শেষ_প্রহর পর্বঃ০৫

0
1189

#শেষ_প্রহর
পর্বঃ ০৫
জাহান আরা

চন্দ্রর ভার্সিটি থেকে বাসায় ফেরার পর থেকে নিষাদের মাথার ভিতর দাউদাউ করে জ্বলছে। এই মেয়েটা এতো বহুরূপী!
নামাজের সিজদাহ্ তে তার যে রূপ দেখেছিলো সেটা কি তাহলে নকল রূপ ছিলো?
চন্দ্রর সাহস হলো কিভাবে তার সামনে ওই ছেলের কাঁধে মাথা রাখার নিষাদ ভেবে পাচ্ছে না।

চন্দ্র বাসায় ফেরার সময় হয়ে এসেছে,নিষাদ গিয়ে গেটের বাহিরে অপেক্ষা করে।
আকাশে মেঘ জমতে শুরু করেছে,মেঘের গুমগুম শব্দ হচ্ছে।হালকা বাতাস দিচ্ছে,নিষাদের ইচ্ছে ছিলো এমনিই কোনো এক মূহুর্তে খোলা বারান্দায় নিজের অর্ধাঙ্গিনীর সাথে দাঁড়িয়ে চা খাবে,দুষ্ট বাতাস এসে তার অবাধ্য চুলগুলোকে এলোমেলো করে দিবে মুখ ঢেকে দিবে,নিষাদ চুল কানে গুজিয়ে দেওয়ার বাহানায় ছুঁয়ে দিবে তাকে।শিউরে উঠবে সে নিষাদের আকস্মিক স্পর্শ পেয়ে।

হেসে ফেলে নিষাদ,জীবনে বউকে নিয়ে কতো পরিকল্পনা তার ছিলো অথচ কি হলো!
তার বউ মাথা রাখে অন্যকারো কাঁধে তারই সামনে।

আচ্ছা আমি যে চন্দ্রর এই কাজের জন্য এতো রেগে আছি আমি নিজেও তো চন্দ্রকে কম কথা শুনাই নি গতকাল দুপুরে।আমিও তো বলেছি চন্দ্র ছেলেদের সাথে মিশলেও আমি কিছু বলবো না,চন্দ্র আমার কেউ না।

তবে আমার এতো রেগে যাওয়ার কি আছে!
আমি নিজেই তো অপরাধী,চন্দ্রর ভুলের শাস্তি যদি পেতে হয় তবে আমাকে ও পেতে হবে।

আবার মনে পড়ে,আমি তো আজ থেকে সুস্মিতা কে ভুলে গেছি,মন থেকে কোনো ফিলিংস নেই আমার সুস্মিতার জন্য তবে কেনো চন্দ্র অন্যকারো হবে?

দ্বিধাদ্বন্দে ভুগতে ভুগতে গেটের ভিতর পা বাড়ায়। টুংটাং শব্দ করে বাহিরে একটা রিকশা এসে থামে,নিষাদ পেছন ফিরে তাকায়।
চন্দ্র নেমে আসছে রিকশা থেকে,সেই ছেলেটা রিকশায় বসে আছে।
চন্দ্র আদিবকে বায় জানিয়ে,রাতে কথা হবে বলে ভিতরে প্রবেশ করে দেখে নিষাদ সামনে দাঁড়িয়ে আছে,চন্দ্রর কোনো ভাবান্তর হয় না নিষাদকে দেখে,যেনো সেখানে নিষাদ না,দাঁড়িয়ে আছে একটা কারেন্টের খাম্বা যার এখানে দাঁড়িয়ে থাকার কথা,এমন ভাব করে ভিতরে চলে যায় চন্দ্র।
নিষাদ চন্দ্রর এই ব্যবহারে হকচকিয়ে যায়,চন্দ্র একটুও বিব্রত হলো না নিষাদ তাকে আর ছেলেটা কে দেখেছে একই রিকশায় তার পরে-ও?
তবে কি চন্দ্র নিষাদ কে কিছুই মনে করে না?
এতোটাই ফেলনা হয়ে গেছে নিষাদ?

মাথা ঠান্ডা করে ভিতরে প্রবেশ করে,চন্দ্রকে এই ছেলের কথা জিজ্ঞেস করতেই হবে।
বাগানে কিছুক্ষণ পায়চারি করে নিষাদ ভিতরে যায়।চন্দ্রর খাওয়া দাওয়া শেষ,মাজেদা খালা সব তুলে ফেলছে।

নিষাদ সিদ্ধান্ত নেয় আজ সে নিজ মুখে চন্দ্রকে বলবে খাবারের কথা।
রুমের দরজা ভেজানো,নিষাদ দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করতেই ৪০০ বোল্টের শক খায়,চন্দ্র ড্রেস চেঞ্জ করছে,ফর্সা পিঠ দেখা যাচ্ছে পিছন থেকে।
নিষাদ তাকিয়ে থাকে আজ আর চোখ সরাতে ইচ্ছে করে না।
কেনো চোখ সরাবে,চন্দ্র তার স্ত্রী,তার পূর্ণ অধিকার আছে চন্দ্রর উপর। নিষাদের কেমন যেনো অস্থির লাগছে,মনের ভিতর জেগে উঠেছে অন্যরকম অনুভূতি,কি এই অনুভূতি,কেনো হচ্ছে এরকম,পুরো শরীর কাঁপছে,ইচ্ছে করছে একছুটে গিয়ে চন্দ্রকে জড়িয়ে ধরে বুকের সাথে পিষে ফেলতে। নিজেকে কেমন তৃষ্ণার্ত মনে হচ্ছে,যেনো কতো জনম ধরে পানি খেতে পাচ্ছে না,এই তৃষ্ণা কিসের?
নিষাদ বুঝতে পারে।

ভিতরে এসে দেখে টেবিলে খাবার এনে রাখা আছে,একটা ফ্লাস্ক ও আছে সাথে,নিষাদের জন্য চা রাখা আছে নিষাদ বুঝতে পারে।

চন্দ্র বইখাতা নিয়ে বসে গেছে ফ্লোরে,নিষাদের মনে পড়ে তখনই একটা পড়ার টেবিল দরকার চন্দ্রর জন্য। বাড়িতে স্টাডিরুম আছে,তারা সবাই সেখানে পড়তো।

নিষাদ খাবার খেয়ে উঠে চা ঢেলে নেয়,চন্দ্রর সাথে কথা বলার অযুহাত খুঁজছে সে।
গড়িমসি করে বলেই ফেললো,”তোমার সাথে যে ছেলেটা এসেছিলো কি নাম তার?”

“আদিব”

“তোমার সাথে কি সম্পর্ক?ভালোবাসার?”

“হু”

চন্দ্রর এই সহজ স্বীকারোক্তি নিষাদের বুকের ভিতরের আগুন শতগুণ বাড়িয়ে দেয়।

“ঠিক করে উত্তর দাও,হু-হা করবে না”

চন্দ্রর ফোন বেজে উঠে ততক্ষণে।নিষাদ স্পষ্ট দেখতে পায় আদিব লিখা ভেসে উঠেছে স্ক্রিনে। ফোনের স্ক্রিনটা যদিও ফেটে গেছে অনেকটা।

“আপনাকে একটা ধাঁধা জিজ্ঞেস করি,যেদিন সঠিক উত্তর দিতে পারেন সেদিন আমি আদিব সম্পর্কে খুলে বলবো”

নিষাদ ভ্রু কুঁচকে তাকায়।

“আসছে যতো,আসবে ততো,তার অর্ধেক,তার অর্ধেক,আপনাকে নিয়ে একশ করি”

ফোন হাতে নিয়ে চন্দ্র বারান্দায় চলে গেলো। নিষাদ বসে বসে ভাবছে আসছে যতো,আসবে ততো,কে আসছে?
আজব কথাবার্তা!

না আবার মনোযোগ দেয় কিন্তু মাথায় কিছু ঢুকছে না নিষাদের।
বারান্দায় চন্দ্র কথা বলছে,টুকরো টুকরো কথা ভেসে আসছে নিষাদের কানে।

“আরে বিয়ের টেনশন তুই ছাড়,আমি ম্যানেজ করে নিবো,তুই তোর যেটা করা দরকার সেটা কর”

————–

“এতোই সোজা নাকি কারো মন পাওয়া,যেই মনে তুই আছিস সেই মন অন্যকেউ পাবে এতো সহজে?”

—————

“দূর,এটা কোনো কথা হলো,অনেক টাকাপয়সা থাকলেই কি মানুষের মন পেয়ে যায় না-কি, টাকাপয়সা তো ফকিরের ও আছে,ভালোবাসা না থাকলে টাকাপয়সা তে কি এসে যায়”

নিষাদ আর শুনতে পারছে না,নিষাদ বুঝে যায় কি হচ্ছে। নিষাদের ফোন বেজে উঠে, ভাইয়ের কল।
কল রিসিভ করে রুম থেকে বের হয়ে যায় নিষাদ।ফিরে আসে গম্ভীর হয়ে,ভাবীর কন্ডিশন ভালো না।

কথা শেষ করে ভিতরে এসে দেখে চন্দ্র এখনো কথা বলছে,হাসাহাসি শোনা যাচ্ছে। নিষাদ কানে বালিশ চাপা দিয়ে শুয়ে পড়ে। আদিবের বিষয় টা মাথায় থাকে,ধাঁধার উত্তর খুঁজতে খুঁজতে ঘুমিয়ে যায়।

ঘুম ভাঙে চন্দ্রর কান্নায়,নিষাদের আজ আর শুনতে ভালো লাগে না,সব নকল,সব মানুষ নকল এই দুনিয়ায়।
বুকের ভিতর কি ভীষণ অভিমান জমে তা কেউ বুঝতে পারে না।

চন্দ্র ফজরের নামাজের পর সোফায় গিয়ে শুয়ে পড়ে।নিষাদ ও নামাজ পড়তে উঠে যায়।

নামাজ পড়ে এসে ওয়ারড্রব থেকে নতুন একটা ফোন বের করে চন্দ্রর সিমকার্ড খুলে তাতে লাগিয়ে দেয়।চন্দ্রর পুরোনো ফোনটা রেখে দেয় লুকিয়ে নিজের কাছে।

“বাসর রাতে স্ত্রীকে গিফট দেওয়ার প্রচলন আছে আমাদের সমাজে,সে রাতে দিতে পারলাম না আজকে দিলাম,পুরোনো ফোনটা ফেলে দিয়েছি,সিম কার্ড লাগিয়ে দিয়েছি,ব্যবহার করলে খুশি হবো”

চিরকুট লিখে ফোনের সাথে লাগিয়ে রেখে দেয় ফোন যেখানে ছিলো।তারপর বের হয়ে যায় বাসা থেকে সকালেই।

চন্দ্র ঘুম থেকে উঠে ফোন হাতে নিয়ে টাইম দেখে,ফোন হাতে নিতেই চমকে উঠে।তার ফোনের উপরের গ্লাস ফেটে চৌচির ছিলো এটা এতো স্মুথ লাগছে কেনো?

শোয়া থেকে উঠে বসে যায় চন্দ্র।চোখ কচলে ভালো করে তাকিয়ে দেখে এটা তার ফোন না,একটা আইফোন। সাথে একটা চিরকুট।
চিরকুট পড়ে বুঝতে পারে নিষাদের কাজ এটা।কিন্তু তাকে কেনো দিচ্ছে,সে-তো তার স্ত্রী না,নিষাদ তো তাকে মানে না স্ত্রী হিসেবে।

সাড়ে আটটা বেজে গেছে,১০ টায় ক্লাস।চন্দ্র উঠে ব্রাশ হাতে নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। গোসল শেষ করে দৌড়ে বের হয়ে আসে,আজকে প্ল্যান করেছে সবাই কালো শাড়ী পরবে তারা,আদিব কালো পাঞ্জাবী।
বিয়েতে অনেক শাড়ী পেয়েছে সব ওয়ারড্রবে রাখা,চন্দ্র খুঁজতে খুঁজতে জর্জেটের মধ্যে হালকা কাজ করা একটা শাড়ি পেয়ে যায়।

তাড়াতাড়ি পরে,চোখে কাজল দিয়ে বের হয়ে যায়। ভেজা চুল হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে শুকিয়ে নেয়।বের হয়ে যায় না খেয়েই।
ক্যাম্পাসে গিয়ে দেখে আদিব ছাড়া সবাই হাজির।তাকিয়ে আছে সবাই চন্দ্রর দিকে,কালো শাড়ি,খোলা চুল,চোখে কাজল,চন্দ্রকে মনে হচ্ছে যেনো অপ্সরা।
চন্দ্র কাছে আসতেই নিশি প্রথম বলে উঠে,”তোর বর আজকে তোকে দেখেছে চন্দ্র এভাবে?”

“না তো,কেনো?”

“বিশ্বাস কর চন্দ্র,তোকে আজকে দেখলে ওই বেটার মাথা হ্যাঙ করবে,কিসের মডেল ফডেল,বেটা তোর প্রেমে পড়ে হাবুডুবু খাবে”

“হইছে অনেক মজা করা,আদিব্বা আসে না কেনো,কল দিয়ে দেখ মিরা”

মুখে বিষন্ন ভাব মিরার,আদিব কে ফোন দেয়।ওপাশ থেকে কিছু শুনেই মিরার বিষন্ন চেহারা বদলে ভয়ার্ত হয়ে যায়। ঠাস করে বসে পড়ে মিরা সেখানে।

নিশি,রুমি,চন্দ্র মিরাকে জিজ্ঞেস করতে থাকে কি হয়েছে।

“আদিব কে কারা যেনো খুব মেরেছে,আদিব এখন হাসপাতালে ভর্তি আছে”

মিরার কথা শুনে ৩ জনেই চমকে উঠে,রুমি পিচ পিচ করে কান্না শুরু করে।

“কোন হাসপাতালে আছে আদিব?”

“যারা মেরেছে তারাই না-কি হাসপাতালে নিয়ে গেছে,দ্যা কেয়ার হাসপাতালে আছে”

“উফফ,গরু মেরে জুতো দান করে গেছে শালারা”

ক্লাস রেখে চারজন রওনা দেয় হাসপাতালের দিকে,দ্যা কেয়ারে পৌঁছাতে ওদের ৪৫ মিনিট সময় লাগে,মিরা ছুটে যায় রিসিপশনে,আদিবের কথা জিজ্ঞেস করতেই শুনে আদিব ৬ তলায় ভিআইপি কেবিনে আছে,লিফটে উঠে ৬ তলায় পৌছায়। আদিবের মাথায় ব্যান্ডেজ,হাত পা সব ছিলে গেছে।

আদিবকে ঘুমের ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে,ঘুমিয়ে আছে আদিব।
ওদেরকে বলা হলো রিসিপশনে গিয়ে অপেক্ষা করতে,ক্লান্ত,বিধ্বস্ত ৪ জন রিসিপশনে গিয়ে বসে।রিসিপশনিস্টের পেছেনের দেয়ালের দিকে তাকিয়ে নিশি চমকে উঠে,নিশি রুমি কে দেখায়,রুমি চন্দ্রকে দেখায়,চন্দ্র নিজেও চমকে উঠে দেখে।

নিষাদ চন্দ্রর বলা ধাঁধা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে,কিছুতেই বের করতে পারছে না।মেজাজ খারাপ হয়ে যায় নিষাদের,একটা সোজা কথা সোজা ভাবে বললেই তো হতো,এতো ধাঁধা কিসের আবার!

রেস্টুরেন্টে বসে বন্ধুরা সবাই মিলে আড্ডা দিচ্ছে,নিষাদ এখনো ভাবছে।

“গুরু,বৌয়ের কথা এখন একটু ভাবা বন্ধ করে আমাদের সাথে কথা বল”

“বিয়ে করবে না করবে না করে,এখন বিয়ে করার পর আমাদের সাথে আড্ডা তে ও মন দেয় না।”

সবাই হাসাহাসি করতে থাকে।সবার হাসি থামার পর কৌশিক জিজ্ঞেস করে,”তুই কি কোনো কিছু নিয়ে চিন্তিত নিষাদ,আরে কি আছে চিন্তার বাকি বল,আমরা সলভ করে দিবো,আমরা আছি তো ইয়ার”

নিষাদ কিছুক্ষণ ভেবেচিন্তে বললো,আমাকে একটা ধাঁধার উত্তর দে,এই ধাঁধার উত্তর না পেলে আমি ঘুমাতে পারবো না,স্বস্তি পাবো না।

“ধাঁধা কি বৌদি দিয়েছে বস?” ময়ুখের প্রশ্ন।

” হু ”

সবাই আবার একচোট হেসে উঠে।

“এইজন্যই তো বন্ধু আমার উদাস হয়ে আছে,ভাবী নিশ্চয় বলেছে ধাঁধার উত্তর না দিতে পারলে বিছানায় জায়গা দিবে না”

সবার হাসাহাসি শুনে নিষাদের কান ঝালাপালা হয়ে যায়।

“আচ্ছা,ধাঁধা কি বল?”

”আসছে যতো,আসবে ততো,তার অর্ধেক,তার অর্ধেক,আপনাকে নিয়ে একশ করি”

সবাই ভ্রু কুঁচকে একে অন্যের দিকে তাকায়।কেউ বুঝতে পারছে না ধাঁধার মানে।

“বৌদি কোন বিষয় নিয়ে পড়ে রে নিষাদ? ম্যাথ নাকি?”
ময়ুখ জিজ্ঞেস করে।

“ফিন্যান্স”

“হু এইজন্যই এসব অংক টংকের ধাঁধা জিজ্ঞেস করে। ”

কৌশিকের মুখ হাসিহাসি হয়ে যায়।

“দোস্ত,পাইছি ধাঁধার উত্তর ”

চলবে……???

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here