#শুভ_বিবাহ
লেখা #AbiarMaria
পর্ব ৭
পরদিন সকালে ঘুম ভেঙেও আমার মন খারাপ শেষ হয়নি। জানালার গ্রিল ধরে কয়েদিদের মত বাইরের আকাশ দেখছি। এ সময় আম্মু এসে বিরক্ত হয়ে বলল,
❝নাস্তা না করে এমন জানালা ধরে বসে আছিস কেন? নাস্তা করতে আয়, তোর আব্বু ডাকে❞
আমি বিষাদ বদনে বিষন্ন নয়নে মরুভূমির মতো শুকনো ক্যাকটাসের মতো কাঁটাযুক্ত এক রমনীকে দেখলাম যিনি আমার মা। সে শুধু আমাকে আটকে রাখে, কিচ্ছু করতে দেয় না। দুঃখের সমুদ্র বুকে চাপা দিয়ে ডাইনিং টেবিলে গেলাম। মুখ নিচু করে খাচ্ছি বলে আব্বু বললেন,
❝আমার আম্মাজানের কি মন খারাপ? সকাল সকাল এমন মুখ করে আছিস কেন?❞
আমার চাপা দেয়া দুঃখের সমুদ্র উথলে উঠল, আর তা চোখ দিয়ে উপচে পড়ল।
❝আম্মু আমাকে ছাদেও যেতে দিবে না! আম্মু আমাকে কোথাও যেতে দেয় না! শুভ ভাইয়া আমাকে আজেবাজে কথা বলেছে কিন্তু আম্মু আমাকেই উলটা এখন ছাদে যেতে দিবে না। আমার কি দোষ? আমি কি করেছি?❞
এত জোরে জোরে ভ্যা ভ্যা করে কান্না শুরু করে দিলাম যে আব্বু আমার অর্ধেক কথাও বুঝলো না। হাতের রুটির টুকরো মুখে না পুরে আমার দিকে অবাক হয়ে তাকালো।
❝ছাদে আবার কি করল? শুভটা আবার কে? আমি তো কিছুই বুঝলাম না!❞
আম্মু কটমট করে আমার দিকে বিষদৃষ্টি নিক্ষেপ করল। আমি তবুও কেঁদে কেঁদে বললাম,
❝শুভ ভাইয়া আমাকে ছাদে দেখলেই খারাপ ব্যবহার করে। সেদিন আমাকে ভয় দেখিয়ে আমার বই নিয়ে গিয়েছিল। কালকে আমাকে দুই শিং ওয়ালী বলেছে! কিন্তু আমি কি করেছি? আমি তো কিছু করিনি!❞
আব্বু আমার কথা না বুঝে আম্মুর দিকে তাকালো। আম্মু বিরক্ত হয়ে বলল,
❝মেয়ে বড় হচ্ছে। ছাদে গেলে ছেলেরা উল্টাপাল্টা বলে। এটা তো বলবেই, না? আমি কয়টা ছেলেকে আটকাবো? এজন্য তোমার মেয়েকে বললাম ছাদে যাস না। তোমার উলটা কাল থেকে কান্নাকাটির বাজার লাগিয়ে বসে আছে!❞
এরপর আমাকে বলল,
❝এই! তুই কি কান্না ছাড়া কিচ্ছু পারিস না? প্লেটে যা আছে সব খেয়ে শেষ কর। নাহলে পিঠের উপর দুইটা দিয়ে খাওয়াবো। খেয়াল আছে এক ঘন্টা পর যে কোচিং? খাবি কখন আর যাবি কখন?❞
আমার খেয়াল আছে সবই, কিন্তু পিঠের উপর দুইটা দেয়ার কথা শুনে কান্নায় আরও চোখের পানি পড়তে শুরু করল। আমি মায়ের বাধ্য সন্তান। আমাকে সেভাবে পিঠের উপর দুটো দিয়ে কিছু করাতে হয়নি। ঝি কে মেরে যেমন বউকে শেখানো হয়, তেমনি আমার দুই ভাইকে মেরে আমাকে শিক্ষা দিয়েছেন আম্মু। ওদের শরীর বোধহয় ইস্পাতের তৈরি, মার খেয়েও কিছু হতো না। আমার শরীর তো ইস্পাত না, তাই আমি আগে আগে সাবধান হয়ে গিয়েছি। তবে আম্মুকে বিশ্বাস নেই। যেভাবে আমার হাত চুল ধরে টানাটানি করে, আমি ব্যথায় মরে যাই। ধরে পিটালে আমার হাড়ের জোড়া খুলে আসবে।
মারের ভয়ে হোক, কিংবা বাবার কাছে এর সঠিক বিচার না পাওয়ার ভয়েই হোক, আমি দ্রুত খেয়ে উঠে গেলাম সেখান থেকে। দ্রুত তৈরি হয়ে কোচিং-এ রওনা দিলাম। আম্মু আমাকে কোচিং এ দিয়ে বাজার করে। বাজার শেষে রান্না বসিয়ে আবার আমাকে সেখান থেকে নিয়ে আসে। মাঝে মাঝে রান্নায় বেশি ব্যস্ত থাকলে আব্বু এসে নিয়ে যায়। উনি আগে সরকারি চাকরি করত, এখন অবসরপ্রাপ্ত হয়ে ঘরে বসে থাকেন। তবে আমি তার অবসারপ্রাপ্তের কোনো নমুনা দেখি না। আব্বু সবসময় কিছু না কিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। হয়ত গাছ পালা নিয়ে কাজ করবেন, নাহলে খবরের কাগজ কিংবা টিভি নিয়ে গবেষণায় নামবেন, কিংবা ঘরের নষ্ট ইলেকট্রনিকস গ্যাজেট আর টেস্টার নিয়ে গুতোগুতি করতে থাকবেন।
বিকালে দোতলার মুমু আর ঝুমু আসলো আমাকে নিয়ে ছাদে যাওয়ার জন্য। আমি চুপ করে থাকলাম। আম্মু যদি পিঠের উপর দুইটা দেয়? বললাম,
❝আম্মু আমাকে ছাদে যেতে মানা করেছে। কালকে শুভ ভাইয়া যে বকা দিল, উল্টাপাল্টা বলল, সেটা বলার পর আমাকে আর ছাদে যেতে দিবে না বলল। এখন যদি আমাকে মারে?❞
❝ছাদ তো তোমাদের, বাসা তো তোমাদের। তাহলে তুমি যাবা না কেন? ঐ ভাইয়ার তাতে কি?❞
তাই তো! এই বাসা তো আমার আব্বুর, ছাদ আমার আব্বুর। তাহলে শুভ ভাইয়ার কি? আমি ছাদে গেলে তার কি হবে? আমি মনে কিঞ্চিৎ সাহস জোগাড় করলাম। ঝুমু আর মুমুর হাত ধরে উঠে গেলাম ছাদে। আম্মু বোধহয় বিশ্রাম নিচ্ছে। নিক, এই সুযোগ।
ছাদে গিয়ে আমরা তিনজন দড়িলাফ খেলছিলাম। কে কার চেয়েও বেশি লাফ দিতে পারে, সেই প্রতিযোগিতা। এখন পর্যন্ত ওরা আমাকে হারাতে পারেনি, তবুও ওরা একটুও হতাশ হয় না। ওদের বক্তব্য, ওরা বড় হচ্ছে তাই এক সময় না এক সময় ওরা আমাকে ঠিক হারাবে। মুমু তৃতীয় শ্রেণি আর ঝুমু ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী। ওরা বড় হতে হতে আমি আরও বড় হয়ে যাবো। তখন তো খেলার সময়ই পাবো না আমি! এসব ভাবতে ভাবতে কানে একজনের কন্ঠ ঠেকলো। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখি অশুভ ভাইয়া। আজকে তার চেহারা আরও অশুভময় লাগছে। আমার কেমন যেন ভয় ভয় লাগছে। তাকে দেখলেই কেমন যেন ভয় লাগে।
সে আগের মতই রাগী মুখ করে বলল,
❝এই মেয়ে! তোমার এত সাহস কি করে হয় যে আমার নামে বিচার দাও?!❞
আমি মুমু আর ঝুমুর দিকে তাকালাম। ঝুমু বেশ চটপটে, তাই আমার হয়ে ও জবাব দিল,
❝আপু তো কোনো বিচার দেয় নি। আপনি আপুকে পঁচা পঁচা কথা কেন বলেন?❞
❝এইটুকু পিচ্চির তো সাহস কম না! এই মেয়ে, তোমার দেখি নাক টিপলেই দুধ পড়বে, আর তুমি কিনা তর্ক করছ আমার সাথে?❞
❝নাক টিপলে দুধ পড়ে না, হিঙ্গিস পড়ে। এত বড় হয়ে এটাও জানেন না?❞
আমরা তিনজন একত্রে হেসে উঠলাম। অশুভ ভাইয়া ধমক দিলেন,
❝এই তুতুন! তুমি আমার নামে তোমার মায়ের কাছে নালিশ কেন করেছ? জবাব দাও❞
❝আপনি আমাকে দুই শিং ওয়ালী কেন বলেছেন? আর আমি কি প্রেম করতে ছাদে আসি? আপনিই তো আমাকে আজেবাজে কথা বললেন!❞
❝কিসের আজেবাজে কথা, হ্যাঁ? দুই বেণী করলে তোমাকে দেখলে মনে হয় দুটো শিং গজিয়েছে! তাছাড়া তুমি ছাদে আসলেই তোমাদের পিছের ছাদে যে দুটো ছেলে উঠে, সেটা কি আমি দেখি না? তুমি কি আমাকে দুধের শিশু ভাবো? আমি বুঝি না ছেলেগুলো যে তোমার জন্যই উঠে?❞
আমি চমকে উঠলাম। সত্যি সত্যি আমি ছাদে উঠলেই আমাদের পেছনের দিকের তিন বিল্ডিং পরের ছাদে দুটো ছেলে ওঠে। আমিও খেয়াল করেছি, কিন্তু পাত্তা দেইনি। ছেলেগুলো উঠলে উঠবে, আমার কি?আমি তো ওদের দিকে তাকাই না। তাছাড়া আম্মু জানলে ছাদে উঠা বন্ধ করবে, এজন্যই কাউকে বলিনি। এই কথা অশুভ ভাইয়া কি করে জানলো? ভাইয়ার এরপরের কথা শুনে আমি কেঁপে উঠলাম। বেশ ঠান্ডা গলায় সে বলছে,
❝আমার নামে যে তোমার মায়ের কাছে বিচার দিয়েছ, তোমার মা এসে আমার মাকে বলেছে, এখন আমি যদি এই কথা তোমার মাকে বলি, তাহলে কেমন হবে?❞
আমি কেঁদে ফেললাম। কথায় কথায় কাঁদার বদঅভ্যাসের কারণে অনেক রকম ডাকনাম হয়ে গেছে আমার ইতিমধ্যে। অশুভ ভাইয়ার ঠোঁটে আমি অশুভ হাসি দেখতে পাচ্ছি। আমাদের দেখে ঝুমু আর মুমু থমকে গেছে। আমার মাকে বললে আমার কি হবে? আম্মু বলেছে, কখনো তার অগোচরে প্রেম করলে সে আমাকে জবাই করে বটি দিয়ে। আম্মু কি সত্যি সত্যি জবাই করবে? আমি এক হাতে এক চোখ চেপে কেঁদে দিলাম। শব্দ না করে নীরবে চোখ মুছছি কেবল। কান্নায় ব্যস্ত বলে অশুভ ভাইয়া কখন সেদিনের মতো করে এই ছাদে লাফিয়ে এসেছেন, তা টেরও পাইনি। উনি এসে আমার ডান হাত ধরতেই আমি লাফিয়ে পড়ে গেলাম ছাদে। উনি স্বাভাবিকভাবে বললেন,
❝এত ভয়ের কি আছে? এরপর থেকে আর কখনো আমার নামে তোমার আম্মুর কাছে ভুলেও বিচার দিবে না। বুঝতে পেরেছ?❞
আমি ছাদের মাটিতে পিছিয়ে গিয়ে মাথা নাড়ালাম। উনি মুমু আর ঝুমুর দিকে ফিরেও বললেন,
❝তোমরাও কিচ্ছু বলবা না। মনে থাকবে?❞
ওরাও মাথা নাড়ল। উনি আমার হাত ধরার জন্য হাত বাড়ালো। আমি সরে যেতে চাইলেও জোর করে হাত ধরে টান দাঁড় করালো। তারপর ভ্রু কুঁচকে বলল,
❝তোমার কি মাথায় সমস্যা? এত ভীতুর ডিম কেন তুমি? মায়ের কাছে আবার নালিশ দেয়ার সাহস তো ঠিকই আছে। এরপর থেকে ছাদে উঠলে মাথায় কাপড় দিয়ে রাখবে। আর ছাদের ঘরের এই পাশে খেলবে। এদিকে খেললে ঐ ছাদ থেকে দেখা যায় না। কি? মনে থাকবে?❞
উনি আমার হাত ধরে ঝাড়ি দিলেন। আমি ভয়ে জোরে জোরে মাথা নাড়লাম। আমার হাত ছেড়ে উনি লাফ মেরে আবার উনার ছাদে চলে গেলেন। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলাম। এতক্ষণে ঝুমুর মুখে বুলি ফুটলো।
❝আপু, তুমি ব্যথা পাইছ?❞
❝না, ব্যথা লাগে নি। কিন্তু তোর কি হলো? আমি তো ভীতু, কিন্তু তুইও যে কিছু বললি না?❞
❝কত্ত বড় একটা মানুষ! উনাকে আমি কি বলব? যদি মারে? কিভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে এই ছাদে চলে আসে! দেখলেই তো ভয় লাগে। এই ভাইয়াটা তোমাকে বকে কেন এত?❞
আমি ঠোঁট উলটে বললাম,
❝জানি না। মনে হয় আমি বোকা মানুষ তো, আমাকে বকতে সবার ভালো লাগে। ফোনে ভাইয়ারা বকে, আম্মু বকে, বড় চাচ্চু, মেঝ চাচ্চু, ছোট চাচ্চুও বকে। এখন শুভ, না না, অশুভ ভাইয়াও বকে!❞
মুমু আমার হাত চেপে ধরল।
❝আপ্পু! তুমি একদম মন খারাপ করবা না। আমার আম্মু বলছে দুধ খেলে তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যাবো। এখন থেকে আমি অনেক বেশি করে দুধ খাবো। তাপ্পর শুভ ভাইয়ার চেয়েও বড় হয়ে যাবো! এত্তত্ত বড় হয়ে যাবো! তাপ্পর শুভ ভাইয়াকে আমি মেরে দিব! তুমি মন খারাপ করবা না, থাক❞
মুমুর কথা শুনে আমি আর ও হেসে ফেললাম। ওদের দুজনের হাত ধরে বললাম,
❝আম্মু দেখলে বকবে। চলো আমরা বাসায় গিয়ে লুডু খেলব। ছাদে থাকতে ইচ্ছা করছে না❞
ঠিক করেছি মেট্রিক পরীক্ষা শেষ হওয়ার আগে পর্যন্ত আমি আর ছাদে যাবো না। ছাদে না গেলে ঐ ছেলেগুলোর ঝামেলাও থাকবে না, শুভ ভাইয়াও বকতে পারবে না, আম্মুও বকবে না। আমাকে গোল্ডেন জিপিএ ফাইভ পেতেই হবে। দিন রাত এত বকা খেলে পরে সব পড়া ভুলে যাবো। আমার ভুলে গেলে চলবে না, শুভ ভাইয়ার চেয়েও বড় ভার্সিটিতে আমাকে ভর্তি হতে হবে। নাহলে আম্মু আমাকে বকতে বকতে মেরে ফেলবে, একদম মেরে ফেলবে!
চলবে…