শেহজাদী পর্ব-১২

0
991

#শেহজাদী
Part–12
Arishan_Nur (ছদ্মনাম)

হিম শীতল বাতাস এসে দোলা দিচ্ছে। আশেপাশে মৃদ্যু আওয়াজে মেঘ ডাকছে। মিরা রেলিঙের সঙ্গে ঘেঁষে দাঁড়িয়ে নিচের দিকটা দেখার চেষ্টা করছে৷ কিন্তু নিচে কেউ নেই! সে কি ভুল দেখলো? নাহ! তার চোখ ভুল দেখতে পারেনা! সে স্পষ্ট ইমানকে দেখেছে। ঠিক সেই সময় মিরার ফোন বেজে উঠল। সে তড়িঘড়ি করে ফোন রিসিভ করে।ওপাশ থেকে সোনালী আপু বলে উঠে, কি রে? বিদেশ থেকে এসে কি ছাদেই পড়ে থাকবি? বাসায় আয়। গল্প করব।

মিরা উশখুশ করে বলতে লাগে, আপু একটা প্রশ্ন করি?

— হ্যাঁ কর?

— ইমান কি বাসায় এসেছে ?

সোনালী আপু উত্তর দিলোনা। এরপর একটা মিনিট থেমে বলে, কে এসেছে? শুনতে পাইনি।আবার বল?

মিরা বিপাকে পড়ে গেল। ইমানের কথা জিজ্ঞেস করতে তার সংকোচ বোধ কাজ করছে। আপুকে পুনরায় তার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা মিরার জন্য সম্ভব না। সে মিনমিনে সুরে বলে, নাহ কিছু না৷

— তুই কি ফোনে কথা বলার জন্য এতোগুলা টাকা খরচ করে দেশে ফিরলি?

মিরা স্মিত হেসে বলে, আসছি আমি।

সে ফোন রেখে আরো একটা বার রেলিঙের ফাঁক দিয়ে নিচটা দেখে নিলো। তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে ইমান এসেছে আর মেয়েদের গাটস্ ফিলিংস কখনো ভুল হয় না। কিন্তু ইমানকে আর দেখতে পায়নি সে।

সে আর সময় নষ্ট না করে নিচে নেমে এলো।

সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে ছয়তলা থেকে তিনতলায় নেমে এসে সে যেই না দরজা খুললো, ড্রয়িং রুমে বাবার মুখোমুখি হয়ে পড়ল। মিরার বুকটা কেঁপে উঠে। ভয়ে কিংবা সংকোচে! সে চোখ তুলে একবার বাবার দিকে তাকালো। বাবার আধো কাঁচা আধো পাকা হওয়া দাঁড়ি গুলোর দিকে নজর পড়তেই প্রথমবারের মতো মনে হলো, অনেকটা সময় অতিবাহিত হয়ে গেছে৷ এয়ারপোর্ট থেকে আসার পর একবারও মনে হয়নি যে ছয়টা বছর! বাহাত্তর টা মাস পেড়িয়ে গেছে।

সে মাথা নিচু করে নরম গলায় বলে উঠে, আসসালামু আলাইকুম আব্বু।

মিরার বাবা একবার নিজের মেয়েকে সরু চোখে দেখে নিয়ে বলে, ওয়ালাইকুম আসসালাম। এরপর আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করেই সে নিজের রুমে ঢুকে পড়ে। মিরা চুপচাপ দাঁড়িয়ে বাবার প্রস্থান দেখলো। সে জানে বাবা তার উপর ভীষণ রেগে আছে। এই রাগ ভাঙ্গাবে কিভাবে সে?

তখনি ইরা নিজের রুম থেকে বের হলো। মিরা বলে উঠে, তোর পড়া শেষ?

— হ্যাঁ।

— তোর সঙ্গে আজকে রাতে ঘুমাই?

ইরার বলতে ইচ্ছা করলো যে, আজকে না অন্য দিন একসাথে ঘুমাই কিন্তু মুখে প্রকাশ করতে পারছেনা। আপুর এমন মায়া-মায়া দৃষ্টি সে উপেক্ষা করতে পারলো না বিধায় বলে উঠে, আচ্ছা ঠিক আছে আসো।

মিরা বলে উঠে, মুখটা কালো হয়ে গেল কেন?

ইরা চমকে উঠে। এরপর নিজেকে ধাতস্থ করে বলে, মুখ কালো, নীল সাদা হয়না আপু! ঘুমাতে আসো!

মিরা ইরার রুমে এসে ঢুকে নিজের মনের খেয়ালে গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে বিছানা ঝাড়তে লাগে। বিছানা ঝাড়া শেষ হলে সে চিরুনি হাতে নিয়ে চুল আছড়ালো।

ইরা তার দিকে তাকিয়ে বলে উঠে, আপু তুমি বদলে গেছো।তুমি আগের মতো নেই আর,,,,,,

মিরা ইরার দিকে তাকিয়ে, তার চোখে চোখ রেখে বলে, মানুষের ধর্মই বদলে যাওয়া। কাল, স্থান ও পরিস্থিতি ভেদে মানুষকে বদলে যেতে হয় নাহলে টিকে থাকা যায়না। দেখি আয়! তোর চুলে বেনী গেঁথে দিই।

— দরকার নাই।

— এক কাজ করি, তোর মাথায় তেল দিয়ে দিই।তাহলে মাথা ঠাণ্ডা থাকবে তোর। কালকে এক্সাম ভালো হবে৷

ইরা বলে, আমার মাথা ঠাণ্ডাই আছে৷

— তোর মাথার উপর একটা মুরগীর ডিম রাখলে সেই ডিম ভেঙে মুরগীর বেবি বের হবে!

ইরা না হেসে পারলোনা। আপু মাঝে মাঝে খুব মজার কথা বলে৷

মিরা কিছুক্ষণের মধ্যে বেশ আয়োজন করে তেল দেওয়া শুরু করে ইরার মাথায়। ইরা আর মিরার কুটুর কুটুর গল্প করার আওয়াজ শুনে সোনালী আপু এলো। তিন বোন মিলে একসাথে অনেক দিন পর গল্প করলো। খুব চমৎকার কিছু মূহুর্ত কাটলো!

★★★

ইমান খাওয়ার টেবিলে বসে আছে৷ রাত সাড়ে এগারোটা ছুঁইছুঁই। সে এখনো না খাওয়া। রাত আটটায় সোফার মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়েছিল সে।মাত্র উঠল। ক্ষুধা লেগেছে এইজন্য ঘুম থেকে উঠে খাওয়ার রুমে আসলো। তার জন্য খাবার টেবিলে রাখা আছে। শুধু গরম করে খেতে হবে। আজকের আয়োজন খুবই সাধারণ। ছোট মাছের তরকারি, মুরগির মাংস ঝোল ঝোল করে আলু দিয়ে রান্না করা। সঙ্গে মরিচ ভর্তা আছে। ইমান মরিচ ভর্তা পছন্দ করে।

সে ঘুম ঘুম চোখে ক্লান্ত শরীরে ওভেনে খাবার গরম করে নিল। টানা তিন ঘন্টা ঘুমানোর পরও তার ক্লান্তি ভাব যায়নি। বরং বেড়েছে শুধু তাই না! মিরাকে এক ঝলক দেখার পর থেকে মাথার অগ্রভাগে একটা সুক্ষ্ম চিনচিনানি ব্যথা শুরু হয়ে গেছে। মনে ভেতর বিদ্রোহ চলছে। আচ্ছা মিরা কি তাকে দেখে ফেলেছিল তখন? দেখার তো কথা না! এর আগে কতোবারই তো মিরাদের বাসার রাস্তার সামনে রাতে দাঁড়িয়ে থেকে মিরাকে ছাদে হাটঁতে দেখত সে!তখন তো মিরা টের পেত না! আজো পায়নি হয়তোবা। কিন্তু তাহলে রেলিং ধরে উঁকি কেন মারছিলো সে?

সে মাইক্রোওয়েভটার দিকে তাকিয়ে রইল নিষ্পলক চোখে। এই মাইক্রোওয়েভ থেকে নির্গত রশ্মি যেমন ভেতরে ঘুরতে থাকা খাবারের প্রতিটা দানার অনু-পরমাণুতে গিয়ে খাদ্যকে ভেতর থেকে গরম করে তুলছে তেমনই মিরাকে এক ঝলক দেখার পর থেকে ইমানের মনের ভেতরের প্রতিটা কোণায় কোণায় আঘাত হচ্ছে অবিরাম!

সে খাবার খেয়ে নিয়ে রুমে ঢুকে যায়। ফোন হাতে নিতেই দেখে চৌধুরীর ফোন। সে সঙ্গে সঙ্গে কল ব্যাক করে।

মিস্টার চৌধুরী কল রিসিভ করে বলে, ইমান! কেমন আছো এখন?

— আমি কখনো খারাপ থাকি?

— তোমাদের কোম্পানির জন্য দুর্দান্ত একটা অফার আছে।

ইমান কিছুটা উত্তেজিত হয়ে বলে, কি?

— আমি আজকে সন্ধ্যায় ড্রিম এটিয়ারের ওনারের সঙ্গে ফোনে কথা বললাম। উনি আমার সঙ্গে কাজ করতে ইচ্ছুক। তো আমি চাইছিলাম,,,,,,

— আমাদের সঙ্গে পার্টনারশীপ রাখবেন না তাই তো?

— আমার কথা শুন!

— আই নো আমাদের কোম্পানি লসের সম্মুখীন হয়েছে কিন্তু এটা ওভারকাম করতে পারব। তারপর ও আপনার আমার সঙ্গে কাজ করতে ইচ্ছা না থাকলে ইটস টোটালি ওকে।

মিস্টার চৌধুরী ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলে, ইমান! তোমার কাজ আমার খুব পছন্দ! তুমি অনেক ওনেস্ট। আই লাইক ইউ এটিটিউট। এটা ঠিক যে একবার যেই কোম্পানির সাথে কাজ করার পর আমার লস হয়, আমি সেকেন্ড টাইম ওই কোম্পানির সঙ্গে কাজ করিনা। বাট দিস টাইম আই এম ব্রেকিং দ্যা রুল। তোমার সাথে আরো কাজ করার ইচ্ছা আছে আমার। বাট ফিনানশিয়াল একটা ব্যাপার আছে তাই না? এইজন্য ড্রিম এটিয়ারের সঙ্গে পার্টনার শীপে যাচ্ছি। ওদের জনপ্রিয়তা আছে। একসাথে কাজ করলে, আমরা কোম্পানির লসটাকে দ্রুত রিকভারি দিতে পারব।

— বাট,,,,,

— ইমান! আমি অনেক চিন্তা-ভাবনা করেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তোমার চেয়ে সিনিয়র আমি। যা সিদ্ধান্ত নেই এর পেছনে কল্যাণ লুকিয়ে আছে। জাস্ট কো-অপারেট।

ইমান বলে উঠে, আর কাউকে পাইলেন না? ড্রিম এটিয়ারের জন্যই কিন্তু আমার লস হয়েছে। আই জাস্ট হেইট দিস কোম্পানি! উড়ে এসে জুড়ে বসেছে।

— ইমান মাথা ঠাণ্ডা করো। ভেবে দেখো যার জন্য লস হয়েছে তার মাধ্যমেই আবার প্রোফিট আনব! এটাই আমার মাস্টার প্লান। ওদের জনপ্রিয়তা ভাঙ্গিয়ে আমরা লাভবান হবো সেই সাথে ওরাও এস্টাবলিশ হবে। দুই পক্ষেরই লাভ! আর তাছাড়া ওদের সঙ্গে কম বাজেটেই ডিলটা ফাইনাল করেছি। যেটা কিনা আমার জন্য খুবই ভালো।

ইমান হালকা গলায় বলে, একটা মিটিং ফিক্সড করে লাইভ করা সুন্দরী আপুর সঙ্গে।

মিস্টার চৌধুরী বলে উঠে, কালকে দুপুরে ধানমণ্ডিতে দেখা-সাক্ষাৎ হবে। গ্লোরিয়া জিন্সে। তুমি আসো। কথা বলো। গল্প করো। আমরা সবাই মিলেমিশে কাজ করে ক্ষতি পূরণ করব৷

— আচ্ছা আসব।

— ঘুমাও তাইলে। কালকে দেখা হচ্ছে। ও ভালো কথা! তোমার কি বিয়ে হয়েছে?

ইমান এই প্রশ্নে পিলে চমকে উঠে বলে, না৷

— ড্রিম এটিয়ারের মেয়েটাও কিন্তু কমবয়সী।

— তো? আমি কি করব?

— আরে চেতে যাও কেন? এক কাজ করো কালকে মিটিংয়ে দেখা করার সময় ম্যাডামের জন্য ফুল নিয়ে এসো।

ইমান কিছু বললো না।

মিস্টার চৌধুরী হেসে বলে, আমি যদি ম্যারিড না হতাম তাইলে আমিই ওনার সঙ্গে লাইন মারার চেষ্টা করতাম। তুমি এতো নিরামিষ কেন?

— নিরামিষই ভালো।

______________

পরের দিন সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে ইমান ভালো দেখে একটা দামী সাদা শার্ট পড়লো। সঙ্গে কালো প্যান্ট। শার্ট ইন করলেও, টাই পড়লো না। চুল গুলো সুন্দর করে গুছিয়ে হেয়ার ব্রাশ করে নিলো। কালো শু পড়ে নিল। হাতে ঘড়ি পড়ে পরিপাটি হয়ে রেডি হলো। যাওয়ার আগে কড়া করে পারফিউম লাগিয়ে নিলো। বলা যায় না! ড্রিম এটিয়ারের মালিক যদি আবার লাইভে আসে তাদেরকে নিয়ে!

যারা ফেসবুক লাইভ, টিকটক, ব্লগ করে, তারা সুযোগ পেলেই যেখানে সেখানে ভিডিও বানানো শুরু করে দেয়! কোন প্রাইভেসি মানে না! ভিডিও বানানোর জন্য তারা চাতক পাখির মতো বসে থাকে। যেই না একটা সুন্দর ডেকোরেশন যুক্ত জায়গা পায়, ওমনি হামলে পড়ে ভিডিও বানাবে!

গাড়ি নিয়ে অফিসের উদ্দেশ্য রওনা হলো৷ অফিসে আসলেও কোন কাজে তার মন বসছেনা! সবকিছুতেই অস্থিরতা ভাব প্রকাশ পাচ্ছে৷ আজাদ ভাই তো বলেই ফেললো, ভাই আপনি কি অসুস্থ?

ইমান উত্তর দেয়নি৷ সত্যি বলতে সে কেন এতো অস্থিরতা করছে এটা সে নিজেও জানে না!

সময়ের আগেই সে গ্লোরিয়া জিন্স পৌঁছে যায়। যাওয়ার পথে একটা লাল গোলাপের তোড়া নিলো কি মনে করে যেন!

প্রায় একঘন্টা পর মিস্টার চৌধুরী আসলেন। উনি এসে হড়বড় করে বলে, ম্যাডাম এসে গেছে। তুমি বাইরে গিয়ে রিসিভ করো। আমার ইংলিশ একসেন্ট ভালো না। তুমি সুন্দর করে ওয়েলকাম বলবে৷

ইমান বলে, আমি তো ওনাকে চিনি না! কাকে রিসিভ করব তাইলে?

— বাইরে গিয়ে দাঁড়াও। তোমার চোখে যেই মেয়েটাকে সবচেয়ে সুন্দরী লাগবে তাকে গিয়ে বিনা সংকোচে বলবে, ওয়েলকাম মিস বিউটিফুল!

ইমান বাইরে গিয়ে দাঁড়ালো। সে দাঁড়াতেই একটা কালো গাড়ি এসে রেস্টুরেন্টের সামনে থামলো। এরপর!

এরপর ইমান একটা বড়-সড় শক খেল। তার হলেও হতো পলাতক বউ হালকা গোলাপি শাড়ি পড়ে নামছে। ইমান চোখ সরাতে পারছেনা।

মিরা সম্ভবত তাকে দেখেনি। সে এদিকেই এগিয়ে আসছে। ইমানের হাত কাঁপছে। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। মিস্টার চৌধুরী তার পাশে এসে দাঁড়ালো।

মিরা রেস্টুরেন্টের গেটের সামনে এসে দাঁড়াতেই তার মাথায় বজ্রপাত এসে পড়লো। ইমান! ইমান এখানে কি করছে? তাও ফুল হাতে দাঁড়িয়ে কেন সে?

মিস্টার চৌধুরী ইমানের হাতে থাকা তোড়াটা জোরপূর্বক মিরার দিকে ঠেলে এগিয়ে দিয়ে বলে, ইমানের তরফ থেকে আপু আপনার জন্য লাল গোলাপের শুভেচ্ছা। লাল গোলাপ হলো ভালোবাসার প্রতীক!

ইমান-মিরা দুইজনেই দুজনের দিকে তাকিয়ে রইল। তারা নির্বাক। এভাবে দেখা হবে সেজন্য কেউই প্রস্তুত ছিলোনা।

ইমান মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থেকে হুট করে হাতে থাকা তোড়াটা মিরার পায়ের দিকে ছুঁড়ে মারে। বুটিকটা মিরার পায়ের কাছে এসে ফ্লোরে পড়ে বিকট আওয়াজ তুলে। সকলের দৃষ্টি তাদের দিকে।

মিরা পায়ে সামান্য ব্যথা পেয়ে আউ বলে উঠে। ইমান প্রচন্ড রাগে ফুঁসছে।

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here