শুভ্র বর্ষণ পর্ব- ১৯

0
2080

#শুভ্র_বর্ষণ
#প্রভা_আফরিন
#পর্ব_১৯

সকাল সকাল এক গ্লাস ইসবগুলের শরবত ছাড়া আনোয়ার সাহেবের দিন শুরু হয় না। ঘুম থেকে উঠে বাসি মুখে ইসবগুলের শরবত খেয়ে তারপর নিত্যদিনের কার্যক্রম শুরু করেন। আগে আনোয়ার সাহেবের কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা ছিলো। সেই থেকেই পাইলস রোগ হয়। একবার অপারেশন করেও যখন কোনো উপকার হলো না তখন দীর্ঘদিন হোমিওপ্যাথি মেডিসিন এবং খাদ্যাভ্যাসে খেয়াল রেখে এই সমস্যা থেকে মুক্তি পেয়েছেন তিনি।

শরবত খাওয়ার পর মিহার কাছে গেলেন তিনি। ওর হাতের ফ্রেকচার অনেকটা সেরে উঠেছে দুই সপ্তাহে। নিশান্তের ইচ্ছায় খুব শীগ্রই পুত্রবধূকে ঘরে তুলবেন নাজমুল হক। যার ফলে আনোয়ার সাহেব বাড়িতে থাকার সময়টুকু কারনে অকারনে মিহাকে ডেকে আনেন। পাশে রাখেন।
মিহা ডাইনিং টেবিলের ওপর ঘুমু ঘুমু চোখে বসে ছিলো। ইদানীং ঘুম খুব বেড়ে গিয়েছে ওর। হাতের আঘাতটার পর মূলত ঔষধের প্রভাবেই ঘুমটা বেড়ে গেছে। মাথায় কারো হাত পড়তেই ঘুম তাড়ানোর চেষ্টা করে তাকালো সে। আনোয়ার সাহেব মুচকি হেসে বললেন,

“মিহা মনির ঘুম হয়নি আজ?”

“ঘুম দিন দিন বাড়ছে মামা। তুমি বসো। আমি চা আনছি।”

আনোয়ার সাহেব উঠতে দিলেন না। পাশে বসে বললেন,
“তোর যেতে হবে না। ঘুম পেলে আরেকটু ঘুমিয়ে নে।”

“না, আর ঘুমাবো না।”

ঘুমাবো না বলে লম্বা একটা হাই তুললো মিহা। আনোয়ার সাহেব মিহার মাথাটা নিজের কাধের ওপর রাখলেন। মিহার ভালো হাতটা ধরে রাখলেন মুঠোয়। মিহা চোখ বন্ধ করে হেসে ফেললো। কাধে মাথা রেখেই জিজ্ঞেস করলো,

“আচ্ছা মামা! তুমি আমার প্রতি এতো দুর্বল কেনো বলোতো?”

আনোয়ার সাহেব হাসলেন। হাসলেন তার স্ত্রী শিরীন বেগমও। তিনি স্বামীকে চা দিয়ে পুনরায় রান্না ঘরে প্রস্থান করলো। আনোয়ার সাহেব বললেন,

“সন্তান সুখ সবসময় নিজের সন্তান থেকেই পেতে হবে এমন কোনো কথা নেই। শোভার আগে তুই এসেছিস আমার কোলে। তোয়ালে প্যাচানো ছোট্ট শরীরটা তোর বাবা যখন আমার কোলে তুলে দিয়ে বললো,
‘তুমি রাজকন্যার মামা হয়েছো। দায়িত্ব কিন্তু বেড়ে গেলো এখন। আমার পরে ওর মাথার ওপর সবসময় নিজের হাত রেখো।’
সেইদিন বাচ্চাটাকে কোলে নিতে হাত কাপছিলো আমার। এতো ছোট্ট বাচ্চা হাত থেকে পড়ে যেতে পারে ভেবে বেশিক্ষন কোলে রাখতেই পারিনি। অথচ তাকে কাছ ছাড়া করতেও ইচ্ছে করেনি। একটু বড় হতেই হাতের কাছে যা পায় তাই মুখে দেওয়া শিখে গেলো। ছোট ছোট দাত দিয়ে সবই কুটকুট করে কামড়াতে লাগলো। মামার গালে যে কত কামড় দিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। আমি মামা বলে যখন ডাকলে দূর থেকেও চিনে ফেলতো। গলা জড়িয়ে ধরে বসে থাকতো। আধো আধো বুলিতে মামা মামা বলে ডাকতো৷ তোর শৈশবের বেশিরভাগ দুষ্টুমি আমার কোলে, কাধে চড়ে। আমার প্রথম সন্তানের সুখ তোর মাধ্যমে পেয়েছি। তোর প্রতি দুর্বল হবো না তো কার প্রতি হবো?”

মিহার সুখে কাদতে ইচ্ছে করছে। আল্লাহ ওকে একদিক থেকে সুখ কেড়ে নিয়ে অপরদিক থেকে অঢেল সুখ দিয়েছে। ওদের কথার মাঝেই শোভা মুখ ফুলিয়ে এসে বললো,

“আমাকে কুড়িয়ে আনা হয়েছে রাস্তা থেকে। তাই কারো চোখে পড়ি না। কেউ ভালোই বাসে না। থাকবো না এই বাড়িতে।”

মিহা এবং আনোয়ার সাহেব দুজনে একযোগে হাসলো ওর কথা শুনে। শোভার হাত ধরে পাশে বসিয়ে আনোয়ার সাহেব বললেন,
“বাবা মায়ের ভালোবাসা কখনো কোনো সন্তানের প্রতি কমে না বা ভাগ বসে না। বরং সন্তানের সংখ্যা বাড়লে বাবা মায়ের হৃদয়ে যায়গাও বাড়ে। সাথে ভালোবাসাও।”

________

ইদানীং শোভা খাবারের দিকে বেশিই অনিয়ম করছে৷ আশে পাশের রেস্টুরেন্ট গুলো হোম ডেলিভারি সার্ভিস শুরু করার পর থেকে ইচ্ছে হলেই খাবার অর্ডার দিয়ে খেয়ে নেয়। যার ফলে বদহজম, কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দিচ্ছে ওর। বিষয়টা নিয়ে শিরীন বেগম চিন্তিত। স্বামীর পাইলস রোগ থেকে তিনি জেনেছেন কোষ্ঠকাঠিন্য পাইলস এর সূত্রপাত ঘটায়। মেয়েটাকে হাজার বকেও কাজ হয় না। বাবার আশকারায় মাথায় উঠে আছে সবার। তাই এখন থেকে সব আশযুক্ত, সহজপাচ্য এবং শরীর ডিহাইড্রেট করে না এমন খাবার জোর করে খাওয়াবেন মেয়েকে।

বাড়ির সামনে দিয়ে ভ্যানে করে পালংশাক বিক্রি করতে দেখে শিরীন বেগম এগিয়ে গেলেন। পালংশাক, পুইশাক এবং ঢেড়স কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সাহায্য করে। পালংশাক যেহেতু পাওয়া গেছে তাই সেটাই রান্না করবেন বলে ঠিক করলেন। শিরীন বেগম ভ্যানের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে দেখলেন শোভা বাড়ি ফিরছে। তার পেছনে আছে টফি। শোভার হাতে টফির গলার বেল্ট ধরা। মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে দু’জনই দুজনের ওপর বিরক্ত। শোভা কাছাকাছি আসতেই শিরীন বেগম জিজ্ঞেস করলো,

“আবার বাইরে ঘুরছিস? মানুষ হবি না আর। তোর থেকে তো টফিই ভালো, বাড়ি থেকে অনুমতি না পেলে বের হয় না।”

শোভা টফির দিকে তাকিয়ে বললো,
“কে বলেছে অনুমতি ছাড়া বের হয় না! সে বাড়ি থেকে পালিয়েই বেরিয়ে গেছে। আমি জোর করে নিয়ে এলাম। এই শিয়াল মুখো কুকুর আমার থেকেও বড় চোর। সুযোগ পেলেই পঁচা ডোবার কাছে চলে যায়। সেখানে গিয়ে অন্য কুকুরদের সাথে ঝগড়া বাধায়।”

টফির বোধহয় নিজের অপমান পছন্দ হলো না। সে প্রতিবাদ করে শোভার দিকে তাকিয়ে ডাকলো কয়েকবার। শোভা মুখ ভেংচি দিয়ে মাথায় থাপ্পড় দিতে গিয়ে থেমে গেলো। রিয়াদ আসছে। রিয়াদ অফিসে জয়েন হওয়ার পর খুব একটা দেখা বা কথা হয়নি দুজনের। রিয়াদকে দেখে শোভা আর মারলো না টফিকে। টফি লাফিয়ে লাফিয়ে রিয়াদের কাছে চলে গেলো। রিয়াদ ওর মাথা চুলকে দিলো। শোভাকে দেখেও কিছু বললো না। শোভা নিজেই কথা বললো।

“আপনার টফিকে শাসন করা উচিৎ। হুটহাট বেরিয়ে পঁচা যায়গায় গিয়ে রাস্তার কুকুরদের সাথে ঝগড়া করে। টফি ভ্যাক্সিন দেওয়া, ওরা নয় কিন্তু।”

রিয়াদ টফির দিকে তাকিয়ে শাসনের সুরে বললো,
” তুই একাজ করিস?”

টফি চুপসে রইলো। কোনো আওয়াজ করলো না। রিয়াদ শোভার দিকে তাকিয়ে বললো,
“ঝগড়া না করে দুজনে একটু মিল থাকলেই পারো। তাহলে দেখবে আমি না থাকলে টফি এখানে ওখানে না গিয়ে তোমার কাছে থাকছে।”

শোভা মুখ বাকালো। বললো,
“আমি কি ওর পার্ট টাইম কেয়ার টেকার হবো নাকি?”

“হতে ক্ষতি কি? পার্ট টাইম পছন্দ না হলে ফুল টাইম হতে পারো।”

শোভা ভ্রু কুচকে তাকালো। লোকটার কথাবার্তা ইদানীং অন্যরকম লাগে। কেনো লাগে তার সুস্পষ্ট উত্তর শোভার কাছে নেই। বললো,
“আমি কেনো ফুল টাইম কেয়ার টেকার হতে যাবো শুনি? আপনি কি দুনিয়ায় মানুষ পাচ্ছেন না?”

রিয়াদ হতাশা মিশ্রিত নিশ্বাস ত্যাগ করে বললো,
“পেলে কি আর তোমার সাথে অযথা সময় নষ্ট করি!”

শোভা কিছু বলার আগেই শিরীন বেগম পালংশাক কিনে ওদের কাছে আসলো। রিয়াদের সাথে কুশল বিনিময় করে শোভার দিকে তাকিয়ে বললো,
“এখনো বাড়িতে ঢুকিসনি কেনো? দুপুরের খাবারও খাসনি এখনো। খাবারে এমন অনিয়ম করিস বলেই এতো রোগ বাসা বাধে। তোকে টাকা দেওয়া বন্ধ করছি আমি।”

শোভা কিছু বললো না। রিয়াদ উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“কি রোগ হচ্ছে?”

“বাইরের হাবিজাবি তেল-মশলা খেয়ে কোষ্ঠকাঠিন্য বাধাচ্ছে। বাথরুম হচ্ছে না ঠিকমতো।”

মায়ের কথায় শোভার ইচ্ছে করলো মাটি ফাক করে ঢুকে যেতে। শেষমেষ কিনা রিয়াদের সামনে এমন কথা বলে ফেললো মা! রিয়াদ শোভার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট টিপে হাসলো। তা দেখে শোভা আরেক দফা লজ্জায় পড়লো। মাকে চোখ দিয়ে ইশারা করে বাধা দিতে গেলেও শিরীন বেগম বকেই চললেন,

” ওর বাবার যে কি সমস্যা হয়েছিলো ও কি দেখেনি? তাও এমন করবে। ইসবগুলও খেতে চায়না। তাইতো পালংশাক কিনলাম যেন একটু সাহায্য করে। না খেলে খবর আছে।”

শোভা রিয়াদের সামনে আর দাড়াতে পারলো না। যত লজ্জা সব কেনো এই লোকটার সামনেই পেতে হয় ওর! মানসম্মানকে বিদায় দিয়ে ছুট লাগালো বাড়ির দিকে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here