#শুকতারা (পর্ব-৮)
#হালিমা রহমান
সূচির দিন আজকাল বেশ ভালো যায়। বাড়ির আবহাওয়া দারুন,সূচির আদর-কদরের কমতি নেই কোথাও।ফয়সালরা বাড়িতে আসার পর থেকে জীবনের রঙটাই যেন বদলে গেছে।রতন কাকা সেদিন বাড়িতে এসেছিল।বসার ঘরে বসে বাবার সাথে বিস্তর পরামর্শ করলো। পানদানি থেকে পান মুখে দিয়ে, ঠোঁটের কোনে হাসি নিয়ে বলছিলো ফয়সালদের কথা। সূচিকে খুব পছন্দ হয়েছে রোমেলা বানুর। ফয়সালেরও নাকি খুব পছন্দ হয়েছে।রোমেলা বানু বলেছেন,মমিন শেখ যদি তাদের সাথে আত্মীয়তা করতে চায় তবে যেন পা বাড়ায়। বিয়ের আগে পাত্রীপক্ষের ছেলের, ছেলের পরিবার সম্পর্কে যেসব খোঁজ-খবর নেওয়া লাগে সেসব খবর নেওয়ার কথাই বলেছেন। সূচির অনেক আগ থেকেই আড়িপাতার স্বভাব। টিনের সাথে কান চেপে লুকিয়ে-লুকিয়ে কথা শুনছিলো।সাহিদা বেগম পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে কথা শুনছিলেন।মেয়েদের জীবন, চলাফেরা অথবা সংসারের কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা তার কোনোদিন ছিল না।মমিন শেখের সহযোগী তিনি,অর্ধাঙ্গিনী তিনি।সুতরাং যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার তার আছে, এই কথা ভাবতেও পারেন না।তিনি নিতান্তই সহজ-সরল গৃহিণী। ঘরের কর্তা যা বলেন তাই নতমুখে শুনেন,মেনে চলেন, অবাধ্য হন না,স্বাধীনভাবে নিজের মনের কথা বলেন না।এই চলে আসছে সংসারের সেই শুরুর দিন থেকে।সাতাশ বছরের সংসার।মেনে নিতে নিতে অভ্যাস হয়ে গেছে।স্বকীয়তা বলতে কোনো শব্দ সাহিদা বেগমের জীবনে নেই।
সূচির ইচ্ছা ছিল পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে কথা শোনার।কথা শোনার পাশাপাশি পর্দা আড়াল করে একটু বাবার মুখটাও দেখার ইচ্ছা ছিল।বাবা নিশ্চয়ই রতন কাকার কথা শুনে খুব খুশি হচ্ছে! বাবার হাসি মুখটা দেখার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু মায়ের জন্য পারেনি।মায়ের সাথে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়ানোর সাধ্য সূচির নেই।
শীতের বেলার সাথে পাল্লা দেওয়া বেশ মুশকিল।কাজ করতে করতে কখন সময় চলে যায় বুঝাই যায় না।সূচি বসে আছে পুকুর পাড়ে।পুকুরের দিকে মুখ করে বসে আছে।ঘড়িতে সাড়ে তিনটা বাজে বোধহয়।একটু আগে বাবার ফোনে কল দিয়েছিল রত্না। বলেছে এ বাড়িতে আসবে।ওর জন্যই পুকুর পাড়ে বসে অপেক্ষা করছে সূচি।সাহিদা বেগমের সামনে যেতে ভয় পায় রত্না।মেলার ঘটনা অতীত হয়েছে বেশিদিন হয়নি।সাহিদা বেগমও সহ্য করতে পারেন না রত্নাকে।সামনে পড়লে কিভাবে যেন তাকান।দুই জনের মধ্যকার অস্থিতিশীল সম্পর্ক চোখে পড়েছে সূচির।তাই রত্নাকে ঘরে না ডেকে পুকুর পাড়ে আসতে বলেছে। তাছাড়া রত্নাকে দিয়ে একটা কাজ করাতে হবে। তাই না ঘুমিয়ে অপেক্ষা করছে সূচি।
চারপাশে ঝকঝকে রোদ।পুকুরের পানি কমে ঘাটের শেষ সিঁড়ি দেখা যাচ্ছে। শেষ সিঁড়িটা বাকি ঋতুতে পানির নিচেই থাকে।শুধু শীতকালে জেগে উঠে পানির নিচ থেকে।শ্যাওলা জমা সিঁড়ির পাশেই কাপড় ধোয়ার বড় গাছটা রাখা।কাপড় ধোয়ার সুবিধার্থে একটা নারিকেল গাছের গুড়ি কেটে ফেলে রাখা হয়েছে।এখানে সবাই কাপড় কাচে।সুচি পুকুরের দিকে মুখ করে বসে আছে।পিঠে নরম রোদ এসে পড়ছে।বেশ আরাম পাচ্ছে সূচি।চুলগুলো অযত্নে পিঠ বেয়ে ঘাসের উপর পড়ে আছে।ঘন কালো চুলে খেলা করছে শীতের নরম রোদ।নিস্তব্ধ বিকালে একা বসে সূচির অনেক কথা মনে পড়ে।ভূমির কথা,ইশতিয়াকের কথা সবশেষে ফয়সালের কথা।ফয়সালকে ভালো লাগতো অনেক বছর আগ থেকে। ভূমির ক্লাসমেট ছিল ফয়সাল।মাঝে মাঝে বাড়ি আসতো নোট নিতে।ভালোলাগার শুরু তখন থেকেই।সূচি তখন সবে কৈশোরে পা দিয়েছে।যা দেখে তাই নতুন লাগে।সদ্য কিশোরী সূচির আশেপাশে অনুভূতিরা ভীড় করেছে।সে হিন্দি ছবি দেখে স্বপ্ন দেখে, বাজারের অখ্যাত লেখকের সস্তা উপন্যাস পড়ে অভিভূত হয়,নারিকেল গাছের চিড়ল পাতার ফাঁকে পূর্ণিমার চাঁদ দেখে দু-এক লাইন ছন্দ লেখে।কি এক ভয়াবহ অবস্থা! এমন ভয়ংকর অবস্থায় ফয়সালকে ভালো লেগেছিল সূচির।গ্রীষ্মের তপ্ত রোদে ফয়সাল ভূমির কাছে এসেছিল বাংলা গাইড নিতে।কপালের দু’পাশ বেয়ে ঘাম পড়ছিলো,কলেজের সাদা শার্ট পুরো ভিজে গিয়েছিলো ঘামে। রোদের তীব্রতায় ফর্সা চেহারা লাল হয়ে গিয়েছিল একদম।কোঁকড়া চুলগুলো শোভা বাড়াচ্ছিলো ক্লান্ত চেহারার।সেই মুখ এখনো ভুলতে পারে না সূচি।ভালোবাসা হোক অথবা ভালোলাগা, সেখানেই শুরু।সূচি মরলো।ডুবে মরলো একদম। কোনো আয়োজন ছাড়া,বিশেষ মূহুর্ত ছাড়া,ফয়সালের পরিপাটি রূপ ছাড়াই প্রেমে পড়লো সূচি।ইশ! সে কী প্রেম।স্কুলে আসা-যাওয়ার পথে যেখানেই দেখতো, সেখানেই বেহায়ার মতো চেয়ে থাকতো। কত কত কল্পনা-জল্পনা ঐ একটা মানুষকে ঘিরে! সহসা জন্মানো অনুভূতি দিন দিন বেড়েছে।একটুও কমেনি।সূচি বড় হয়েছে,তার প্রেমেরও বয়স বেড়েছে, আরো বেশি পাগল হয়েছে।সব সমানুপাতিক। প্রেমে পড়ে বসে ছিল না সূচি।ভূমি চলে যাওয়ার পরেই বুঝেছিল তার পক্ষে প্রেম সম্ভব না।বাবা-মায়ের কঠিন শাসনের বুহ্য ভেদ করে বুক ফুলিয়ে স্বাধীনভাবে প্রেম করার সাহস সূচির নেই।তাই ভিন্নপথে ফয়সালকে চেয়েছে সূচি।এমন এক মোনাজাত নেই যেখানে সেই মানুষটাকে চায়নি।উঠতে,বসতে,হাঁটতে, চলতে শুধু ওই একজনকেই চেয়েছে।অনুনয় -বিনয় করে বার বার ফয়সালকে চেয়েছে।স্কুল মাঠে একবার বিরাট মাহফিল হয়েছিল। সেখানে হুজুর বলেছিলেন, আল্লাহর কাছে কোনোকিছু চাইলে আল্লাহ কখনো ফিরিয়ে দেন না।চাওয়ার মতো চাইলে আল্লাহ ঠিকই দেন।
সূচি সেই কথা শোনার পর থেকে আরো বেশি করে চাইতো।অর্ধাঙ্গ হিসেবে শুধু ওই একজনকেই চাইতো।হয়তো চাওয়ার মতোই চেয়েছে। প্রতিদিন,প্রতি মুহূর্তে, প্রতি মোনাজাতে শুধু ফয়সালকেই চেয়েছে।আর কিছু চায়নি।সুখ,শান্তি,সাফল্য,স্বাধীনতা,বাবা-মায়ের আদর আর কিছু না।ফয়সাল কি আর যে-সে? সে বড় সাধনার ফল।
শত শত শুকনো পাতা জুতোর নিচে ভেঙে, সূচির পাশে রত্নাও ধপ করে বসে পড়ে ঘাটে। পা দুটো নিচের সিঁড়িতে রেখে ক্লান্ত গলায় বলেঃ” ভাত খায়াই দৌড়ায়া আইছি বইন।হয়রান লাগতাছে অনেক।”
রত্নার প্রতি সচেতন হয় সূচি।ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করেঃ” গরুর মতো ভাত খেয়েই আসছিস কেন? পরেই আসতে পারতি।”
_” না, কাকি যদি ঘুম থেকা উইঠা যায়।তাই তাড়াতাড়ি আইছি কাকিরে ডর লাগেরে।”
_” আম্মা তোরে মারবে নাকি?”
_” না,কিন্তু ক্যামনে যেন তাকায়।আচ্ছা,বাদ দে।তোর কথা ক।ফয়সাল ভাই পছন্দ করছে তোরে?”
একটু লজ্জা পায় সূচি।কানের পিছে চুল গুজে দিয়ে বলেঃ” রতন কাকা তো বললো পছন্দ করেছে।”
_” ওই দিন তোর দিকে তাকাইছিলো?”
_” সঠিক জানি না।আমি তো নিচের দিকে চেয়ে ছিলাম। তবে একবার চোখাচোখি হয়েছিল।”
_” বাহ! তাইলে তো হইলোই।তোরে কিছু দেয় নাই?”
_” দুই হাজার টাকা দিয়েছে যাওয়ার সময়।”
বান্ধবীর কাঁধে ধাক্কা দিয়ে ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি হাসে রত্না।ফিঁচেল হেসে বলেঃ” তাইলে তো বিয়াটা হইবই।ফোনে টোনে কথা কছ?”
_” যাহ,আমার লজ্জা করে।”
_” এহ,আইছে আমার লজ্জাবতী।বারো ইন্দুর মাইরা এখন সন্ন্যাসী সাজো? তোমারে আমি চিনি।ওই দিন ফয়সাল ভাইরে দেইখা তোর পেট মোচড় দেয় নাই? বাথরুম ধরে নাই?”
উপর-নিচে সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে সূচি।মলিন মুখে বললোঃ” অনেক কষ্টে চেয়ারে বসেছিলাম।অদ্ভূত এক রোগ বুঝলি।নিজের উপরেই বিরক্ত লাগে।”
_” তুই সংসার করবি ক্যামনে? তোর তো বাথরুমে আইতে-যাইতেই জীবন শেষ হইব।তখন?”
রত্নার পিঠে দুম করে কিল বসায় সূচি।
_” বলদের মতো কথা বলবি না।বিয়ের পর সব ঠিক হয়ে যাবে।একটা কাজ করে দিতে হবে রত্না।”
রত্না জিজ্ঞাসু চোখে চেয়ে থাকে। গলায় আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করেঃ” কী কাজ? ভূমি আপার বাসায় যাওন লাগব?”
_” না, ওই বাসায় আমিই যাব সময় পেলে।আরেকটা কাজ করবি।তোকে আমি পাঁচশ টাকা দেব।তুই একটু কষ্ট করে বাজারের বড় মসজিদের দানবক্সে টাকাটা ফেলে দিবি।পারবি না?”
_” পারমু।কিন্তু হঠাৎ দান করবি ক্যান?”
_” বলছি। তার আগে ওয়াদা দে কাউকে বলবি না।”
_” আচ্ছা,ওয়াদা।”
_” আল্লাহর কসম বল।”
_” আচ্ছা আল্লাহর কসম।”
এদিক-ওদিক নজর বুলায় সূচি।কোথাও কেউ নেই।ফিসফিসিয়ে বলেঃ” অনেক আগে মানত করেছিলাম।যদি ফয়সালের সাথে আমার কিছু হয় তাহলে পাঁচশ টাকা মসজিদে দেব।”
_” তাইলে বিয়ার পরেই দিছ।”
_” না এখনি দেই।কথা-বার্তা এগোচ্ছে,আমি কি অকৃতজ্ঞ? সেই কবে মানত করেছিলাম,এখন না দিলে আর কবে দেব? তুই পারবি কিনা বল?”
_” পারমু।বাবা রে বাবা বিয়া করার কত শখ! বিশ্বাস কর বইন রাতুলের লেগা আমিও এতো কষ্ট করি না,যতটা তুই করছ।”
পিঠে পড়ে থাকা চুলগুলোকে হাতে পেঁচিয়ে হাত খোঁপা করে সূচি।চুলগুলোকে এক হাতে পেঁচাতে পেঁচাতে বললোঃ” তোর মতো আমার টকটকের প্রেম না। আমার প্রেম হচ্ছে একদম সত্যিকারের প্রেম।বুঝলি?বিয়ের জন্য আমি আরো কতকিছু মানত করেছি। বিয়ের পর সব পালন করব। সূচির প্রেম কি আর যা-তা জিনিস নাকি? এ হলো সাধনা।তুই কী বুঝবি?”
রত্না কিছুই বলে না। সূচি মেয়েটা পাগল। ওর সাথে কথায় পারা যাবে না।ছবি,উপন্যাস থেকে প্রেম বিষয়ক তত্ত্বকথা একদম গিলে খেয়েছে। ওর সাথে কথায় জিতার সাধ্য রত্নার নেই।রত্না অবাক চোখে চেয়ে থাকে সূচির দিকে।কমলা রঙা রোদের আলো তীর্যকভাবে পড়ছে সূচির মুখে। পাশের আম গাছের বুড়ো ডালটা নুয়ে আছে এদিকে।সূচির মাথার উপরেই ঝুলছে পাতাগুলো।আশীর্বাদের ভঙ্গিতে সূচির মাথার উপরে ঝুঁকে আছে ডালটা।খুব ভালো লাগলো রত্নার।সূচিকেও ভালো লাগছে।সূচির দিকে চেয়ে সহসা উদাস হতে গেল রত্না। একরাশ উদাসীনতা গলায় ঢেলে দিলো রত্না।
” ফয়সাল ভাই অনেক ভাগ্য নিয়া দুনিয়াতে আসছে সূচি।তোর মতো বউ পাওয়া চাট্টিখানি কথা না।ছেলে হিসেবে তার ভাগ্যটা বান্ধায়া রাখার মতো।”
__________________
রতন পাটোয়ারী চায়ের কাপে একবার চুমুক দিলেন।রত্নার মতোই ভীষণ হুজুগে তিনি।অকারণেই হৈ হৈ করা তার স্বভাব।সূচি ও ফয়সালের জন্য বেশ দৌড়ঝাঁপ করছেন। তিনিও চাইছেন মেয়েটার বিয়ে এখানে হোক।রত্নার সাথেই বড় হয়েছে মেয়েটা।বাবা-মায়ের আদর কতখানি পেয়েছে তা বেশ জানেন তিনি। তাই ঘটকালি করছেন আরো বেশি করে।মেয়েটাকে বড়ই ভালোবাসেন।হাতের উপর বড় করেছেন।রত্নার পাশাপাশি লেলে-পুলে বড় করেছেন। ফয়সালটাও চোখের উপর বড় হয়েছে।আদব-কায়দা ভালো,কথা-বার্তা ভালো,দেখতে-শুনতে সুন্দর,চরিত্র ভালো।সূচির জন্য এর চেয়ে ভালো পাত্র আর কোথায় জুটবে? তাই তো বিয়ের জন্য বেশি খাটছেন রতন পাটোয়ারী। আহা! মেয়েটাকে তিনি বড় ভালোবাসেন।
” আপনে মমিন ভাইয়ের লগে কথা কইছিলেন ভাই?”
” হ,ভাবি।”
“খোঁজ-খবর নিতে কয়েন।হেগো যদি পছন্দ হয় তাইলে আমরা দেরি করুম না।একটা পোলা আমার।একটা সঙ্গীর দরকার।একটু তাড়াতাড়ি বিয়া করাইতে চাইতাছি।”
রতন শেখ এক চুমুকে কাপের চা’টুকু শেষ করে ফেললেন।তোষামুদে গলায় বললেনঃ” না,না ফয়সালের ব্যাপারে আর কী খোঁজ নিমু।আমগো হাতের উপরে বড় হইছে ।নিজের ঘরের ছেলের মতোই।মমিনেরও এক কথা।আপনেরা আগাইতে চাইলে আমগো কোনো আপত্তি নাই।ফয়সালের পছন্দ হইছে তো?”
” আমার পছন্দই ছেলের পছন্দ।ফয়সালরে তো চিনেনই।আমার কথার উপরে কোনো কথা কয় না।সাত চড়ে রা কাড়ে না।ওর আবার কীয়ের পছন্দ? আমার কথাই শেষ কথা।”
ফয়সালের মাতৃভক্তির কথা শুনে খুশি হন রতন পাটোয়ারী। আজকাল এমন মা ভক্ত ছেলে পাওয়াই দায়।রতন পাটোয়ারী প্রসন্ন গলায় বললেনঃ” তাইলে তো আর চিন্তাই নাই।মমিনসহ বসেন পরশু। আংটি পরাইবেন কখন জানায়েন।এইডা তো আর চাওয়া-পাওয়ার বিয়া না।”
রোমেলা বানু পান মুখে দেন।তিনি বৈষয়িক মানুষ।স্বামী মারা যাওয়ার পর ছেলে দুটোকে বড় করেছেন।কষ্ট যে হয়েছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কখনো পেট ভরে খেয়েছেন,কখনো আধ-পেট খেয়েছেন।তবুও এক কানি জমিও বিক্রি করেননি।যক্ষের ধনের মতো আঁকড়ে রেখেছেন জমিটুকু।নাহয় এতো তাড়াতাড়ি ছেলে দুটো নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারতো না। চাওয়া-পাওয়ার কথা কানে আসতেই মস্তিষ্ক সজাগ হয়ে উঠে রোমেলা বানুর।বড়ই চালাক মহিলা তিনি।দশটা পুরুষকে এক হাতে বেঁচে আরেক হাতে কিনতে পারবেন।ছোট-খাটো চালাক-চতুর মহিলা না ভেবে এক কদম ফেলেন না।রতন পাটোয়ারীর কথার বিপরীতে হালকা গলায় বললেনঃ” না, চাওয়া -পাওয়ার কী আছে? যৌতুক-টৌতুকের ভিতরে আমি নাই ভাই।আফজালের শ্বশুড় বাড়ি থেকা ঠেকায় পইরা তিন লাখ টাকা ক্যাশ আনছিলাম।আফজাল বেকার আছিলো, বিদেশে যাইব তাই টাকার দরকার আছিলো।হুমায়রার বাপের অঢেল আছিলো, তাই দিছে।এডা কি যৌতুক হইছে, কন ভাই? আমরা কি হুমায়রার উপর অত্যাচার করছি টাকার লেগা? তাইলে কি এইডা যৌতুক?”
দু-পাশে ঘন ঘন মাথা নাড়েন রতন পাটোয়ারী। যেন খুব পাপের কথা শুনে ফেলেছেন।
“না, ভাবি।এইডা আবার যৌতুক ক্যামনে? আমার মাইয়ার জামাইয়ের দরকার হইলে আমি দিমু না? এইডা সবাই দেয়।”
” সেইটাই।এহন মমিন ভাইয়ের সামর্থ্যও আমি জানি।তার কাছে কি আমি কিছু চামু? তিনিও দেশের মানুষ।দেশ চল হিসেবে তিনি তো মাইয়ারে কিছু না কিছু দিবই।এইটা কি আর আমি জানি না।”
” দেশ চল হিসেবে আংটি,চেইন এগুলি তো দেওয়া লাগেই।একটা সামাজিকতা বলতেও কথা আছে।মমিন তো আর অক্ষম না।তারপর আবার আজা-পোজা এগুলির কথা বাদই দেন। আমগো দেশের সংস্কৃতি আমরা না মানলে কে মানব।”
” এই যে আমার কথাটাই কইছেন ভাই। মমিন ভাইয়ের যদি কিছু ইচ্ছা হয় তাইলে দিব।মনে করেন, একটা আলমারি দিলো,এক ভরি গয়না দিলো।কার থাকব? সূচিরই তো থাকব।আমার তো আর মাইয়া নাই যে মাইয়াগো আঁচল টানমু।আমার যা আছে সবই তো দুই পোলার।তবুও বউগো বাড়ি থেকা কিছু আনলে ভালো লাগে।এই এছাড়া আর কিছু না।ধরেন সূচির লগে কিছু দিলো,আর পাঁচটা মানুষ দেখলো।তারাও তো ভালো কইব।বুঝব আমি যেনে-সেনে সম্বন্ধ করি নাই।সূচির মাথাটাও উঁচা হইব।তাই না ভাই? ভুল কইছি,বলেন?”
তীব্রভাবে মাথা নাড়েন রতন পাটোয়ারী।
” হ, উঁচা তো হইবই। এ আর কওন লাগব?”
রোমেলা বানুর বসার ঘরের পাশেই হুমায়রার রান্নাঘর।টিনের চালা ও বাঁশের খুঁটির ছোট্ট রান্নাঘর। হুমায়রা রাঁধছিলো। রোমেলা বানু ও রতন পাটোয়ারী, দুজনেই জোরে কথা বলেন।আগা-গোড়া সব কথাই ভেসে এসেছে হুমায়রার কানে।কেউ না বললেও দেবরের যে বিয়ে ঠিক হচ্ছে তা বেশ বুঝতে পারে হুমায়রা।ডালে লবন দিতে দিতে মনে মনে হাসে সে।শ্বাশুড়ি মা সোজা খান না, ঘুড়িয়ে খান। তার সাথে পারা মুশকিল।মাটির চুলার আগুনের দিকে এক নজরে চেয়ে থাকে হুমায়রা।সহজ,সরল, শান্ত, শিষ্ট মেয়ে।তবুও আজ কেন যেন খুব অস্থির লাগছে।অকারণেই মন খারাপ হচ্ছে খুব।কোন মেয়েটা আসবে এই বাড়িতে? মেয়ের বাবা-মা খোঁজ-খবর নেয়নি? নাকি মধু মাখানো কথায় ভিজে গেছে।
চুলার আগুন নিভে যাচ্ছিলো।হুমায়রা আরেকটা কাঠ গুজে দেয় চুলার ভিতর। এই তো আগুন জ্বলছে দ্বিগুণ তেজে।অনাগত মেয়েটার জন্য মনে মনে প্রার্থনা করে হুমায়রা।
” যেই মেয়েটা এই আগুনে আসব তারে অনেক ধৈর্য্য দিয়ো খোদা। তার চামড়াগুলা গন্ডারের মতো মোটা কইরা দিয়ো।আমি পারি নাই, সে যেন পারে।গোশত কামড়ায়া যেন সংসার করতে পারে। তুমি সবাইরে ভালো রাইখো খোদা।”
চলবে…