#শেষ_রাত
#পর্বঃ৭
#সাইয়ারা_হোসাইন_কায়ানাত
‘এই যে শুনছেন! সকাল হয়ে গেছে। ঘুম থেকে উঠুন।’
আমার ডাকে ধ্রুব খানিকটা নেড়েচেড়ে আরও গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হলেন। আমি চায়ের কাপ টেবিলের উপরে রেখে আবারও ডাকলাম।
‘তুলতুলের আব্বু আপনার চা পাঠিয়েছে মনি মা। ঘুম থেকে উঠুন। অনেক বেলা হয়ে গেছে।’
কি আশ্চর্য! সাড়ে আটটা বেজে যাচ্ছে অথচ তিনি এখনও বেঘোরে ঘুমাচ্ছেন। পর পর কয়েকবার ডাকার পরেও ওনার ঘুমে ব্যাঘাত ঘটাতে পারলাম না। আমার ডাক কি ওনার কান অব্দি পৌঁছাচ্ছে না! নাড়াচাড়াও তো করছে না এখন। ম’রে টরে গেল না-কি!! আমার ভ্রু জোড়া ঈষৎ কুচকে এলো। সরু চোখে তাকিয়ে ওনাকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলাম। নাহ, ধ্রুব একদমই নড়ছে না। বিছানার সাইডে বসে খানিকটা ঝুঁকে ওনার নাকের কাছে হাত রাখলাম। ঠিক মতোই তো শ্বাস নিচ্ছে। ম’রেও তো যায়নি। আমি আরেকটু ঝুঁকে এসে বিস্ময় নিয়ে নরম সুরে আবারও ডাকলাম-
‘তুলতুলের আব্বু!’
এবারও তার কোনো হেলদোল হলো না। ম’রার মতো পরে পরে বেঘোরে ঘুমাচ্ছেন। বিরক্তবোধ করলাম খুব। বিরক্তিতে তিতিয়ে উঠলো আমার মেজাজ। ক্ষিপ্ত হয়ে ওনার হাত ধরে ঝাকুনিয়ে দিয়ে শক্ত গলায় বললাম-
‘আরে ভাই উঠুন না! এত ঘুমান কীভাবে আপনি!’
ঝট করেই ভূতের মতো তৎক্ষনাৎ চোখ মেলে তাকালেন ধ্রুব। এহেন কাজে খানিকটা হকচকিয়ে গেলাম আমি। চোখজোড়া আপনাআপনিই বড় হয়ে গেল। ড্যাবড্যাব করে ওনার মুখের দিকে চেয়ে রইলাম। এভাবে কেউ ঝট করে চোখে মেলে তাকায় নাকি অদ্ভুত! ধ্রুব আমার দিকে চেয়ে ঘুম জড়ানো কন্ঠে বললেন-
‘এভাবে ডাকলে কেউ ঘুম থেকে উঠবে না বরং আরও আরাম করে ঘুমাবে তুলতুলের আম্মু।’
আমার চাহনি তীক্ষ্ণ থেকেও তীক্ষ্ণ হলো। আগের মতোই তাকিয়ে রইলাম ধ্রুবর দিকে। ধ্রুব কিছুটা নেড়েচেড়ে উঠে তার দৃষ্টি সরিয়ে নিলেন। অত্যন্ত সহজ গলায় বললেন-
‘আমার পারসোনাল হাতটা ছেড়ে দিন। আমি উঠবো এখন।’
আমি পিটপিট করে তার হাতের দিকে দৃষ্টি দেই। এতক্ষণে খেয়াল হলো আমি এখনও ওনার বা হাত চেপে ধরে ঝুঁকে আছি। আমার মস্তিষ্ক ব্যাপারটা বুঝতে পেরেই তটস্থ হাত সরিয়ে নিয়ে সোজা হয়ে বসলাম। অপ্রস্তুত হয়ে আশেপাশের দিকে নজর দিয়ে চোখ সরিয়ে নিলাম অন্যত্র। পরক্ষণেই ধ্রুবর কথা পুরোপুরি বুঝতে পেরে খানিকটা রাগ হলো। পারসোনাল বুক, পারসোনাল হাত এসবের মানে?? ওনার বুক, ওনার হাত-পা সব তো ওনারই। আমি কি কখনও বলেছি ওসব আমার! তার শরীরে উপর দখল বসিয়েছি নাকি যে বার বার পারসোনাল পারসোনাল বলে চিল্লাপাল্লা করতে হবে। কথা গুলো ভেবেই রাগে চিড়বিড় করে উঠলো আমার সারা শরীর। নিজের হাতের উপরেই রাগ হচ্ছে ভীষণ। কেন ওনার পারসোনাল বডিকে ধরতে গেলাম। নিজের রাগ সংযত করে গম্ভীর কণ্ঠে বললাম-
‘আপনার চা টেবিলে রাখা আছে। ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নিয়েন। আমি আসছি।’
আমি বিছানা থেকে উঠে পা বাড়ালাম দরজার দিকে। তখনই ধ্রুবর আকর্ষণকাড়া ডাকে থমকে দাঁড়ালাম।
‘তুলতুলের আম্মু শুনুন!’
আমি পেছন ফিরলাম। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম ওনার শান্ত শীতল মুখের দিকে। ঘুম জড়ানো ফোলা ফোলা চেহারা। এলোমেলো হয়ে আছে তার চুল। টিশার্ট ঠিক করতে করতে তিনি বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। কন্ঠে হতাশা নিয়ে বললেন-
‘মেয়েদের মুখের ভাই ডাক ছেলেদের কলিজায় তীরের মতো করে বিঁধে। আর আপনি তো আমার বউ। একমাত্র বউ। বউয়ের মুখে ভাই ডাক শোনা মানে হৃদপিন্ডটা মেঝেতে রেখে পাথর দিয়ে আঘাত করে সেটাকে ক্ষত-বিক্ষত করা। হৃদয় ভেঙে চুরমার করে ফেলার মতো যন্ত্রণাদায়ক এই ভাই ডাক। আশাকরি এতটা নিষ্ঠুর আপনি হবেন না। দয়া করে ভাই না ডেকে আমার হৃদয়টাকে রেহাই দিন।’
ধ্রুব ওয়াশরুমে চলে গেলেন। আর আমাকে রেখে গেলেন হতভম্ব অবস্থায়। ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম সেদিকে তাকিয়ে। লোকটা কি বলে গেলেন এসব! শুধু একবার ভাই ডাকার জন্য এত জ্ঞান! এত লেকচার!! এ কেমন উম্মাদের সাথে বিয়ে হলো আমার? কি সব উদ্ভট আচরণ তার। মাথায় গণ্ডোলা আছে নিশ্চয়ই। স্বাভাবিক মানুষ বলে তো মনেই হয় না। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। থমথমে পায়ে বেরিয়ে এলাম রুম থেকে।
———————
‘তুলতুল পাখি আমি অফিস যাচ্ছি। তুমি একদম দুষ্টুমি করবে না ঠিক আছে! আর আমাকে মিস করবে বেশি বেশি।’
ধ্রুবর কথাতে তুলতুলের মাঝে কোনো আগ্রহ দেখা গেল না। সে আগের মতোই বিছানার ঠিক মাঝে বসে আপনমনে খেলছে। তুলতুলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে না পেরে ধ্রুব কপাল কুচকালেন। বিছানায় ভর দিয়ে তুলতুলের দিকে ঝুঁকে এসে আলতো করে গালে চুমু দিলেন। এতে বোধহয় তুলতুল খানিকটা বিরক্ত হলো। সঙ্গে সঙ্গেই হামাগুড়ি দিয়ে চলে আসলো আমার কাছে। মাম্মা মাম্মা বলে আমার কলে উঠে বসলো। ধ্রুব দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তুলতুলের দিকে চেয়ে উদাসীন গলায় বললেন-
‘সব সময় শুধু মাম্মা মাম্মা মাম্মা। আমি তো শুধু নামেই তুলতুলের আব্বু। সব ভালোবাসা তো শুধু মাম্মার জন্যই৷ বাড়ির কারো কাছেই এখন আর আমার মূল্য নেই। সবাই শুধু নতুন বউয়ের পেছনে ঘুর ঘুর করে। আমার আর এখানে থেকে কি লাভ? আমি যাই। থাকুন আপনারা দু’জন।’
আমি নিঃশব্দে মনোযোগ সহকারে ধ্রুবর কথা গুলো শুনলাম। তবে কিছু বললাম না। তার অসহায়ত্বের কথা শুনে ঠোঁট চেপে হাসলাম। ধ্রুব আড় চোখে দেখলেন আমাকে। ভারি কন্ঠে বললেন-
‘আমি যাচ্ছি তুলতুলের মাম্মা। আর আপনি যত পারেন সবাইকে নিজের দলে নিয়ে নিন। শুধু বাড়ির সবাইকে না পুরো এলাকাবাসীকে নিজের পক্ষে করে নিন।’
আমার হাসি চেপে রাখার চেষ্টা ব্যর্থ হলো। খুব চেষ্টা করেও হাসি দমিয়ে রাখতে পারলাম না। শব্দ করেই ফেললাম। আমার দেখাদেখি তুলতুলও হাসলো খিলখিল করে। ধ্রুব কিছুক্ষণ স্থির চেয়ে থেকে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন নিঃশব্দে। আমি এখনও হেসেই যাচ্ছি৷ বহুদিন পর প্রানখুলে হাসতে চাইছে আমার বিষন্ন মন। বিষন্নতা কাটিয়ে আগের মতোই একটু হাসলাম।
চোখের পলকেই বিয়ের এক সপ্তাহ কেটে গেল। এই এক সপ্তাহ অফিসের কাজ থেকে সম্পূর্ণভাবে দূরে ছিল ধ্রুব। এই ছুটি অবশ্য ওনার আব্বুই দিয়েছেন ওনাকে। আব্বুর অফিসেই কাজ করেন তিনি। ধ্রুব ছুটি নিতে না চাইলেও আব্বুর কড়া গলায় তিনি বাসায় থাকতে বাধ্য হলেন। ছুটির দিন গুলো সারাদিন তুলতুলকে নিয়েই কাটয়েছেন। আর মাঝেমধ্যে হুটহাট করেই বাহিরে চলে যেতেন। আমি জানতে যাইনি কোথায় যান, কি করেন কিছুই না। তার শর্ত মেনেই চলছি আমি। তার স্বাধীনতায় বাধা দিচ্ছি না। তবে সব কিছুর মাঝে একটা বিষয়ে একটু কৌতূহল ছিল। তুলতুল ধ্রুবকে সব সময়ই মাম্মা ডাকে। বাবা বলে কখনই ডাকেনি। একারণে ধ্রুবর মনে হয়তোবা কিছুটা আক্ষেপ ছিল। যদিও তা কখনও প্রকাশ করেনি৷ তবে আজকের কথায় খানিকটা মন খারাপের আভাস পেয়েছি।
‘মা মেয়ে মিলে এভাবে হাসছিস কেন?’
মনি মা’র কথায় আমি হাসি থামিয়ে ফেললাম। দরজা দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম মনি মা কপাল কুচকে তাকিয়ে আছেন আমাদের দিকে। আমি নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে বললাম-
‘তেমন কিছু না মনি মা। আসো, ভেতরে এসে বসো আমাদের সাথে।’
মনি মা ভেতরে এলেন। আমার পাশে বসে বললেন-
‘ভার্সিটিতে যাবি কবে থেকে? এক সপ্তাহ হয়ে গেছে বিয়ের। পড়াশোনা তো মনে হচ্ছে একদমই ছেড়ে দিয়েছিস।’
ভার্সিটির কথা মনে পরতেই সর্বপ্রথম সাদাফের কথা মাথায় আসলো। সাদাফের সাথে কাটানো মুহুর্ত গুলো একের পর এক এসে মস্তিষ্কে হানা দিতে লাগল। আবারও সেই পুরনো ব্যথা জাগ্রত হলো মনে। মনি মা’র দৃষ্টি আমার দিকে স্থির থাকায় নিজেকে যথাসাধ্য স্বাভাবিক রাখতে চাইলাম। ছোট করে তপ্ত শ্বাস ফেলে ক্ষীণ স্বরে বললাম-
‘যাবো কিছুদিন পর। তুমি এসব নিয়ে চিন্তা করো না।’
‘আবার কিছুদিন পর কেন? এমনিতেই অনেক গুলো ক্লাস মিস দিয়েছিস৷ আমি তোর মা’কে কথা দিয়েছিলাম বিয়ের জন্য তোর পড়াশোনায় কোনো প্রকার ক্ষতি হতে দিবো না৷ এখন তুই যদি ঠিক মতো পড়াশোনা না করিস তখন আমাকে সবার কাছে ছোট হতে হবে।’
আমি মনি মা’র হাত ধরে আশ্বস্ত করে বললাম-
‘চিন্তা করো না মনি মা। আমি ঠিক মতোই পড়াশোনা করবো।’
মনি মা আমার মাথায় বুলিয়ে দিলেন। আমি ম্লান হেসে মনে মনে ভাবতে লাগলাম কিভাবে ভার্সিটিতে যাবো৷ সাদাফের মুখোমুখি হবো কিভাবে? কি হবে আমাদের কথা? সাদাফ বিশ্বাস করবে আমার বিয়ের কথা? হয়তো করবে না। ভাববে তার অনু পাখি তার উপর অভিমান করে এসব মিথ্যা নাটক করছে। একটু পরেই হয়তো অনু পাখির রাগ অভিমান চলে যাবে। আদোও কি এই অভিমান শেষ হবে??
রাত প্রায় নয়টা। তুলতুলের জামা চেঞ্জ করছিলাম তখনই কলিং বেল বেজে উঠল। তুলতুলকে তাড়াতাড়ি করে জামা পরিয়ে বসিয়ে দিলাম বিছানায়। তড়িঘড়ি করে বিছানা থেকে ছবি গুলো নিয়ে টেবিলের ডয়ারে রাখলাম। ওড়না ঠিক করে রুম থেকে বের হতে নিবো তখনই ধ্রুবর কন্ঠস্বর শোনা গেল। তুলতুলকে ডাকতে ডাকতে রুমের দিকে আসছেন উনি। ধ্রুব রুমে আসতেই তুলতুল হাসলো। ধ্রুবকে অবাক করে দিয়ে অস্ফুটস্বরে পর পর দু’বার ‘পাপা’ ‘পাপা’ বলে ডাকলো। তুলতুল দাঁড়িয়ে দু-হাত বাড়িয়ে ধ্রুবর কোলে যাওয়ার আগ্রহ দেখালো। ধ্রুব থমকালো। স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো একই জায়গায়। পালটে যেতে শুরু করলো তার মুখের রঙ। ক্লান্ত মুখটা হঠাৎই বিস্ময়ে থমথম হয়ে গেল। নিষ্পলক তাকিয়ে রইলো মিনিট খানেক সময়। আচমকাই খুশিতে আত্মহারা হয়ে তুলতুল কোলে তুলে নেয়। আনন্দে তার চোখদুটো ঝলঝল করে উঠলো। তুলতুল আবারও পাপা ডাকতেই ধ্রুব অতিমাত্রায় আনন্দিত হলো। মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছে না৷ হয়তো গলার মাঝেই সকল কথা আর আনন্দ দলা পাকিয়ে গেছে। কি বলবে তা হয়তো বুঝতে পারছে না ধ্রুব। তুলতুলের সারা মুখ জুড়ে অজস্র চুমু এঁকে দিলেন। ঠোঁটের কোণে তার বিশ্বজয়ী হাসি। আনন্দের অশ্রু চিকচিক করছে চোখের কোণে। তুলতুল এবার হাসফাস করতে লাগল। ধ্রুব তুলতুলকে বিছানায় নামিয়ে দিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসলেন৷ খুশিতে আত্মহারা হয়েই এবার আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। উত্তেজিত হয়ে ধরা গলায় বললেন-
‘তুমি তুলতুলকে পাপা ডাক শিখেছো তাই না সানসাইন!’
আমি ইতস্তত করে হাল্কা মাথা নাড়ালাম। ধ্রুব আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন আমাকে। ঘটনার আকষ্মিকতায় বরফের ন্যায় জমে গেলাম আমি। অবশ হয়ে আসলো পুরো শরীর৷ ধড়ফড় করছে আমার হৃদপিণ্ড। এখনই বোধহয় লাফাতে লাফাতে বেরিয়ে আসবে। ধ্রুব খেয়াল করলো না আমার অস্বস্তি। বুঝতে পারলো না আমার অদ্ভুত অনুভূতি। সে পর পর কয়েকবার আমাকে জড়িয়ে ধরে কোলাকুলি করলেন। তবুও তার খুশি প্রকাশ করা হলো না। তিনি তুলতুলের মতোই নিজের ঠোঁট চেপে ধরলেন আমার গালে। কেঁপে ওঠলাম আমি। গলা শুকিয়ে কাঠ কাঠ হয়ে গেল মুহুর্তেই। তাকে বাধা দেওয়ার কোনো প্রকার শক্তি নিজের মাঝে খুঁজে পেলাম না। দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হলো।
চলবে..
[আমি আগেও একবার বলেছি রোজার কারণে গল্পটা নিয়মিত দিতে পারছি না। তবে আপনারা চাইলে পর্ব ছোট করে লিখে প্রতিদিন দেওয়ার চেষ্টা করবো। আর হ্যাঁ অপেক্ষা করুন সাদাফ আসবে তার সময় মতো। ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। সবাইকে ধন্যবাদ আর ভালোবাসা।❤️]