#শেহজাদী
Part–13
Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
পায়ে অসহ্য ব্যথা নিয়ে মিরা ইমানের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে হতভম্ব। নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে আছে সামনে থাকা ব্যক্তির উপর। প্রথম দেখায় সে ইমানকে চিনতেই পারেনি। চেহারায় এতো পরিবর্তন আসলো কিভাবে? বয়সের তুলনায় চেহারা দশ বছর বেড়ে গেছে তার! চুলগুলো আছড়ানো হলেও অযত্ন ভাবটা ফুটে উঠেছে। শার্ট ইস্ত্রি করা থাকলেও হাতের দিকে কোচকানো। ইমানের চোখ এক জায়গায় স্থীর নয়। সে বার কয়েক দৃষ্টি নত করেছে। এই মূহুর্তে তাদের দুইজনের বুকেই বর্ষণ চলছে। তুমুল বজ্রপাত হচ্ছে বুকের ভেতর।
মিস্টার চৌধুরী বিরক্ত হয়ে বলে, ইমান? এসব কি? ফুল মানুষের হাতে দিতে হয়!,পায়ে না।তুমি ম্যাডামের পায়ে কেন ফুলের বুটিক ছুঁড়ে মারলে? ওনাকে আঘাত কেন করলে তুমি?
ইমান বিড়বিড় করে বলে, আপনার ম্যাডামের দেয়া আঘাতের সামনে আমার দেয়া আঘাত খুব সামান্য। অনুপাত করলে, ১০০ঃ১ হবে!
— কিছু বললে?
ইমানের চোখ মুখ লাল হতে লাগে। অতিরিক্ত উত্তেজিত বা অনাকাঙ্ক্ষিত কোন ঘটনা ঘটলে তার শ্বাসকষ্ট উঠে। এখনো নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তার।
ইমান টেনে টেনে শ্বাস নিতে লাগে। যা চোখ এড়ালো না মিরার।
সে নত হয়ে ফুলের তোড়াটা কুড়িয়ে নিয়ে নম্র গলায় বলে, আপনি ঠিক আছেন?
ইমান কড়া গলায় বলে, আমার ঠিক বা বেঠিক থাকা নিয়ে আপনাকে মাথা ঘামাতে হবেনা।
ইমানের ত্যাড়া জবাবে পুনরায় মিস্টার চৌধুরী বিরক্ত হয়ে বলে, ইমান প্লিজ বিহেইভ ইউরসেল্ফ৷
ইমান চুপ বনে গেল। সে চোখ উঠিয়ে মিরার দিকে তাকালো। সঙ্গে সঙ্গে বুকে কি যেন হয়ে গেল তার! মনের ভেতরে কুয়া গর্ত করে রাখা বিদ্রোহ গুলো শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়িয়ে ময়দানে নামতে চাচ্ছে! মিরাকে এই মূহুর্তে রুপকথার গল্পের বন্দিনী শেহজাদীর মতো ভয়ংকর রূপবতী লাগছে। ইশ কি মায়া সেই আঁখিযুগলে! যে আঁখিতে তার প্রতিসরণ নেই!
মিরা ব্যতিব্যস্ততা দেখিয়ে ফুলের তোড়াটা দেখতে লাগে। ওটার এক পাশ ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার জন্য ভেঙে গেছে৷ মিরা মূলত ওই ভাংগা অংশ ঠিক করার জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে গেছে৷
ইমান কিছুটা এগিয়ে আসে তার দিকে। এতে মিরা ঘাবড়ে যায়। সত্যি বলতে এই ইমানকে সে চেনে না! কেমন অচেনা, অপরিচিত লাগছে তাকে! তার চাউনীতে কোন অনুভূতি নেই।মিরা হালকা গলায় বলে, কি,,কি হয়েছে?
ইমান একেবারে তার মুখের সামনে দাঁড়িয়ে বলে, সামান্য একটা বেতের তোড়া ভেঙে যাওয়ায় এতো ব্যতিব্যস্ততা দেখাচ্ছ কিন্তু আমার হৃদয় ভেঙেও কোন হেলদোল নেই?
মিরা প্রথমে কথাটার মর্ম বুঝে উঠতে পারেনি৷ পরবর্তীতে যখন কথাটার অর্থ মস্তিষ্ক বুঝে নিল, সঙ্গে সঙ্গে তার মধ্যে প্রতিক্রিয়া দেখা দিলো। সে নড়েচড়ে উঠে ইমানের দিকে তাকালো। কিছু ই বুঝে পাচ্ছে না সে। সে কবে ইমানের মন ভাংলো?
মিস্টার চৌধুরী বলে উঠে, আপনারা কি পূর্বপরিচিত?
মিরা উত্তরে কিছু বলবে তার আগেই ইমান কাঠ কাঠ হয়ে বলে, না। পূর্বপরিচত ও নই এবং পরবর্তীতে পরিচিত হতেও চাচ্ছিনা।
মিস্টার চৌধুরী ইমানকে আর কিছু না বলে মিরাকে উদ্দেশ্য করে বলে, ম্যাডাম আসুন। রেস্টুরেন্টের ভেতরে আসুন। ওয়েলকাম!
মিরা ভদ্রতাসূচক হেসে বলে, ধন্যবাদ।
ইমানকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় একটা অঘটন ঘটে গেল। সকালে বৃষ্টি হওয়ায় রেস্টুরেন্টের সামনের জায়গাটা ভেজা ছিলো। মিরা হাই হিল পড়া পায়ে পিচ্ছিল জায়গায় পা রাখতেই ব্যালেন্স হারিয়ে হুমড়ি খেয়ে পেছনের দিকে পড়ে যেতে ধরলো। পেছনে ইমান স্তম্ভের মতো দাঁড়িয়ে ছিল বিধায় শেষ রক্ষা পায় মিরা।
সে ইমানের ঠিক বুকে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। বাঁচার জন্য তার শার্ট খামচে ধরে মিরা৷ ইমান খুব কষ্টে নিজের ভারসাম্য রক্ষা করে নাহলে সেও মিরাকে নিয়ে নিচে কাদায় পড়ে যেত।
মিরার মাথা গিয়ে ঠেকে ইমানের বুকে ঠিক হৃদপিন্ড বরাবর! ইমান ধাক্কা সামলানোর জন্য হলেও জোরপূর্বক মিরাকে বাহুডোরে আবদ্ধ করে নেয়।
মিরা চুপটি মেয়ের মতো ইমানের বুকে লেপ্টে পড়ে তার বুকের ধুকপুক আওয়াজ শুনতে লাগে। ইমানের হৃদস্পন্দনের তালে তালে মিরার হৃদপিন্ড ও ক্রমশ জোড়ে জোড়ে উঠানামা করছে। কানে বেজে চলেছে ইমানের স্পন্দন!
প্রতিটা স্পন্দন যেন মিরা মিরা বলে হাক ছেড়ে ডাকছে– এমন বোকা বোকা চিন্তায় মিরা নিজেই লজ্জা পায়।
ইমান দাঁতে দাঁত চেপে বলে, এই যে ভদ্রমহিলা! এটা আমার বুক। আপনার বেডরুম না যে হেলান দিয়ে পড়ে থাকবেন। এই বুকে আপনার কোন জায়গা নেই।
মিরা তড়িঘড়ি করে উঠে দাড়ালো।কি আশ্চর্য! সে মাত্র চব্বিশ বছরের একটা মেয়ে তাকে মহিলা বলে কোন সাহসে?
সে রাগে-দুঃখে সরে আসতে গেল কিন্তু ভাগ্য সহায় ছিলোনা। মিরার অবাধ্য চুলগুলো গিয়ে ইমানের শার্টের বোতামের সঙ্গে আটকে গেল। যার ফলে মিরা সরে এসেছেও তার থেকে দূরে যেতে পারলোনা।
ইমান তিক্ততা নিয়ে বলে, প্রবলেম কি আপনার?
ইমানের বলা কথায় কোন কারন ছাড়াই চমকে উঠে মিরা। কেমন অদ্ভুত একটা অনুভূতি হচ্ছে তার। শ্বাস নেওয়ার পর মনে হচ্ছে বুকে আরো বাতাস দরকার! ইমান কি তাকে চিনতে পারেনি? আপনি-আপনি।বলে ডাকছে কেন?
সে হাত এগিয়ে ইমানের শার্টের বোতাম ধরতে চাইলে ইমান বাঁধা দিয়ে বলে, ডোন্ট টাচ মি৷
মিরা থমকে গেল তার গমগমে সুরে। হাত বাড়ানোর সাহস পেল না।
ইমান নিজ উদ্যোগেই বোতাম থেকে চুলগুলোকে মুক্তি দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে কিন্তু বেয়াদব চুলগুলোও নাছোড়বান্দা। তারা আরো জট পাকিয়ে ঘাপটি মেরে বসে রইল। ইমানের রাগ উঠে গেল। সে বেশ শক্তি অপচয় করেই চুল গুলো টান দিয়ে ছিঁড়ে ফেলে। মিরা হতবাক হয়ে নিরব দর্শক হয়ে চেয়ে থাকে৷ কিছু বলতে পারছে না সে।মনে মনে বলে উঠে, বজ্জাত ছেলে! আমার এতোগুলো চুল টান মেরে ছিঁড়ে দিলো!
ইমান গটগট করে রেস্টুরেন্টের ভেতরে ঢুকে যেতে লাগলে, মিরা পিছু ডেকে উঠে, ইমান?
ইমান থেমে যায়। সে ভীষণ অবাক হলো। কিন্তু ঘাড় ঘুরালো না বরং থামলোও না। সামনে এগিয়ে যায় যেন মিরা নামের কোন রূপবতী তরুণী তার নাম ধরে ডাকেনি৷ কিন্তু সে বিষ্মিত কারণ এই প্রথমবার মিরা তাকে নাম ধরে ডাকলো। অথচ আগে বাক্যের শুরু তে একবার এবং শেষে একবার ভাইয়া যুক্ত করত!
ইমান রেস্টুরেন্টের ভেতরে ঢুকে চেয়ার টেনে বসলো। মিস্টার চৌধুরী তার পাশে বসে ছিল আগে থেকেই। ইমানকে বসতে দেখে উনি বলে উঠে, মেয়েটার সঙ্গে এমন রুড বিহেইভ কেন করলে তুমি? ও যদি এখন এই ডিলে রাজী না হয়৷
ইমান পুনরায় বিমূঢ হয়। আচ্ছা মিরাই কি তবে ড্রিম এটিয়ারের মালিক? এই খেয়াল আগে আসেনি কেন তার মাথায়? তার টনক পড়লো। একে একে দুই মিলাতে থাকলে, ইতিমধ্যে মিরা ফুল হাতে তার বিপরীতে বসলো।
মিস্টার চৌধুরী বলে উঠে, ও হচ্ছে ইমান। আমাদের বিসনেস পার্টনার। শুধু আমার না। যদি তুমি আমাদের সঙ্গে এই প্রেজেক্টে কাজ করতে রাজী হও, তাহলে তোমার ও বিসনেস পার্টনার হবে৷
— ওহ। [ মিরা হালকা গলায় বলে। ]
মিস্টার চৌধুরী বলে উঠে, ইমান কিন্তু খুব ব্রিলিয়ান্ট। ইঞ্জিনিয়ার ও। সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার।
মিরা কিছু বললোনা। সে ধারণা ও করতে পারেনি যে ইমানের সঙ্গে সে কাজ করবে! ঢোক গিলে জবাব দেয়, আমার সঙ্গে কাজ করতে মেবি ওনার সমস্যা আছে।
ইমান চোখ তুলে মিরার দিকে তাকালো। প্রতিত্তোরে কিছু বলেনা।
মিস্টার চৌধুরী হোহো করে হেসে বলে, আরে ধুর কি বলো ইমান তো এক পায়ে রাজী তোমার সাথে কাজ করার জন্য
একথা শুনে মিরা ইমানের দিকে তাকালো। সঙ্গে সঙ্গে তার প্রচন্ড লজ্জা লাগতে লাগে। এর আগেও তো ইমানকে সে দেখেছে। এমন কি ইমান তার গালে চুমুও খেয়েছে তারপরে ও কেন আজ এতো লজ্জা লাগছে তার? লজ্জায় তার মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না। সে উশখুশ করে চশমা ঠিক করতে লাগলো এবং ইমানকে দেখে কেন তার এমন অনুভূতি হচ্ছে এই বিষয়টা নিয়েও ভাবতে লাগে।
মিস্টার চৌধুরী একটা পেপার এগিয়ে দিয়ে বলে।,নাও ইমান সিংনেচার দাও একটা।
ইমান রোবটের মতো ঘটাঘট নিজের সিংনেচার দিয়ে দিলো কাগজে।
এবারে উনি মিরার দিকে পেপারে এগিয়ে দিলে, সে কাঁপা হাতে সিংনেচার করতে লাগলো।
ইমান মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইল তার দিকে। আচ্ছা
এক জীবনে কি মানুষ একজনকেই ভালোবাসে? দ্বিতীয় জনকে ভালোবাসার অবকাশ নেই? কেন বারবার বেহায়া মন মিরাতেই গিয়ে থামে? ইমান অনুভূতি শূন্য হয়ে পড়েছে।
মিরাকে এতোটা সফল হতে দেখে সে খুশি হয় কিন্তু মিরাকে না পাওয়ার তীব্র ব্যথা, সেই সুক্ষ্ম অপমান টাও মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে লাগলো।
মিরা যেই না মিস্টার চৌধুরীকে পেপার টা এগিয়ে দিলো, উনি হুটহাট করে বলে উঠে, অভিনন্দন আজ থেকে তোমরা লাইফ পার্টনার !
একথা শুনে ইমান এবং মিরা পিলে চমকে উঠে একে অপরের দিকে তাকায়।
চলবে।