শেহজাদী পর্ব-১০

0
938

#শেহজাদী
Part–10( বোনাস পর্ব)
Arishan_Nur (ছদ্মনাম)

গুলশানের এক রেস্টুরেন্টে বসে আছে ইমান। বিসনেস মিটিং হবে। আগে আগে আসায় সে বাদে অন্য কলিগরা এখনো আসেনি। ইমান অপেক্ষা করছে।

অপেক্ষা করতে বড্ড বিরক্ত লাগে তার। অপেক্ষা করা বিষয়টা তার জন্য অসহ্যকর হয়ে পড়েছে। আগে একটা সময় সেও অপেক্ষা করত। এখন আর করেনা। ওয়েটার কফি দিয়ে গেল। ইমান মুচকি হেসে একশ টাকা বখশিশ দিয়ে বলে উঠে, এই যে শুনুন! আমাকে এক প্যাকেট সিগারেট কিনে এনে দিন তো।

— স্যার আমাদের রেস্টুরেন্টে স্মোকিং জোন ছাড়া স্মোক করা নিষেধ।

ইমান মুখ তেতো করে বলে, নরমালাইজ যেখানে-সেখানে বসে সিগারেট খাওয়া৷

— নো স্যার। ইটস হার্মফুল। ছোট্ট বাচ্চারা আশেপাশে থাকে।

— ঠিক আছে। যাও এক প্যাকেট বেনসন কিনে আনো। আমি বাইরে গিয়েই খাব৷।

— থ্যাংকস স্যার।

ওয়েটার দশ মিনিটের মধ্যে সিগারেট নিয়ে হাজির হলো। ইমান সিগারেট হাতে নিয়ে রেস্টুরেন্টের এক সাইডে গেছে। বারান্দা টাইপ। এখানে এসি নেই। এসি না থাকা সত্ত্বেও তার গরম লাগছে না একদমই৷ আরাম করে পর পর দুটো সিগারেট খেলো সে। এরপর ফিরে আসলো রিজার্ভ করা রেস্টুরেন্ট টেবিলে। সে আসতেই দেখলো দুই-এক কলিগ পৌঁছে গেছে।

ইমান সামনে এগিয়ে এসে তাদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করে বসে পড়ে। তারা টুকটাক গল্প করছে৷ একথা থেকে সেকথা বলতে বলতে মিস্টার চৌধুরী বলে উঠে, আরে জানেন না তো ড্রেইম এটিয়ারের ওনার তো বাংলাদেশে আসবে।

ইমান কফি খাচ্ছিলো। ড্রিম এটিয়ারের নাম শুনে তার নাকে-মুখে কফি উঠে গেল। সে কাশতে লাগে।

মিস্টার চৌধুরী বলে উঠে, আর ইউ ওকে ইমান?

— ইয়াহ! আই এম টোটালি ফাইন। সর‍্যি ফর ডিস্টার্ব।

— ইটস ওকে। বাই দ্যা ওয়ে, আপনি ড্রিম এটিয়ারের ওনারকে চেনেন?

ইমান কর্কশ কণ্ঠে বলে, নো৷

— অনেক কম বয়সী একটা মেয়ে। বিদেশে থাকে। সম্ভবত ঘুরতে বাংলাদেশে আসছে৷

ইমান মুখ ভোতা করে বলে, বাংলাদেশে ঘুরার মতো আছেটা কি? কক্সবাজার আর সিলেট ছাড়া?

— হাহা ভেরি ফানি। ড্রিম এটিয়ারের ওনার বাঙ্গালী মেয়ে। আপনি ওর লাইভ দেখেন নি কোন দিন?

— এইসব ফালতু কাজে টাইম ওয়েস্ট করি না আমি।

— আই সি। মেয়েটা খুবই মিস্টি ভাষী। কি সুন্দর মিস্টি-মিস্টি করে কথা বলে। দেখতে ও মাশাল্লাহ। কিন্তু চশমা পড়ে মেয়েটা৷

ইমান চমকে উঠে। কিন্তু চমকানো ভাবটা নিজের মধ্যে লুকায়িত রাখলো। ছোট থেকেই অনুভূতি গোপন করে রাখায় সে ওস্তাদ। আজো এই অভ্যাস গেল না! ইমানের মনে হয়, অন্যের সামনে নিজের অনুভূতি প্রকাশ পাওয়া লজ্জাকর বিষয়!

ইমান জিজ্ঞাসা করলো, উনি কেন বাংলাদেশে আসবে? বিদেশ থেকে কেউ বাংলাদেশে ফিরে আসেনা। উনি কেন ফিরে আসছেন?

মিস্টার চৌধুরী বলে উঠে, ফিরে আসছে না তো! ঘুরতে আসছে সেই সাথে বাংলাদেশে শোরুম খুলবে। নিজের হাতে আউটলেট সাজাবে এইজন্য বাংলাদেশে আসছে।

ইমান গভীর চিন্তায় পড়ে গেল। অনলাইনে ব্যবসা করেই মেয়েটার জন্য তাদের এতো বড় লস হলো আর এখন যদি আউটলেট খুলে তাহলে কি হবে তাদের শপের? এসি থাকা সত্ত্বেও ঘামা শুরু করলো ইমান।

সে প্রশ্ন করে, আপনি এতোকিছু কিভাবে জানলেন?

— আরে ওনার অফিশিয়াল পেজেই সব ইনফরমেশন দিয়ে দেয়। আমি তো ঠিক করেছি নেক্সট প্রজেক্ট ড্রিম এটিয়ারের সঙ্গেই করব৷

ইমানের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। চৌধুরী সাহেব লোকটা ধান্দাবাজ টাইপের। একবার যেই কোম্পানির সঙ্গে তার লস হয় সেই কোম্পানির সাথে সেকেন্ড টাইম সে কাজ করেনা। চৌধুরী ইনভেস্টমেন্ট না করলে কাদের সঙ্গে পাটনার শীপ করবে? কার কাছ থেকে ইনভেস্টমেন্ট নিবে সে? একা একা নিজের পক্ষে এই মূহুর্তে বিসনেস রান করা তার জন্য অসম্ভব! এমনিতেই সামনে ইদ। কি করবে সে?

মিস্টার চৌধুরী চিকেন ফ্রাই খেতে খেতে বলে, ইমান তোমাকে চিন্তিত দেখাচ্ছে। আই থিংক ইউ আর সিক। এক কাজ করো টেক এ ব্রেক। আজকের জন্য বাসায় চলে যাও। রেস্ট নাও। আমরা মিটিং অন্য দিন করব। ওকে?

ইমান কিছু বললোনা। একে তো এতোবড় লসের ধাক্কা সে নিতে পারেনি তার উপর ড্রিম এটিয়ারের ওনার আউটলেট বাংলাদেশে লঞ্চ করবে শুনে মাথা ভোভো করছে তার৷ বাসায় গিয়ে এক ঘুম দিয়ে ঠান্ডা মাথায় বাবার সঙ্গে আলাপ করতে হবে। সে ফোস করে একটা নিশ্বাস নিলো। জীবনটা কেমন বিষাদময় হয়ে গেছে। তিক্ততা এসে ভর করেছে। তার উপর বিসনেস সংক্রান্ত এইসব প্যারা নিতে পারছেনা।

ইমান উঠে দাড়ালো এবং রেস্টুরেন্ট থেকে বের হলো। আজকে ড্রাইভার সঙ্গে আনেনি সে। নিজেই ড্রাইভ করে এসেছে। গাড়ি পার্কিং লট থেকে বের করে সে ড্রাইভিং সীটে বসে গাড়ি চালু করলো। মোড় ঘুরিয়ে মেইন রোডে আসতেই তার মনে হলো মিরা তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সে সঙ্গে সঙ্গে বেশ জোরেই ব্রেক কষলো। কিন্তু নাহ মনের ভ্রম ছিলো। মিরা কেন সামনের মেইন রাস্তায় কোন জন-মানব নেই। গাড়ি আর গাড়ি। মানুষ জন ফুটপাত ধরে হাঁটছে।

ইমান হুট করে গাড়ি থামিয়ে দিয়েছে জন্য পেছন থেকে অন্য গাড়ি গুলো হর্ণ বাজানো শুরু করলে সে বাধ্য হয়ে গাড়ি চালানো শুরু করলো। কেবল আজকেই না! এর আগে অনেক বারই মনের ভ্রমে মনে হতো মিরা তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মিরার কণ্ঠস্বর সে শুনতে পায় মনের ভুলে। ইমান জানে এটা তার মনের ভুল। এই জীবনে মিরার সঙ্গে দেখা হওয়ার সম্ভাবনা খুবই তীক্ষ্ম!

ইমান বিড়বিড় করতে করতে বলে, “যে ভাগ্যে নেই তার প্রতি অনুভূতি জাগ্রত হওয়া নিষিদ্ধ করা হোক!”

★★★

মিরার শাড়ির আঁচল ফ্লোরে গড়াগড়ি খাচ্ছে। চার চারটে লাগেজ নিয়ে সে একা সামনে আগাতেও পারছেনা। তার উপর হুট করে এমন মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়েছে যে এয়ারপোর্টের বাইরেও বের হতে পারছে না সে।কাঁচ ভেদ করে দেখতে পাচ্ছে মা দাঁড়িয়ে আছে। পাশেই ইরা আর সায়েমা আপা৷ একটু দূরেই বড় আব্বু দাঁড়িয়ে আছেন বিশাল প্লাকার্ড হাতে। মিরা আবারো এক গাল হাসলো। সে ইশারায় বুঝালো যে আসছে সে।

মিরার কি যেন হলো! লাগেজগুলো শব্দ করে টেনে টেনে এই বৃষ্টির মধ্যই বের হয়ে গেল। এয়ারপোর্ট থেকে হয়ে খোলা আকাশের মাঝে দাঁড়াতেই সে সম্পূর্ণ ভিজে গেলো। ভেজা শাড়ি, এলোমেলো চুল এবং লেপ্টানো কাজলে কি পরিমাণ মায়াবী লাগছে তাকে!

বৃষ্টির মাঝে দাঁড়াতেই বড় আব্বু ছাতা হাতে দৌড়ে এসে ধমক দিয়ে বললেন, বৃষ্টির মাঝে বের হয়ে আসার দরকার কি ছিলো?

মিরার বকা খেয়েও কি যে খুশি লাগলো।ইশ রে! বকাও এতো মধুর হয়?

মিরা ছাতা মাথায় প্রায় এক প্রকার ছুটে পরিবারের দিকে দৌড়ে গেল। তারা রাস্তার অপর পাশে এক ছাউনি যুক্ত জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিল। মিরা সেখানে গিয়েই সবার আগে মাকে জড়িয়ে ধরে। সুপ্তি বেগম মেয়েকে বুকে জড়িয়ে নিয়েই কেঁদে দিলো।

মিরা একদম বড়দের মতো মায়ের মাথায় হাত দিয়ে বলে, কাঁদছো কেন আম্মু? প্লিজ ডোট ক্রাই।

সুপ্তি বেগম নাক টেনে বলে,খবরদার আমার সামনে ইংরেজি বলবি না তুই!

মিরা মৃদ্যু হাসলো। কি যে প্রশান্তি পাচ্ছে সে। এরপর ইরার কাছে গেলে, সে ততড়িঘড়ি করে, আপু চল বাসায় যাই। এখানে দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট না করি। আমার কালকে এক্সাম।

মিরা দ্রুত ইরার গালে একটা চুমু দিয়ে বলে ,পড়লেও তুই ফেল করবি, না পড়লেও ফেল করবি।

ইরা সরু চোখে তাকালো কিন্তু কিছু বললোনা। মিরা সায়েমা আপার সঙ্গে কোলাকুলি করে গাড়ি তে বসে। সে ভিজে গেছে। মা তার পাশে বসে নিজের আঁচল দিয়ে মিরার চুল মুছে দিতে লাগে। মিরাও চুপটি করে মায়ের আদর উপভোগ করতে লাগলো।

বড় আব্বু বলে উঠে, ফ্লাইট মেবি এক ঘন্টা লেটে ল্যান্ড করেছে তাই না?

মিরা উত্তর দিলো, জি বড় আব্বু।

এরপর মায়ের বুকে নেতিয়ে পড়ে ফিসফিস করে বলে, আম্মু?

— হু?

— আব্বু এলো না যে?

সুপ্তি বেগম মেয়ের প্রশ্নের জবাব দিলোনা।

মিরা কাতর গলায় বলে, এখনো রেগে আছে আমার উপর?

উনি এই প্রশ্নেরও জবাব দিতে ব্যর্থ হলো। কিছুক্ষণ পর তিনি টের পেল মিরা কাঁদছে।

সুপ্তি বেগম পিলে চমকে উঠে। আজকের দিনে মেয়েটার না কাঁদলে কি খুব ক্ষতি হতো?

চলবে।

[ আসসালামু আলাইকুম সবাইকে। আজকে বাবা দিবস উপলক্ষে একটা বোনাস পার্ট দিলাম। সবাই মন্তব্য করবেন এবং পৃথিবীর সকল বাবাদের জন্য রইল অসীম শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও দোয়া। সব বাবারাই সুস্থ থাকুক৷ ভালোবাসা অবিরাম ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here