#শেহজাদী
Part–4
Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
রাতের ঢাকা শহরটাকে বড্ড অচেনা লাগছে আমার কাছে। এই শহরটা যেন কোন কালেই আমার আপন ছিলো না। আশেপাশে সব অপরিচিত মুখ দেখে আমি ঘাবড়ে গেলাম। ভেতর থেকে অস্থিরতা তৈরি হতে লাগলো। আমি পেছনে ফিরে তাকিয়ে দেখলাম, উবার চলে গেছে। সামনের পিচ ঢালা কালো রাস্তা ধরে সাইসাই করে ছুটছে গাড়ি। আমি অসহায় দৃষ্টিতে গাড়ি গুলোর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। আশায় আশায় আছি যদি এই গাড়ির মধ্যে কোন একটা থেকে বাবা বের হয়ে আসে। কিন্তু আদৌতে এটা সম্ভব নয়। বাবা তো জানেও না আমি এখন কোথায়! আবিরকে বিশ্বাস করে বড্ড বেশি বোকামী করে ফেলেছি। অচেনা এক ছেলের মোহে আটকা পড়ে এভাবে নিজের বাবা-মা কে ফেলে আসা যে একটা অন্যায় তা দিব্যি বুঝতে পারছি। আমার খুব করে কান্না পাচ্ছে। যদিও বা কান্না করার কিছু নেই। কারণ আমি চাইলেই এই মূহুর্তে ফিরে যেতে পারি। জন্ম থেকে ঢাকায় বড় হয়েছি আমার কাছে ফিরে যাওয়া কঠিন না কিন্তু আমি মানতে পারছি না যে আমার সঙ্গে আবির প্রতরণা করেছে৷ কি মিস্টি মিস্টি কথোপকথন করত! কই গেল সেই প্রেম মাখা কথা গুলো? ইতিমধ্যে আমার হাত-পা কাঁপছে। রাত এগারোটা ছুঁইছুঁই। ঢাকাবাসীর জন্য রাত এগারোটা কিছু না হলে আমার জন্য রাত এগারো মানেই ঘরে থাকা। এই প্রথম এতো রাতে আমি একলা বাইরে আছি। ঢাকা শহর আমার প্রিয় শহর হলেও বলতে বাধ্য এই শহরে এতো রাতে বাইরে একা থাকা তেমন একটা নিরাপদ না। আমি ফোন বের করলাম। ফোন বের করতেই মন বিষিয়ে এলো। এই ফোন হাতে নিয়ে থাকার জন্য আম্মু কতো বকেছে তার নেই হিসেব। আম্মুর চেহারা আমার চোখের সামনে ভেসে আসতেই আমি ঠোঁট কামড়ে কেঁদে দিই৷ অপরাধ বোধে আমার গা কাঁপতে লাগে। কিভাবে পারলাম নিজের মা-বাবা কে ফেলে চলে আসতে? আমি এতো অবিবেচক হলাম কি করে? আমি অস্ফুটে আম্মু বলে কেদে দিতেই পেছন থেকে ভরাট কন্ঠে কেউ বলে উঠে, কলেজ পড়ুয়া হয়েও এভাবে আম্মু আম্মু করছিস ক্যান? ছিঃ ছিঃ তুই কি গ্যাদা বাচ্চা রে মিরা?
নিজের পরিচিত কাউকে পেয়ে আমি পিলে চমকে উঠি। সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎ গতিতে ঘাড় ঘুরাতেই নজরে আসলো,লম্বা রোগা শরীরের কোমল ফর্সা চেহারাটা। উনি ভ্রু কুচকে দাঁড়িয়ে আছে৷ ভ্রু কুচকে তাকালে ওনার কপালের ঠিক মাঝ বরাবর একটা দাগ ফুটে উঠে৷ কিছুটা আরবী বর্ণ আলিফের মতো দেখতে লাগে। ওনার চেহারা খুবই সাধারণ। আরজে হলে কি হবে? চেহারা তার আর দশ মানুষের মতোই।তবে আরো একটা বৈশিষ্ট্য আছে তার! ওনার সিল্কি চুল। কপালে পড়ে থাকা সিল্কি চুল!
উনি সামনে এগিয়ে এসে বলে, এই তোর বাপ-চাচা কই? তুই একা এখানে রাস্তায় দাঁড়িয়ে এভাবে ভ্যা ভ্যা করে কেন কাঁদছিস?
আমি নাক টানতে লাগলাম। কান্না থামানোর চেষ্টা করলেও লাভ তো হলোই না বরং কান্নার স্রোত বেড়ে গেল যেন। এবারে যেন ওনার আমার প্রতি মায়া হলো। সে নিচু আওয়াজে নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলে, মামা-মামী কোথায়? রাত ক’টা বাজে কিছু জানিস? তোদের গাড়ি কই?
ওনার কোন প্রশ্নেরই উত্তর দিতে পারলাম না। ওনার চোখ এবারে আমার হাতে থাকা ব্যাগের দিকে গেল। তিনি এক মিনিট ও অপেক্ষা না করে আমার ব্যাগ ছো মেরে নিয়ে নিলো। ব্যাগ খুলে সে একে একে আব্বুর মগ বের করলো, এরপর সেটা ঢুকিয়ে, আম্মুর ওড়নাটা বের করে নেড়েচেড়ে দেখে আবার ঢুকিয়ে আমার টাকাগুলো বের করে গোনা শুরু করলো। আমি এদিক-ওদিক তাকাচ্ছি৷ লজ্জায় আমার মাথা নিচু হয়ে গেছে।
উনি বলে উঠে, এই মিরা! তুই কি বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছিস?
ওনার কথা শুনে আমি মাথা তুলে তাকিয়ে ব্যাপার টা যেই না অস্বীকার করব ওমনি উনি বলে উঠে, দেখ একদম মিথ্যা বলবি না আমাকে। মনে রাখবি! তুই যেই স্কুলের কিন্ডারগার্টেন স্টুডেন্ট আমি সেই স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক। এবার বল, এতো সাহস হলো কিভাবে তোর? তুই তো কানি। কানি মানুষ তো ভীতু হয়৷
আমার মেজাজ একটু একটু করে বিগড়ে যেতে লাগলো। আমি মোটেও কানি নই। শুধু চোখে চশমা পড়ি। এইজন্য কেউ কানি হয়ে যায় না নিশ্চয়ই?
উনি বললেন, চুপ করে আছিস কেন? উত্তর দে!
আমি কপটতাহীন ভাবে বলে দিই, আমি আপনাকে বিয়ে করব না শুনেছেন নিশ্চয়ই?
সে কাধ বাকিয়ে বলে, হ্যাঁ।
— জোর করে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে আমাকে। তাও বাল্যবিবাহ। পালাব নাতো কি বসে বসে মুড়ি খাব?
— মোটেও বাল্যবিবাহ না। আমার স্পষ্ট মনে আছে তুই দুই হাজার এক সালে হয়েছিস। এখন তোর বয়স গুনে গুনে বিশ।
আমি এবার বাঘিনী গলায় বলি, আমি আপনাকে বিয়ে করব না। ব্যস।
উনি উত্তরে কিছু বলবেন তার আগেই ওনার ফোন বেজে উঠল। তিনি ফোন রিসিভ করে বলে উঠে, আসসালামু আলাইকুম মামা।
আমি কেঁপে উঠি। সর্বনাশ বাবা ওনাকে কেন কল দিলো? বাসায় কি সবাই জেনে গেল যে আমি পালিয়ে গেছি৷
আমার কানে ওনার কন্ঠ ভেসে আসে। উনি বলে উঠে, মামা আসলে মিরা আমার সঙ্গেই আছে আমরা তো বাসার পাশেই একটু আলাদা ভাবে কথা বলছি। আপনি চিন্তা করবেন না। মিরা আমার সঙ্গেই আছে। আমি একটু পর ওকে বসায় দিয়ে আসব।
আমার অবস্থা তখন পানির মাছকে মাটি ফেললে যেমন ছটফট করে ঠিক তেমন।
উনি কথা শেষ করে ফোন পকেটে ঢুকিয়ে বলে, চল তোকে রেখে আসি।
— লাগবে না আমি একাই যেতে পারব।
— কানি মেয়েদের এতো ফরফর করতে হয় না। আয় চুপচাপ।
আমি আর প্রতিবাদ করলাম না । ওনার সঙ্গে হেঁটে যেতে লাগতাম।কান্না করার জন্য মাথা ব্যথা হয়ে গেছে। সামনেই ওনার গাড়ি। উনি চাবি বের করে গাড়ির লক খুলে ড্রাইভিং সিটের পাশের সিটটা খুলে দিলো৷ কিন্তু ওই যে আমি তো আমিই। একটু বেশি ঘাড়ত্যাড়া। এইজন্য ঠাস করে দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে পেছনের সিটে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে পড়লাম।
মশাটার রিয়্যাকশন দেখতে পেলাম না। নিশ্চয়ই হা হয়ে গেছে সে। হা হলে হোক! মশার মুখে মাছি ঢুকে গেলে ঢুকুক! আমার কি?
উনি নিজেও এবারে ড্রাইভিং সিটে এসে বসে পড়ে আমার সালামীর টাকা হাতে নিয়ে আমার চোখের সামনে মেলে ঝাঁঝালো কন্ঠে বলে, এই টাকা গুলো কোথা থেকে চুরি করেছিস?
আমার ভীষণ রাগ হলো। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে বলি, এগুলো আমার সালামীর টাকা।
— এতো টাকা কে তোকে সালামী দিয়েছে?
— বড় আব্বু।
— সে কি! কই আমাকে তো একটা পয়সাও দেয় নি বড় মামা।ঈদের তিন পর তোদের বাড়ি গেলাম আমাকে সাত হাজার টাকা তো দূর এক আনাও দেয় নি। এমন অন্যায় কেন করা হলো আমার সঙ্গে?
আমি মনে মনে বলে উঠি, দেয় নি ভালোই হয়েছে! কিন্তু মুখে বললাম, আমি জানি না।
উনার আমার টাকাগুলো নিজের পকেটে রেখে বলে, বাচ্চা মানুষের কাছে এতো গুলো টাকা রাখতে নেই। আমি রেখে দিচ্ছি।
আমি বাঁজগাই গলায় বললাম, এই বাচ্চা মেয়েকেই তো বিয়ে করছেন! বাচ্চা যদি ভাবেনই তাহলে বিয়ে কেন করছেন৷
আমি লুকিং গ্লাস দিয়ে দেখলাম, উনি হালকা হেসে উঠেছেন।
তিনি রেডিও চালু করে। রেডিওতে তারই কন্ঠ ভেসে আসলো, আসসালামু আলাইকুম এবং হ্যালো গাইস, আমি আরজে ইমান আছি “প্রিয়তমা” সো থেকে এবং আবারো ফিরে এলাম আপনাদের মাঝে। আজকে আমাদের আড্ডার টপিক হলো এক তরফা ভালোবাসা। ওয়ান সাইড লাভ। প্রোবাবলি ওয়ান সাইন্ড লাভ ইস দ্যা মোস্ট বিউটিফুল ফিলিং এভার!
আমি আর শুনলাম না। উনি আরজে হলে কি হবে? ওনার কণ্ঠ পুরাই কাকের মতো৷ আমি আপাতত শুনতে পাচ্ছি রেডিওতে কেউ কাকা কাকা কাকা করছে।
জানালার দিকে তাকাতেই আমার খেয়াল হলো, আবিরের দেওয়া ঠিকানায় উনি কিভাবে আসলো?
চলবে।
[ আসসালামু আলাইকুম সবাইকে। আপনাদের সঙ্গে জরুরি একটা কথা আছে৷ কথাটা হলো পর্ব বেশ ছোট হচ্ছে এর পেছনে কারণ হলো আমি লিখে আরাম পাচ্ছি না। লেখা আটকে আসছে। আমি সবসময়ই গল্প থার্ড পার্সন বা তৃতীয় ব্যক্তি হয়ে দুই পক্ষকে নিজের ভাষায় তুলে ধরি৷ কিন্তু এই গল্প হুটহাট ফাস্ট পার্সনে লিখা শুরু করে বিপাকে পড়ে গেছি। একফোঁটা আরাম পাচ্ছি না লিখে। এইজন্য একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি তাহলো, আগামী পর্ব থেকে থার্ড পার্সনে লিখব। আশা করি, আপনারা আমাকে বুঝবেন এবং আমার সিদ্ধান্তকে শ্রদ্ধা করবেন সেই সাথে গল্পের এই সীমাবদ্ধতার জন্য আমি আন্তরিক ভাবে দুঃখিত। ভালোবাসা অবিরাম। ]