#শেষ_চৈত্র [০৯]
সুমনার অবৈধ সন্তানের দায়ভার অমিতের উপরে চাপিয়ে দিয়েছিলো কথা শুনতেই আমার বুক আরো বেগতিক রকম ধুকধুক করে উঠলো।
আমি মাথা তুলে অমিতের দিকে তাকিয়ে আছি।
অমিত একটা হাত দিয়ে মাথায় হাত বুলাচ্ছে আর আশ্বস্ত হওয়ার ইশারা করছে।
বাইরে থেকে সুমনা এখনো বলছে,
‘ অমিত তুমি শুনতে পাচ্ছো? শুনছো আমার ওহোম আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। তোমার চলে আসার কয়েকমাসেই যে আমাকে পুরোপুরি একা করে চলে গেলো। সবাই আমাকে এমন একা করে দিচ্ছে কেন?
অমিত কোনো শব্দ করছেনা। দরজায় দাঁড়িয়ে শুনছে, হাতটা এখনো আমার মাথা থেকে সরায়নি।
সুমনা দরজায় হাত দিয়ে আস্তে আস্তে ধাক্কাচ্ছে আর বলছে,
‘ আমাকে একটু আশ্রয় দাও প্লিজ।
অমিত এটা শুনতেই পা সরালো। আমার মাথা থেকে হাত সরিয়ে বললো,
‘ রুমে চলো চৈতি।
আমি একটু ইতস্তততার সহিত বললাম,
‘ কই থাহুম? আম্মার সাথে?
অমিত একটু চোখ ঘুরিয়ে বললো,
‘ যেখানে ইচ্ছে। তবে চাইলে আমার সাথে আসতে পারো!
বলেই হনহন করে চলে গেলো। আমি আম্মার রুমের দিকে একবার তাকালাম, তারপর তাকালাম অমিতের চলে যাওয়ার দিকে। তারপর ধিরে ধিরে উনার পিছুই নিলাম।
অমিত ভেতরে গিয়ে পাখা অন করে ফ্লোরে বসে পড়লো।
আমি রুমে যেতেই অমিত মৃদু হাসলো। আমি প্রথমবারের মতো অমিতের মুখে হাসি দেখলাম, একটা স্বচ্ছ নির্মল হাসি। আমি গুটিগুটি পায়ে ভেতরে গিয়ে উনার থেকে একটু দূরত্ব নিয়ে বসলাম। আমি বসতেই অমিত বিছানার দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ খাট থেকে একটা বালিশ দিবে?
আমি আবার ওঠলাম, সাইডের বালিশটা উনাকে দিয়ে আবার বসলাম। অমিত আমার দিকে তাকিয়ে নিচে শুয়ে পড়লো। উপরে ঘূর্ণায়মান ফ্যানটার দিকেই এখন তার নজর। আমাকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে অমিত চোখ ফিরিয়ে বললো,
‘ উপরে চলে যাও তুমি।
আমি আস্তে আস্তে বললাম,
‘ আপনি এখানে থাকবেন?
অমিত এবার দাঁত বের করে হাসলো। ভয়ংকর সুন্দর তার হাসি। বিয়ের পরে আজই তাকে হাসতে দেখলাম আমি। সে হাসতে হাসতে বললো,
‘ আমার এতো ভালো লাগছে কেন বলতে পারো?
আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম,
‘ নাহ ক্যান?
অমিত হাত বাড়িয়ে বললো,
‘ এখানে আসো।
আমি হাসিমুখে উনার কাছে গেলাম। উনি আমার ডান হাতটা ধরে নিজের বুকের উপর রাখলেন। আর উপরে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বললেন,
‘ প্রকৃতির অপূর্ব সুন্দর প্রতিশোধ দেখে!
আমি চুপ করে রইলাম। অমিত ভ্রু কুঁচকে বললো,
‘ আমাকে তুমি অনেক ভয় পাও?
আমি এবার হেসে ফেললাম। ভেবাচেকা খেতে খেতে বললাম,
‘ হ্যাঁ, কিন্তু এই মূহুর্তে পাচ্ছিনা।
অমিত আমার হাতটা ছেড়ে তার সেই হাতটাই ফ্লোরে ছড়িয়ে দিয়ে বললো,
‘ এখানে মাথা রাখো, তোমাকে আজ গল্প বলবো। আমার গল্প!
আমি ডানে বায়ে না তাকিয়ে খুশির সাথে উনার হাতের উপর মাথা রাখলাম। অমিত একবার আমার দিকে তাকিয়ে আবার উপরে বরাবর তাকালো। একটু দম নিয়ে বলতে লাগলো।
‘ কোনো রকম খেটে-খাওয়া পরিবারের সন্তান ছিলাম আমি। আমার আর আমার বোনকে ছোট রেখেই আমার বাবা মৃত্যুবরণ করেছিলেন। তখন আমার বয়স মনে হয় দশ কি এগারো, আমার বোন অরুণার বয়স তখন ৪ কিংবা ৫ হবে। দরিদ্র পরিবারের রোজগারের একমাত্র অবলম্বন যখন বিলীন হয়ে যায় তখন পরিবারে বাকি মানুষগুলো বুঝতে পারে জীবন আসলে কি! আমরাও বুঝতে পারছিলাম।
বাবার মৃত্যুর পরে কয়েকদিন পাড়াপ্রতিবেশিরা আমাদেরকে দয়া করেছিলো। কিন্তু কয়েকদিন যেতে না যেতেই টের পেলাম সবাই মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। রোজ রোজ কে দয়া করবে? স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম আমরা অনাহারে মারা যাবো। ঘরে চাল নেই, বাজার করার মতো টাকা নেই। আমাদের জগৎ থেমে গিয়েছিলো। কিন্তু পেট তো আর থেমে যায়না! সেদিন সারাদিন আমরা উপোস ছিলাম। বিকেলে শুনলাম পাশের গ্রামে মিলাতের পর ফিরনি দিবে। ছুটে গেলাম সেখানে। সেখানে না খেয়ে পলিথিনে করে নিয়ে আসলাম ঘরে। তিনজন মিলে সেই খাবারটুকু দিয়েই রাত পার করলাম। আম্মা চাইছিলো মানুষের বাড়িতে কাজ করবে কিন্তু আমি দেইনি। বলেছিলাম একজন পুত্র থাকতে মা কেন বাইরে কাজ করবে? মা অসহায় ছিল তখন! পরেরদিন সকাল থেকেই ঘুরতে থাকলাম কীভাবে ভিক্ষা ছাড়া কয়েকটা টাকা আয় করে কিছু খাবার কিনতে পারবো।
ঘুরতে ঘুরতে সকাল পেরিয়ে দুপুর হয়ে গেলো। হঠাৎ শুনলাম মেম্বার বাড়িতে দিঘী কাটছে। সিদ্ধান্ত নিলাম মাটি কাটবো। চলে গেলাম সেখানে, প্রথমবার এইটুকু উঠতি বাচ্চা আমি হাতে কোদাল তুলে নিলাম। আমার কাজ কারোরই পছন্দ হচ্ছিলোনা, সারাদিন কাজ করেও সবার তুলনায় সেদিন অর্ধেক টাকা হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলো মেম্বার সাহেব।
তাও আমি খুশি ছিলাম, বাজার থেকে এক কেজি চাল আর ডাল নিয়ে ফিরলাম।
আম্মা আমার হাতের দিকে তাকিয়ে সেদিন কাঁদছিলো খুব। তবে তখন যাবতীয় চিন্তা ছেড়ে দিয়েছিলেন আমার উপরেই। আমি চারদিকে কাজের জন্য হন্নেহই হয়ে ছুটতাম৷ মানুষের জমিতে হাল চাষ,চারা বপন, ধান ভানা,ধান কাটা আরো টুকটাক যত কাজ পেতাম সব করতাম। স্কুলেও আবার ভর্তি হয়েছিলাম, ক্লাস করতাম না, রাতে অল্পস্বল্প পড়ালেখা করেই পরিক্ষা দিতাম। একটা সময় মানুষের জমি জমা রেখে কিংবা ভাগে চাষ করতাম, পরিবার চালিয়েও টাকা বাঁচতো তখন। পরবর্তীতে কিছু করার জন্য জমাতে লাগলাম। আমি বিশ বছর বয়সে মেট্রিক পাশ করেছিলাম, অবশ্য দুইবারে পাশ করতে হয়েছে, আগের বছর নির্বাচনীতে ফেল করায় পরিক্ষা দেওয়ার সুযোগ পাইনি।
৮-৯ বছরে আমার অক্লান্ত রোজগারের সব বাড়তি টাকা আম্মার কাছে ছিলো। মেট্রিক পাশের পরে সআম্মাকে জিজ্ঞাসা করলাম, মোট কতো টাকা হয়েছে? আম্মা বলতে পারেনি, কেননা উনি শুধু টাকাটা রেখেই দিতেন, কখনো হিসাব করতেন না। মজার ব্যপার কি জানো চৈতি? সেদিন টাকাগুলো গুনে জীবনের সবচেয়ে বড় আনন্দের ধাক্কাটা খেয়েছিলাম। প্রায় তিন লক্ষ টাকা জমে গেছে, আম্মা মাটির নিচে একটা বাক্সে এগুলো রাখতো। সেই টাকা একসাথে দেখেই আমার লোভ হলো দেশে না থেকে বিদেশে চলে যাওয়া উচিত, এতে ভালো উন্নতি করতে পারবো।
আমি উনার কথার মধ্যে বলে উঠলাম,
‘ ২০-২১ বছরে বিদেশে গেছিলাইন আপনে! না মানে হয়তাছে আইছেন তো মাত্র কয়েক বছর হয়লো। অতদিন কি সুমনাদের বাসায়ই আছিলেন?
অমিত আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো। অপর হাতটা দিয়ে কপাল ছুঁয়ে বললো,
‘ হ্যাঁ জীবনের ১০ বছর বিদেশ কাটিয়েছি। তবে সুমনাদের বাসায় নয়।
তারপর অমিত আবার বলতে লাগলো,
‘ তারপর আমি আম্মাকে বলে বিদেশে যাওয়ার জন্য মনস্থির করি। একটা কোম্পানিতে কাজ করার আশাতেই ভিসা রেডি হয়। প্রথম দুই বছর কোম্পানিতেই ছিলাম। কিন্তু বেতনে সন্তুষ্ট হতে পারছিলাম না। ড্রাইভিং শিখলাম, ইলেকট্রনিকস নিয়ে প্রশিক্ষণ নিলাম। কোম্পানিতে থেকেও আমি ইলেকট্রনিকসের টুকটাক কাজ করে বাড়তি অনেক টাকা আয় করতাম। গ্রামে দুইটা জমিও কিনলাম , ভালো জায়গায় বোনের বিয়ে দিয়ে দিলাম। বোনের জামাইকেও বিদেশে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলাম। সেখানে অবস্থানের সাড়ে চার বছরের মাথায় শুনলাম একটা বাঙালী পরিবার ব্যক্তিগত এবং বিশ্বস্ত বাঙালী ড্রাইভারের সন্ধান করছে। যেটার বেতন আমার কোম্পানির বেতনের চেয়ে দ্বিগুণ। ওভারটাইম কাজেরও দরকার নেই, আর সেখানেও দিনের কয়েক ঘন্টা কাজ করলেই যথেষ্ট।
তারপর কাগজপত্র আর বিভিন্নজনের সাহায্য নিয়ে পৌঁছালাম সেখানে।
আমি বেশ মনোযোগ দিয়ে সুমনার ব্যপারে শুনতে কান পেতে আছি।
অমিত বলতেছে,
‘ সেখানে গিয়ে বুঝলাম আমার কাজটা বেশ আরামদায়ক, শুধু বাড়ির লোকেদের বাইরে যাওয়ার সময় হলেই গাড়ী নিয়ে বের হতে হবে। সুমনা তখন ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে, প্রায় শেষের দিকেই ছিল তার পড়ালেখা। আমিই প্রথম দুয়েকবার যখন ওকে ইউনিভার্সিটিতে পৌঁছে দিলাম,তখনও সব ঠিক ছিলো। কিন্তু কয়েকদিন যেতেই বুঝতে পারলাম সে আমাকে ড্রাইভার হিসেবে মানতে পারছেনা, নানারকম অশ্লীল গালাগাল করে। আসলে আমার জন্য প্রথম প্রথম সে তার কাজগুলো করতে পারতোনা।আমার তখন বেশ হজমশক্তি ছিল, সেটা এতটাই প্রবল যে সুমনার সব কুকীর্তি নিজ চোখে দেখেও চুপ থাকতাম। ওর কয়েকটা ছেলে ফ্রেন্ড ছিল। আমার সামনেই ওদের খোলামেলা চলাফেরা দেখতাম। ও নেশাও করতো। তবুও নিজের মতো করেই কাজ করছিলাম, মনে হতো আমার কাজটাই সব। ওদের যা ইচ্ছে ওরা করুক। একজনের সাথে সুমনার গভীর সম্পর্ক ছিলো, বলতে গেলে আমি বুঝতাম ওদের সম্পর্কটা অতি জঘন্য ছিল।
এসবের ভীড়েও এক বছর পার হয়ে গিয়েছিলো। হঠাৎ একদিন গাড়ী নিয়ে বাসায় ফেরার পথে সুমনাকে অনেক কাঁদতে দেখি, বিষয়টা তখন বুঝতে পারিনি।
কিন্তু আমি বাসায় এসে খাওয়াদাওয়া করে রুমে গিয়ে শুতেই সুমনার বাবা আমাকে আধশোয়া অবস্থায় গিয়ে একটা লাথি মারলেন। আমি হুড়মুড় করে উঠে বসার পরে কলারে ধরে একনাগারে ১০ টা থাপ্পড় মারলেন। এতটাই জোরে থাপ্পড়গুলো দিয়েছিলেন যে উনি নিচে বসে পড়তে বাধ্য হন। আমি তখনও অপরাধ বুঝিনি। কিন্তু কিচ্ছুক্ষণের মধ্যে সুমনা প্রবেশ করে যখন আমার কাচের পানির জগটা আমার মাথায় ছুড়ে বললো,
‘ ফকিন্নির বাচ্চা স্বীকার কর, এই সর্বনাশ করার পেছনে তোর সার্থ কি!?
আমি হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম। মুখ থেকে কোনো শব্দ বের হচ্ছিলোনা। তবে বুঝতে পেরে গিয়েছিলাম আমাকে কোথায় ফাঁসাতে যাচ্ছে।
চলবে…..
লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার
https://www.facebook.com/groups/925137588256294/