#শেষ_চৈত্র [০২]
আমার স্বামী প্রবাসে থাকাকালীন আরেকটা বিয়ে করেছিলো শুনে ইচ্ছে করছে নিজ হাতে টেনে ভেতর থেকে হৃদপিন্ডটা ছিঁড়ে ফেলি, খুব অসহনীয় যন্ত্রণা হচ্ছে ওখানে, আমি আর নিতে পারছিনা।
এদিকে আমার মস্তিষ্ক বারবার মহিলাটার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করতে চাচ্ছে, ‘ উনি বিয়ে করেছেন এই বিষয়টা গোপন করলেন কেন? আর উনি কি বাংলাদেশী কোনো প্রবাসী মেয়ে বিয়ে করেছিলেন নাকি অন্যদেশী? আর তাকে ছেড়ে চলেই বা আসলেন কেন?
কিন্তু মুখ থেকে সেসব উচ্চারণ হলোনা। আমি আমার কণ্ঠনালীতে বিশাল পাথর অনূভব করছি, খুব ভারী সেটা! এই পাথর ভেদ করে চিৎকারটুকুনও আসছেনা। অথচ আমার গলা ফাটিয়ে খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছে।
মানুষের ভেতরটা দেখানো যায়না কেন? এই যে আমি সুন্দর করে বসে আছি, একেকজন আসছে, হাসছে আর কথা বলছে আমিও তাদেরকে সায় দিচ্ছি! কেন বুঝতে পারছেনা আমার সবকিছু অসহ্য লাগছে, আমি একা থাকতে চাচ্ছি! একদম একা।
আমার স্বামীর বিয়ের সংবাদ দেওয়া সেই মহিলাটাকে আমি দেখিনি, এখন আছে কিনা তাও জানিনা। কেননা এর মধ্যে আরো কয়েকজন এসেছে, মাথার ঘোমটা তুলে আমার মুখ দেখেছে।
কেউ কেউ জিজ্ঞাসা করেছে, পড়ালেখা কতটুকু করেছি? ভাইবোন ক’জন? নিচু স্বরে সবার জবাব দিচ্ছি। কিন্তু মনের একটুখানি প্রশান্তির জন্যও কান্নার সুযোগ পাচ্ছিনা। শুধু ভেতরে ভেতরে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছি!
কিছুক্ষণ পরে একজন হনহন করে ভেতরে প্রবেশ করে বললো,
‘ সবাই যার যার বাড়িত যাও দেহি। বউ এখন খায়বো, জিরাইবো।
কথা শুনে আমি বুঝতে পারলাম উনি আমার ননদ, যিনি কিনা কিছুক্ষণ আগে আমাকে শাড়ী বদলাতে সাহায্য করছিলেন।। কিন্তু ননদ হলেও উনি তিন বাচ্চার মা। বয়স ২৫ হবে।
উনার কথা শুনে সবাই আস্তে আস্তে বের হতে হতে লাগলো। পেছনে আরেকজন খাবার এনে আমার বসার খাটে রাখলো।
ইশারা করলো হাত ধুয়ে খেয়ে নিতে।
কিন্তু খাবার দেখেই আমার গা গুলাতে লাগলো। ভেতরে রক্তক্ষরণ হলে গলা দিয়ে খাবার নামবে?
তবুও তাদের জোরাজুরিতে এক মুঠো ভাত মুখে দিয়ে হাত ধুয়ে ঘুরে বসে রইলাম।
খাওয়া শেষ হতেই বারান্দায় অমিতের গলার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। এখন আরো কান্না পাচ্ছে আমার। মনে হচ্ছে উনার প্রচন্ডরকম বদমেজাজকে আমি চোখ বন্ধ মেনে নিতে পারবো, বিনিময়ে এমন একটা বাজে সংবাদ মিথ্যে হয়ে যাক!
সেসময়ই উনি দরজা ঠেলে একটু মাথা উঁচিয়ে বললো,
‘ কিরে ওরে খাওয়াইছস?
উনার বোন আমার দিকে একবার তাকিয়ে বললো,
‘ একটু খালি গলাডা ভিজাইছে। থাক পরে খাইবোনে।
বলেই বেড়িয়ে গেলো। উনিও দরজার ওপার থেকেই আবার কোথায় চলে গেলেন। আমি মনস্থির করলাম, পূর্বের বিয়ের ব্যপারে আমি আজকেই প্রশ্ন করব। এর জন্য আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করার হলে করবে। এমনিতেও তো উনার চরিত্রে সমস্যা!
সত্যিই পূর্ব বিবাহিত শুনে খুব খুব ঘৃণা লাগছে আমার। আব্বার উপর খুব অভিমান হচ্ছে, নিজের মেয়েকে এতটাই ফেলনা মনে করছিলো যে ১৬ বছরের মেয়ের জন্য ৩০- ৩২ বছর বয়সের জামাই ঠিক করে নিলেন , তাও আবার বিবাহিত ঘাড়ত্যাড়া। এসব মেনে নেওয়ার মতো সহ্য ক্ষমতা আমার ভেতরে একদম জন্মায়নি । উনি যদি আমার সাথে উল্টো খারাপ আচরণ করেন নিশ্চিত আমি কালই মৃত্যুপথ বেছে নেবো। জানিনা আমার কম বয়সের আবেগ উল্টা পাল্টা ভাবাচ্ছে, নাকি আমার জায়গায় যে কেউ থাকলেই এসব ভাবতো?
এখন বাড়ির মেহমানরা একেকজন আসছে যাচ্ছে। অনেকেই আমার কাছে এসে অনেক কথা বলছে। সবচেয়ে বেশি যেটা শুনছি সেটা হচ্ছে আমার স্বামী বাইরের দিকে বেশ রাগী হলেও নাকি ভেতরের দিকে ভীষণ কোমল। আমি যদি বুঝে শুনে তার শিরায় শিরায় চলতে পারি তাহলে অনেক সুখী হবো।
সবাই শুধু উনার প্রশংসাই করছে, এমনও বুঝাচ্ছে উনি বয়স্ক হলেও এখনো দেখতে বিশালকার আর সুদর্শন। সেই তুলনায় আমাকে উনার সাথে মানায়নি। একজন সরাসরি বলে ফেললো, বউ আরেকটু লাম্বা হইলেই চলতো।
এই কথা কি করে জানি উনার কানে চলে গেলো। সাথে সাথে রুমে এসে কর্কশ গলায় বললেন,
‘ এই তুই এই কথা বলার কে হ্যাঁ? আমার বউ বেটে কিনা অসুন্দর এসব আমি দেখে বিয়ে করছি। তুই কেমন রূপবতী যে এসব বলার সাহস পাস! আরেকদিন শুনলে থাপ্পড় দিয়ে সব কটা দাঁত ফেলে দিবো,অসভ্য!
বলেই আবার শনশন করে চলে গেলো। মনে হয় দরজার বাইরেই ছিল, উনার কথা শুনে নিয়েছে।
আমি এখন সরাসরি দেখলাম, ছি! কি ভয়ানক ব্যবহার? আর যে এই কথা বলছিলো সে লজ্জায় মাথা নিচু করে চলে গেলো। বোধহয় চোখ বেয়ে জলও পড়ছিলো, তাই আর চোখ উপরে তুলেনি।
এদিকে সময় যাচ্ছে আর আমার বুকের ধড়ফড় বেড়ে যাচ্ছে। ভেতরের ঢিপঢিপ আওয়াজ বাহির থেকে শোনা যাচ্ছে। এমন মানুষের সাথে এক মূহুর্তও থাকা সম্ভব? কখন জানি কোন সহজ বিষয়টাকে অপরাধ দাবি করে আমার গলা টিপে ধরে! একটু আগের ব্যবহার যদি আমার সাথে করে আমি কেঁদে বন্যা বয়ে দিবো।
‘
রাত এগারোটা,
উনি দ্রুত পায়ে রুমে প্রবেশ করলেন। ফ্যানের স্পিড একদম ফুল দিয়ে বাতিটা অফ করে সাথের স্বল্প আলোর বাতিটা জ্বালিয়ে দিলেন।
বড় আপু বলেছিলো বর প্রবেশের সাথে সাথে যেন সালাম করি। কিন্তু আমি জেদ করে বসে আছি। ভেবেছিলাম এর জন্য কোনো প্রশ্ন তুলবে।
কিন্তু কিছু না বলে সামনের অল্প জায়গাটাতেই শুয়ে পড়লেন ।
প্রায় ২ মিনিট পরে বললেন,
‘ চৈতি তুমি দেখি আমার মতো।
আমি এটা শুনে অবাক হলাম। কিসের জন্য আমাকে উনার মতো বললো আমি বুঝতে পারিনি। আবার উনার মতো রুক্ষ বুলির মানুষকে এমন নরম গলায় দেখেও আমার কাছে বেমানান লাগছে।
তবে উত্তরটা উনি নিজেই দিলেন।
বালিশ থেকে আমার দিকে ঘাড় ফিরিয়ে বললেন,
‘ এসব পায়ে ধরে সালাম আমার জঘন্য লাগে জানো? দেওয়ার হলে মুখে দিবে। তুমি পা ছুঁতে আসো নাই বলে আমার খুব ভালো লাগছে।
উনাকে যতদূর দেখেছি উনি শুদ্ধ ভাষায় কথা বলেন। পড়ালেখা জানেন আবার দেশ বিদেশ ঘুরেছেন, সেইজন্যই বোধহয় ।
কিন্তু নিজের জমানো রাগের রেশ কাটাতে পারিনি। উনার কথাকে বেপাত্তায় উড়িয়ে আমি খুব ধাঁচের সাথে বলে উঠলাম,
‘ জ্বী ভালা তো লাগবোই, একবার বিয়া কইরাও আবার এমন বাচ্চা মাইয়া পাইছেন না?
আমার কথা শুনে উনি চোখ কপালে তুলে হুড়মুড়িয়ে উঠে বসে গেলেন।
চলবে…..
লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার
গল্প সম্পর্কে যাবতীয় আলোচনা Tajrin’s world এ করা হয়! কখন দিবো না দিবো এই বিষয়েও সেখানে আপডেট পাবেন❤️
আর অবশ্যই সবাই রেসপন্স করবেন!🌻