#শুধু_তুই
#পর্বঃ১৫
Rifat Amin
রাত তখন ন’টা বেজে পয়তাল্লিশ। বদ্ধ রুমের এককোণে চুপটি করে বসে আছি আমি। চারপাশে পিনপতন নীরবতা। ড্রইংরুমে কাজীসাহেব বসে আছেন। সাথে বসে আছেন দুই পরিবারের লোকজন৷ প্রহরভাই সোফায় বসে মাথা নিচু করে আছেন, একটু আগে তুমুল কথা কাটাকাটি হয়েছিলো আঙ্কেল-আন্টির সাথে। প্রহরভাই হঠাৎ কেনো বিয়ে করতে এত উৎসুক? এই বিষয়টা তাঁদের মাথায় কিছুতেই ঢুকছে না৷ যেখানে প্রহরভাই রশ্নি নামক মানবীকে’ই সহ্য করতে পারতো না। সেখানে হঠাৎ এত তাড়াহুড়ো?
আমার মা-বাবা বিষয়টাকে স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছে। তাঁদের কাছে প্রহর মানেই সকল সমস্যার সমাধান। হঠাৎ বিয়ে করার যথেষ্ট কারণ আছে বলেই উনারা মনে করছেন। অন্তত প্রহরভাইয়ের উপর যথেষ্ট ভরসা আছে। আমি প্রহরভাইয়ের এই গুরুগম্ভীর সিদ্ধান্তে কিংকর্তব্যবিমুঢ়। কিছুতেই স্বাভাবিক করতে পারছি না নিজেকে। বিয়েতে হ্যাঁ বলে দিতেও পারছি না। আবার না বলে দিতেও পারছি না।
প্রেমটাও নেই যে একটু কথা বলবো কারো সাথে। আমি বসা থেকে উঠে ঐশীর রুমে গেলাম। সে নিজেও মাথা নিচু করে বসে চিন্তা করছে। ওর পাশে প্রেয়সী ঘুমিয়ে আছে। আজ এত তারাতারি ঘুমিয়ে পরার কারণটা বুঝতে পারলাম না। আমি ওর পাশে গিয়ে বসতেই ঐশী মাথা তুলে চাইলো। ক্ষন কাল মৌনতা কাটিয়ে বললো,
– বিয়েতে তুই রাজি কি না বল? দেখ, প্রহরভাইকে আমরা যথেষ্ট সম্মান করি। শ্রদ্ধা করি। কিন্তু এমনটা না যে, তাঁর কথায় আমাদের চলতে হবে৷ আর এটা সাধারণ ডিসিশন নয়, বাকিটা জীবন কার সাথে থাকবি তাঁর মতো একটা বড় সিদ্ধান্ত। হুজুগে মাতাল হয়ে হ্যাঁ বলে দিলেই আর হয় না। (এশী)
আমি নিজেকে প্রশ্ন করেও কোনো সমাধান পাচ্ছি না। বারবার হতাশ হচ্ছি। ঐশীর কথায় নিজের মধ্যে কোনো ভাবান্তর ঘটলো না। আমার মস্তিষ্ক কোনো সঠিক সিদ্ধান্ত দিচ্ছে না এই মহুর্তে। সবকিছুই যেন ধোঁয়াশা লাগছে। শুষ্ক কন্ঠে বললাম,
– আমি কিছুই বুঝতেছি না। যা হবে হবে। আমার বাবা-মা যা চাইবে, তাই হবে। শুধু শুধু নিজেকে প্রেসার দিয়ে কি লাভ? তোর কি মনে হয়, আমি বিয়েতে রাজি না হলেই প্রহরভাই আমাকে ছেড়ে দিবে? অভিয়েসলি না! সে বিয়ে করেই ছাড়বে। এট এনি কস্ট। (আমি)
– যা ভালো বুঝিস কর। (ঐশী)
আমি সেখান থেকে উঠে আসলাম। কেউ এখন কোনো সাজেশন দিতে পারবে না। নিজের সিদ্ধান্ত নিজেকেই নিতে হবে৷ আমি নিজের নিয়তির উপর অটল থাকলাম। প্রহরভাইয়ের সাথে নিজেকে জড়াতে মন থেকে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম। একটু পর বিয়ের সব ব্যাবস্থা হয়ে গেলো। প্রেমকে দেখে হতাশ হলাম। এতটাই ভদ্রভাবে চুল কেটেছে যে ওকে চেনাই যাচ্ছে না। ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্টরা যে চুলের স্টাইল নেয়। ঠিক তেমন আর্মি কাট। ওকে দেখে বাড়ির সবাই হতবাক। সে নিজেও বাকরুদ্ধ এই পরিস্থিতি দেখে। দুই ঘন্টার মধ্যে বিয়ের সব ব্যাবস্থা হয়ে গেলো? সে নিজেকেই যেনো বিশ্বাস করাতে পারছে না সবটা। দুঘন্টা আগেও সবকিছু স্বাভাবিক ছিলো দেখতে দেখতে কেটে গেলো বাকি সময়টা। প্রহরভাইয়ের দুটো বন্ধু এসেছে দেখলাম। প্রেমেরও এসেছে। কিছুক্ষণ পর আমাদের বিয়েটা হয়ে গেলো৷ আমি নিজেকেই বিশ্বাস করাতে পারছি না আমি বিবাহিত। ঘন্টা দুয়েক আগেও যে জানতো না বিয়েটা ঠিক এই বছরে হবে কি না? অথচ ভাগ্যের কি পরিহাস! নিজেকে স্বাভাবিক করতেই আরো দুটো ঘন্টা সময় লাগলো। বিয়ে হওয়ার পর মেয়েরা যেমন কাঁদে, আমি ঠিক তেমনভাবে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারছিলাম না। একধরনের ট্রমা কাজ করছিলো৷ যদিও শশুরবাড়ি আর নিজের বাড়ির মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। তবুও বিয়ে তো? নিজের বাবা মা কে হারিয়ে ফেলার একটা সুচনা কেন্দ্র। এখন তাদের আমার প্রতি যতটা না অধিকার। তাঁর থেকেও বেশী অধিকার প্রহরভাইয়ের। আঙ্কেল-আন্টি এখনো মন খারাপ করে আছে। প্রহরভাইয়ের সিদ্ধান্তে তারা সবসময় হাসি-খুশি থাকে। কিন্তু আজ মন খারাপ। হঠাৎ করে বিয়েটা তারা ঠিক মেনে নিতে পারছে না৷ প্রহরভাইকে বারবার বলার পরও তিনি মুখটি খুলে একটা শব্দও বের করছেন না। তাঁর একটাই কথা, “আমায় রশ্নিকে বিয়ে করতে হবে। সেটা এক্ষুনি। আশা করি আমি কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নিচ্ছি না৷ আমার প্রতি আস্থা রাখতে পারেন। ”
ওনাদের বাসায় আসার পর দেখলাম বাসাতে কোনো সাজ-গোছ নেই। হঠাৎ নিজের এই ভাবনায় নিজের প্রতিই বিরক্ত হয়ে গেলাম৷ ওনাদের বাসা কি সাজগোছ করার কথা? আন্টি আমাকে তাঁর রুমে নিয়ে গেলেন। আমাকে বিছানায় বসিয়ে দরজাটা বন্ধ করে বললেন,
– তুই কি বিয়েটা মন থেকে মেনে নিতে পারবি মা? আমাদের তোকে বউ করে নিতে কোনো সমস্যা নেই সেটা তো জানিস? বরং তোকে নিজের মেয়ে করে নিতে আমি সবসময় প্রস্তুত ছিলাম। কিন্তু প্রহর হঠাৎ পাগলামো করে বিয়ে করলো কেনো সেটাই আসলে বুঝতে পারছি না। অন্তত একটা দিন আমাদের সময় দিক। আমাদের বুঝতে দিতো, আসলে কি সমস্যা হয়েছে? যার কারণে এত দ্রুত বিয়ে। (আন্টি)
আমি কি বলবো বুঝতে পারলাম না। এখানে আমার কি বলা উচিত? আমি চুপ করে থাকতেই আন্টি আবার বললেন,
– যা হবার হয়েছে। বাবু যখন বিয়ে করেই ফেললো, তখন আমাদের আর কি করার আছে? ওর ভালো থাকাই আমাদের ভালো থাকা। শুধু একটা কথাই ভাবছি সেটা হলো তুই খুশি কিনা? বিয়েটা তো বাবুর একার না। দুজন মানুষকে একসাথে থাকতে হবে বাকি জীবনটা। তাই আমি তোকে বলবো, নিজেকে সময় দে। আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করবি। আর আমার প্রতি কি তোর কোনো রাগ আছে? (আন্টি)
-আরে না না আন্টি। আপনার প্রতি আমার কোনো রাগ নেই। নিজের মায়ের পর সব থেকে আপন করে পেয়েছি আপনাকে। আমি ছোটবেলা থেকেই বুঝে নিয়েছিলাম আমার দু’টো মা। দুজনই আমাকে অনেক ভালোবাসে। (আমি)
কথাটা বলেই মাথা নিচু করে থাকলাম। উনি আমাকে বসিয়ে রেখে ড্রয়ার খুললেন। ড্রয়ার খুলে সেখান থেকে একজোড়া বালা বের করলেন। বালাদুটো বোধহয় স্বর্ণের। আমার সোনা সম্পর্কে তেমন কোনো ধারণা নেই তাই ঠিক ধরতে পারলাম না। বালাদুটো নিয়ে এসে আমার সামনে রেখে বললেন,
– দেখতো পছন্দ হয় কি না? পছন্দ না হলেও আমার করার কিছু নেই। কারণ এই বালা জোড়া বিয়ের দিন বাবুর দাদি আমাকে দিয়েছিলো৷ এখন আমার দায়িত্ব এইটা আমার ছেলের বউকে দেয়া। তোর ছেলের যখন বিয়ে হবে৷ তখন তোর দায়িত্ব এটা তার কাছে পৌঁছে দেয়া। বুঝলি? (আন্টি)
আমার মাথায় এই মহুর্তে কিছুই ঢুকছে না৷ পছন্দ না হওয়ারও কোনো কারণ দেখছি না। অনেক সুন্দর। আমি স্বল্পস্বরে বললাম,
– এটা আমাকে এই মহুর্তে দেয়ার কি দরকার আন্টি? আর এসব আপনার কাছেই রাখেন। আপনার কাছে থাকা মানেই আমার কাছে থাকা৷ (আমি)
– আন্টি কি হ্যাঁ? আমাকে মা বলবি, মা! আমার যে একটা মেয়ের অভাব ছিলো? সেটা কি এখনো অপূর্ণ রাখবি? (আন্টি)
– আচ্ছা চেষ্টা করবো আম্মি। আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে। (আমি)
-আচ্ছা বল, আজ আমার সাথে থাকবি নাকি বাবুর সাথে?
বাবু যেহেতু আমার অমতে বিয়ে করেছে। তাই শাস্তিস্বরুপ তোকে আজকের জন্য ওর কাছ থেকে আলাদা করে রাখি। কি বলিস? (আন্টি)
আমি কি বলবো বুঝতেই পারলাম না। প্রহরভাইয়ের সাথে থাকতে চাই, এটা কি আদৌ বলা সম্ভব? লজ্জার তো একটা সীমা আছে নাকি? আমি মুচকি হেসে বললাম,
– আপনার সাথেই থাকবো। (আমি)
——–🌧️
ছাদের ছোট্ট কোনে বসে আছে চারজন মানব। দুজন অপ্রাপ্তবয়স্ক, আর দুজন প্রাপ্ত বয়ষ্ক। প্রেমের সাথে আছে সাব্বির আর প্রহরভাইয়ের সাথে আছে তার বেষ্টফ্রেন্ড অর্জন ভাইয়া। সবাই নিজেদের যায়গা থেকে নিশ্চুপ। প্রেম ফোনটা বের করে রাফিকে কল করলো,
– হ্যালো রাফি৷ বল, ওদিকের কি অবস্থা? (প্রেম)
ওপাশ থেকে রাফি বললো,
– শোন, আমি গত একঘন্টা ধরে এখানে বসে আছি। এই একঘন্টায় সোনিয়া রোবটের মতো কফিশপে বসে আছে। আর হেডফোনে কারো সাথে জানি কথা বলছে! আমার মনে হয় এখানে থাকাটা আর আমার উচিত হবে না৷ সন্দেহের তালিকায় পরে যাবো। (রাফি)
– সমস্যা নাই, আমি আর সাব্বির যাচ্ছি ওখানে। আমরা পৌঁছে গেলে তুই চলে আসিস। যদিও আমি গেলে ঝামেলা একটা বাঁধবেই। তবুও যেতে হবে। অর্জন ভাইয়াও আমাদের সাথে আছে। (আমি)
– আচ্ছা দাঁড়া দাঁড়া। একটা মেয়ে এসে বসলো ওর সামনে। মেয়েটাকে আমি চিনিনা। বয়সটা বোধহয় সোনিয়ার সমান৷ পিক কেমনে পাঠাবো বুঝতেছিনা৷ এখানে ছবি উঠানোর ওয়ে নাই। কি করি বলতো?
– যেভাবেই হোক একটা পিক পাঠায় দে। আমার মনে হয় ঐ মেয়েই সব কিছুর মাথা৷ দেখি আমি বা ভাইয়া চিনি কি না?
আগাম একটা করে বেশি পর্ব পড়তে চাইলে আমাকে ফ্লো করুন 🖐️✊
চলবে?