#শুকতারা (পর্ব-৩৯)
#হালিমা রহমান
বৈশাখের প্রথম বিকাল।নতুন বছরের শুরু।চারদিকে নতুনত্বের গান।বছর শুরুর এই নতুন প্রহরেই নিজেকে সবচেয়ে বিশ্রী, অসহায়, দুর্বল মনে হচ্ছে সূচির। রাগ,দুঃখ,ক্ষোভের সংমিশ্রণে গোয়ালঘরের সামনের পুরোনো মাটিতে মাথা ছেঁচে ফেলতে ইচ্ছা করছে। একে আসলে কী বলা যায়? ভাগ্যের নির্মম পরিহাস? কথাটা মনে আসতেই লম্বা-চওড়া দেহের মাঝে লুকিয়ে থাকা বিধ্বস্ত মনটা ফুঁসে উঠলো।দুনিয়ায় এতো মানুষের মাঝে ভাগ্য কেবল ওর সাথেই হাসি-তামাশা করে? সবই কি ভাগ্যের দোষ? অসম্ভব। মানতে নারাজ সূচি। ভাগ্য নয়,সবাই মিলে ওকে জব্দ করার পায়তারা করছে।ওর গলা টিপে ধরছে। ওর বিরুদ্ধে যেয়ে ওকে নিঃস্ব,দুর্বল বানিয়ে একটু একটু করে ভেঙে দিচ্ছে।
শাশুড়ি ওকে বাড়ি থেকে জিনিসপত্র আনতে বলবে।ও সেই অন্যায় আবদার মানবে না।ও বাড়ি থেকে একটা খড়কুটোও আসতে দেবে না।এতে রোমেলা বানু যা করে করুক। সূচিও দেখবে শাশুড়ি ঠিক কতকিছু করতে পারে। চিরকালের একগুঁয়ে মেয়েটার অবাধ্য হওয়ার বাসনা ছিল মনে মনে।নিজের অবাধ্যতায় খুশি ছিল সে।মনে হতো, এক্ষেত্রে সে যা করবে তাই ঠিক। শাশুড়ির মতের বিরুদ্ধে গোঁ ধরে বসে থাকা জায়েজ।কোনোমতেই নরম হয়ে আরেকজনের অন্যায় আবদার ও মেনে নেবে না।কখনোই বাবার বাড়ি থেকে একটা সুতো এনেও নিজের অসম্মান,শ্বশুরবাড়ির অসম্মান করবে না।এই চাওয়া-পাওয়ার ব্যাপারে নিজের বিজয় একদম ধরেই নিয়েছিলো সূচি।ভেবেই নিয়েছিলো রোমেলা বানু কিছুদিন চাইতে চাইতে বিরক্ত হয়ে যাবে।তারপর নিজেই মুখ বন্ধ করব। আর নিজের দিকটা তো পরিষ্কার ছিলোই।মনে মনে একটা জেদ,যতকিছুই হোক বাবার বাড়ি থেকে একটা কিছু এবাড়িতে আসতে দেবে না।অতএব ঝামেলা হওয়ার কোনো কারণই নেই।
ভুল ভাঙলো আজ বিকালে।নির্মম আঘাতটা এলো নিজের বাড়ির দিক থেকে।রোমেলা বানুর কথা শুনে মমিন শেখ কোনো ধরনের উচ্চবাচ্য না করে নিজেই মেয়ের শ্বশুড়বাড়িতে দুটো ভ্যান ভর্তি জিনিসপত্র দিয়ে যাবে— এ কথা সূচির মনে কেন কল্পনাতেও আসেনি।বাবার বাড়ি থেকে এ বাড়িতে পা রেখেছে সে জানুয়ারিতে।বাবার বাড়ির অবস্থা তার জানা।আর পাঁচটা মধ্যবিত্ত চাষী পরিবার যেমন হয়,তাদেরও একই অবস্থা। তিনবেলা নির্বিঘ্নে খাওয়া-পরার সংস্থান আছে,মাথা গুজার ঠাঁই আছে।একমাত্র আয়ের উৎস বাবা।পৈতৃক সম্পত্তির এক কোনাও এখনো বিক্রি করেনি বলে তাদের জমিও আছে চোখে পড়ার মতোই। কিন্তু ফেলে রাখা জমিতে আর কতটুকু আয় হয়? মমিন শেখ একা মানুষ।যতটুকু জমিতে ছক কেটে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে চাষ করা হয়,ঠিক ততোটুকুই তো আয়।সংসারে সঞ্চয়ের বালাই নেই, খাওয়া-পরার ঝামেলা মেটানোর পর বাকি টাকা হাতখোলা বাজারের আর এটা-ওটার পিছনেই চলে যায়। তাছাড়া নিভৃত পল্লির একজন পরিশ্রমী চাষীর মেয়ে হিসেবে বৈশাখের হালখাতার ব্যাপারটাও সূচির অজানা নয়।সারা বছরের ধার-দেনার হিসাব চুকিয়ে নতুন খাতা খোলার ঝক্কি পেরিয়ে বাবা এতো টাকা খরচ করে এতোগুলো জিনিস কী দিয়ে কিনলো, তাই সহসা ভেবে পেল না সূচি। নিষ্প্রাণ চোখে নিতান্ত অবহেলায় চেয়ে রইলো দূরের ভ্যানের দিকে। সোফাসেট,একটা দেয়াল আলমারি, একটা চার ড্রয়ারের ছোট ওয়ারড্রব আর আর খুব হাবিজাবি নকশার একটা ছোট্ট বেডসাইড টেবিল।ঝাপসা চোখে দেখলো সূচি।বাবার পছন্দের তারিফ করতে হয়।বেছে বেছে হয়তো দোকানের শ্রেষ্ঠ জিনিসগুলোই এনেছে।ভ্যানওয়ালার সাথে দুটো ছেলে এসেছে।তাদের সাথে হাতে হাতে জিনিসগুলোর হেফাজত করছে ফয়সাল।আবার বৃষ্টি শুরু হলে জিনিসগুলো ভিজে সারা হবে। স্বামীর আচরণটাও চট করে চোখে বাজলো।সে কিন্তু একবারও জিজ্ঞেস করলো না এগুলো এ বাড়িতে আনার কারণ কী? ফয়সাল শুরু থেকেই যেমন নিশ্চুপ ছিল এখনো তেমনই।সে যেন জানতো এমনটাই হবে।
রোমেলা বানু বসার ঘরে দাঁড়িয়ে তদারকি করছেন। কোথায় কোনটা ফেলা হবে তা দেখিয়ে দিচ্ছেন সোৎসাহে।বাইরে থেকে জিনিস ভিতরে তুলতে তুলতে ফয়সালসহ ছেলেগুলোর গলদঘর্ম অবস্থা।কাজের ফাঁকে একবার শ্বশুরের দিকে নজর গেল ফয়সালের।তিনি এখনো বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন।শ্বশুর-শাশুড়ির সাথে কথা বলার সময় অদ্ভুত এক বিনয় ঝরে পড়ে ফয়সালের গলায়।এখনো পড়লো।খুব বিনয়ী গলায় বললো, ” আব্বা আপনি ঘরে যেয়ে বসেন।সূচি কী করো তুমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে? আব্বাকে ঘরে নিয়ে বসাও।”
হুকুম করে আবারও নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো ফয়সাল।মমিন শেখ জামাইয়ের কথার বিপরীতে একবার আপনমনেই হাত তুলে ঘরে যাওয়ার প্রস্তাবটাকে নাকচ করে দিলেন।ঐ ঘরটায় যেতে কেমন একটা বাধোবাধো ঠেকে তার।রোমেলা বানুর কথাগুলোর রেশ কাটেনি এখনো।তাই তার মুখোমুখি হতে ভালো লাগে না।সেদিন বিকালে অপ্রত্যাশিতভাবে যেই কথাগুলো ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে শুনেছিলেন, সেই কথাগুলো এখনো জীবন্তভাবে কানের কাছে রি রি করে ঘুরে বেরায়।একটা অপরাধবোধ কাজ করে ভিতরে।না জানি তার অসামাজিকতা,তার বোকামির জন্য মেয়েটাকে কত কথাই শুনতে হয়েছে। আপনা-আপনি মাথা নিচু হয়ে আসে।ঘরে ঢুকতে পারেন না।মেয়েকে উঠোনে একা পেয়ে নিচু গলায় প্রশ্ন করেন, ” কী রে, তোর কী হইছে? এমনে দাঁড়ায়া আছোছ ক্যান?”
বাবার কথার উত্তর দেয় না সূচি।খুব কাতর গলায় পাল্টা প্রশ্ন করে, ” তুমি কি জমি বন্ধক রেখেছো আব্বা? নাকি ধার করেছো? এতোগুলো জিনিস কী দিয়ে কিনলে?”
জিনিসগুলো দেওয়ার কথা ছিল আরো দেরিতে। সেই হিসাবে টাকাটা হাতে ছিল না এখন।কিন্তু সেদিন বেয়াই বাড়ি যাওয়ার পরে কিছুতেই মন ঘরে টিকলো না।রতন পাটোয়ারীসহ আরো দু-তিনজন মুখবোলা বন্ধুর কাছ থেকে পুরো টাকাটা ধার করে বাজারের রঞ্জু হাওলাদারকে তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করার জন্য বাড়তি কিছু টাকা দিয়ে তবেই আজকে ফার্নিচার আনতে পেরেছেন। কিন্তু এতো জোড়া-তালির কথা তো মেয়েকে বলা যায় না।তাছাড়া মেয়ের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার দরকারই বা কী? সে তো আর এসবের কিছু বুঝবে না।তাই তিনি কেবল হালকা চালে বললেন, ” ঐগুলা জাইন্না তোর কী লাভ? তোর শখ হইছে,এখন শখের জিনিস পায়া খুশি থাক।”
” কিন্তু আমি তো সত্যিকারের শখ করিনি আব্বা।এতো বছর লেলেপুলে বড় করেছো,কখনো দুটো চাহিদার কথা বলেছি? শখ করার হলে আমি আমাদের ঘরেই তোমার কাছে শখ করতাম।বিয়ের পর করতে হতো না। আমার শাশুড়ি কি না কি বলেছে ওমনি তুমি ফট করে কিনে ফেললে।আল্লাহর কসম,আমি তোমাদের জামাইকে এসবের কথা একদিনের জন্যও বলিনি সেখানে শখ করা তো আরো দূরের কথা।আমাকে এভাবে আঘাত করার আগে তুমি আগেই বলতে আব্বা।আমি যদি জানতাম তুমি এসব ভাবছো তাহলে কিছুতেই কিনতে দিতাম না। আমার সংসার সাজানোর দায়িত্ব কি তোমার?”
” এগুলা বিয়ার উপহার।সবাই দেয়।যা গো অবস্থা ভালো তারা আরো বেশি দেয়।”
” তাহলে বিয়ের সময় কেন দিলে না আব্বা? বিয়ের উপহার মানুষ এতোদিন পরে দেয়? সত্যি করে বলো তো,আমার শাশুড়ি না বললে এসব দেওয়ার কথা তোমার মাথায় থাকতো? তুমি শুধু তার কথা শুনেই কিনেছো না?”
অযাচিত কৈফিয়ত কোনোদিন ভালো লাগেনি মমিন শেখের।আজও লাগলো না।তিনি মুখ শক্ত করে মেয়েকে ধমক দিয়ে বললেন, ” চুপ কর সূচি।বিয়া হইছে বইলাই অনেক বড় হইয়া যাছ নাই।তোরে এতো প্রশ্ন করার সাহস কে দিলো? বেদ্দপ মাইয়া।যা ঘরে যা,জামাই আর বেয়াইন একা একা সব করতাছে। পাকনা পোলাপাইন।”
দমে গেল সূচি।এই একটা জায়গায় সে বড়ই দুর্বল।প্রত্যেকটা মানুষের সীমাবদ্ধতা থাকে।সূচিরও আছে।সে তার বাবাকে মাত্রাতিরিক্ত ভয় পায়।এই পৃথিবীতে মূলত এই একজনকেই সে সবচেয়ে ভয় করে।অবশ্য শ্রদ্ধা থেকে যে সুন্দর ভয়টা আসে এটা সেই ভয় না।বাবার সাথে রক্তের টান আছে বটে কিন্তু ভক্তি-শ্রদ্ধার সম্পর্ক নেই।ওটা কখনো ছিলই না।যে বাবা প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের গায়ে হাত তোলার আগে দু’বার ভাবে না তার প্রতি ঠিক কতটুকু শ্রদ্ধা কাজ করে তা আল্লাহ মালুম।বাবার কথার বিপরীতে মুখও তুলতে পারলো না সূচি।মনে মনে একটা ভয়,যদি এখানে বাড়াবাড়ি হয়ে গেলে বাবা হাত নাড়া শুরু করে দেয়! তখন কী হবে?
দুই-আড়াই ঘন্টা কীসের উপর দিয়ে কেটে গেল তা বুঝতেই পারলো না সূচি। এতোক্ষণের মাঝে মমিন শেখ এ বাড়িতে এসে বসেছেন ঠিকই কিন্তু কিছুই খাননি।সূচিও খুব জোর করেনি। দু-একবার মুখে সেধেছে কেবল।পশ্চিমাকাশে আবার মেঘ জমেছে।দিনের আলোটুকু চুষে নিয়ে যাচ্ছে সেই মেঘের আঁধার।ফের বৃষ্টি নামার ভয়ে মমিন শেখে তড়িঘড়ি করে বাড়ি ফিরে গেলেন।আসবাবপত্র ঠিকঠাকমতো রেখে ফয়সাল গেল খামারে।রোমেলা বানু সোফায় গেড়ে বসে তার নমনীয়তা পরীক্ষা করছিলেন।তার চোখ দুটো চকচকে। কালকেই টুটুলের মাকে চায়ের দাওয়াত দিতে হবে।এই সুন্দর জিনিসগুলো দেখাতে হবে না? টুটুলের বউয়ের বাড়ি থেকে যা দিয়েছে তার চেয়ে এগুলো একটু বেশিই সুন্দর।আজকে তিনি যথার্থই বেয়াইয়ের কদর করেছেন। খাওয়ার জন্য জোরাজুরিও করেছেন। কিন্তু লোকটাই কিছু খায়নি।
সবাই ব্যস্ত, এতোকিছুর মাঝে একমাত্র সূচিই কেবল নির্লিপ্ত,অন্যমনস্ক। তার চোখ দুটো ফুলে আছে,নাকের পাটা লাল,চোখের পাতাগুলো ভিজে আছে ভেজা আকাশের মতো। হেঁটে-চলে হতভাগী বোধহয় খুব কেঁদেছে।
আহত মন নিয়ে ভাবগ্রস্তের মতো শুধু রাতের খাবারটা তৈরি করতে পারলো সূচি। মনের মাঝে কাঁটাঝোপের বুনো কাঁটার মতো বিঁধে একটা কথা।ও যা চায় সবসময় তার উল্টোটাই কেন হয়? সে ঘর ঝাঁট দিলো না,বৃষ্টির ঝাপটা থেকে গরু দুটোকে বাঁচানোর জন্যে গোয়ালঘরের সামনের টিনের আগল দিলো না,হাঁস-মুরগি তুললো না,ঘরের জানলা বন্ধ করলো না,সন্ধ্যার নাশতা তৈরি করতে পারলো না।আসলে এসবের দিকে মন দেওয়ার মতো সুস্থ মনটাই সেদিন আর বেঁচে ছিল না।রান্নার সময় ভুল করে পটল তরকারিতে দু চামচ লবনের বদলে দু চামচ চিনি ঢেলে দিলো।মরিচের গুঁড়ার বদলে অতিরিক্ত হলুদের গুঁড়া দিয়ে রাতের খাবারের জন্য অখাদ্য খাবার বানিয়ে হতবুদ্ধ হয়ে বসে রইলো। বাইরে তখন জোর বৃষ্টি। কিছুক্ষণের মাঝেই হয়তো লোডশেডিং হবে।হাতের কাছে টর্চ লাইটটা রাখা দরকার।দরকার জেনেও কিছুই করলো না সূচি।চুপচাপ হাঁটুতে মুখ গুজে বসে রইলো এক ধ্যানে। তার চোখ দুটো তরকারির পাতিলের দিকে,ধ্যানটা যোজন দূরে আর মন? ছাই ওটা হয়তো আর বেঁচেই নেই।
কিছুক্ষণ পর ঠিক কতোক্ষণ তা জানা নেই। বৃষ্টি-বাতাসের তেজ দ্বিগুণ হতে না হতেই ফুস করে অন্ধকারে ডুবে গেল চারদিক।বিদ্যুৎ পালিয়েছে। এদিকের এই এক সমস্যা।একটু বৃষ্টি হলেই কারেন্ট চলে যায়। বসার ঘরে বসে মায়ের সাথে কথা বলছিলো ফয়সাল।সন্ধ্যা নেমেছে একটু আগে।সে বসে বসে নাশতার জন্য অপেক্ষা করছিলো ও মায়ের কথা শুনছিলো।আকাশের অবস্থা দেখে খামার থেকে চলে এসেছে আযানের একটু আগেই।ততোক্ষণে বাতাস ছুটেছে ঘোড়ার গতিতে।বসার ঘরেই পা রেখে মেজাজ চটে গেল ফয়সালের।ঘরের দু-মাথার বিশাল জানালাগুলো খোলা।খোলা জানালা দিয়ে রাজ্যের যত বালি এসে বিছানা-ফ্লোর তলিয়ে দিয়েছে।পায়ের নিচে গিজগিজ করে চিকচিক বালু। রোমেলা বানু শক্ত মুখে সোফার উপরে বসেছিলেন।বউয়ের জ্ঞানহীনতায় সে যে অতিষ্ঠ তা তার মুখের সবগুলো পেশিই বলে দিচ্ছে।মায়ের চেহারা দেখেই আগে আগে সতর্ক হয়ে গেল ফয়সাল। সূচি এমনিতে আজকে রেগে আছে।ঘুমানোর আগে একটা ঝামেলা যে হবে তা আন্দাজ করার জন্যে জ্যোতিষী হতে হয় না।মা মুখ খুললে হয়তো ঝামেলা বেশি হবে।তাই মায়ের আগে গলা বাড়িয়ে কয়েক প্রস্থ গলাবাজি করার উদ্দেশ্যে গলা তুলতেই হাত তুলে থামিয়ে দিলেন রোমেলা বানু।কাছে ডেকে বললেন, ” এদিকে আয়।”
জানালাগুলো আটকে দেওয়ার ইচ্ছা ছিল। মায়ের ডাক শুনে আর দিলো না।ধীরে ধীরে যেয়ে রোমেলা বানুর মুখোমুখি বসলো।
” তোর বউয়ের আক্কেল দেখছোছ? বাতাস হইতাছে চোখ নাই ওর? দেখে না? জানালাগুলি লাগাইতে পারে না?ইচ্ছা কইরাই করে নাই এইসব।আজকে ঘরের একটা কাজও করে নাই। তোর বউয়ের দেমাগ দেখছোছ? বাপে এতো টাকার ফার্নিচার দিছে,এহন সে মাটিতে পাও ফেলব? ভুলেও না।”
” আমি যেয়ে এক্ষুনি বলছি ওকে আম্মা। দাঁড়াও তার আগে জানালাগুলো লাগিয়ে দেই।”
” থাম।তুই যে কী কবি তা আমি জানি।আর জানলা লাগাইতে হইলে তো আমিই লাগাইতাম।আমি খালি বইসা বইসা বা** বাচ্চার তামশা দেখতাছি।তুইও কতক্ষণ বয়।তোর বউয়ের ঢং দেখ। আমি কিছু কইলেই তো তোগো গায়ে ফোসকা পড়ে।এহন দেখ।এডি দেইক্ষা কোন ভদ্র মাইনষের মাথায় রক্ত উঠব না? আমি দেইক্ষাই এই ছেড়িরে নিয়া সংসার করি।আবার থাইক্কা আইছে বাপের বাড়ি।সেইখানে মায়ের লগে আমগো কথা কয় নাই? মায়ে শিখায়া দেয় নাই কিছু? নিশ্চয়ই শিখাইছে।নাইলে এতোদিন তো এতো সাহস আছিলো না।এহন কোনতে আইলো?আধা ঘন্টা অপেক্ষা কর।আজকে সন্ধ্যায় নাস্তাও জুটব না।”
ঠিক তাই হলো।সেই কখন থেকে বসে বসে অপেক্ষা করছে ফয়সাল।না দেখলো সূচির মুখ,না দেখলো নাস্তার মুখ।কেবল সামনে-পিছনের জানালা দিয়ে বৃষ্টি-বাতাস এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে চারদিক। কারেন্ট চলে যেতেই আর বসে থাকতে পারলো না।মাথায় একটা চিনচিনে রাগ উঠে যাচ্ছে।পরের ঘরে বিনা পয়সায় থাকছে,খাচ্ছে,পরছে।এতোকিছুর পরে আবার অত্যাচারও করবে?রাগ-জেদও দেখাবে? এতো সাহস?
” জুতার জায়গা পায়েই হয় ফয়সাল।এইটা যত উপকারই করুক না কেন,মানুষ কিন্তু জুতারে মাথায় নিয়া নাচে না।মাথায় নেওয়ার চেষ্টা করলেই তা আগে গালে আইসা পড়ে।তুই পুরুষ মানুষ।দেখি তো ইদানীং। বউয়ের লগে তোর ভাবের অভাব নাই।যা চায় তাই দেছ,যা কয় তাই মাইন্না নেছ। বউ তো লাই পাইবই। আফজালরে দেখোছ নাই? বউয়ের কথায় নাইচ্চা আজকে আলাদা থাকে।মরলে একটা কুত্তায়ও ওরে জিগাইব না।একলগে থাকলে পোলাডা মরতো? আমি বউয়ের ধারে-কাছে যাইতাম না? আলাদা হওয়ার পরে যাই নাই। তুইও যদি এরকম নাচোচ তইলে মনে রাখিছ তোরে আলাদা করুম না। একদম ত্যাজ্য কইরা দিমু।এক কোনা সম্পত্তিও তোরে দিমু না।তারপর আজীবন বউয়ের হাত ধইরা ভিক্ষা কইরা খাইছ।”
খসখসে গলায় আসন্ন ভবিষ্যতের পূর্বাভাস। রেগেমেগে ঘর ছাড়ার আগে কানে এলো মায়ের হতাশ স্বর।
” তোর বাপের ঘর থেকা কী হইলি তোরা? আমি তো আরো ছোট আছিলাম।আরো অত্যাচার সইছি।তাও তোর বাপে তার মায়েরে একটা কিছু কয় নাই কখনো।আমিও মুখ খুলি নাই।আমরাও তো মানুষ আছিলাম।সহ্য করি নাই? এহনকার মাইয়াগুলি একছ্যাড় ননীর….
না,আর এরকম চলতে দেওয়া যাবে না।আজ একটা হেস্তনেস্ত করতেই হবে।
ফোনের আলো জ্বেলে রান্নাঘরে পা দিতেই পায়ের রক্ত চড়চড় করে মাথায় উঠে গেল ফয়সালের।রান্নাঘরের জানালাটাও খোলা।ওপাশ দিয়ে বৃষ্টি-বাতাস এসে চুলা নিভে গেছে আরো আগেই। তরকারি খাওয়ার দরকার পড়ে না,চোখে দেখেই বোঝা যায় এ দিয়ে আর যাই হোক ভাত খাওয়া সম্ভব না।কতটুকু বালি সেখানে আশ্রয় নিয়েছে তা আল্লাহ মালুম।সূচি সেই আগের মতোই চুপচাপ এক ধ্যানে বসে আছে। সে হয়তো এই পৃথিবীতেই নেই।থাকলে অন্তত এই অন্ধকার ও মশার মিছিলের মাঝে এখানে বসে থাকতো না।ফয়সালের উপস্থিতি সে বুঝলোই না।বউয়ের এই অমনোযোগীতা অথবা মন খারাপকে গোয়ার্তুমি ভাবলো ফয়সাল।তার এই ভাবনাটা অবশ্য অমূলক নয়।তাদের সম্পর্কের অবস্থা এখন ভালো না।এলোমেলো,ভারসাম্যহীন। বোঝাপড়াটা বন্ধ হয়ে আছে সূচি বাড়ি ফেরার পর থেকেই।তাই বউয়ের এই আচরণে গায়ের পশম থেকে মাথার চুল অবধি দাঁড়িয়ে গেল ফয়সালের।ক্ষ্যাপা জানোয়ারের মতো আর্তনাদ করলো সে,
” সূচিইইইইইই ”
ব্যস,ধ্যান ভেঙে গেল সূচির।এতোক্ষণ বসে কতকিছু ভাবছিলো ও। নিজের প্রথম প্রেম,ফয়সালের প্রতি দুর্বলতা,নিজের ব্যক্তিগত প্রার্থনা,কল্পনা-বাস্তবের বিভেদ,তীব্র প্রেম ফিকে হয়ে আসার গল্প,নিজের অবস্থা,ভবিষ্যৎ, বাবার কথা,মায়ের কথা— আরো কতকিছু। ফয়সালের তীক্ষ্ম স্বর কল্পনা থেকে বাস্তবে ফিরিয়ে নিয়ে এলো ওকে।যেমনটা নিয়ে এসেছে বিয়ের পর থেকে।চমকে পিছে ফিরলো সূচি।
” সমস্যা কী তোমার? কী সমস্যা? তুমি কী ভেবেছো? যা করবে তাই হবে? যা ভালো মনে করো তাই ঠিক? এখানে তুমি যা চাইবে তা হবে না।কারণ এটা তোমার বাড়ি না।”
ফোনটাকে মিটসেফের উপরে রেখে কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে ফয়সাল।সূচির ঘোলা মস্তিষ্ক সচল হয়নি এখনো।সে কিছুই বললো না।কেবল বসা থেকে ফয়সালের মুখোমুখি উঠে দাঁড়ালো মাত্র।
” কী শুরু করেছোটা কী তুমি? ঘরের কোনো কাজ করোনি,সন্ধ্যার নাশতা বানাওনি,ঘরের অবস্থা পুরো বস্তি বাড়ির মতো।একবার তাকিয়ে দেখো তরকারিটার কী অবস্থা করেছো? এগুলো নষ্ট করার জিনিস? টাকা দিয়ে কিনতে হয় এগুলো।মাথার ঘাম পায়ে ফেলে টাকা উপার্জন করি, সেই টাকা দিয়ে এসব ঘরে আসে।তোমার বাবার বাড়ি থেকে আসে না এগুলো যে নষ্ট করবে।নিজে উপার্জন করলে তখন বুঝতে টাকা দিয়ে কেনা জিনিস নষ্ট করলে কতটা খারাপ লাগে।বসে বসে খাও তো,বোঝো না কিছুই।তাই এতো আহ্লাদ করার সুযোগ পাও। তোমার অত্যাচার আর সহ্য করতে পারছি না।আমাদের জীবনটাকে নরক বানিয়ে ফেলেছো তুমি।ভালো না লাগলে বেরিয়ে যাও ঘর থেকে।যাও বেরোও,এখনি বের হও।জাহান্নামে যাও।”
শাসনের নাম করে বউয়ের কাঁধে আলতো চাপড় মারলো ফয়সাল। এতোক্ষণে হুঁশ ফিরলো সূচির।মাথা কাজ করছে,মন কাজ করছে।কাঁধের উপরে ফয়সালের স্পর্শ আগুনের মতো লাগলো।দেহের মাঝে লুকিয়ে থাকা চির অবাধ্য মনটা ঘোষণা দিলো, ” তোর ভালো-মন্দ যে বুঝবে না সে আবার কেমন স্বামী? ওর প্রতি ভালোবাসা কীসের? ওকে থামা সূচি।”
মনের কথাতেই সায় দিলো সে।ঝটকা দিয়ে ছুঁড়ে ফেললো স্বামীর হাত।দাঁত কিড়মিড়িয়ে বললো, ” জাহান্নাম? হ্যাঁ, আমি এখন সেখানেই আছি।নতুন করে যাওয়া লাগবে না। টাকার জিনিস নষ্ট হলে খারাপ লাগে আপনার? সত্যিই? তাহলে প্রতি বেলায় বেলায় যে বাড়তি তরকারি ফেলতে হয় আমাকে তখন কোথায় থাকে আপনার খারাপ লাগা? নাকি খারাপ লাগে শুধু আমার ক্ষেত্রেই? আর কী বললেন? আমার বাবার বাড়ি থেকে আসে না এসব।আপনার মনে হয় এই দৈনিকের বাজারটাও আমার বাবার বাড়ি থেকে আসবে? এই আশা করছেন? অবশ্য আশা আপনি করতেও পারেন।যেখানে আপনার আম্মার কথা শুনে আপনার ঘর সাজিয়ে দেয় আমার বাবা,সেখানে আপনি এতুটুকু আশা করবেন না তো কে করবে? আর কাজের কথা তুলছেন কেন? প্রত্যেকদিন তো আমাকে বলা লাগে না।আমি নিজেই করি।আজ নিশ্চয়ই না করার কারণ আছে।একটা মানুষের ভালো-মন্দ বুঝবেন না আপনারা? আমি মরি-বাঁচি আপনাদের ঘরের কাজ আমাকে শেষ করে রাখতেই হবে? তিন কবুলের জোরে ঘরে বউ এনেছেন নাকি দাসী?”
পরিস্থিতি উত্তপ্ত। বউয়ের প্রশ্নের উত্তর দিলো না ফয়সাল।ডান হাতের আঙুল তুলে রান্নাঘরের দরজা দেখিয়ে বললো, ” ভালো না লাগলে বেরিয়ে যাও।দরজা খোলা আছে।তোমাকে কেউ পায়ে ধরে আটকে রাখেনি।”
” এই আপনি বারবার বেরিয়ে যাওয়ার কথা বলছেন কেন? লজ্জা করে না আপনার? আমার বাবা যে আজকে এতোগুলো জিনিস দিয়ে গেল তার প্রতিদান দিচ্ছেন? আপনি বললেই আমি বেরিয়ে যাব? এতো সহজ? আমি আপনার হাত ধরে একা একা এ বাড়িতে এসেছি? আপনার আম্মা নিজে পছন্দ করে নিয়ে এসেছে। বারবার বেরিয়ে যাওয়ার কথা বলার সাহস কে দিলো আপনাকে?”
সাহসের ইঙ্গিত করতেই রেগে আগুন হয়ে গেল ফয়সাল।সূচির গাল থেকে ঠিক তিন আঙুল দূরে ডান হাত নিয়ে ইতরের মতো চেঁচিয়ে বললো, ” আমার সাহস দেখার সাহস করো না।একদম থাপড়ে গাল লাল করে দেব বেয়াদব।বিয়ের পর থেকে অশান্তি ছাড়া আর কী দিয়েছ? আমি জানতাম এরকমই কিছু হবে।তাই বিয়ের আগেই বারবার বলেছি এই মেয়েকে আমার অপছন্দ।একে আমার চলবে না।আমার আম্মার উপরেই তো তোমার যত রাগ? যার উপরে রাগ করছো তার দৌলতেই তুমি কাজী বাড়িতে বউ হয়ে আসতে পেরেছো।নয়তো তোমার মতো মেয়ের দিকে আমি ফিরেও তাকাই না।নিজের সাথে মিলাও তো আমাকে।আমার পাশে মানায়?তোমার না আছে রূপ,না আছে গুণ।তোমার মতো একশটা সূচিকে আমি মাড়িয়ে যেতে পারব।সেই তুমিই করো আমার সাথে চোটপাট! বেহায়া মেয়েমানুষ।”
সহ্য করতে পারলো না সূচি।তেড়ে এসে বললো, ” এতো কীসের অহংকার? আমাকে বউ করার জন্য আমার আব্বা-আম্মা পায়ে ধরেছিলো আপনাদের?আর একটা বাজে কথা..
” একদম চুপ করো।মানুষের বাচ্চা হলে আর মুখ নাড়তে না। তিনবেলা বিনা পয়সায় খাওয়াচ্ছি-পরাচ্ছি।তার বিনিময়ে সংসারের কাজগুলোও করতে পারো না তুমি।একটু শান্তি দেও না আমাদেরকে। চোখের চামড়া নেই বলে কি কৃতজ্ঞতা নেই? নেমকহারামের জাত।এক্ষুনি তোমার আব্বার কাছে ফোন দিচ্ছি।দরকার নেই তার মেয়েকে আমাদের। নিয়ে যাক এসে।”
পৃথিবীটা যেন দুলে উঠলো।ভয়ংকর এক ভূমিকম্প অনুভব করলো সূচি। শেষ পর্যন্ত খাওয়া-পরার খোঁটা! সব কল্পনা,ভালোবাসা,আবেগ,অনুভূতি, এই কয়েক মাসের সংসারের চিত্র– সব উবে গেল।অনুভূতিরা মরে গেল। জিহ্বা নেড়ে কিছু একটা বলতে চাইলো কিন্তু স্বর ফুটলো না।ফয়সাল ফোন নিয়ে চলে গেল বসার ঘরে।অন্ধকার রান্নাঘরে কেবল ভূতের মতো দাঁড়িয়ে রইলো সূচি। মেয়েটা সে রাতে অজ্ঞান না হয়ে কীভাবে স্থির ছিল তা এখনো এক রহস্য বটে।
তারপরের ঘটনা বর্ণনা করতে আর ইচ্ছা করে না।সেই রাতে প্রচন্ড ঝড়-বৃষ্টির কারণেই মস্ত এক ফাঁড়া কেটে গেছে সূচির।মেয়ের শ্বশুরবাড়ি থেকে জরুরি সংবাদ পেয়েও ছুটে যেতে পারেননি মমিন শেখ।বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে বাজার থেকে সবে বাড়ি ফিরেছিলেন।এমন সময়েই ফয়সালের কল এলো।ভিজা জামা-কাপড় ছাড়ার আগেই ফোন ধরলেন।তারপর বজ্রাহতের মতো শুনলেন মেয়ের অধঃপতনের কথা।মেয়ের অহংকার বেড়ে গেছে,শাশুড়ি-জামাইয়ের কদর করে না,কথা শোনে না,ওকে দিয়ে সংসার চলে না,ও এরকম করলে ওকে আর ঘরে রাখা যাবে না— এরকম হাজারটা অভিযোগ।
ফয়সালের কাছ থেকে পাঁচ মিনিটের জন্য ফোনটা রোমেলা বানু নিয়েছিলেন।ততোক্ষণে তার জোশ এসেছে শরীরে।গলা উঁচিয়ে বলেছেন, ” কালকে আইসা আপনের মেয়েরেও নিয়া যাইবেন,ফার্নিচারও নিয়া যাইবেন।কিছু দরকার নাই।আমরা ভদ্রলোক দেইখা এই মাইয়ারে নিয়া সংসার করি। নাইলে এরে নিয়া আর যাই চলুক সংসার চলে না।এইবার বাড়ি থেকা আসার পর থেকা বেশি বাড়াবাড়ি করতাছে। এরকম আমরা সহ্য করুম ক্যান? আপনার মাইয়া আপনার বাড়িতে বাড়াবাড়ি করুক। আর কোনো কথা নাই আপনাগো সাথে।কালকে সকালে মেয়ে নিয়া যাইবেন।”
আঘাতটা ঠিক জায়গামতো এসেছে।মমিন শেখ আর যাই পারুক মেয়ের বিচ্ছেদের কথা শুনতে পারবে না।এক মেয়ে মুখে চুনকালি দিয়েছে।আরেক মেয়ে যদি এতো ভালো বংশেও সংসার করতে না পারে তো লোকসমাজে মুখ দেখানোর জো থাকবে তার? ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলে এই মেয়েকে বাড়িতে রেখেই তিনি কী করবেন? এর ভবিষ্যৎ অন্ধকার।মেয়ের গায়ে কালি লাগলে কালির এক অংশ তার গায়েও এসে পড়বে।এ কি হতে দেওয়া যায়? কখনোই না।
বৃষ্টির কারণে মেয়ের কাছে যেতে পারলেন না মমিন শেখ।যেতে পারলে সে রাতে খবর ছিল সূচির।নিজে অনুপস্থিত থেকেও ফোনের মাধ্যমে কাজ সেরেছেন।ফোনের ওপ্রান্তে বসে সূচির সাথে কথা বলেছেন।শাসন-বারনের কঠিন লিপি।মমিন শেখের জিহ্বা যা উচ্চারণ করেছে সেদিন,তা উচ্চারণ করার মতো জিহ্বা এ দেশে খুব কমই আছে।তবে আগাগোড়া অশ্রাব্য গালিগালাজে মোড়ানো কথার শেষাংশটুকু বলা যায়।ফোন রাখার আগে কঠিন গলায় বলেছেন, ” তুই ভাবিছ না ঐ বাড়ি থেকা বাইরায়া আমার বাড়িতে পা রাখতে পারবি।আমি সেরকম মানুষ না। তোরে দাঁড়াইতেও দিমু না ঘরে।কাইট্টা মেঘনায় ভাসামু। তোর মতো অজাত-কুজাতের কোনো দরকার নাই।”
বাবার পরে আবার মায়ের ভাষণ শুনলো সূচি।স্বামীর পাশে বসে মেয়ের কথা শুনছিলেন সাহিদা বেগম।যত শুনেছেন,ততো বিরক্ত হয়েছেন,রেগে গেছেন।স্বামীর কথার শেষে ফোনটাকে ছোঁ মেরে নিয়ে ত্যক্ত গলায় বললেন, ” তুই মরার আগে শান্তি দিবিনা কাউরে? আমার ঘরে থাকতে আমারে জ্বালাইছোছ,ঐ মহিলার কাছে যায়া তারে জ্বালাছ।দুনিয়াতে তুই একা ঠিক বাকি সবাই ভুল? এই ভাবোছ? নিজেরে কী মনে করোছ? তোরে আমিই সহ্য করতে পারি না আর মাইনষের মায়ে ক্যামনে করব? তুই জ্বালানের লেগাই জন্মাইছোছ।প্রতিদিন এতো মানুষ মরে,তুই মরতে পারোছ না? কী শিখাইলাম এতো এইবার? কিছু কানে ঢুকে নাই? করবি না সংসার? বাপের ঘরে আইসা খুঁটি হবি? হ্যাঁ? তুই মরলে আমি দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ুম।জানোয়ার একটা।”
এ বাড়িতে দুইজন,ও বাড়িতে দুইজন।মোট চারজনে মিলে শাসন করার পর যখন অবসর মিললো,সূচি তখন নিজের দিকে চেয়ে দেখলো সে বিষন্নতার শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে।কাউকে কিছুই বলেনি।সবকিছু চুপচাপ শুনেছে। হাবিজাবি কতকিছুই যে মাথায় ঘুরলো! ভিতর থেকে কেউ একজন চুপিচুপি বলেদিলো, ” তুই মরলে সবার হাড় জুড়ায়।মরে যা তো।ফ্যানের সাথে ঝুলে পড়া খুব কঠিন নয়।অথবা এই বৃষ্টি-বাদলার রাতে পুকুরে যা।চোখ-মুখ বন্ধ করে ঝাপিয়ে পড়।একটা ডুবেই সব শেষ।তুই তো সাতার জানিস না।কেউ কাঁদবে না,কেউ খুঁজবে না।দূর হ হতভাগী।”
সেদিন অঘটন একটা ঘটিয়েই ফেলতো।কিন্তু শক্তি পাচ্ছিলো না সূচি। পা শক্ত করে দাঁড়াতেই পারছিলো না।নির্জীবের মতো পড়ে ছিল রান্নাঘরের এক কোনে।উঠে ঘরে যাওয়ার শক্তি অবধি ছিল না। সব শক্তি অজানা এক শক্তি এসে চুষে নিয়ে গেছে।দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে মরা-বাঁচার মাঝে এক প্রকারে বেঁচে ছিল সূচি।বাইরে হাওয়ার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ে দীর্ঘশ্বাস। অবশেষে সবাই ছেড়ে গেল।মা-বাবা,স্বামী–সবাই।পাশে দাঁড়ানোর মতো কেউ নেই,এই ঘর ছেড়ে এক পা দাঁড়ানোর জন্য জায়গা নেই,নিজের পায়ে দাঁড়ানোর মতো সামর্থ্য নেই,শিক্ষা নেই,রূপ নেই,গুণ নেই,উঠে দাঁড়ানোর মতো শক্তি নেই,এ বাড়িতে কদর না থাকলে বাবার বাড়িতেও কদর নেই।এতো এতো প্রতিকূলতায় বৈশাখের প্রথম রাতে অন্ধকার রান্নাঘরে বসে সূচির মনে হলো, ও আসলে পৃথিবীতে একা।ভয়াবহভাবে একা।
চলবে…