শেষ রাত পর্ব-২৫

0
1660

#শেষ_রাত
#পর্বঃ২৫
#সাইয়ারা_হোসাইন_কায়ানাত

ধ্রুব খুব আশ্চর্যজনক ভাবে নিজের গাম্ভীর্যতা লুকিয়ে ফেললেন। ঠোঁটের কোণে এক চিলতে সরল হাসি ঝুলিয়ে এগিয়ে এলেন আমাদের দিকে। আমার সামনে আসা মাত্র তুলতুল আর এক মুহুর্তও অপেক্ষা করলো না। ধ্রুবর কাছ থেকে লাফিয়ে এসে পরলো আমার কোলে। আমি তৃপ্তির হাসি দিলাম। মেয়েটা কত সুন্দর ভাবেই না আমার সারা মুখে আদরের ছোঁয়া দিয়ে দিচ্ছে। কেন যেন মনে হচ্ছে মেয়েটা বেশ বড় হয়ে গেছে। যদিও এই বিশ দিনে বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছে তুলতুলের সঙ্গে। তবে আজ ভিন্ন লাগছে। চুল গুলো বড় হয়েছে বোধহয়। খুব নিখুঁত ভাবে তার বড় বড় চুল গুলোতে সিঁথি কেটে দু’টো ঝুটি করা হয়েছে। আমি বুঝতে পারলাম এই নিখুঁত কাজ আর কারও নয় ধ্রুবর। ঘন্টা খানেক সময় লাগিয়ে হলেও সে খুব নিখুঁতভাবেই তুলতুলের চুল বাধার কাজ সম্পূর্ণ করেন। খুব উৎসাহ নিয়েই এই কাজ করেন। বিয়ের পর থেকে এমনটাই দেখেছি। একবার না পারলে বার বার চেষ্টা করেন। আর তুলতুলও লক্ষী মেয়ের মতো চুপচাপ বসে থাকে। একটু বিরক্তি প্রকাশও করে না।

‘কেমন আছো সাদাফ?’

ধ্রুবর কন্ঠস্বর শুনে আমার দৃষ্টি সেদিকে দিলাম। দেখলাম ধ্রুব সাদাফকে জড়িয়ে ধরে আন্তরিক ভঙ্গিতে কথা বলছেন। সাদাফের মুখেও হাসি তবে সেটা অপ্রস্তুত কৃত্রিম হাসি। ওনারা একে অপরের হালচাল জিজ্ঞেস করে পাশের বেঞ্চিতে বসলেন। আমিও তুলতুলকে কোলে নিয়ে সামনের বেঞ্চিতে বসলাম। দূর থেকেই সংকোচিত মনে ধ্রুবকে লক্ষ্য করতে লাগলাম৷ তার কথা বলার ধরনে সুখী সুখী ভাব। মুখটাও বেশ হাসি হাসি। তাকে দেখে বোঝার উপায় নেই তিনি তার স্ত্রী’র প্রাক্তনের সঙ্গে কথা বলছেন। খুব কাছের বন্ধুর সাথে অনেক দিন পর দেখা হলে যতটা আন্তরিকতা প্রকাশ করা প্রয়োজন ঠিক ততটাই তাদের মাঝে দেখা যাচ্ছে। সাদাফ নিজেও এখন সহজ হয়ে এসেছে। কোনো জড়তা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। কথা বলার মাঝেমধ্যেই তুলতুলের তীব্র চিৎকারে বিস্ময় নিয়ে আমাদের দিকে তাকাচ্ছে। আবারও চোখে ফিরিয়ে নিচ্ছে স্বাভাবিকভাবেই।

‘তা কি করছো এখন? কোথাও কি ট্যুরে গিয়েছিলে এই কিছুদিনের মধ্যে?’

ধ্রুবর এই সহজ প্রশ্নেও সাদাফের মাঝে বিষন্ন ভাব এসে পরলো। মাটির দিকে চেয়ে ম্লানমুখে বলল-

‘নাহ ট্যুরে এখন আর যাওয়া হয় না। ঠিক করেছি কানাডা একেবারে সেটেল্ড হয়ে যাবো। কাল রাতেই ফ্লাইট। দেখি সেখানে আব্বুর কোনো কাজে আসতে পারি কি-না।’

সাদাফের জবাবে ধ্রুব কিছুটা সময় চুপ করে রইলো। ভ্রু কুচকে ক্ষীণ স্বরে জিজ্ঞেস করল,

‘আমার জানা মতে ধরাবাঁধা নির্দিষ্ট নিয়মে চলা এমন জীবন তোমার পছন্দ না। তাহলে হঠাৎ করেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়াটা কি ঠিক হচ্ছে?’

সাদাফ আড়চোখে আমার দিকে একঝলক তাকালো। তার এই তাকানোর মাঝে ছিল আমার প্রতি অভিযোগ কিংবা তীব্র অভিমান। সাদাফ অদূরে দৃষ্টি দিয়ে আক্রোশ ভরা কন্ঠে বলল-

‘সব সময় পছন্দ অপছন্দ এক থাকে না। পরিস্থিতির সাথে সাথে পছন্দের জিনিসও একটা সময় অসহনীয় হয়ে ওঠে। পছন্দের না হলেও কিছু সিদ্ধান্ত পরিস্থিতির কারণে নিতে হয়।’

আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। খেয়াল করলাম ধ্রুব আমার দিকেই নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে আছেন। শান্ত শীতল তার চাহনি। মুখের হাসিটা এখন আর নেই৷ হয়তো সাদাফের চলে যাওয়ার কথায় কিছুটা অবাক হয়েছেন। হয়তোবা আমার ভাবভঙ্গি বোঝার চেষ্টা করছেন। ধ্রুব আমার দিকে চেয়েই গাঢ় স্বরে বললেন-

‘আমি সোজাসাপ্টা কথা বলার মানুষ। ঘুরিয়ে পেচিয়ে আমি কথা বলতে পারি না। তাই যা বলার কোনো প্রকার বিনীতা ছাড়াই বলবো। হয়তো আমার কথায় বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি হবে। তবে কিছু কথা বলা প্রয়োজন বলেই আমি বলতে চাচ্ছি।’

সাদাফ হাল্কা করে মাথা নাড়লো। আমি বেশ আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছি ধ্রুবর দিকে৷ উনি ঠিক কি বলতে চাচ্ছেন তা-ই বোঝার চেষ্টা করছি। ধ্রুব আমার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সাদাফের দিকে স্থির করলেন। অত্যন্ত সহজ গলায় বললেন-

‘আমি তোমার অতীত সম্পর্কে সবটাই জানি। হয়তো আমি তোমাকে তোমার অতীত আর অনন্য কোনোটা-ই ফিরিয়ে দিতে পারবো না। তবে আমি চাইনা তোমাদের মনে একে অপরের প্রতি তিক্ততা থাকুক। কোনো না কোনো কারণে বিচ্ছেদ যেহেতু হয়েছে সেটা মেনে নিয়েই তোমরা নতুন ভাবে জীবন শুরু করো সেটাই আমি চাই। তুমি আমার ফ্রেন্ড। অল্প দিনের হলেও আমার খুব কাছের ফ্রেন্ড। আমার চোখের সামনে তুমি ভেঙে পরবে সেটা আমি দেখতে পারবো না। আশাকরি তুমি আমার কথা বুঝতে পারছো।’

‘এসব বলা খুব সহজ তাই না! তবে মেনে নেওয়া কি এতটা-ই সহজ? কাউকে এতটা ভালোবাসার পর তাকে ভুলে যাওয়া কি সত্যিই সম্ভব? তুমি কি বুঝবে আমার যন্ত্রণা ধ্রুব! হয়তো বুঝবে না। কারণ আমার জায়গায় তো তুমি নও। বিচ্ছেদের তীব্র কষ্ট। অবাঞ্ছিত কিছু যন্ত্রণা দিন দিন ঘুনে পোকার আমাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। তিল তিল করে শেষ হয়ে যাচ্ছি আমি। এসব কি বুঝবে তুমি?’

ধ্রুব নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে রইলো সাদাফের দিকে। নিরুত্তর তার দৃষ্টি। আমি চুপচাপ বসে তাদের কথা শুনছি। তাদের কথার মাঝে কথা বলার কোনো প্রয়োজন বোধ মনে হলো না বলেই আমি নিশ্চুপ। তুলতুল বেলুন নিয়ে খেলছে। এদিক ওদিক ছুটোছুটি করছে। সব সময়ের মতো আজ সেই পে পু শব্দ করা জুতো পায়ে নেই। ভালোই হয়েছে আজ সেই জুতো না পরায়। জুতোর তীক্ষ্ণ পে পু শব্দে হয়তো তাদের কথার মাঝে ব্যাঘাত ঘটাতো। অবশ্য এই পর্যন্ত দু বার বেলুন ফুটিয়ে তুলতুল আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তবে এতে তুলতুলের মাঝে কোনো ভাবান্তর নেই। সে নিজের মতোই খিলখিল করে হাসছে। প্রাণোচ্ছল হাসি।

‘আমি বুঝতে পারি অনন্যর তীব্র যন্ত্রণা কেমন ছিল। তার চোখে দেখেই আমি সবটা বুঝে ফেলি। কিছুদিন পর পর তোমার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করায় প্রতিবারই বিচ্ছেদের যন্ত্রণায় ছটফট করেছে সে। তার চেয়েও বেশি যন্ত্রণাদায়ক ছিল তাকে অপেক্ষায় রেখে বন্ধুদের সাথে তোমার আনন্দে থাকার মুহূর্ত গুলো ভাবা। প্রতিবার তার অনুভূতি, অপেক্ষা, অভিমান সব কিছুকে পুরোপুরি অগ্রাহ্য করে তোমার চলে যাওয়া। তীব্র যন্ত্রণাদায়ক ছিল। নির্ঘুম রাত ছিল তার সাক্ষী। তুমি কি খেয়াল করে দেখো নি তোমার ভালোবাসার মানুষের চোখ দুটো! বিষন্নতায় আঁধার হয়ে যাওয়া তার মুখখানা দেখে তোমার বুকে ব্যাথা হয়নি?’

সাদাফ প্রত্যুত্তর করলো না। মূর্তি ন্যায় স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো। এতগুলো বছর এই প্রশ্নগুলো করতে চেয়েও আমি সাদাফকে করতে পারিনি। হয়তো তার কাছে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর নেই। এইজন্যই হয়তো দৃষ্টি নামিয়ে চুপ করে বসে আছে। ধ্রুব আমার নির্লিপ্ত চোখের দিকে চেয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসলেন। তার দৃষ্টি স্থির রেখেই অতি নরম গলায় বললেন-

‘আমি খেয়াল করেছি সবটাই। তার বিষাদগ্রস্ত মুখ, তার উদাসীন দৃষ্টি, গাঢ়তর কালি পড়া ক্লান্ত চোখ সবটাই খেয়াল করেছি। হঠাৎ হেসে সেই হাসি আবার মিলিয়ে যাওয়ায় আমার বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যথাও অনুভব করেছি। আমি জানি না তুমি কিভাবে অনন্যকে উপেক্ষা করেছো বা করতে পেরেছো। তবে আমি পারিনি। অনন্যকে দেখার পর আমার আর অন্য কোনো কিছুর প্রতিই মায়া কাজ করেনি। এই মেয়েটাকে ভালোবাসার পর আর কোনো কিছুকেই ভালোবাসতে ইচ্ছে করেনি। প্রকৃতিকে ভালোবাসতে ইচ্ছে করেনি। ট্যুরে যেতে ইচ্ছে করেনি। এই মেয়েটার মাঝেই আমি আমার সারা পৃথিবীর মুগ্ধতা খুঁজে পেয়েছি। ওকে ভালোবাসার পর পাহাড় পর্বত, সমুদ্র, আকাশ, মেঘ, বৃষ্টি সব কিছুই অনন্যর সামনে তুচ্ছ মনে হয়। ওর চোখের দিকে তাকালেই বিশাল এক সাগর দেখতে পাই। নীল আকাশ দেখতে পাই। ওর চোখদুটো দেখে আমি পারিনি বেশিক্ষণ নিজের বেপরোয়া স্বভাবটাকে আঁকড়ে ধরে রাখতে। প্রকৃতিকে ভালোবেসে সব সময়ের মতো উড়নচণ্ডী হয়ে থাকতে পারিনি। তুমি পেরেছো তবে আমি পারিনি। হয়তো এই দিক দিয়ে তুমি আমাকে ব্যর্থ ভাবতে পারো। আমি একদিনও ওকে ছাড়া থাকতে পারছি না। এতেই আমার ঘুম উড়ে যাচ্ছে। অল্প কিছুদিনের দূরত্বেই ভালোবাসার তীব্রতা অনুভব করতে পারছি। এই মেয়েকে ছাড়া একমুহূর্তে ভালো থাকা আমার জন্য অসম্ভব। তুমি কি বুঝতে পারছো ভালোবাসার পার্থক্যটা! তোমার উচিত নিজের ভুল গুলো শুধরে নেওয়া। পরের বার কাউকে ভালোবাসলে তার মাঝেই নিজের পৃথিবী খোঁজার চেষ্টা করা। যদি নিজের আনন্দ, উল্লাস, মুগ্ধতা সব কিছু কারও মাঝে খুঁজে পাও তখন বুঝবে তোমার ভালোবাসার প্রখরতা।’

আমি মুগ্ধ হলাম। ধ্রুবর প্রতিটি কথায় আমি আবারও নতুন করে ভালোবাসার মানে খুঁজে পেলাম। ধ্রুবর চাহনিতে এক রাশ মুগ্ধতা দেখলাম। আমি আবারও ভালোবাসা শিখলাম নতুন করে। ধ্রুব নামক ভালোবাসা। কিছু নতুন নতুন অনুভূতির সঙ্গে পরিচিত করালো আমাকে। আমাকেও কেউ এতটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করে ভেবেই অভিভূত হলাম। আমার মাঝেও কেউ তার পৃথিবী খুঁজে পায় শুনেই নিজেকে কারও সুখের কারণ হিসেবে মনে করলাম। এই বুঝি আমি আবারও প্রেমে পরলাম। খুব ভয়ংকর ভাবেই পরলাম। আমি বুঝি নিজেকে আত্মসমর্পণ করলাম ধ্রুবর ভালোবাসার কাছে!
সাদাফ মাথা নত করে আছে। হয়তো সে বুঝতে পেরেছে তার ভুল। কেউ কোনো কথা বলছে না। এবার সত্যিই বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি হইলো। তবে বেশিক্ষণ আর এমনটা থাকলো না। তুলতুল সাদাফের কাছে যেয়ে তার কোলে ওঠার জন্য শার্ট ধরে টানছে। সাফাদ দৃষ্টি তুলে তুলতুলের দিকে চাইলো। খুব যত্নসহকারেই তাকে কোলে তুলে নেয় হাসি মুখে। পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে এলো। তবে ধ্রুবর শান্ত শীতল চাহনি এখনও আমার মাঝেই নিবদ্ধ হয়ে থাকলো।

‘আপনি কি আমার উপর রেগে আছেন?’

আমার প্রশ্নে ধ্রুব কাঠকাঠ গলায় জবাব দিলেন-

‘না, আপনার উপর রেগে থাকার কোনো কারণ নেই।’

আমি ভ্রু কুচকে সন্দিহান কন্ঠে বললাম- ‘রেগে না থাকলে মুখ এমন অন্ধকার করে রেখেছেন কেন?’

ধ্রুব কোনো প্রকার প্রত্যুত্তর করলেন না। চুপচাপ সামনের দিকে চেয়ে ড্রাইভ করছেন। আমি হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে তুলতুলের দিখে চাইলাম। ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পরেছে মেয়েটা। সাদাফকে ছেড়ে কিছুতেই আসতে চাচ্ছিলো না। গলা জড়িয়ে ধরে সে কি কান্না। আমি শুধু অবাক হয়ে দেখছিলাম ওর কান্ডকারখানা। মেয়েটা অল্পতেই সবার সাথে মিশে যায়। মেয়ে, মেয়ের বাবা, দাদা-দাদি সবার মাঝেই এত ভালোবাসা আসে কোত্থেকে! সবার প্রতি তাদের ভালোবাসার আর সীমা থাকে না। সে অচেনা হলেও তারা আপন করে নিতে একটুও সময় নেয় না। আমি ছোট করে একটা শ্বাস ফেলে তুলতুলের কপালের চুল গুলো সরিয়ে দিলাম। ভালো করে আগলে নিলাম তাকে৷ ধ্রুবর দিকে চেয়ে মলিন কন্ঠে বললাম-

‘আমি বুঝিতে পারছি আপনি আমার উপর রেগে আছেন। তবে আমি সত্যি করে বলছি আমি ইচ্ছে করে সাদাফের সাথে দেখা করিনি। আমি জানতাম না ও এখানে আসবে।’

ধ্রুব কড়া গলায় বললেন- ‘বললাম তো আমি রেগে নেই।’

‘এই তো রাগ দেখিয়ে কথা বলছেন আমার সাথে। তাহলে মিথ্যা কেন বলছেন যে রেগে নেই!’

ধ্রুব বিরক্তি নিয়ে তাকালেন আমার দিকে। আমার কথায় তিনি ভীষণ বিরক্ত হচ্ছেন সেটা ওনার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে।

চলবে…

[রিচেক করা হয়নি। ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। সবাইকে ধন্যবাদ আর ভালোবাসা।❤️]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here