#শুভ্র_বর্ষণ
#প্রভা_আফরিন
#পর্ব_২০
নিশান্তের বাড়িতে উৎসব শুরু হয়েছে কাল থেকে। বাড়িতে নতুন অতিথি আসছে। অনন্ত এবং ফাইজার চার বছরের সংসারে নতুন সদস্যের আগমণ বার্তা পৌঁছে গিয়েছে। খবরটা পেতেই সকলের মাঝে খুশির ঝর্ণা ছুটেছে। ছেলে বাবু নাকি মেয়ে বাবু আসবে, বাচ্চার নাম কি হবে, দেখতে কার মতো হবে, কে বেশি ভালোবাসবে এইসব নিয়ে আলোচনা হচ্ছে।বাড়ির সকলের পাগলামি দেখে ফাইজার ভীষণ লজ্জা লাগছে। এই বাড়ির মানুষগুলো আসলেই পাগল। বাচ্চা এখনো পৃথিবীতে আসেনি তার আগেই পারলে বাচ্চার ভবিষ্যৎ ভেবে ফেলছে সকলে। তবে সকলের এই আনন্দে খুশি ফাইজা নিজেও। কিছুদিন ধরেই শরীরটা ঠিক লাগছিলো না। অল্পতে দুর্বল হওয়ার মতো মেয়ে ফাইজা নয়। এইবার এমন ঘন ঘন অসুস্থতা ওকে অন্যকিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছিলো। হলোও তাই। অনন্তকে নিয়ে ঘুরতে যাওয়ার নাম করে মেডিকেলে টেস্ট করে এসেছিলো। রিপোর্টটা হাতে পেয়ে কেদে ফেলেছিলো সে। নিজেকে পরিপূর্ণ লাগছিলো। একটা পুচকের অভাব সত্যিই অনুভব করছিলো কিছুদিন।
সকলের পাগলামি দেখতে দেখতে অজান্তেই ফাইজার হাত চলে গেলো পেটে। ভাবতেই অবাক লাগে এইখানে নাকি একটা প্রানের সঞ্চার ঘটছে। শরীরের ভেতর আরেকটা শরীর হবে। যে ধীরে ধীরে বড় হবে পেটের ভেতর। নড়াচড়া করবে। কেমন হবে সেই অনুভূতি! ফাইজার ভাবনার মাঝেই অনন্তের আগমন ঘটলো রুমে। ফাইজাকে দরজায় দাড়িয়ে থাকতে দেখে আলতো করে কাধে হাত রাখলো। ফাইজা ভাবনার সুতো ছিড়ে বাস্তবে প্রবেশ করতেই অনন্তের হাসিমুখ নজরে এলো। কি পরিতৃপ্ত সেই হাসি! সেও মৃদু হাসি বিনিময় করলো। অনন্ত ওকে খাটে বসিয়ে বললো,
“তোমার একাকিত্ব সময়ের অবসান ঘটতে চলেছে শীগ্রই। এখন আর আমায় ফোন দিয়ে বলতে হবে না যে একা একা লাগছে।”
ফাইজা হাসলো। বললো,
“তুমি পাশে না থাকলে হাজার মানুষের ভীড়েও আমার একা লাগে। সন্তান আসলে হয়তো একাকিত্ব অনেকটা কমে যাবে। কিন্তু তোমার তৃষ্ণা আমার কমবে না।”
“আর আমার! আমার তৃষ্ণা যে আরো বেড়ে গেলো। এতোদিন শুধু তোমাকে এবং আমার পরিবারকে মিস করতাম। এখন যে সেটা আরো বেড়ে গেলো। তুমি, তোমরা প্রতিনিয়ত ওর বড় হয়ে ওঠা উপভোগ করতে পারবে। আমি সবসময় তা পারবো না। এই তৃষ্ণা মিটবে কি করে বলোতো?”
ফাইজা স্বামীর ডান হাত জড়িয়ে ধরে কাধে মাথা রাখলো। অনন্তের যাওয়ার সময় ঘনিয়ে আসছে। প্রতিবারই বাড়ি থেকে যাওয়ার সময় একবুক শূন্যতা ওকে ঘিরে ধরে। যদিও কর্মক্ষেত্রে পরিবার ভুলে যেতে হয় অনন্তকে। তখন পরিবারের প্রতি আবেগের আগে নিজের কর্তব্য থাকে। আরো অনেক পরিবারের ভালো থাকা নিশ্চিত করতে হয়।
বাড়িতে খুশির আমেজ আরেকদফা বৃদ্ধি করতে নাজমুল হক দুই বেয়াই বাড়িতে দাওয়াত পাঠিয়েছেন। কাল দুপুরে ফাইজার পরিবার এবং মিহার পরিবারের সবাইকে নাজমুল হকের বাড়িতে দাওয়াত করা হয়েছে। এর মাঝেই কাল নিশান্ত এবং মিহার আনুষ্ঠানিক বিয়ের আয়োজন সম্পর্কে সব ফাইনাল করে ফেলা যাবে। এতো আয়োজনে মিহা উপস্থিত থাকবেনা শুনে নিশান্তের খারাপ লাগলো। সে চেয়েছিলো মিহা আসুক। কিন্তু মিহা আসবে না জানিয়েছে। যেহেতু এখনো এই বাড়িতে বধু বরণ হয়নি ওর, তাই একটু সঙ্কোচ কাজ করছে। এতো আত্মীয় ফেলে নিশান্তও যেতে পারবে না তার মাহযাবীনের কাছে। মনটা তাই একটু বিক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো।
রাতে মিহাকে ফোন দিয়ে কিছুক্ষণ বকাঝকাও করলো ওর অযথা সঙ্কোচ নিয়ে। নিজের শশুর বাড়ি আসতে সমস্যা কোথায়! এমন তো না বিয়ে ঠিক হচ্ছে। বিয়েতো আগেই হয়ে গেছে। নিশান্তের যাওয়ার সুযোগ থাকলে নিশ্চয়ই যেত। মিহা কেনো যে ওর ভেতরের উদ্বিগ্নতা বোঝে না।
মিহা অবশ্য নিশান্তের বকাঝকা আমলে নিলো না। সে বরং প্রসঙ্গ বদলাতে বললো,
“আপনার সাথে একটা জোৎস্নারাতে ফাকা রাস্তায় হাটতে ইচ্ছে করছে।”
“আমার সাথে কেনো ইচ্ছে করবে! আমার কাছে আসতে তো তোমার ভালো লাগে না।”
“আপনার সাথে চাঁদ দেখতে ইচ্ছে করছে। নরম সবুজ ঘাস খালি পায়ে স্পর্শ করতে ইচ্ছে করছে। জোৎস্না গায়ে মেখে রাতভর আলাপ করতে ইচ্ছে করছে। রাস্তার ধারে বসে চা খেতে ইচ্ছে করছে। হাত ধরে হাটতে ইচ্ছে করছে।”
নিশান্ত কিছুটা বিস্মিত হলো। তার মাহযাবীন কখনোই কোনোকিছু আবদার করে না তার কাছে। প্রতিবার মাহযাবীনের কাছে গিয়ে নিয়ম করে জিজ্ঞেস করে ওর কোনো আকাঙ্ক্ষা আছে কিনা। মেয়েটা মুচকি হেসে মাথা নেড়ে বলে, নেই। আজ নিজে থেকে বললো। যদিও খুবই সাধারণ ইচ্ছা। নিশান্ত খুশি হলো। তবে মুখে সেটা প্রকাশ করলো না। বললো,
“পারবো না। ভিডিও কলেই আমার সাথে চাঁদ দেখো।”
“আমি আপনার সাথে সশরীরে চাঁদ দেখতে চাই।”
“তাহলে কাল চলে এসো। রাতে দুজনে রাস্তায় বেরিয়ে পড়বো একসাথে।”
“না। আপনি একটু বোঝার চেষ্টা করুন। আমার লজ্জা লাগবে ওখানে যেতে।”
“তাহলে আমিও পারবো না। যে আমার মন বোঝে না, আমিও তার মন বুঝি না।”
নিশান্ত ফোন কেটে দিলো। মিহা হাসলো। অযথা রাগ দেখানোর ভাণ ধরে লোকটা। ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে বলল,
“আমি জানি আপনি আসবেন।”
_________
সকাল সকাল টফি এসে শোভার নতুন ফুলের টব উল্টিয়ে দিয়েছে। তাতেই শান্ত হয়নি মাটি গুলোকে চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে নিজেও মেখে নিয়েছে। ঘুম থেকে উঠে নিজের পছন্দের গোলাপ গাছের এই হাল দেখে শোভার হাতে থাকা ঘড়িটা পড়ে গেলো। অবহেলায় পড়ে থাকা গোলাপটা দেখে ইচ্ছে করলো হাত পা ছুড়ে কাঁদতে। মাত্র একটা ফুলই ফুটে ছিলো শখের গাছটায়। এই শিয়ালকে আবার ছেড়ে দেওয়ায় ইংলিশ আন্টির ওপরও রাগ হলো। একটা কুকুরকে খেয়ালে রাখতে পারে না!
টফি শোভাকে দেখে মাটি নিয়ে গড়াগড়ি করা থামিয়ে দিলো। ছুটে এসে শোভার পায়ের কাছের ঘড়িটা কামড়ে নিয়ে ছুট লাগালো নিজের বাড়ির দিকে। শোভাও রেগেমেগে ওর পেছনে দৌড়ে গেলো।
টফি বাড়ির ভেতর ঢুকে ঘড়িটা সোফায় বসে থাকা রিয়াদের সামনে রাখলো। রিয়াদ অফিসের জন্য তৈরী হচ্ছিলো। টফিকে ছুটে এসে ঘড়ি রাখতে দেখে সেদিকে তাকালো। ঘড়িটা চেনা চেনা লাগলো।বললো,
“আবার কি অকাজ করলি সকাল সকাল! কার ঘড়ি এটা? আর গায়ে এতো মাটি কেনো?”
“আপনার টফি আমার ফুলের টব ভেঙে দিয়েছে।”
দরজার কাছে দাঁড়িয়ে শোভা বললো। রিয়াদ সেদিকে তাকিয়ে টফির দিকে তাকালো। টফি দৌড়ে সেখান থেকে ভেতরে চলে গেলো। রিয়াদ শোভার দিকে তাকালো আবার। আধখোলা অগোছালো চুল কানের পেছনে গুজে দেওয়া। কপালেও ছড়িয়ে আছে বেশ কিছু অবাদ্ধ চুল। কিছুক্ষন আগেই যে ঘুম থেকে উঠেছে সেটা ওর ফোলা চোখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। মুখে একরাশ বিরক্তি ফুটিয়ে সে তাকিয়ে আছে রিয়াদের দিকে।
রিয়াদের কোনো প্রতিক্রিয়া না পেয়ে শোভার আরো রাগ হলো। আরেকটু ভেতরে ঢুকে বললো,
“টফি আমার ফুল গাছ নষ্ট করে দিয়েছে আপনি কিছুই বলবেন না? কেমন মানুষ আপনি? শাসন করবেন না?”
রিয়াদ জিজ্ঞেস করলো,
“কি রঙের ফুল ছিলো?”
“লাল গোলাপ।”
রিয়াদ হাসলো। লাল রঙের ফুল ভালোবাসে টফি। লাল রঙের যে কোনো জিনিসই টফির ভীষণ পছন্দ। রিয়াদকে হাসতে দেখে শোভার রাগ হলো। সরু চোখে তাকিয়ে বললো,
“আবার হাসছেন! আমার ঘড়িটা পর্যন্ত ছিনতাই করে নিয়ে এসে আপনার সামনে রেখেছে। আপনি শিখিয়ে দেননি তো এরকম করতে?”
“ঘড়ি ছিনতাই করে এনে দিলে কি হবে। মনটা তো আর আনতে পারেনি। সেটা এনে দিলে কিছু করা যেত।”
শোভা ভ্রু কুচকে তাকালো।
“মানে?”
“মানে কিছু না। টফি লাল রঙ পছন্দ করে বলেই এমন করেছে। তাছাড়া তোমরা দুজনেই দুজনের সাথে লেগে থাকো। টফি নালিশ করতে পারে না বলে ওর প্রতি বিচার করা হয় না। শুধু নিজে বিচার চাইলে তো হবে না।”
“আমি ওর সাথে কি এমন করেছি হু? ওর দোষ লুকাতে আমায় ফাসাবেন না বলে দিলাম। আমার গোলাপ গাছ আমায় এনে দিবেন। নিজেদের বাগান ভরা ফুল রেখে আমার প্রিয় টবে যেন নজর না দেয়।”
“আমার থেকে গোলাপ নেবে তুমি?”
“একশবার নেবো। পারলে আজই কিনে আনবেন। নাহলে বাগান থেকে আমার পছন্দমতো গাছ তুলে নেবো বলে দিলাম।”
রিয়াদ কিছু না বলে হাসলো শুধু। শোভা আর পাত্তা না দিয়ে নিজের ঘড়ি তুলে নিয়ে ফেরত যাওয়ার সময় রিয়াদ পেছন থেকে ডাকলো। বললো,
“তোমার প্রাতঃকালীন কাজ সম্পন্ন হয়েছে তো শোভা?”
শোভা কথাটার অর্থ বুঝলো না। বললো,
“মানে?”
“মানে বাথরুম ক্লিয়ার তো! নাকি ঢেরস বা পালংশাক কিনে আনতে হবে। এইসব গুরুতর রোগ নিয়ে থাকা কিন্তু একদম ঠিক না। তাছাড়া…”
রিয়াদের আর কোনো কথা শুনতে পারলো না শোভা। লজ্জায়, অপমানে ঘড়ি ফেলেই ছুট লাগালো। ইশ, কি লজ্জা! আজ মায়ের সাথে এই নিয়ে ঝগড়া করতেই হবে৷ নাহলে দেখা যাবে দুইদিন পর পুরো এলাকা জেনে যাবে এই কথা। তখন জনে জনে এসে ওর পেটের খবর জানতে চাইবে। ছিঃ!
রিয়াদ শব্দ করে হেসে ফেললো শোভাকে ছূটে যেতে দেখে। ওর পড়ে থাকা ঘড়িটা তুলে পকেটে ঢুকিয়ে নিলো। সকাল সকাল বেশ শায়েস্তা করা গেছে মেয়েটাকে। আজ আর এমুখো হবে বলে মনে হয় না।
চলবে…