শেষ রাত পর্ব-১৯

0
1653

#শেষ_রাত
#পর্বঃ১৯
#সাইয়ারা_হোসাইন_কায়ানাত

‘তুলতুলের আম্মু একটু এদিকে আসুন তো।’

ধ্রুবর গলা ফাটানো ডাকে আমি দ্রুত পায়ে ছুটে আসলাম রুমে। ধ্রুব তার ঘামে ভেজা শরীরটা এলিয়ে দিয়েছে বিছানায়। দু হাত দু’দিকে ছড়িয়ে রেখে চোখ দুটো বন্ধ করে রাখা। পা দুটো বিছানার বাহিরে ঝুলছে। যেন কোনো বলহীন শরীর পরে আছে। আমি কিছুটা এগিয়ে এসে সহসা উদ্ধিগ্ন গলায় জিজ্ঞেস করলাম-

‘কি হলো ডাকছেন কেন? কিছু লাগবে?’

গত দু’দিন ধরে ভীষণ গরম পরেছে। উত্তপ্ত সূর্যের রশ্মি কাঁটার মতো বিঁধে যেতে চায় শরীরে। দিনের শেষ বেলাতেও এসে থেকে যায় প্রখর রোদের রেশ। ধ্রুব অফিস থেকে আসার মিনিটখানেক আগেই কারেন্ট গেছে। আধঘন্টা হতে চলল অথচ এখনও কারেন্ট আসার নাম নেই। তিনদিন ধরে গাড়ি না থাকায় এই তীব্র গরমেই রিকশায় যাতায়াত করছে সে। আব্বু বাসার গাড়ি নিয়ে সিলেট গেছে। আর অফিসের গাড়ি সে নিজের ব্যক্তিগত প্রয়োজনে ব্যবহার করতে নারাজ। নারী কর্মচারীদের জন্য রাখা গাড়ি যদি সে নিজেই ব্যবহার করে তাহলে রাতবিরেতে অফিসের মেয়েদের বাসায় পৌঁছে দেওয়ায় ঝামেলা হবে। অফিসের মেয়েদের নিরাপত্তা নিয়েও ধ্রুব বেশ সচেতন। এই নির্লিপ্ত মানুষটা যেন সব কিছুরই খেয়াল রাখে। নিজের অসুবিধে হলেও অন্যদের যেন কোনো অসুবিধে না হয়।

ধ্রুব উঠে দু’হাত পেছনের দিকে ভর দিয়ে বসলেন। তার শার্টের উপরে তিনটা বোতাম খোলা। বুকে জমে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘাম চিকচিক করছে। ক্লান্তিমাখা তার মুখ। ঠোঁটের কোণে তরল ভঙ্গির হাসি। তার বড় বড় চোখের ক্লান্তিমাখা বিষন্ন চাহনি স্থির করলেন আমার চোখে। ঠোঁট নাড়িয়ে অলস ভঙ্গিতে বললেন-

‘কেন! কোনো কারণ ছাড়া আপনাকে ডাকা বারণ বুঝি?’

আমি অপ্রস্তুত হয়ে বললাম-

‘না না তা কেন হবে! আসলে তুলতুলকে খাওয়াচ্ছিলাম তো তাই আরকি।’

ধ্রুব উঠে আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। ওনাকে কাছে আসতে দেখেই ভীষণ অস্বস্তিতে দৃষ্টি নামিয়ে নিলাম। তিনি ঝুঁকে তার মুখ নিয়ে এলেন আমার কানের কাছে। ফিসফিসিয়ে বললেন-

‘শুধু কি মেয়ের খেয়াল রাখলেই হবে? মেয়ের আব্বুকেও তো একটু সময় দিতে হবে।’

ধ্রুবর এতটা কাছে আসা আর তার ফিসফিসিয়ে কথা বলায় আমার নিঃশ্বাস ভারি হয়ে এলো। বুকের ধুকপুকানি তীব্রভাবে বেড়ে যেতে লাগল। পাজরের হাড়গোড় ভেঙে এখনই যেন হৃদপিণ্ডটা লাফাতে লাফাতে বেরিয়ে আসতে চাইছে। ভ্যাপসা গরমেও শরীরে শীতল হাওয়া বয়ে গেল। আমার শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাওয়া গলায় শুকনো ঢোক গিললাম। মাথা তুলে চোখ দুটো বড় বড় করে চাইলাম। লজ্জা মিশ্রিত দৃষ্টি যেয়ে স্থির হলো ধ্রুবর ঘামার্ত বুকে। চিরচেনা সেই পুরুষালী গন্ধ। যে গন্ধে এখন প্রতিদিন সকালেই আমার দেহের প্রতিটি লোমকূপ শিউরে ওঠে। চারদিন যাবৎ ঘুম থেকে উঠেলেই এই ঘামার্ত বলিষ্ঠ বুকে নিজেকে খুঁজে পাই৷ রাতে দুজন দু’পাশে ঘুমালেও ঘুম ভাঙতেই নিজেকে ধ্রুব বাহুডোরে বন্দী অবস্থায় আবিষ্কার করি। কখন আর কিভাবে এমনটা হয় তা আমার জানা নেই৷ রহস্যময় হয়ে থাকে আমার প্রতিটি সকাল।

‘এই যে তুলতুলের আম্মু! কোথায় হারিয়ে গেলেন?’

আমার ধ্যান ভাঙলো। আগ্রহ নিয়ে চাইলাম ধ্রুবর দিকে। আমার থেকে দুয়েক পা দূরত্বেই দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। ঠোঁটের কোণের মৃদু হাসিটা প্রসারিত হয়ে ছড়িয়ে পরলো চিবুকে সহ সাড়া মুখে। আমাকে নিরুত্তর দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ধ্রুব একটা শপিং ব্যাগ এগিয়ে দিয়ে শুধালেন,

‘এটা আপনার জন্য।’

আমি তার হাতের ব্যাগটার দিকে ভ্রু কুচকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে কৌতূহল নিয়ে প্রশ্ন করলাম-

‘কি এটা?’

‘আপনার জিনিস আপনি নিজেই খুলে দেখুন।’

ধ্রুব আমার হাতে ব্যাগ ধরিয়ে দিয়েই পূনরায় বিছানায় হাত পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে পরলেন। আমি বেশ আগ্রহ নিয়ে ব্যাগ খুলে দেখলাম। ধ্রুবর দিকে চোখ বড় বড় তাকিয়ে উৎকন্ঠিত হয়ে বললাম-

‘নতুন ফোন! কিন্তু ফোন দিয়ে কি করবো আমি?’

‘সেদিন তো একটা ফোনের হ’ত্যা করলেন। তাই দ্বিতীয় হ’ত্যা কার্য সম্পূর্ণ করার জন্য এটা এনে দিলাম। নিশ্চিন্তে পরিকল্পনা করে তারপরেই হ’ত্যা করবেন। তেমন কোনো তাড়াহুড়ো নেই।’

ধ্রুবর রসিকতায় আমি ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললাম-

‘আমার সাথে এসব রসিকতা না করলে কি ভালো লাগে না?’

ধ্রুব জবাব দিলেন না। সব সময়ের মতোই হাসলেন। আমি হতাশ হয়ে মিহি কন্ঠে বললাম-

‘আমার তো ফোনের দরকার ছিল না। শুধু শুধু কেন টাকা নষ্ট করে ফোন কিনে আনলেন আপনি?’

ধ্রুব উঠে আবারও আমার কাছে আসলেন। গভীর দৃষ্টিতে তাকালেন আমার প্রশ্নাত্মক চোখের দিকে। ঘামে কপালে লেপ্টে থাকা আমার চুলগুলো ঠিক করে দিয়ে উদাসীন গলায় বললেন-

‘এখন দরকার না থাকলেও কিছুদিন পর দরকার হবে। তোমার জন্য না হলেও আমার ভীষণ প্রয়োজন পরবে সানসাইন।’

ধ্রুব রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। আমি ওনার কথার মানে না বুঝে বিমূঢ় দৃষ্টি তার যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইলাম। মাঝেমধ্যে খুব অদ্ভুত আচরণ করেন উনি। ভীষণ প্যাচানো ধরনের কথাবার্তা বলে আমার মাথা এলোমেলো করে দেন। আমি কিছুই বুঝি না ওনার এমন প্যাচানো কথা। বুক চিড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো।

‘অনু আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’

খাবার টেবিলে মনি মা’র গম্ভীর কণ্ঠস্বর শুনে কিঞ্চিৎ বিস্ময় নিয়ে মাথা তুলে তাকালাম। সহসা খানিক কৌতূহল নিয়ে প্রশ্ন করলাম-

‘কিসের সিদ্ধান্ত মনি মা!’

‘দু’দিন পর থেকে তুই তোর মা’র বাসায় থাকবি। ধ্রুব তোর সব প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে দু’দিন পর তোকে ওই বাসায় দিয়ে আসবে।’

আমি হতভম্ব হয়ে স্থির বসে রইলাম। অবিন্যস্ত দৃষ্টিতে কখনো মনি মা, কখনো ধ্রুব আর কখনও আব্বুর দিকে তাকাতে লাগলাম। বোঝার চেষ্টা করলাম পরিস্থিতি। কিন্তু ব্যর্থ হলাম। সবাইকে স্বাভাবিক লাগছে। এ বিষয়ে আমি অবগত না থাকলেও তাদের মধ্যে এ নিয়ে অনেক আগেই আলোচনা হয়েছে তা তাদের ভাবগতি দেখেই বোঝা যাচ্ছে। আমি নিজেকে যথাসাধ্য সামলিয়ে নিয়ে ক্ষীণ স্বরে বললাম-

‘কি বলছো মনি মা? ওই বাসায় কেন থাকবো?’

মনি মা জবাব দিলেন না। আমি উত্তরের আশায় ঘাড় বাঁকিয়ে পাশে তাকালাম। ধ্রুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই খাচ্ছেন। মনি মা আর আমার কোনো কথাই যেন তার কানে যাচ্ছে না। মনি মা তার আচল দিয়ে তুলতুলের মুখ মুছে গম্ভীরমুখে বললেন-

‘যা বলছি ঠিক বলছি। পাঁচ দিন পর তোর এক্সাম। এখানে থাকলে তোর পড়াশোনা কিছুতেই হবে না। সারাক্ষণ তুলতুলকে নিয়ে ব্যস্ত থাকবি। পরিক্ষার পড়া কিছুই পড়তে পারবি না৷ বিয়ের জন্য পড়াশোনায় এমনিতেও অনেক পিছিয়ে গেছিস৷ তা ছাড়া এখান থেকে তোর ভার্সিটি অনেকটা দূর হয়ে যায়৷ প্রতিদিন এতটা পথ জার্নি করে পরিক্ষা দেওয়ার কোনো মানেই হয় না। তাই আমি ঠিক করেছি পরিক্ষা শেষ না হওয়া অব্দি তুই ওই বাসায় থাকবি।’

আমি ভড়কে গেলাম। ভীষণ অস্থির হয়ে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলাম। তুলতুল আর বাকি সবাইকে ছাড়া থাকবো ভেবেই বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যথা অনুভব করলাম। গলার স্বর আটকে গেল। কি বলবো না বলবো কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না। দলা পাকিয়ে গেল সব কিছু। চোখদুটো ভীষণ আবেগে ঝাপসা হয়ে এলো৷ মনি মা আমার প্রতিত্তোরে অপেক্ষা করলেন না। তুলতুলকে কোলে নিয়ে চলে গেলেন রুমে। আমি আহত দৃষ্টিতে একবার ধ্রুবর দিকে দিকে আরেকবার আব্বুর দিকে তাকালাম। আব্বু খাওয়া শেষে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন-

‘মন খারাপ করিস না মা। তোর মা এসব নিয়ে অনেক বেশি সিরিয়াস। নিজের সিদ্ধান্তে সব সময়ই অটল থাকবে। কারও কোনো কথাই শুনবে না।’

একে একে সবাই চলে গেল। আমি এখনও স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম। ধ্রুবও কিছু বললেন না। একবারও মনি মা’কে বাধা দিলেন না। আমাকে আশ্বস্ত করার জন্যেও কিছু বললেন না। কেন এমন নিষ্ঠুরতা করছেন আমার সাথে? আমি কোনো রকম ডাইনিং টেবিলের সব কিছু গুছিয়ে ড্রয়িং রুমে আসলাম। ধ্রুব আর আব্বু সোফায় বসে অফিসের কাজ নিয়ে আলোচনা করছেন। আমি দীর্ঘ শ্বাস ফেলে মনি মা’র রুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালাম। দরজার কাছে এসেই থমকে দাঁড়ালাম। ভয় করছে খুব। বুক ধুকপুক ধুকপুক করছে তীব্র গতিতে। চেনা মানুষটাকেও ভীষণ অচেনা লাগছে। ভয় লাগছে। আমি ইতস্তত করে বললাম-

‘মনি মা আসবো?’

‘আমার রুমে আসতে অনুমতি নেওয়া শুরু করলি কবে থেকে? থাপ্পড় খেতে না চাইলে চুপচাপ এসে বস এখানে।’

মনি মা দারুণ বিরক্তি নিয়ে কথা গুলো বললেন। তবে একবারের জন্যেও আমার দিকে ফিরে তাকালেন না। আমি থমথমে পায়ে রুমে এসে বিছানার এক পাশে কাচুমাচু হয়ে বসলাম। অনেক কথা বলার আছে। তবে মুখ ফুটে কিছু বলতে পারলাম না। মনি মা তুলতুলের মাথায় তেল দিতে দিতে সহজ গলায় বললেন-

‘আমি জানি তুই কি বলতে চাচ্ছিস। কিন্তু তার আগে আমার কিছু কথা আছে তোকে বলার জন্য। সে গুলো মনোযোগ দিয়ে শুনবি তারপর তোর যা ইচ্ছে হয় করিস।’

চলবে…

[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। ভালো মন্দ যেমনই হোক নিজেদের মন্তব্য জানাবেন সাবলীল ভাষায়। আমি আমার ভুল শুধরে নেওয়ার চেষ্টা করবো। সবাইকে ধন্যবাদ আর ভালোবাসা।❤️❤️]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here