#শুকতারা (পর্ব-৭)
#হালিমা রহমান।
” বরিশাল আনন্দময়ী হাই স্কুল এন্ড কলেজ “— সাইনবোর্ডের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো অন্তু।দেরি করে ঘুম ভাঙায় আজকেও দেরি। সময়ের সাথে সন্ধিটা ঠিক হয়ে উঠে না অন্তুর। সময়ের সাথে দৌড়াতে পারে না ছেলেটা। সময়ের কাজ অসময়ে করাই অন্তুর সবচেয়ে বড় বদঅভ্যাস। কাল রাতে মাথা ব্যাথায় ঘুমাতেই পারলো না। ব্যাথার ঔষধ খাওয়ার পরেও অসুরের মতো চেপে ধরেছিল ব্যাথাটা।তার উপরে রুমমেট কাজলের ফাইনাল পরীক্ষা চলছে।রাতভর লাইটের আলোয় গুনগুন করে পড়ে। অন্তুর আরো মাথা ধরে যায়।বিন্দুমাত্র আলোতেও ঘুমাতে পারে না সে। সাবলেটের এই এক সমস্যা। মানবিকতা নামের জিনিসটা অন্তুর মাঝে ষোল আনা।তাই কাজলকে কিছু বলতেও পারে না।ব্যাচেলর হওয়ায় রুম পাওয়া দায়।তাই শত ইচ্ছা থাকলেও বাড়ি ছাড়ার চিন্তাও করতে পারে না অন্তু।
হন্তদন্ত হয়ে গেটে পা রাখতেই কম বয়সী দারোয়ানটা মিটমিট করে হাসলো।ফিচেল হেসে বললোঃ” স্যার,আপনে আজকেও দেরি করছেন।আপনের ক্লাস শুরু হইছে আরো আগে।এতো দেরি…
কান দিলো না অন্তু।প্রায় দৌড়ে উঠে গেল সিঁড়ি বেয়ে। দো-তলার টিচার্স রুমে পা দিতেই কোথা থেকে হতচ্ছাড়া পিয়নটা এসে আদেশ নামা উগড়ে দিলো।
_” আপনেরে এসিস্ট্যান্ট প্রিন্সিপাল স্যার যাইতে কইছে।তাড়াতাড়ি যান স্যার।”
অন্তু আরো একবার দীর্ঘশ্বাস ফেললো।এই সর্বনাশের বাকি ছিল।টিচার্স রুমে বসে থাকা দু-একজন সহকর্মীর মুখে সহানুভূতির সুর শোনা গেল।ইংরেজির সিনিয়র শিক্ষক হেনা ম্যাম খাতা দেখতে দেখতে বললেনঃ” দেরি করো না অন্তু। রোজ রোজ দেরি করো বলেই স্যার এতো রেগে থাকে তোমার উপর।”
” কাজী অন্তু “— শিক্ষক হাজিরা খাতায় সই করে আবারো দৌড় লাগালো অন্তু।মোটাতাজা নাক বোঁচা এসিস্ট্যান্ট প্রিন্সিপালকে খুব ভয় পায় ছেলেটা।
_” আসব স্যার?”
এসিস্ট্যান্ট প্রিন্সিপাল শফিক হায়দার ভ্রু কুঁচকে তাকালেন দরজার দিকে।গম্ভীর গলায় বললেনঃ” ভিতরে আসুন।”
_” আসসালামু আলাইকুম স্যার “— দ্রুত পায়ে এসে চেয়ার টেনে বসে সালাম দিলো অন্তু।
নাক বোঁচা স্যার উত্তর উত্তর দিলেন না।গম্ভীর মুখে কপাল কুঁচকে প্রশ্ন করলেনঃ” আজকেও দেরি কেন?”
_” আমার শরীরটা কাল ভালো ছিল না, স্যার।তাই আজ উঠতে দেরি হয়ে গেল।”—- আমতা আমতা করে উত্তর দেয় অন্তু।
_” আরেকটা অজুহাত।আপনার প্রায় দেরি হয় মি.অন্তু।প্রত্যেকদিনই আপনার শরীর খারাপ থাকে?”
উত্তর দিতে বেগ পেতে হয়। স্কুলে আসতে প্রায় দেরি হয় অন্তুর,অভিযোগ মিথ্যা নয়।তার দেরি হওয়ার কারণগুলোও খুব অদ্ভূত। না চাইতেও কি করে যেন হয়েই যায়।হয়তো কোনোদিন মিনির কারণে দেরি হয়,আবার কোনোদিন কাজের খালার কারণে, কোনোদিন আবার কাজলের কারণে ।একটা রুমের একটাই বাথরুম।অন্তুর সকালে স্কুলে আসতে হয়।সকাল সকাল গোসল সাড়তে হয়।বেশিরভাগ সময় ঘুম থেকে উঠেই দেখতে হয় বাথরুম দখল করে আছে কাজল।দরজায় হাজার ধাক্কাধাক্কি করলেও পৌনে এক ঘন্টার আগে ও ব্যাটা বের হয় না।অন্তুর দেরি হয়ে যায়।বাড়িওয়ালার লতা-পাতার ভাগ্নে কাজল।ওর দৌলতেই রুমটা পাওয়া গেছে।অন্তু তাই কিছু বলতেও পারে না।আবার অন্তুর পোষা বিড়াল মিনির জন্যেও মাঝে মাঝে দেরি হয়।মেলা থেকে কিনে আনার পর প্রায় এক সপ্তাহ হয়ে গেছে তবুও এর স্বভাব ভালো হয়নি।অন্তু এখনো ভাব জমাতে পারেনি মিনির সাথে।মিনি যেখানে সেখানে মল ত্যাগ করে। ঘুম থেকে উঠেই এসব আবর্জনা পরিস্কার করতে করতেই আধ ঘন্টা লাগে।এরপর মিনির দুধের ব্যবস্থা করতে হয়,সারাদিনের জন্য নিরাপদে রাখার ব্যবস্থা করতে হয়, আরো কতো ঝামেলা। অন্তুর ঝামেলার কি অভাব আছে? দেরি হবে না কেন?
_” আপনাকে এর আগেও অনেকবার ওয়ার্নিং দেওয়া হয়েছে মি.অন্তু।প্রিন্সিপাল স্যারও সেদিন আপনার বিষয়টা দেখেছেন।”
_” সরি স্যার।আসলে ব্যাচেলর মানুষ, বুঝতেই পারছেন ঝামেলা..
_” ব্যাচেলর হলে চাকরি করতে এসেছেন কেন? চাকরি করার আগেই মনে রাখা উচিত ছিল ব্যাচেলরদের চাকরি করা উচিত নয়।এদের ঝামেলা থাকে। আমি আশ্চর্য হয়ে যাই আপনার কথা শুনে।আমরা কি ব্যাচেলর ছিলাম না? আমরা চাকরি করিনি কখনো? আর আপনার সমস্যা স্কুল কর্তৃপক্ষ কেন শুনবে? জবাব দিন।”
থমথমে হয়ে উঠলো অন্তুর মুখ।চশমার আড়ালে শীতল চোখে দেখলো শফিক হায়দারকে।কিছুই বললো না।
_” আপনাকে এর আগেও ওয়ার্নিং দিয়েছি।নেক্সট টাইম আর দেব না।আর একদিন এরকম করলে চাকরিটা আর থাকবে না মি.অন্তু।আপনি এখন আসতে পারেন।”
ধপধপ পা ফেলে উঠে যায় অন্তু।খুব রাগ করতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু কার উপর রাগ করা উচিত? এসিস্ট্যান্ট প্রিন্সিপাল,কাজল, মিনি নাকি নিজের উপর? বিভ্রান্ত দেখায় অন্তুকে। মনে মনে আফসোস হচ্ছে খুব।আজ একটা বউ থাকলে এতো ঝামেলা হতো না।সাবলেট থাকতে হতো না,কাজলকে সহ্য করতে হতো না,স্কুলে আসতে দেরিও হতো না।বরং প্রতিটা সকাল হতো রোমাঞ্চকর। অন্তুর সব সমস্যার সমাধান শুধু একটা বউ।ফিন্যান্স বইটা হাতে নিয়ে ক্লাস টেনের দিকে পা বাড়ায় অন্তু।
“শুধু একবার বিয়ে করে নেই তারপর এই ঘোড়ার চাকরির কাঁথায় আগুন”— বিরবির করে জোরে পা চালায় অন্তু।
***
কড়াইয়ের তিন নম্বর রসবড়া প্লেটে নিতেই সাহিদা বানুর পিছনে এসে দাঁড়ালো সূচি।মাত্রই গোসল করেছে হয়তো।চুলগুলো পিঠের উপর বিছিয়ে রাখা। পরনে সাদা-কালোর মিশ্রণে তৈরি একটা বাহারী থ্রিপিস। মাকে কিছু বলতে এসেছে সূচি।তবে কথাটা বলা ঠিক হবে কি হবে না তাই ভাবলো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে।কিছুক্ষণ চুপ থেকে ওড়নার আঁচল আঙুলে পেঁচিয়ে মাথা নিচু করে বললোঃ” আম্মা কিছু করব?”
চমকে পিছু ফিরেন সাহিদা বেগম।গুনে গুনে এক সপ্তাহ পর মেয়ে কথা বললো তার সাথে। তিনি কিছুটা বিস্ময় ধরে রেখে প্রশ্ন করেনঃ” কী করবি?”
_” কোনো কাজ যদি বাকি থাকে।তুমি বলেছিলে মেহমান আসবে তাই বলছিলাম। ”
_” হ,একটু পরেই আসব মনে হয়।তুই এই বেলা গোসল করলি ক্যান?”
_” গরম লাগছিলো তাই করে ফেললাম।”—
সম্পূর্ণ মিথ্যা বললো সূচি।এই শীতে গরম লাগবে কেন? একটু পরিপাটি,একটু সতেজতার জন্যই এই শেষ বেলায় গোসল করা।এছাড়া আর কিছুই নয়।ফয়সালের সামনে কি আর এমনি এমনি দাঁড়াতে পারবে সূচি?
_” জামাটায় তোরে মানাইছে সূচি।”
প্রশংসা শুনে চওড়া হাসি ফুটলো সূচির মুখে।বেড়াতে যাওয়ার জায়গা নেই বলে রোজার ঈদের জামাটা পরা হয়নি এতোদিন।এতো সুন্দর জামাটা আলমারিতেই পড়ে ছিল। এতোদিন পর আজ সদ্ব্যবহার হলো। মনে ইচ্ছা ছিল শাড়ি পরার।ঐ যে নাটক-সিনেমায় যেমন দেখায় শাড়ি পরে মাথায় আঁচল টেনে চায়ের কাপ নিয়ে লজ্জাবতী লতার মতো নায়িকারা পাত্রপক্ষের সামনে দাঁড়ায়,ঠিক সেরকম।তবে সাহস ও লজ্জার অভাবে শাড়ি পরার কথা মাকে বলতে পারেনি সূচি।আর যাই হোক সূচি নিশ্চয়ই নির্লজ্জ মেয়ে নয়।
_” আপেল কাটা হয় নাই।তুই পারলে আপেল কাইটা দে।”
খুশি মনে মায়ের পাশে পিঁড়ি পেতে বসে সূচি।বাম পায়ের তালুতে বটি চেপে ধরে ধোয়া আপেলগুলো কাটতে উদ্যত হয়।মিনমিন করে বলেঃ” আম্মা নাস্তায় আরো কিছু রাখলে ভালো হতো না? তারা তো কখনো আসেনি আমাদের বাড়ি।”
সবগুলো রসবড়া প্লেটে তুলে নেন সাহিদা বানু।মিটসেফে সযত্নে রাখতে রাখতে প্রশ্ন করেনঃ” আর কি রাখব?”
_” বাজারে এখন নতুন নতুন নাস্তা পাওয়া যায়।বার্গার,পিজ্জা…
_” না লাগব না।হাবিজাবি মেহমানরে খাওয়ায়? তুই তোর কাজ কর।”
একটু মন খারাপ হলো সূচির।মা যদি একটু আধুনিক হতো!
সাহিদা বেগম একবার আড়ঁচোখে দেখলেন সূচিকে।আজ বেশ স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে মেয়েটাকে।সকাল থেকেই মেয়েকে চিনতেই পারছেন না।এ যেন এক অন্য সূচি। ভোরে ঘুম থেকে উঠেই উঠোন ঝাড়ু দিয়েছে।এ মাথা-ও মাথা পুরো উঠোনটা ঝাড়ু দিতে সাহিদা বেগমের কোমড় ধরে যায়।সেখানে সূচি হাসিমুখে পুরোটা করলো।তারপর নাস্তা খেয়ে রনিকে নিয়ে দর্জিদের বাড়ি থেকে মাটি আনলো।পুরো ঘর লেপলো।কিছু বাদ দেয়নি।বসার ঘর থেকে একদম রান্নাঘর অবধি।সব চকচক করছে আজ। তারপর জয়ার কাছ থেকে হাবিজাবি কিসব এনে চেহারায় দিলো।সাহিদা বেগম আজ যতটা অবাক হয়েছেন এতটা অবাক আর কোনোদিন হননি। সূচি চূড়ান্ত পর্যায়ের অলস।রান্নাঘরের কাজে কোনোদিন তাকে খুঁজে পাওয়া যায় না। রান্নাবান্না মোটামুটি সবই পারে।কিন্তু অলস বলে চর্চা করা হয় না বহুদিন।সূচির ধরা বাঁধা কাজ।দুপুরবেলা ঘর গোছায়,বিছানার চাদর ঠিক করে।ব্যস! এইটুকুই।তবে আজ অনেক কাজ করেছে সূচি। ঘর লেপা থেকে শুরু করে ঝাড়া-মোছা সব।বিছানার চাদর বদলেছে, মিটসেফ পরিষ্কার করেছে,টিনের ময়লা ঝেরেছে,কলতলা “ঘসে ঘসে পরিষ্কার করেছে।সাহিদা বেগম নিশ্চিত সূচির হাত দুটোর দিকে এখন তাকানো যাবে না। কেটে-কুটে একাকার।
মায়ের মন,একটু একটু সন্দেহ জাগে সাহিদা বেগমের মনে।চেনা-জানা মেয়েটা একদিনেই যেন বদলে গেল। আঠারো বছর ধরে লেলে-পেলে বড় করা মেয়েটাকে চেনাই যাচ্ছে না আজ। কাল রাতে পাত্রপক্ষের কথা বলার পর থেকেই মনে হচ্ছে সূচি আগা-গোড়া বদলে গেছে।তবে কি? মনের মাঝে জোরালোভাবে জেগে উঠা সন্দেহ দুই হাতে দূর করেন সাহিদা বেগম। না,না সূচি এমন নয়। সূচি খুব ভালো মেয়ে।এদিক-ওদিক নজর তার একদম কম।দুই চোখ মেলে মেয়েকে দেখেন সাহিদা বেগম।মেয়েটা এতোদিন কথা বলতো না।ঘরটা যেন পানির নিচে ডুবে ছিল। আজ খুব ভালো লাগছে সাহিদা বেগমের। রান্নাঘরের ছোট্ট জানলা দিয়ে শীতের বিকালের নরম রোদ এসে ছুঁয়ে দিচ্ছে সূচির চুলের গোছা,পিঠ,ওড়না সব।সাহিদা বেগমের খুব ভালো লাগলো। আর কিছু না হোক, মেয়েটা চুলগুলো বেশ সুন্দর। কোমড় ছোঁয়া কটকটে কালো চুলগুলো খুলে রাখলে দারুন লাগে। এই প্রথম সাহিদা বেগমের মনে হলো সূচি সুন্দর। চলতি পথে দেখতে পাওয়া সৌন্দর্যের চাইতে সূচি বেশ সুন্দর।গায়ের রঙ একটু ময়লা হলেও তার ঘরের মেয়েটাই জলজ্যান্ত একটি অপ্সরী।
***
বসার ঘরে সবাই বসে আছে।কাঠের ছোট্ট টেবিলে প্লেটে প্লেটে নাস্তা সাজিয়ে রাখা। চেয়ারে বসে কথা বলছেন মমিন শেখ,রতন পাটোয়ারী ও রোমেলা বানু।গ্রামের বউ হলেও ওতোটা রক্ষণশীলতা নেই তার মাঝে। একটা চেয়ারে ফয়সাল বসে আছে নিচের দিকে চেয়ে। পর্দার আড়াল থেকে ফয়সালকে এক নজর দেখে চম্পা ছুট দিলো সূচির ঘরে। মুখ টিপে বললোঃ” সূচিরে, পুরা রাজপুত্র।তোর রায়হান ভাইয়ের কথা আগে বিশ্বাস করি নাই।এহন তো দেখি,একটুও কম কয় নাই।”
মাথা নেড়ে সায় দেয় মনি।
_” হ,ভাবি।আমি বাজারে যাওয়ার সময় দেখি মাঝে মাঝে।পোলারে ঠ্যালা যাইব না কোনোদিক দিয়া।”
সূচি গর্বে ফুলে-ফেপে উঠে।এতো এতো সুনাম যেন স্পষ্ট ঘোষনা দিচ্ছে সূচির পছন্দ ফেলে দেওয়ার মতো নয়।
সাহিদা বেগম তড়িঘড়ি করে মেয়ের ঘরে ঢুকলেন।ব্যস্ত গলায় বললেনঃ” সূচি,জলদি আয়।তোর বাপে ডাকে।চা দিয়ায়।”
কপাল পর্যন্ত ওড়না টেনে দিয়ে নিচে নেমে দাঁড়ায় সূচি।আলগোছে আয়নায় একবার নজর বুলায়। সব ঠিক আছে।কাজলটা চোখের শোভা বাড়াচ্ছে,সিল্কি চুলগুলো ছোট ক্লিপে আঁটকে রাখা,খোঁপাটা ঘাড়ের উপর পড়ে আছে।সূচি ওড়না আরেকটু টেনে দেয়, কামিজ টেনে সোজা করে। খারাপ লাগছে না, বেশ ভালোই লাগছে।
সাহিদা বেগম নিচু গলায় মেয়েকে বুঝিয়ে দেন। উগ্র আচরণ করা যাবে না,এদিক-ওদিক চোখ ফেরানো যাবে না,নিচের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে,কোনো প্রশ্ন করলে ত্যাড়াব্যাকা উত্তর দেওয়া যাবে না।সূচি যা মুখরা,সাহিদা বেগমের ভয় হয়।মেয়ে কি বলতে কি বলে ফেলে।পরে মান-সম্মান নিয়ে টানাটানি।
চায়ের কাপ নিয়ে বসার ঘরে পা দিতেই হইহই করে উঠলেন রতন পাটোয়ারী। চেয়ার থেকে উঠে আহ্লাদী গলায় বললেনঃ” আসো মা,আসো।বসো এইখানে।”
সূচি সালাম দিয়ে মাথা নিচু করে ট্রে রাখে টেবিলের উপর।চেয়ারে বসে নিচু করা ঘাড়টাকে আরো নিচু করে ফেলে।শান্ত-শিষ্ট মেয়ের মতো চুপ মেরে বসে রইলো চেয়ারে।
মমিন শেখ মেয়ের বাধ্যতায় খুশি হলেন।হাসিমুখে রোমেলা বানুকে বললেনঃ” ভাবি,এইটাই আমার মাইয়া সূচি।”
_” ওরে চিনি আমি।রতন ভাইয়ের বাসায় দেখছি।মা, ভালো আছো তুমি?”
_” জ্বি।”— নিচু গলায় উত্তর দেয় সূচি।
_” পরীক্ষা ক্যামন হইছে তোমার?”
_” আলহামদুলিল্লাহ ভালো। “— উত্তর দিয়ে মনে মনে হাসে সূচি।ফেল করা ও টেনেটুনে পাশ করা ছাত্রীকে কখনো পরীক্ষার কথা জিজ্ঞেস করতে নেই।এদের পরীক্ষা সবসময় ভালো হয়।শুধু খারাপ হয় রেজাল্ট। এছাড়া বাকি সব আলহামদুলিল্লাহ।
এক কাপ চা হাতে নিলেন রোমেলা বানু।চায়ের কাপে এক চুমুক বসিয়ে বললেনঃ” চা তুমি বানাইছো?”
_” না,আম্মা বানিয়েছে।”
পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা সাহিদা বেগম বিরক্ত হলেন। এতো সৎ হওয়ার কী দরকার ছিলো? বললেই হতো নিজেই বানিয়েছে। মেয়ে সারাদিন মিথ্যা কথা বলে শুধু জায়গা মতোই দু-একটা মিথ্যা বলতে পারে না।
এতোক্ষণে ফয়সালের প্রতি সচেতন হলেন মমিন শেখ।নরম গলায় বললেনঃ” বাবা,চা নেও। তুমি তো কিছুই নিলা না।”
_” এই তো নিচ্ছি।”— বিরক্ত মুখে চা নিলো ফয়সাল।এতো আয়োজন, এতো আড়ম্বর সবকিছু ভীষণ ফিকে লাগছে।সামনে বসে থাকা মেয়েটার প্রতি বিন্দুমাত্র আকর্ষণ নেই ফয়সালের।চোখ তুলে তাকানোর ইচ্ছা নেই মোটেও।রোমেলা বানু ডান হাতের কনুই দিয়ে মৃদু আঘাত করলো ফয়সালের শরীরে।এ যে সূচিকে দেখার আদেশ তা বেশ বুঝতে পারলো ফয়সাল।মায়ের বাধ্য ছেলে ফয়সাল।মায়ের ইশারায় চোখ তুলে একবার দেখলো।মাত্র এক পলক।মাথা নিচু করে বসে থাকা মেয়েটাকে ভালো লাগছে না।খুব বিরক্ত লাগছে।মায়ের রুচি তো এমন ছিল না।আফজালের বিয়ের সময় পুরো গ্রাম খুঁজে হুমায়রাকে ঘরে এনেছেন।রূপে-গুনে একদম পরিপূর্ণ হুমায়রা।তবে ফয়সালের বেলায় কী হলো? মায়ের পছন্দ বদলে গেল?
আরেকবার তাকায় ফয়সাল।সূচিও আড়ঁচোখে তাকিয়ে ছিল হয়তো।চোখাচোখি হতেই চোখ নামিয়ে নেয় ফয়সাল। মেয়েটাকে আর দেখার ইচ্ছে নেই।ফয়সালের চোখে পৃথিবীর সবচেয়ে কুৎসিত মেয়েটার নাম সূচি।
***
সূচিদের বাড়ি থেকে বেরোতে বেরোতে মাগরিবের সময় হয়ে গেল।মমিন শেখ ও রতন পাটোয়ারী মা-ছেলেকে এগিয়ে দিতে এসেছিলেন।ফয়সাল নিষেধ করলো।মায়ের হাত শক্ত করে ধরে রতন পাটোয়ারীকে বললোঃ” কাকা,বাড়ি চলে যান।
আমরা যেতে পারব।আর কষ্ট করে আসা লাগবে না।”
_” রিকশায় তুইলা দেই?”
_” না,দরকার নেই।”
মমিন শেখ এগিয়ে এলেন। রোমেলা বানুর পাশে দাঁড়িয়ে বললেনঃ” ভাবি আইসেন আবার।”
_” আসব ভাই।আপনারাও যায়েন।কথা-বার্তা বলা যাইব।”
বিনয়ের হাসি হাসেন মমিন শেখ।মাথা ঝুকিয়ে বলেনঃ” যামুনি।সাবধানে যাইয়েন,ভালো থাইকেন।”
_” আচ্ছা ভাই।আসি।”
মাটির রাস্তায় ধীরে ধীরে হাঁটে মা-ছেলে।সন্ধ্যা হতে না হতেই ঘন কুয়াশা পড়েছে।এক হাত দূরের জিনিস ভালোভাবে দেখা যায় না। দর্জিদের ঘাট ভাঙা পুকুরে কে যেন অজু করছিলো।ফয়সালদের আওয়াজ পেয়ে মাথায় ঘোমটা টেনে চলে যায়।গোবরের গন্ধ ভেসে আসছে দূর থেকে। গন্ধে পেট মোচড় দেয়।ফয়সাল দু-আঙুলে নাক চেপে ধরে।রোমেলা বানু আস্তে-ধীরে হাঁটেন। তার কোমড়ে ব্যাথা।জোরে হাঁটতে পারেন না।ধুলো মাখা পথে এক সাইজ বড় বোরকা পরে হাঁটতে বেগ পেতে হয়।দর্জিদের বিশাল তাল গাছের কাছে আসতেই ফয়সালের গলার স্বর শোনা যায়।ধীর গলায় বললোঃ” আম্মা, একটা কথা বলি?”
_” কী কবি?”
_” তোমার কি মেয়ে পছন্দ হইছে?”
_” হ,আমি তো আগেই কইছি সূচিরে আমার পছন্দ।ক্যা? ”
_” না, আসলে অনেক তাড়াতাড়ি করছো তুমি।আরো দু-তিন জায়গায় দেখলে ভালো হতো না?”
_” তোর সূচিরে পছন্দ হয় নাই?”— শেষের দিকে কঠিন শোনায় রোমেলা বানুর কন্ঠ।মাকে খুব ভয় পায় ফয়সাল।আমতা আমতা করে বললোঃ” না,তা বলিনি।তবুও আরেকটু যদি দেখতে।ভূমির বোনকে চিনি আমি।ভালো ছাত্রী না আবার ওতো গুণবতীও না।গায়ের রঙটাও দেখেছো? ময়লার দিকেই।হুমায়রা ভাবির মতো সুন্দর হলে ভালো হতো।ঘরে ঘর শোভা বউ না থাকলে কেমন দেখায়? যেকোনো জায়গায় তো মানুষ বউ নিয়েই যায়।মানে আমি বলতে চাইছিলাম আরেকটু যদি সুন্দর…
_” সুন্দর ধুইয়া পানি খাবি তুই?”— মাঝ পথে ফয়সালকে থামিয়ে দেন রোমেলা বানু।চারপাশে ঘন অন্ধকার।তবুও ফয়সাল বুঝতে পারল মায়ের মেজাজ এখন খারাপ।প্রচুর রেগে গেছে হয়তো।তাই ফয়সালও মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো।কোনো কথা বললো না।
_” হুমায়রার লগে খাইতে পারছি আমি? সুন্দর দিয়া সংসার চলে না।ঘরে সুন্দরী বউ থাকলে এহনকার পোলারা এক্কেরে লাটে উইঠা যায়।দুনিয়াতে বউ ছাড়া আর কিছু বুঝে না।তুই কি চাস তো বউও হুমায়রার মতো হোক? আমার কথা না শুনুক? তুই ও কি আফজালের মতো হইতে চাস? আলাদা থাকতে চাস? ”
কথা যোগায় না ফয়সালের মুখে।বোবার মতো চুপ মেরে থাকে।
_” আমি যা করতাছি ভালোর লেগাই করতাছি।তোর চাইতে পৃথিবী আমি বেশি দেখছি।আর বউ কি মাইনষেরে দেখানের জিনিস? তোর বউয়ের সৌন্দর্য তুই দেখবি,মাইনষে দেখব ক্যান? সূচি কি দেখতে-শুনতে একদম খারাপ? বলদ পোলা একটা।”
_” হ্যাঁ, একদম খারাপ।আমার সাথে একটুও মানায় না।”— কথাগুল মনে মনেই বললো ফয়সাল।জোরে বলার সাহস নেই।এই পৃথিবীতে মাকে সবচেয়ে বেশি ভয় পায় সে।রাস্তার পাশের বাড়ি থেকে খেজুর রসের গন্ধ ভেসে আসছে।কারা যেন রস জ্বাল দিচ্ছে। খেজুর রসের মিষ্টি ঘ্রাণেও বিরক্ত হয় ফয়সাল।ঘন কুয়াশা দেখে বিরক্ত হয়,মায়ের হাত ধরে হাঁটতেও বিরক্ত হয়।আজ মনে হচ্ছে বিশ্ব বিরক্ত দিবস।নাহয় হুটহাট এতো বিরক্ত লাগবে কেন?
চলবে…