজল-টাজল লেপ্টে একদম বিশ্রি দেখাচ্ছে সূচিকে।ওড়নার আঁচলে সূচির চোখের নিচের কালি মুছে দেয় রত্না।গালে আরেকটু ফেসপাউডার ছুঁইয়ে দেয়।
” রত্না,সবাই কী করে? ”
” তোর শ্বাশুড়ি, মামা শ্বশুর, খালু শ্বশুর বাইরে হাঁটতাছে।আব্বা আর কাকা বাজারে গেছে কি যেন আনতে। চম্পা ভাবি আর তোর জা হুমায়রা রান্নাঘরে হাঁস বাছে।কাকি,জয়া ভাবি,মনি ভাবি জয়া ভাবিগো রান্নাঘরে ডিম আর রোস্ট রান্না করে।রনি, লিলি সামনের রুমে নাচানাচি করে।আর কিছু শুনবি?”
আসল মানুষের কথাই বললো না মেয়েটা। সূচি দু-একটা গালি দেয় রত্নাকে।মেয়েটা ইচ্ছা করেই বললো না। সূচি কিছুক্ষণ চুপ থেকে প্রশ্ন করেঃ” তোদের ভাইয়া,উনি কী করে?”
” এইটাই তাইলে আসল প্রশ্ন?”
” আহ,বল না।”
” মিষ্টি আনতে গেছে। হঠাৎ বিয়াতে অনেক খুশি। ফয়সাল ভাইয়ের যেই বন্ধুটা কাজি নিয়া আইছে, হের লগে গেছে।দুলাভাইরে কিন্তু আজকে দারুন লাগছে।হেরা মনে হয় বাড়ি থেকাই বিয়ার পরিকল্পনা কইরা আসছে। দেখছ নাই,কি সুন্দর পাঞ্জাবি পইরা আইছে।”
” মাশাল্লাহ বল।বেচারার নজর লাগবে।”
” হুহ,বাড়িতে আইলে মুখ ভইরা ছেপ দিয়া দিমুনি। ছেপ ছিটায়া দিলে নজর লাগে না।তুই যেন কী কছ,থু থু না?”
সূচি রত্নার চুলের মুঠিতে ধরে চুল টেনে দেয়।হাসতে হাসতে বলেঃ” আমার সামনেই আমার স্বামীর গায়ে থু থু ছিটানোর কথা বলিস! তোর মরার ভয় নাই,হতভাগী? এতো সাহস! ”
রত্নাও হাসে।একলা ঘরে দুই বান্ধবী মিলে প্রাণ ভরে হাসে। সবাই সবার কাজে ব্যস্ত।রনি-লিলির গলার আওয়াজ ভেসে আসছে বসার ঘর থেকে।দুটোর ভাব হয়েছে কিছুদিন আগে। সূচি-রত্না একচোট হাসির শেষে চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ।সূচির জানলার ওপাশেই একটা লেবু গাছ আছে।লেবু ধরেছে গাছে।টিনের ফাঁক-ফোকড় দিয়ে লেবুর ঘ্রাণ ভেসে আসছে।নীরবতা ভাঙে রত্না।উদাস গলায় বলেঃ” এই বাড়িতে তুই আর কতদিন থাকবি সূচি? বড়জোর দুই সপ্তাহ।তারপর? ওই বাড়িতে গেলে কি আমরা আর এরকম করতে পারমু? তুই কাজ ফালায়া আমার লগে কথা কইতে পারবি? অথবা আমগো বাসার নাম দিয়া ভূমি আপার বাসায় যাইতে পারবি? মাইরের হাত থেকা বাঁচার জন্য আসার পথে আম্মার হাতের শিম আর নতুন আলুর তরকারী আনবি?আস্তে আস্তে তুই কাজ-কামে ব্যস্ত হবি,আমগো থেকা দূরে সইরা যাবি।আমগোরে আর মনে পড়ব,সূচি?আমারও বিশ্বাস হয় না তোর বিয়াটা এতো তাড়াতাড়ি শেষ হইল।”
এই একই প্রশ্ন তপুরও।বিস্তীর্ণ ধান ক্ষেতের আইলে হাত-পা ছড়িয়ে বসে আছে তপু। পাশেই বসা ফয়সাল।নিস্তব্ধ আকাশের নিচে বিধ্বস্ত ফয়সাল।আজ ভরা পূর্ণিমা।আকাশে স্টিলের বড় থালার মতো গোল এক চাঁদ উঠেছে।চাঁদের আলোয় ফকফকা চারদিক।সাদা আলোয় ভেসে যাচ্ছে চারদিক। তপু বিস্মিত গলায় বলেঃ” মানে শেষ! চোখের পলকে বিয়েটা হয়ে গেল!”
ফয়সালের কাছ থেকে হু,হ্যাঁ কিছুই শোনা যায় না।মিষ্টি আনার নাম করে সূচির বাবার ক্ষেতের আইলে বসে আছে।আশেপাশে মশারা ভনভন করছে।হাতে-পায়ে কামড়ে দিয়েছে কতগুলো।তবুও বসে আছে ফয়সাল।বিয়ে বাড়ির চাইতে মশার কামড় ঢের ভালো।
” ফয়সাল,বাড়ি থেকেই বিয়ের প্ল্যান করে এসেছ্র সবাই? তুই যখন ফোন করে কাজি আনতে বললি,আমি তখন পুরো বোকার মতো বসেছিলাম।তুই বলেছিলি পালিয়ে যাবি।কিন্তু কী হয়ে গেল বলতো? তোর বিয়েটা কী করে হয়ে গেল?”
এতোক্ষণে মুখ খোলে ফয়সাল। তার মাঝে অদ্ভুত এক নির্লিপ্ততা।উদাস গলায় বলেঃ” আমি আম্মাকে আজ নতুন করে চিনলাম। জোর করে বিয়ে দিলো,আবার আমাকেই বিয়ের মিষ্টি আনার আদেশ দিলো। মানে তুই একটু চিন্তা কর।আমার মতের বিরুদ্ধে আমি বিয়ে করলাম।আবার আম্মা বিয়ের আনন্দ প্রতিষ্ঠা করছে আমাকে দিয়েই।আমাকে দিয়েই মিষ্টি আনাচ্ছে।এর চেয়ে গলায় পা দিয়ে প্রাণটাই বের করে ফেলতো।এটা বেশি ভালো হতো।”
” কী হয়েছে এখানে? খুলে বলতো।”
” কিছুই না।এখানে আসার আগে আম্মা আমার খাটের নিচে কাপড়ের ব্যাগটা দেখেছে।আম্মা চালাক মানুষ। ঠিকই বুঝে ফেলেছে আমি পালিয়ে যাব।যাতে পালিয়ে না যেতে পারি তাই এই বিয়ের ব্যবস্থা।বিয়েটাও হলো, আমার পালানোও বন্ধ হলো।এক ঢিলে দুই পাখি। আম্মা বিয়ের নাম করে আমার পায়ে শিকল বেঁধে দিলো তপু।”
ফয়সালের গলায় তীব্র বিষন্নতা।তপু সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে। নরম গলায় বলেঃ” যা হয় তা ভালোর জন্যই হয়।সংসারে ঢুকে গেলে দেখবি এসব ভালো লাগা,খারাপ লাগা কোথায় পালিয়ে গেছে। তাছাড়া, ভাবিকে দেখলাম। তুই যতো বলিস ততোটাও খারাপ না।শুধু একটু শ্যামলা।গায়ের রঙে কী আসে-যায়? শাড়িতে বেশ মানিয়েছে কিন্তু।”
” তোর চোখেও ভালো লেগেছে! অদ্ভুত! শুধু আমার চোখেই খারাপ লাগছে কেন? তোর চোখ দুটো খুলে আমাকে দে তো।আমিও দেখি মুগ্ধ হতে পারি নাকি।”
” তুই পাগল হয়ে যাচ্ছিস,ফয়সাল।আমি একটা বুদ্ধি দিচ্ছি।তুই এখন এখান থেকে উঠবি।সোজা বাজারে যেয়ে মিষ্টি আনবি।আসার আগে আমি সুযোগ বুঝে ভাবির সাথে কথা বলিয়ে দেব।মন থেকে সবকিছু ঝেড়ে-ঝুড়ে ভাবীর সাথে দু-মিনিট কথা বলবি।দেখবি ভালো লেগে গেছে।আরে ভাই,প্রেম হতে কতোক্ষণ লাগে? তোদের এরেঞ্জ ম্যারেজ।কত এরেঞ্জ ম্যারেজ দেখলাম জীবনে।একসময় দেখবি ভাবিকে ছাড়া ভালোই লাগছে না।ভাবির আঁচল ধরে ঘুরবি।বুঝলি?”.
ফয়সালের কানে কিছুই ঢুকে না।মশার যন্ত্রণায় বসা দায়। আজকে সবাই কেন ফয়সালের বিরুদ্ধে যাচ্ছে? ফয়সাল কিছুই ভেবে পায় না। সবকিছুর বিরুদ্ধে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে ইচ্ছা করে।তাও পারে না।ছেলেটার আসলে সাহসের অভাব।
তপুর ফোন বাজছে।টুংটাং শব্দে বিরক্ত হয় ফয়সাল। তপু পকেট থেকে ফোন বের করে।স্ক্রিনে চোখে বুলিয়েই দেখতে পায় রোমেলা বানুর নাম্বার।তপু কপাল কুঁচকে প্রশ্ন করেঃ” তোর ফোন বন্ধ?”
“হুম।”
তপুর ফোন হাতে নিয়ে কল কেটে দেয় ফয়সাল।গা এলিয়ে দেয় মাটিতে। সাদা পাঞ্জাবিতে মুহূর্তেই ময়লা লেগে গেল।তপু হায় হায় করে উঠে।
” কী করছিস,ফয়সাল?”
” এর শেষ কোথায়,তপু?”
ফয়সালের গলায় তীব্র বিষন্নতা। সত্যিই তো,এর শেষ কোথায়?
_________________
খাবারটা এরা ভালোই রেঁধেছে।প্রথমে কড়কড়ে রুই মাছ ও ডিন।এরপর গরম গরম পোলায়ের সাথে রোস্ট।তারপর কনকনে শীতের রাতে ঘন ঝোলের হাঁসের মাংস।সবশেষে, গরম ভাতের সাথে এক চামচ চিনি ছাড়া দই।দইয়ের সাথে দুই চামচ চিনি।রমিজ শিকদারের পেট টইটম্বুর। মেয়েপক্ষ বেশ অতিথিপরায়ণ। ভোজনরসিক রমিজ শিকদারের মনে ধরেছে।এরা যত্ন করে রাঁধতেও জানে,খাওয়াতেও জানে।জান-প্রাণ জুড়িয়ে যায় একদম।মুখে একটা পান গুজে দিয়ে সবার কথায় মনোযোগী হন রমিজ শিকদার। সবাই উঠার উদ্যোগ নিচ্ছে।প্রায় সাড়ে আটটা বেজে গেছে।যাওয়ার আগে বিদায়ী কথা-বার্তা বলছে সবাই।রতন পাটোয়ারীর কথা কানে আসে তার।লোকটা হুজুগে।যেকোনো কিছুতে হইচই করতে পছন্দ করে।
রতন পাটোয়ারী উচ্ছল কন্ঠে বলছেনঃ” তাইলে আগামী সাত তারিখই ফাইনাল। কী কন ভাবি?”
রোমেলা বানু মাথা নাড়েন।
” হ,ভাই।আমগোও ইচ্ছা তাই।আপনেরা আয়োজন করেন,আমরাও করি। বেশি দেরি করার ইচ্ছা নাই।মমিন ভাইয়ের কী মত?”
” আমার আর কী মত থাকব? বিয়াটা তো শেষই।বাকি যা আছে তা তাড়াতাড়ি করাই ভালো।আপনেরা সবাই যা কইবেন তাই ঠিক।”
রোমেলা বানু উঠে পড়েন।মুখের উপর নিকাব ফেলে দিয়ে বলেনঃ” আচ্ছা,তাইলে ওই কথাই রইলো।অসময়ে আপনেগোরে অনেক কষ্ট দিলাম।মাফ-টাফ কইরা দিয়েন।”
” না,না।কীসের কষ্ট। আমগো সৌভাগ্য। আমগো ভুল-ত্রুটিও মাফ কইরেন।আপনেগো যোগ্য আয়োজন করতে পারি নাই।সব তাড়াতাড়ি হইলো।”
ঘরের এককোনে রত্না দাঁড়িয়ে ছিল।তার মনটা একটু খারাপ।বিয়ের একটা ছবিও তোলা হলো না।একটা ছবি তোলা উচিত ছিল।রত্না মিনমিন করে বললোঃ” ফয়সাল ভাই একটু আমার সাথে আসেন।আপনাদের একটা ছবি তুলি।”
রোমেলা বানু খুশি হলেন না।ছবি তোলা লাগবে কেন? মাথা নেড়ে না করার আগে বাদ সাধলেন রমিজ শিকদার। মৃদু হেসে বললেনঃ” দুলাভাইকে নিয়ে যাও।কিন্তু দশ মিনিটের মধ্যেই ছেড়ে দিয়ো।বাড়ি যেতে হবে আমাদের।”
খুশিতে বাকবাকুম রত্না।ফয়সালের হাত টেনে সূচির ঘরে নিয়ে যায়।সূচি ঘরে পায়চারী করছিল।হঠাৎ করে ফয়সালকে ঘরে ঢুকতে দেখে অবাক হয়ে গেল।দরজার বাইরে ভাবি মহল।পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে চোখ টিপে দিচ্ছে।সূচি পরিস্থিতি বুঝতে পেরে এককোনে দাঁড়িয়ে থাকে লজ্জায়।মাথাটাকে নুইয়ে রাখে।
রত্না ফয়সালকে খাটে বসায়।সূচির হাত ধরে সূচিকেও বসায়।দুজনের মাঝে এক একটুখানি দুরুত্ব।সূচি লজ্জায় মরে যায়। কি লজ্জা! রত্নাটা কি পাগল?
” সূচি মাথা তোল।দুলাভাই একটু হাসেন।কিরে সূচি, ক্যামেরার দিকে তাকা।এই ছবিটা তোগো বাচ্চা-কাচ্চারে দেখামু।মুখ তোল।”
সূচি মুখ তোলে।ঠোঁটের কোনে মিষ্টি হাসি।পাশের মানুষটাকে একটা কথা বলতে ইচ্ছা করছে।একদম তীব্র ইচ্ছা।সূচি মনে মনে বলেঃ” সাধ্য থাকলে আপনাকে একটা চুমু দিতাম।একদম জড়িয়ে ধরে একটা চুমু। আমার বহুদিনের শখ।”
জোরে বলার সাধ্যা নেই সূচির।মনে মনে বলে আর হাসে।ক্যামেরার দিকে তাকায় স্থিরভাবে।
” সাধ্য থাকলে তোমায় আমি খুন করতাম সূচি।একদম জঘন্যভাবে খুন।”
মনে মনে বলে ফয়সাল।জোরে বলার সাধ্য নেই।ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে না।নিষ্প্রাণ দৃষ্টিতে স্থির চেয়ে রয় ক্যামেরার দিকে।আজকের দিন কখনো ভুলবে না সে।
চলবে…..