#শুকতারা (পর্ব-৪০)
#হালিমা রহমান
বৃষ্টির তেজ কমতে কমতে এখন থামার পথে। কিছুক্ষণের জন্য মেঘেরা বিশ্রাম নেবে হয়তো। বাতাস আছে আগের মতোই।বাইরে বাতাসের সাথে ঝিরঝিরে বৃষ্টির ঝংকার। থামেনি এখনো, রয়ে-সয়ে ঝরছে।একটু পরেই থেমে যাবে। রান্নাঘরের ছোট্ট জানালা দিয়ে আসা এক পশলা শীতল হাওয়া উদাস করে দেয় ফয়সালকে।খাওয়ার রুচি চলে গেছে অনেক আগেই। সে বসে বসে মাথা নিচু করে ভাত নাড়ে।মাথায় ঘুরে পহেলা বৈশাখের সেই দৃশ্য।দুঃখের দিনও কাটে,রাতও ফুরায়। জীবনের বাঁক বদলায়।যেমন সেই রাতটা এসে রাতারাতি বদলে দিয়েছে ওদের সম্পর্কের স্রোত।আজ এমন এক জায়গায় দুজনে দাঁড়ানো যেখানে খালি চোখে ঝামেলা, মনোমালিন্য দেখা যায় না।বাইরে থেকে ওরা একদম সুখী পরিবার।আগের মতো চিৎকার নেই,হৈচৈ নেই,বেলায় বেলায় অভিযোগ নেই,ঘরের বউ বশ্যতা স্বীকার করেছে,ফয়সাল কর্তা, আর রোমেলা বানু সবার উপরে কর্তৃত্বের রাশ দু-হাতে টেনে ধরে রেখেছেন। সেখানে এক চুল ছাড় নেই।কাজী বাড়ি কর্ত্রী তিনি। এই তো ঝামেলাহীন একটি সুন্দর পরিবার। কিন্তু এই ঝলমলে ছবির বাইরেও একটা ছবি আছে।সেখানে গাঢ় অমানিশা। সম্পর্কের বিষাক্ত বাতাসে জর্জরিত স্বয়ং ফয়সাল।দিন-রাত মেয়েটার শুকনো মুখ,খাবার নিয়ে অবহেলা,মুখ বুজে থাকা, মাটির দিকে দৃষ্টি অথবা নিজের প্রতি চূড়ান্ত অবহেলা প্রতিনিয়ত খুঁচিয়ে ঘা করে।মনে করিয়ে দেয় কিছু একটা ঠিক নেই। যে চিরকালের অবাধ্য তাকে বশ্যতায় সবচেয়ে বাজে দেখায়।যার মুখের বাঁকা-ত্যাড়া কথা শুনতে শুনতে কান পচে যাচ্ছিলো এতোদিন,তার নীরব ভূমিকাই বেশি পীড়া দেয়। সরু বাঁশ পাতা যেই ঠোঁটে হাসিটা ছিল সবচেয়ে মোহনীয়, তার ঠোঁট টিপে মুখ বুজে রাখাটাই সবচেয়ে বিশ্রী। সূচির পিঠ ভাসানো কালো মেঘ চুলের ঘ্রাণ ছিল ফয়সালের সবচেয়ে পছন্দের। তেলতেলে চুলে কৃত্রিম একটা ঘ্রাণ।সেই মেঘের রাশিই আজ যখন সময়ে-অসময়ে রুক্ষতা,শুষ্কতার আড়ালে হারিয়ে যায়;এলোমেলো হয়ে নিতান্ত অবহেলায় পিঠের উপর পড়ে থাকে তখন ফয়সালের বুকে যে হু হু করে মরুভূমির উষ্ণ বাতাস বয়, সে খবর কে রাখে? অজানা এক আতঙ্কে তার বুক ভার করে।এতোদিন এক ঘরে একসাথে থাকার পরে মনের যে অংশে মায়া জন্মেছে, সেই অংশটা হাত-পা ছড়িয়ে বিলাপ করে কাঁদতে বসে।চুপিচুপি বুদ্ধি দেয়, ” সেদিন একটু বাড়াবাড়িই করেছিলি। তুই করেছিস,সে সহ্য করেছে।রাগের বশে মনে পুষে রাখা অত্যন্ত গোপন বাজে কথাগুলো বেরিয়ে গেছে মুখ দিয়ে।আর কেনো বাপু? এবার ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে নিজেদের মাঝে চুপচাপ ঝামেলা মিটিয়ে নে।”
এক ঘরে একসাথে থাকলে জন্তু-জানোয়ারের প্রতিও মায়া জন্মায়,সেখানে সূচি তো রক্ত-মাংসের আস্ত এক মানুষ।নির্জীব সূচিকে দেখলে মনের ভিতরটা যে খামচায় না, তা কিন্তু নয়।মেয়েটাকে একটুখানি প্রশ্রয় দিতে ইচ্ছা করে।কিন্তু তখনই, ঠিক তখনই মন-মস্তিষ্কের সচেতন অংশটা সতর্ক করে দেয় সদর্পে।আকাশের মতো গর্জন করে ঘোষণা দেয়, ” কী দরকার? যে যেমন থেকে ভালো আছে সে তেমন থাকুক। একটুখানি প্রশ্রয় পেলেই আবার মাথায় উঠে বসবে।মনে নেই কিছুদিন আগের কথা? বাবার বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার পরে খুব তো ভালো ব্যবহার করেছিলি।রাত-দিন ফোনে ফোনে প্রেম তো কম হলো না।তারপরে কী হলো? মেয়েটা বাড়ি ফিরে কত ঝামেলা করলো! ভুলে গেছিস সব? ভুলিস না,আবেগে ভাসতে নেই। ঘরের শান্তিই বড় শান্তি।কিছুদিন যাক, দেখবি এমনিই আগের মতো হয়ে যাবে।এখন আগ বাড়িয়ে ঢং করতে গেলেই তোর ভাবমূর্তি নষ্ট হবে।দরকার নেই ওসবের।”
কিছুদিন ধরে এই দুই ধারার চিন্তাই প্রবাহিত হয়।সময়ে-অসময়ে বৈপরীত্য তাকে ঘা মারে হিংস্রভাবে।মন-মস্তিষ্কের টানাপোড়েনে হাঁসফাঁস করে সে।কী করবে,কী করবে না তা স্থির করতে পারে না। কখনো ছোটখাটো বিষয়েও মন শক্ত করে সিদ্ধান্ত না নেওয়া ফয়সাল কিছুতেই ঠিক করতে পারে না সে আসলে কী করবে। বেচারা নিজের মনটাকেই চিনতে পারে না এখনো।ভাত নড়াচড়া করতে করতে আবারো মন-মস্তিষ্কের যুদ্ধে দিশেহারা হয়ে উঠলো সে। এখন অবধি মাথার বুদ্ধিতেই চলছে। বউয়ের সাথে কথা বলছে না ঠিকঠাক।দশ কথায় হু,হ্যাঁ জবাব দেয়। সূচির নিজের প্রতি অবহেলা চোখে বিঁধে কিন্তু তবুও মুখ ফুটে কিছু বলে না।নিজেকে বোঝায়, কী দরকার বলার? অশান্তি হচ্ছে না এই অনেক। কিন্তু হতচ্ছাড়া মনের সেই দুর্বল অংশটার যন্ত্রণায় বাঁচা যায়? মানসিক শান্তি বলেও কিছু একটা আছে।মনের মাঝে কী যে করে তা আল্লাহ মালুম। যার বুক ফাটলেও মুখ ফুটে না, তার চেয়ে অসহায় বোধহয় দুনিয়াতে আর একটাও নেই।দৈনিকের অন্তর্দহন,মানসিক টানাপোড়েন,মন-মস্তিষ্কের ঘাত-প্রতিঘাত,যুক্তি,তর্ক,বুদ্ধি-পরামর্শ– হাজারটা হাবিজাবি ঝুট-ঝামেলার সাথে লড়তে লড়তে ক্লান্ত হয়ে পড়ে সে।যেমন এখন হচ্ছে।পেটে ক্ষুধা অথচ মুখে রুচি নেই। মনের মাঝে গড়ে উঠেছে সমস্যায় বিশাল পাহাড়। সবকিছুর মর্মে এক কঠিন প্রশ্ন, ” কী করা উচিত? যা হচ্ছে তা কি ঠিক?”
এতো কঠিন প্রশ্নের সম্মুখীন সে এই জীবনে আর হয়নি।আগে মনে হতো পদার্থ বইয়ের কঠিন কঠিন প্রশ্নগুলোই সবচেয়ে কঠিন।কিন্তু আজ জীবনের একাংশে বসে মনে হচ্ছে এই সহজ-সরল জীবনটা পদার্থবিজ্ঞানের চেয়ে বেশি কঠিন। মনের প্রশ্নের বেড়াজালে বিভোর হয়ে সে যখন ক্লান্ত-ত্যক্ত-বিরক্ত-ক্ষুব্ধ,ঠিক তখনই সূচি এলো।পাশে দাঁড়িয়ে মৃদু গলায় প্রশ্ন করলো, ” আপনার খাওয়া হয়েছে?”
ভাবনা রাজ্যে কাঁপন ধরতেই বাস্তবে ফিরলো ফয়সাল।সচেতন চোখে চেয়ে দেখলো বউয়ের দিকে।এতোক্ষণের চিন্তাধারা উবে গেল। মনে হলো এই মেয়েটাই সব সমস্যার মূল।সেই শুরু থেকেই জ্বালাতন করছে।সে না থাকলে কোনো সমস্যাই থাকতো না। মেয়েটা প্রজ্জ্বলিত অগ্নির মতো।একে কাছ থেকে সহ্য হয় না একটুও।সহসা অকারণেই রেগে গেল।মুখ শক্ত করে বলে ফেললো, ” আমার খাওয়া দিয়ে তোমার কী দরকার? দেখছো খাচ্ছি তবুও প্রশ্ন করছো।খেতেও দেবে না নাকি?
আশ্চর্য! ”
কথাটা মুখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ার পরেই চটকা ভাঙলো।নিজের আকস্মিক রুঢ়তায় নিজেই একটুখানি হয়ে কুঁচকে গেল। বিপরীতে তাই আর কিছু না বলে নিচু মুখে ভাত নাড়লো কেবল।
যাকে কঠিন কথা বলা হলো তার কোনো হেলদোল নেই।যেন সে জানতো এরকম কিছুই হবে।মাত্রাতিরিক্ত শান্ত গলায় সূচি বললো,” আপনার খাওয়া হলে প্লেটটা দিন।থালাবাটি ধুতে আমি পুকুরে যাব।”
” এই বৃষ্টিতে!”
” বৃষ্টি কম।”
” কম হলেই কী? বন্ধ তো হয়নি এখনো।থালাবাটি ঘরে ধোও।তোমার না জ্বর? বৃষ্টিতে ভিজলে জ্বর বাড়বে।”
” আমার কিছু হবে না।অসুখ-বিসুখ আমাকে কাবু করে না।খাওয়া হলে আমাকে প্লেট দিন।”
আলোচনার পালাটা জোর করে বন্ধ করে অন্য কাজে চলে গেল সূচি। ফয়সাল বুঝলো তার বিরক্তি। তাই আর কথা বাড়ালো না। তাকে যে সূচি না পেরে সহ্য করছে তা বেশ বুঝতে পারে।আর এক লোকমা ভাত মুখে দেওয়াও সম্ভব না।ভাতের প্লেটে হাত ধুয়ে উঠে গেল ফয়সাল।ঘরে যাওয়ার আগে চেঁচিয়ে বললো, ” সূচিইই,ভাতগুলো ফেলে দাও।আর খাব না।”
রান্নাঘরের বাইরেই দাঁড়িয়ে ছিল সূচি। ফয়সালের চোখের আড়াল হওয়ার জন্য এমনিই দাঁড়িয়ে ছিল।তার চোখের সামনে দাঁড়াতে ভালো লাগে না একটুও।স্বামীর কথা শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ইশ! আবার খাবার নষ্ট।
_________________________________
একগাদা থালা-বাটি,বাসন-কোসন নিয়ে পিচ্ছিল উঠোনে সাবধানে পা ফেলে ফেলে পুকুর পাড়ে পৌঁছে গেল সূচি।পুরোনো ঘাট,নারকেল গাছকে মাঝামাঝি দু ফালা করে ফেলা রাখা হয়েছে সিঁড়ি হিসেবে।একটু নড়বড়ে, একটু বিপজ্জনক বটে।শুকনোর দিনেই এই জায়গায় পা দিতে ভয় করে।পা পিছলানোর সম্ভাবনা আছে।সেখানে এই বৃষ্টি-বাদলার দিনে সূচির মতো সাঁতার না জানা মানুষের জন্য পুকুর ঘাট রীতিমতো মৃত্যু পথ।একবার পা পিছলে পড়ে গেলেই কেল্লাফতে।একবারে পুকুরের গভীরে।
ঝিরঝিরে বৃষ্টি ভিজিয়ে দিলো সূচিকে।গায়ের কালচে লাল শাড়ি মুহূর্তেই লেপ্টে গেল শরীরের সাথে। তার কোনোকালেই বৃষ্টি পছন্দ ছিল না।তাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে এই ঘ্যানঘ্যানে বৃষ্টি গায়ে মাখার কোনো মানেই হয় না।ছাই-সাবানের কৌটা ও থালাবাসন ঘাটের শেষ মাথায় রাখার পর, ভাতের পাতিলের উপরে বসানো, ঢাকনা দিয়ে ঢাকা নির্দিষ্ট প্লেটটা নিয়ে দ্রুত পায়ে হুমায়রার ভিটার দিকে ছুটলো সূচি।রোমেলা বানু গোসলে গেছেন।এইটুকুই তো অবসর।
ডান পায়ের ব্যাথাটা সাড়লেও বাজে একটা টনটনে ভাব রয়েই গেছে।এই পা’টাকে নিয়ে পারা যায় না আর।একটু এদিক-ওদিক হলেই কট করে ব্যাথাটা বেড়ে যায়।কিছুদিন আগে একটা ছোটখাটো অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে তার।চাচাতো ভাইয়ের বাচ্চা হওয়ার সুবাদে ভাবীর সাথে হাসপাতালে ছিল হুমায়রা।সে ঝামেলাহীন মানুষ।তার বাচ্চা নেই,স্বামী নেই,শাশুড়ি-দেবরের ভার নেওয়ার দায়িত্ব নেই।তাই স্বেচ্ছায় গিয়েছিল।বিপত্তি বাঁধলো হাসপাতাল থেকে নিজের বাড়ি ফেরার পথে।অটোতে চেপে বাড়ি কাজী বাড়ির পথ ধরেছিল সে।বিধি বাম! বাজারের কাছে আসতেই চালকের অসাবধানতায় ও ভাগ্যের লেখায় অটো উল্টে গেল।আরো দু-একজন যাত্রী ছিল।তাদের ও চালকের অবস্থা বেশি খারাপ হয়েছে।হুমায়রা অটো থেকে গড়িয়ে পড়ে গিয়েছিলো রাস্তায়। হাত-পায়ে ব্যাথা পেয়েছে সেখান থেকেই।বাজারের লোকেরা ধরাধরি করে তাকে তার বাবার বাড়ি দিয়ে এসেছে।এতোদিন সেখানেই ছিল সে।বাড়ি ফিরেছে চার-পাঁচদিন আগে।হাতের ব্যাথাটা কমলেও পায়ের ব্যাথাটা পুরোপুরি যায়নি এখনো। বিশেষত ডান পা’টা একটু বেশিই সমস্যা করছে।টেনে চলতে হয়।
আহত পা’টাকেই টেনেটুনে খাট থেকে নেমে দাঁড়ালো হুমায়রা।তার ক্ষুধা পেয়েছে।কিছু একটা খাওয়া দরকার।কিন্তু তার ঘরে কিছুই নেই।কিছু নেই বলতে বাজার নেই।চাল আছে বোধহয় এক পটের মতো আর কৌটার তলানিতে কিছু ডাল আছে।তেল,হলুদ,লবন,মরিচ ছাড়া বাড়তি একটা ডিমও নেই।বাজারটা সে নিজেই করে।বাড়ি ফেরার পর থেকে কিছু কেনা হয়নি এখনো।একে তো শারীরিক অসুস্থতা তার উপরে রাত-দিন বৃষ্টি।বাজার অবধি যাওয়ার আর সাহস হয়নি হুমায়রার।
দুটো চাল ফুটিয়ে ও তার সাথে একটু ডাল ভর্তা বানিয়ে সকালের খাবারের পালা সাঙ্গ করার ইচ্ছা ছিল।রান্নাঘর অবধি যেতে হলো না।মাঝের ঘরের বেড়ার কাছে আসতেই সূচির সাথে দেখা।আধভেজা শরীরে দ্রুত আসছে শোবার ঘরের দিকে।তার মুখ ভেজা,মাথায় টেনে দেওয়া আঁচলের বাইরে ঝুলে থাকা দু-তিনটে চুল ভেজা,হাতের প্লেট ঢেকে রাখা ঢাকনাটাও ভেজা। হুমায়রার দিকে চোখ পড়তেই চোখ দুটো নমনীয় হয়ে এলো সূচির। কাতর গলায় বললো, ” অনেক কষ্ট দিলাম আজকে।খুব ক্ষুধা পেয়েছে তোমার? এতোক্ষণ ধরে আসার সুযোগ খুঁজছি কিন্তু তা আর হলো কই? তোমার দেবরের খাওয়া শেষ হলো মাত্র। তাকে খাইয়ে-দাইয়ে তারপরেই আসতে হলো।তাড়াতাড়ি খেয়ে ঔষধগুলো খাও।”
একদমে কথাগুলো বলে প্লেটটা হুমায়রার হাতে ধরিয়ে দিলো সূচি।এই সেই প্লেট যেটা সে মিটসেফে সযত্নে লুকিয়ে রেখেছিল।হুমায়রার খাবার-দাবারের ব্যবস্থা সেই করছে তিনবেলা। যার নিজেরই খাবারের খোঁটা শুনতে হয় সে স্বামী-শাশুড়ির চোখ বাঁচিয়ে কীভাবে আরেকজনের খাবারের ব্যবস্থা করছে, সেই ইতিহাসটা গোপনই থাক।
হাত ধুয়ে এসে মাঝের ঘরের খাটের উপরে বসলো হুমায়রা। ভাত মাখতে মাখতে প্রশ্ন করলো, ” আম্মা কই? দেখে নাই তোমারে?”
” না,তিনি গোসলে।”
” কী বইলা আসলা?”
” পুকুরে থালাবাটি ধোয়ার কথা বলেছি।”
” এই বৃষ্টিতে পুকুরে গেছো ক্যান? পাগল তুমি? এমনেই জ্বর, অসময়ের বৃষ্টিতে ভিজলে জ্বর কমে পাগল?”
হাত দিয়ে মাছি তাড়ানোর ভঙ্গি করে কথাটা উড়িয়ে দিলো সূচি। খাটের উপরে হুমায়রার পাশে বসে বললো, ” জ্বর-টরে কিছু হবে না আমার।”
” হ এমনই বইলো।বিছনায় পইড়া গেলে বুঝবা।আমার অবস্থাই হইব।দেখার মতো কেউ থাকব না তখন।আচ্ছা, জ্বর বাদ দিলাম।পুকুরের যেই ঘাট মাশাল্লাহ। পাও পিছলাইলে কী হইব? সাঁতার-টাতার জানো না।পুকুরে পইড়া গেলে কে তুলব তখন? ছেড়ি, তোমার মরার ভয় নাই?”
” আমি এতো সহজে মরব না ভাবি।আরো কত বড় বড় ঘটনার সাথে লড়ে বেঁচে আছি সেখানে এই নড়বড়ে পিচ্ছিল ঘাট তো কিছুই না। আমি অনেক আগেই বুঝেছি,সহজ মরণ আমার কপালে নেই।”
সূচির কন্ঠে তাচ্ছিল্য,ঠোঁটে ফুটে এক চিলতে হাসি।সেই হাসির অর্থ হৃদয়ঙ্গম করতে সক্ষম হলো হুমায়রা।নিজের কথায় নিজেই লজ্জা পেয়ে বললো, ” ছিঃ! ছিঃ! মরবা ক্যান? পৃথিবীর সবচেয়ে বুড়া মানুষের আয়ু পাও তুমি।আরো অনেক বছর বাঁইচ্চা থাকো।”
” বেঁচে থাকাটাই কি সব? যদি আমাকে খুব ভালোবাসো তো দোয়া করো আমি যেন তাড়াতাড়ি মরি।সেদিনের পর থেকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের শেষে কেঁদে কেঁদে এই দোয়াটাই করছি। কিন্তু আমি তো মহাপাপী তাই দোয়াটা কবুল হচ্ছে না।আমার হয়ে তুমি এখন থেকে এই দোয়াটা করে দিও।”
সূচির ভাবলেশহীন সহজ কন্ঠ।কথায় কোনো তাপ-উত্তাপ নেই। এমনভাবে বললো যেই এই ভয়ংকর কথাগুলো ডাল-ভাত।হুমায়রার বুক কাঁপে থরথর করে।একটা কথা মাথায় এসেছে তার। ভাতের লোকমা মুখে তুললো না আর।কম্পিত গলায় বললো, ” তুমি কি এইসব কথা ভাবো সূচি?”
হুমায়রার কথা শুনে অকারণেই আজকের দিনে প্রথমবারের মতো খিলখিল করে হাসলো সূচি।একদম বিষন্নতার শেষ ধাপে দাঁড়িয়ে থাকা অপ্রকৃতস্থ মানুষের মতো।একচোট হাসির শেষে মুখে আঁচল গুজে ভ্রু নাচিয়ে বললো, ” ভয় পাচ্ছো কেন? কীসের কথা ভাবছি আমি? ভাবছো,আত্মহত্যার কথা ভাবছি? ধুর,আমার ওতো সাহস নেই। সাহস থাকলে আবার আজকে তোমার সামনে বসে আছি? বাড়ি ফিরে আমাকে দেখতেই পেতে না। সূচি তখন স্মৃতি হয়ে যেতো। নিজের হাতে নিজের প্রাণ নেওয়া এতো সহজ? না ভাবি, অনেক কঠিন।আমার মতো বেহায়া মানুষদের জন্য আরো কঠিন।আমরা হাজার চড়-লাথি খেয়েও পৃথিবীর মায়া ছাড়তে পারি না।”
শেষদিকে খুব উদাসী দেখায় সূচিকে।হুমায়রার ভাত খাওয়ার ইচ্ছাই চলে গেল।ঝামেলার সময় সে বাড়ি ছিল না।বাড়ি ফেরার পরে সব শুনেছে। সূচি তো প্রথমে বলতেই চাইলো না।কিন্তু তার শুকনো মুখ,নিজের প্রতি অবহেলা,মুখ বুজে থাকা সবকিছু চোখে খট করে বাজলো। একদিন খুব করে চেপে ধরতেই সব বললো সূচি। হুমায়রার সাথে নিজের দুঃখ ভাগ করার পরেই বাংলা নতুন বছরে প্রথমবারের মতো কেঁদেছে মেয়েটা।মন-প্রাণ উজার করে কেঁদেছে।
” এই দেখো,তোমার খাওয়াটাই বন্ধ হয়ে গেছে।হাহ! আমি কাছে থাকলে কিছুই ঠিকঠাক হয় না।তুমি খাও ভাবি, আমি যাই।”
চঞ্চল পায়ে দরজার কাছে যেয়ে আবার ফিরে এলো সূচি। মুখভঙ্গি আগের মতো নেই আর।পুরো মুখ কঠিন, থমথমে।আগের সেই হাস্য-পরিহাসের লেশ মাত্র নেই।খাটের কাছে এসে নিচু গলায় বললো, ” আমি জানি আমাকে নিয়ে তোমার চিন্তা হবে।আমার কথাগুলো মনে মনে ভেবে কষ্ট পাবে।কষ্ট পেয়ো না।আমি আসলে কখন কী বলি তা নিজেও জানি না।ইদানিং মাথাটা ঠিক থাকে না।এটা মনে হয় আস্তে আস্তে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।আমার কথায় খুব গুরুত্ব দেওয়ার দরকার নেই ভাবি।”
নিজের মতো কথাগুলো বলে যেভাবে এসেছিল ঠিক সেভাবেই দ্রুত পায়ে চলে গেল সূচি।মাথা পুরোপুরি ঠিক না থাকলেও একটু তো আছে।অন্তত ওটা যতদিন ঠিক আছে ততোদিন দায়িত্বের বেড়াজাল থেকে তার মুক্তি নেই।
ডিপ্রেশন বলতে যদি কোনো শব্দ থাকে তবে সূচি ঠিক সেটাতেই ভুগছে। একদম শেষ ধাপে আছে সে। সত্যি মাঝে মাঝে সে নিজে কতকিছু যে চিন্তা করে ইয়ত্তা নেই।দিন-রাত চব্বিশ ঘন্টার মাঝে কত শত ভয়ংকর, বাজে চিন্তা-ভাবনার সাথে লড়ে লড়ে যে বাঁচতে হয়, তা আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানে না।জানবে কী করে?সূচি তো কাউকে বলে না কিছুই। আলস্য নিন্দনীয় দোষ।কিন্তু এই মস্ত দোষ ও খোদার অশেষ রহমতই সেই পহেলা বৈশাখের রাতে বাঁচিয়ে দিয়েছে সূচিকে। সেদিন সে সত্যি মরতে যেতো।কিন্তু শক্তি পাচ্ছিলো না।তাছাড়া মরার জন্যেও শক্তি লাগে।সূচির খুব অলস অলস লাগছিলো নিজেকে।তাই আর মরা হলো না।সেই রাতে কতরাত অবধি রান্নাঘরেই বসেছিল তা জানা নেই। যতক্ষণ বসেছিল ততোক্ষণ দু-চোখের পাতা এক করতে পারেনি।কাঁদতেও পারেনি।রান্নাঘরের জানালা দিয়ে ভেসে আসা বৃষ্টি-বাতাস একদম ভিজিয়ে দিয়েছিলো ওকে। নির্জীব বস্তুর মতো দেয়ালে ঠেস দিয়ে পড়েছিলো। শেষ রাতে,হ্যাঁ শেষ রাতের দিকেই ঘোর ভাঙে সূচির। আযান দেওয়ার কিছুক্ষণ আগে তীব্র এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে পিঠ সোজা করে উঠে বসে সে।উঠে দাঁড়িয়ে,টলতে টলতে মাতালের মতো ঘরের বাইরে যেয়ে আকাশের দিকে মুখ করে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ।বৃষ্টি থেমেছে ততোক্ষণে।আশেপাশে কোনো সাড়া-শব্দ নেই।চারদিকে গাঢ় অন্ধকার।সেই অন্ধকারে ঝোঁকের বশে নাকি মনের দুঃখে কে জানে,বেশ কিছুক্ষণ আকাশের দিকে চেয়ে কালো মেঘের রাশিতে একটুখানি আলো খোঁজে।তার জীবন ও প্রকৃতিতে দারুন এক সাদৃশ্য। উভয়েই অন্ধকার।আকাশের মতো নিজের জীবনেও ঘন অন্ধকারের মিল আছে বলেই হয়তো দূর আকাশে কুমড়ো ফালি চাঁদ অথবা জ্বলজ্বলে শুকতারা খোঁজে।চেয়ে চেয়ে আতিপাতি করে খোঁজার পরেও যখন ঘন অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ে না তখন আরেকবার দুনিয়া কাঁপানো দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে সূচি।বাতিকগ্রস্তের মতো নিজের মনেই নিজে প্রতিজ্ঞা করে, ” আমি ভালো বউও হব,ভালো মেয়েও হব।”
তারপর দিন থেকেই শুরু।সূচিকে কিছুই বলতে হয় না আর।একটা কাজের কথাও না।রোমেলা বানু,ফয়সাল ত্যাড়া চোখে অন্য এক সূচিকে দেখে।সে কাজ করে নীরবে,লেবুর মতো তাকে চিপলেও সে তেঁতো হয় না। হাজারটা কথা হজম করেও চুপচাপ কাজ শেষ করে।খুঁত ধরার সুযোগ নেই।প্রথম দুই-তিন রাত ফয়সাল ভেবেছিলো বউ হয়তো রাগ করে কথা কম বলছে।তাই সে প্রথমে খুব একটা পাত্তা দিলো না।কিন্তু তিন-চারদিন পর্যবেক্ষণ করার পর তার ভুল ভাঙলো।না, এ রাগ নয়।সূচি নীরবতাকেই নিজের স্বভাব বানিয়ে নিয়েছে।
সূচি সত্যিই খুব বদলে গেছে।বাড়িতেও কথা বলে না।বাবা-মা দুজনের নম্বর ফেলে রেখেছে ব্ল্যাকলিস্টে। তারা মেয়ের খোঁজ-খবর নেয় ফয়সালের ফোনে।মা-মেয়ের মাঝে ভালো-মন্দ, কুশলাদি বিনিময় ছাড়া আর কোনো কথা হয় না।সূচিও বলে না,সাহিদা বেগমের মুখেও বাড়তি কথা জোগায় না।মমিন শেখের সাথে কথা হয় হুটহাট। সপ্তাহে একদিন অথবা দুই সপ্তাহে একদিন, কয়েক মিনিটের জন্য বাবার কন্ঠ শোনে সূচি।কিন্তু ঐ সামান্য সময়েই কে যেন ওর টুটি চেপে ধরে।কথা আসে না মুখ দিয়ে।আজকাল বাবার বাড়ির কথাও মনে পড়ে না তার।ভাবিদের কথা,রনি-লিলির কথা,বিশাল বাড়ির কথা– কিছুই না।এমনকি ভূমিকেও মনে পড়ে না।ভূমির বাড়ি এখান থেকে কাছে।এখন আর তাকে দেখতে যেতেও ইচ্ছা করে না।এক নিষ্ফল অভিমানে মন-প্রাণ বুজে আসে।কাজের ফাঁকে মনের কোন থেকে বড় আপা মাঝে মাঝে বেরিয়ে আসতে চাইলে জোর করে মন বন্ধ করে রাখে সূচি।মনে বাজে তীব্র অভিমান, সবার সাথে সম্পর্ক রক্ষা করার দায়িত্ব কি একা ওর? এতো কাছাকাছি থেকেও বড় আপা তো একদিনও দেখতে এলো না ওকে।এমনকি কোনোদিন ফোনও দেয়নি।বাকি সবার মতো হয়তো সেও ভালোবাসে না সূচিকে।তাহলে ও কেন একা জোর করে ভালোবেসে মনে রাখবে?
ফয়সালকে এড়িয়ে চলে যথাসাধ্য। তার ছায়া মাড়ালেও কেমন যেন একটা বিতৃষ্ণা চলে আসে।চোখে চোখ রাখে না।একটা কথাই প্রবলভাবে মাথায় ঘুরে অহর্নিশ।সে ফয়সালের যোগ্য না।শুধুমাত্র মায়ের কথাতেই জোর করে সূচিকে বিয়ে করেছে ও। দিনের পর দিন,রাতের পর রাত নিতান্ত বাধ্য হয়ে সহ্য করেছে ফয়সাল।হয়তো এই কয়েকমাসের স্বামী-স্ত্রীর যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কটা ছিল তার ভিত্তিও স্থাপিত হয়েছে চূড়ান্ত অপছন্দ,ঘৃণা,বিরক্তির মধ্য দিয়ে।ইদানিং ফয়সালের সামনে পড়লেও সেই রাতের কথাটা কানে বাজে রি রি করে, ” নিজের সাথে মিলাও তো আমাকে? আমার পাশে মানায়? তোমার না আছে রূপ,না আছে গুণ।তোমার মতো একশটা সূচিকে আমি মাড়িয়ে যেতে পারব।”
একশটা সূচিকে মাড়িয়ে যাওয়ার সাধ্য আছে বলেই ফয়সালের সামনে যেতে বাধোবাধো ঠেকে। এখন আর সেই পুরোনো প্রেমের খোঁজও পায় না সূচি।যে একসময় তার কামনা ছিল,তার সঙ্গটাও এখন কাঁটার মতো বিঁধে শরীরে।একটা হীনম্মন্যতা কাজ করে ভিতরে।বারবার মনে পড়ে, ফয়সাল নিজেই বলেছে সূচি ওর যোগ্য নয়।এরপরেও আর তাকে সহ্য করা যায়? অবশ্য সহ্য হয় না সূচির।তাই তো রাতের খাওয়া-দাওয়ার পালা চুকিয়ে চোখ-কান বন্ধ করে শাশুড়ির ঘরে ছুটে যায় প্রতি রাতে।বসে বসে পা টিপতে টিপতে ফয়সালের ঘুমের অপেক্ষা করে।সে ঘুমিয়ে গেলে আস্তে আস্তে ঘরে ঢুকে বিছানার উপরে দুই হাত তফাতে ক্লান্ত শরীরটাকে ছেড়ে দেয়।আবার এলার্মের শব্দ কানে আসতেই ঝটপট উঠে পড়ে ফয়সালের নজর এড়াতে।মন-প্রাণ উজার করে এতো কাজ করছে সূচি,এসব কি কেবল শাশুড়ির বকা-ঝকা থেকে রক্ষা ও ভালো বউয়ের স্বীকৃতি পাওয়ার জন্যে? না,সারাদিন কাজের মাঝে ডুবে সে সব ভুলতে চায়।নিজের পরিবারকে,নিজের স্বামীকে,নিজের ভবিষ্যকে — সব।তবুও মাঝে মাঝে একদম ভুলে থাকা যায় না।কোনোদিন হয়তো রোমেলা বানুর ঘর থেকে ফিরে ঘুম কাতুরে চোখে চেয়ে দেখে ফয়সাল ঘুমোয়নি এখনো।ওর জন্যই অপেক্ষা করছে।এরকম মুহূর্তগুলোতে কোথাও ছুটে পালিয়ে যেয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচতে ইচ্ছা করে সূচির। বয়ে যাওয়া সময়গুলোতে অস্বস্তিতে ওর মন-প্রাণ যে মরে যায়, সে খবর স্বয়ং ফয়সালও রাখে না।স্বামীসঙ্গ শরীরে বোলতার হুলের মতো ফুটে।গা ঘিনঘিনে এক অনুভূতিতে ভুরভুর করে বমি করে দুনিয়া ভাসাতে ইচ্ছে করে,সে খবরই বা কে রাখে?
বদলে যাওয়া সূচিটা বড্ড অদ্ভুত।তার চিন্তা-চেতনা অদ্ভুত। সবসময় তার মনে একটা ভাবনা কাজ করে,সে কাজের বিনিময়ে পেটে-ভাতে এখানে থাকছে।এটা ওর সংসার নয়।অবশ্য, এই চিন্তা-ভাবনার জন্য তাকে দোষ দেওয়া যায় না।যেই সংসারে ভাত-কাপড়ের জন্য খোঁটা শুনতে হয়,সে সংসারকে আর যাই বলা যাক নিজের বলে দাবি করা যায় না। তার মাথায় একটা কথাই ঘুরে-ফিরে, ও না থাকলেও এখানে কারো কিছু যায় আসে না।তাই তার মরার ভয় নেই। এই সূচি খুব বেপরোয়া।যেখানে নিজের ক্ষতি সেখানে সে এক পা বাড়িয়ে রাখে। এই যে নিজের প্রতি অবহেলা,নিজের অসুখের কথা গোপন করা,জ্বরে কাতরানোর পরেও হুটহাট বৃষ্টিতে ভেজা,বাদলার দিনে পিচ্ছিল ঘাটে সামান্য থালাবাসন ধুতে যাওয়া– সবকিছু কি অর্থহীন? মোটেও না।
আজ কয়েকটাদিন খুব জ্বরে কষ্ট করছে সূচি।তার ঠান্ডার ধাত।বৃষ্টির পানি দু-এক ফোঁটা মাথায় পড়লেই ঠান্ডা লেগে যায়।তারপরেই আসে জ্বর।এই কয়েকদিনের বৃষ্টিতে ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে ভিজেছে সূচি। সেই সূত্রেই জ্বর আসে।সারাদিনে যেমন তেমন,রাতে অবসর মেলার পরেই জ্বরেরা হানা দেয়।তারা সারাদিনে সূচিকে বিচলিত করার সময় পায় না অথবা সূচিই সারাদিনে জ্বরের খোঁজ নেওয়ার সুযোগ পায়না।বিছানায় পিঠ এলিয়ে দিলেই টনটনে মাথা ব্যাথা,গায়ের কাঁপুনি-উত্তাপ,উষ্ণতার খোঁজে ফয়সালের গায়ের ভিতর ঢুকে যাওয়ার অভিলাষ মনে করিয়ে দেয়, তার শরীরটা সুস্থ নয়।কখনো উঠে চুপচাপ একটা ট্যাবলেট খায়,কখনো বা দম খিঁচে চুপ করে শুয়ে থাকে।ভাবখানা এই,” কী দরকার ঔষধ খাওয়ার? আমি মরলেই সবাই বাঁচে।”
এই চিন্তা থেকেই এখন আর কোনোকিছুতে ভয় পায় না সূচি।যার মরার ভয় নেই তাকে পৃথিবী আর কোনো ভয়ই কাবু করতে পারে না।নিজের হাতে নিজের প্রাণ নিতে পারবে না সূচি।তাই অপঘাতে মারা পড়ার জন্যেও সে দুই পা বাড়িয়ে রাখে সামনে।জ্বর থাকা সত্ত্বেও সে বৃষ্টিতে ভিজে,তুমুল বজ্রপাতের সময়ে গোয়ালঘরে কাজের নাম দিয়ে উঠোনে হেঁটে বেড়ায়।মনে কামনা,”একটা বজ্র আমার মাথায় পড়ুক।” সাঁতার না জানা সত্ত্বেও সে পিচ্ছিল পুকুর ঘাটে যেয়ে বসে থাকে পা পিছলানোর আশায়। বদলে যাওয়া সূচি বিষন্নতার বিষ খেয়ে মরে বাঁচতে চায়।
_______________________________
প্রতিদিনের মতো আজকেও ফার্মেসীতে যাওয়া হলো না।সুতরাং, জ্বরের ঔষধও আর এলো না ঘরে। খামার থেকে রাতে বাড়ি ফিরে খাওয়ার সময় বউয়ের মুখের দিকে নজর দেওয়ার অবসর মিললো ফয়সালের।শুকনো , চোয়াল ভাঙা,ময়লা মুখটার দিকে চোখ পড়তেই আঁতকে উঠলো সে।ভাতের লোকমা হাত থেকে প্লেটে ফেলে বিস্মিত গলায় বললো, ” কী হয়েছে তোমার?”
” কিছু না।”
” তাহলে চোখ দুটো এমন লাল কেন? মুখটাও কেমন শুকনো।এদিকে এসো দেখি,জ্বরটা বেড়েছে নাকি।”— সূচির এগোতে হলো না।ফয়সাল নিজেই বাম হাত বাড়িয়ে বউয়ের কপালের উত্তাপ নিয়ে চমকে গেল।
” গায়ে তো অনেক জ্বর সূচি।”
সত্যিই খুব জ্বর।এ হয়তো আজকে বৃষ্টিতে ভেজার ফল।সন্ধ্যার পর থেকেই টের পাচ্ছে সূচি।হাড়ে হাড়ে ব্যাথা,কাঁপুনি,মাথাব্যাথা, গায়ের উত্তাপ– সবকিছু থেতলে দিচ্ছে ওকে।তবুও মেরুদন্ড খাঁড়া করে এতোক্ষণ কীভাবে বসেছিল তা আল্লাহ মালুম।ফয়সাল নজর না দিলে হয়তো কেউ জানতেই পারতো না অসুস্থতার খবর।
” সবকিছুতে তোমার ফাইজলামি।সকালে বললাম বৃষ্টিতে যেয়ো না, তবুও ত্যাড়ামি করে গেছো।কোনো কথা কোনোদিন শোনো না।আচ্ছা,ঔষধের কথা না-হয় আমি ভুলেই গেছি।তুমিও কি একটু মনে করিয়ে দিতে পারোনি? জ্বর আমার না তোমার? সবকিছু আমাকেই কেন নজরে রাখতে হবে? ভুগবে তুমি আর যন্ত্রণা পোহাতে হবে আমার।শান্তি দিলে না আর,যত্তসব।”
ফয়সালকে আবার যন্ত্রণা পোহাতে হবে কেন? সূচি তো অসুখের দোহাই দিয়ে নতুন করে কিছু করেনি।মস্তিষ্কে বহমান উষ্ণ রক্তস্রোতের প্রভাবে প্রশ্নটা মাথায় এলেও জ্বিভ নেড়ে বললো না সূচি।ভালো লাগছে না বাক-বিতন্ডা।খেতে পারবে না বলে ভাতও নেয়নি প্লেটে।জ্বিভটা সিদ্ধ হয়ে আছে যেন।এখানে কোনো স্বাদ নেই।নিজের রান্না নিজের মুখে অখাদ্যের মতো লাগে,খেতেই পারে না কিছু।কিছুই ভালো লাগছে না।লাইটের আলোতে চোখ জ্বলে।বিছানায় শরীরটা ছেড়ে দিতে পারলে ভালো হতো।মনের ইচ্ছাটাকে মনেই গোপন করলো সূচি।টকটকে লাল চোখ ও তীব্র মাথাব্যাথা নিয়ে ফয়সালের খাওয়া শেষ হওয়ার অপেক্ষায় রইলো।তার খাওয়া-দাওয়া চুকলে কোনোমতে হাঁড়ি-পাতিল ধুয়ে, রাতের কাজ শেষ করে বিছানায় ছুটবে সে।
ফয়সালের খাওয়া শেষ হতেই বাসন-হাঁড়ি এক করে ধোয়ার উদ্যোগ নিচ্ছিলো সূচি।ফয়সালের কপাল কুঁচকে গেল।এঁটো হাতের আঙুল পাতিলের দিকে তাক করে প্রশ্ন করলো, ” কী করছো?”
” এগুলো ধুয়ে রাখব।”
” আবার পুকুরে যাবে!”
” না,ঘরেই ধোব।”
ঠাস করে একটা চড় মেরে মেয়েটার মাড়ির সবগুলো দাঁত ফেলে দেওয়ার ইচ্ছা জাগলো ফয়সালের।মনের অসহনীয় বিরক্তি প্রাণপনে গিলে নিয়ে বললো, ” তুমি একটা চূড়ান্ত বেয়াদব। শরীরে মানুষের রক্ত নাই? এই জ্বর নিয়ে যাবে এতো রাতে বাসন মাজতে? এগুলো সকালে করা যাবে না? কাজগুলো কি শরীরের চেয়েও বেশি?”
শান্ত চোখে মাটির দিকে চেয়ে রইলো সূচি।তারপর দৃষ্টির চেয়ে অধিক শান্ত গলায় বললো, ” না, বেশি না।কিন্তু সেদিন কাজ করিনি বলেই তো বলেছিলেন,আমি নিমকহারাম।বিনা পয়সায় তিনবেলা খাওয়ার পরেও ঘরের কাজগুলো ঠিকঠাকমতো করি না।এখন যখন আমি কাজ করছি তখন মানা করছে কেন? সকালে করলেও আমি করব,এখন করলেও আমিই করব।আপনাকে ভাবতে হবে না।”
সূচির শান্ত গলা যেন সর্বাঙ্গে আগুন লাগিয়ে দিল ফয়সালের।অসহ্য ক্রোধে সামনের এঁটো ভাতের থালে সজোরে একটা লাথি মেরে গজগজ করে বললো, ” মরে যাও তুমি।আমি ফিরেও তাকাব না।”
সূচি নির্বিকার।থালাটা নিয়ে অভ্যস্ত হাতে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো সে।
জ্বরের দৌরাত্ম,শরীরে কাঁপন,মাথাব্যাথা, গলাব্যাথা,বন্ধ নাকে শ্বাস টানার অসহ্য যন্ত্রণা সারারাত টানা-হেঁচড়া করে অতিষ্ঠ করে ফেললো সূচির শরীরটাকে।লম্বা-চওড়া দেহটাকে দলিত-মথিত করে যখন এরা ক্ষনিকের বিরতি নিলো, তখন ফজরের আযান পড়েছে চারদিকে।আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করছেন মুয়াজ্জিন। আজ আর শেষ রাতে উঠতে পারলো না সূচি।ফজরের আযান কানে শোনার পরেও গা ঝারা দিয়ে উঠার সাধ্য রইলো না।বাইরে থেকে গরুগুলোর ডাক শোনা যাচ্ছে।ক্ষুধায় কাতর হয়ে ডাকছে এরা।কানে এলেও কিছুতেই উঠতে পারলো না সে।শরীরের শাড়ি থেকে সূচির দিকে বিছানার চাদর– সব ঘামে ভিজে গেছে।চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলো চুপচাপ।পিঠের উপরে কে জানে চেপে বসে আছে। উঠার চেষ্টাও করলো না সূচি।সারারাত শেষে সকালের দিকে দু-চোখের পাতা এক করার সুযোগ মিললো।কাল রাতে কোনোমতে থালাবাসন ধোয়ার পরে ঘর অবধি হেঁটে আসতে পেরেছে।মাথার অসহ্য যন্ত্রণায় চোখে ঝাপসা দেখছিলো।ঘরে এসে খাটের কাছে মাথা ঘুরে পড়েই যাচ্ছিলো।দু’হাতে ধরে ফেললো ফয়সাল।জোর করে একটা নাপা ট্যাবলেট গিলিয়ে খাটে শুইয়ে দিলো। শান্ত গলায় বললো, ” চুপচাপ ঘুমাও।”
দ্বিরুক্তি করেনি সূচি।করার মতো অবস্থাও ছিল না অবশ্য। ফয়সালের হাতের নিচে চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলো চুপচাপ।
কত সকাল হলো কে জানে,রান্নাঘর থেকে ভেসে আসা হাঁড়ি-পাতিলের ঝনঝনানিতে ঘুম ছুটে গেল সূচির। সেখান থেকে অনবরত আছড়া-আছড়ির শব্দ,তুমুল গলাবাজি ভেসে আসছে। হুট করে ঘুম ভেঙে যাওয়ায় মাথাটা কাজ করছে না।সবকিছু ঘোলা ঘোলা লাগছে।শোয়া থেকে উঠে বসে সর্বপ্রথম সূচি ভাবলো ঘরে বুঝি ডাকাত পড়েছে।উঠে বসে এদিক-ওদিক তাকিয়ে ফয়সালকে খুঁজলো।সে নেই ঘরে,সূচি একাই আছে।দেয়ালে টাঙানো ঘড়ির দিকে নজর পড়তেই আঁতকে উঠলো।ইশ! সাড়ে আটটা বাজে।এতোক্ষণে মাথা খুললো।এতো আছড়া-পাছড়ির শব্দের মানে বুঝলো।এক লাফে খাট থেকে নামে ঝড়ের গতিতে ওয়াসরুমে ছুটলো।আজ তার খবর আছে।
” আম্মা,কী করছেন আপনি? আমি করে দিচ্ছি,সরে আসুন।”
রোমেলা বানু আগুন চোখে তাকাতেই চট করে মুখ নামিয়ে ফেললো সূচি।সকাল সকাল মনে-প্রাণে নিয়ে নিলো পুথি শোনার প্রস্তুতি।
” কী করবা তুমি? কী করবা? আমার ঐ কপাল আছে? সকাল দশটা বাজে।খিদায় আমার কইলজা কাঁপে, আমার পোলায় সকালে খামারে গেছে না খায়া আর তুমি আমার লগে ঢং মারাও? এহন আইছো আবার কী করি তা জিগাইতে? আমি নাচি,দেখ না তুমি? সকাল দশটায় উঠছো তুমি ঘুম থেকা। কত বড় নবাবের ঝি হইছো! আমার গরুগুলা দশটা পর্যন্ত না খাওয়া…..
বারবার সকাল সাড়ে আটটাকে দশটা প্রমাণ করার প্রবনতা দেখে আর দাঁড়ালো না সূচি।উল্টো দিকে ঘুরে গোয়ালঘরের দিকে পা বাড়ালো।নিষ্পাপ জন্তুগুলোর ব্যবস্থা আগে করতে হবে।
” আমার কপালডাই খারাপ।নাইলে সব অজাত-কুজাতগুলি আমার কপালেই জুটব ক্যান? এগুলি জামাই ছাড়া কিছু বুঝে না।জামাই ধইরা বইসা থাকলেই মনে করে সব শেষ।ঘরে একটা শাশুড়ি আছে,একটা সংসার আছে,হেই খেয়াল আছে নাকি ওর।কুত্তার ছাও আমার সংসারটারে শেষ করার লেগা হাত ধুইয়া পড়ছে।লজ্জা-শরম কিছু নাই।নির্লজ্জ একটা।আমরা হইলে দশটা বাজে ঘুম থেকা উইঠা মুখ লুকাইতে ছুটতাম।আর বা** বাচ্চা আমারে জিগাইতে আইছে আমি কী করি।আমি ঘরে বইসা ব** ***……
দ্বিগুণ জোরে চলছে রোমেলা বানুর মুখ। বোধহয় গলির মুখ থেকে শোনা যাচ্ছে তার কন্ঠ।মনে মনে বিরক্ত হচ্ছে সূচি।নিজের উপরে,শাশুড়ির উপরে,ফয়সালের উপরে। খামারে যাওয়ার আগে ডেকে দিয়ে গেলেই পারতো।নয়তো আম্মাকে সূচির জ্বরের কথা বলে গেলেই পারতো।তা না করে খামারে ছুটেছে।
ঘরের বাইরে পা রেখে ঘোর বিস্ময়ে কাঠ হয়ে গেল সূচি।হুমায়রার ঘরের সামনেই অন্তু দাঁড়িয়ে আছে হতভম্ব হয়ে।চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে সে হয়তো বুঝার চেষ্টা করছে কী হচ্ছে এখানে।কোন পরিস্থিতিতে সে এসে পড়েছে।
ভিতর থেকে এখনো ভেসে আসছে তিক্ত কথার দল।শ্রাব্য-অশ্রাব্য কথাগুলো কানে শোনা সম্ভব হলেও লেখা সম্ভব না।মোটা ফ্রেমের চশমার আড়ালে ঢেকে থাকা চোখে চোখ মিলতেই সহসা নিজেকে খুব ছোট মনে হলো সূচির।অন্তুও সহজ হয়ে কোনো কথা বলতে পারলো না।কেবল নির্নিমেষ চেয়ে রইলো শুকনো মৃতপ্রায় মুখটার দিকে।ভিতর থেকে ভেসে আসছে সূচির জন্ম নিয়ে সবসময়ের মতো বলা মিথ্যা কথাগুলো।কে যেন পিঠের উপরে চাবুক মেরে লজ্জাকে সজাগ করে তুললো।অজাত-কুজাত,অলক্ষ্মী,বেজন্মা,জারজসহ শাশুড়ির মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসা কুরুচিপূর্ণ শব্দগুলোর মাঝে অন্তুর সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে খুব লজ্জা করলো সূচির।বাইরের একটা মানুষের সামনে অপমানিত হতে হচ্ছে বলে লজ্জায় চোখে জল চলে এলো।একটাও কথা না বলে অদ্ভুত এক কাজ কাজ করলো সূচি।উল্টোদিকে ঘুরে একছুটে ঘরের ভিতরে ঢুকে গেল মুখ লুকানোর জন্য।বাইরে ফেলে গেলে হতভম্ব অন্তুকে।
চলবে….
( ঈদ উপলক্ষে বোনাস পর্ব দিতে পারব না বলে আজকের পর্বটা খুব বড় করে দিলাম।৩৯৮০ শব্দ আছে এখানে।এ পর্যন্ত এটাই সবচেয়ে বড় পর্ব।আমি চূড়ান্ত পরিনতির উপর দাঁড়িয়ে আছি।এবার পাঠকেরা ভাবতে থাকুন প্রথম খন্ডের শেষ কেমন হবে।)