শেহজাদী পর্ব-৫

0
1109

#শেহজাদী
Part–5
Arishan_Nur (ছদ্মনাম)

গাড়িতে থাকতেই ঝুমঝুম করে বৃষ্টি নামলো। বৃষ্টি মিরার খুব প্রিয়। এতোটাই প্রিয় যে সে এক্সাম হলে একবার লেখা বাদ দিয়ে বৃষ্টি দেখায় ব্যস্ত ছিলো। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, আজকে মিরার এই বৃষ্টি গুলো বিষাদময় লাগছে৷ আসলে মিরার মনে হয়, সৌন্দর্য বলতে কিছু নেই। আমার চোখ যেই দৃশ্য দেখে আরাম বোধ করবে সেই দৃশ্যপটই আমার জন্য সুন্দর! সেটা অন্যদের কাছে সুন্দর নাও লাগতে পারে।

ইমান বলে উঠে, মিরা তুই কিন্তু আমার প্রশ্নের জবাব দিস নি?

— আপনি কলেজের টিচার না যে আপনার প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে৷

— বাড়ি থেকে পালিয়ে যাচ্ছিলি তুই, একে তো বিরাট অন্যায় করছিলি আবার আমার সঙ্গে মুখে মুখে তর্ক করে এখন দ্বিতীয়বারের মতো অন্যায় করছিস। তোর বড্ড বাড় বেড়েছে। তোকে সাইজ করতে হবে৷

— আমাকে কষ্ট করে সাইজ করার দরকার নেই তার চেয়ে বরং বিয়ে না করুন।

— শোন মিরা আমিও কিন্তু নিজের মতে বিয়েতে রাজী হইনি। নানী অনুরোধ ফেলতে পারিনি আমি৷ আর তুই! একবারও নানীর কথা না ভেবে পালিয়ে এলি। ধিক্কার জানাই তোর উপর!

মিরা গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে পড়ে। আসলেই তো দাদীর কথা একবারো তার মাথায় আসেনি।

ইমানের কন্ঠস্বর তার কানে এলো, নানী মানুষ টা অসুস্থ হওয়ায় পর একটাই কথা বারবার বলে যাচ্ছে যে তোর আর আমার বিয়ে যেন মরার আগে দেখে যেতে পারে। এটা নাকি তার শেষ ইচ্ছা। অথচ তুই নানীর শেষ ইচ্ছাটাও পালন করতে চাচ্ছিস না। বড্ড স্বার্থপর তুই৷

মিরা চমকে উঠে। দাদীর ক্যান্সার ধরা পড়ার দিন থেকেই সে তার এবং ইমান ভাইয়ার বিয়ে দেখে যেতে চাচ্ছে। মিরার বাবা প্রথমে রাজী হচ্ছিল না কারণ মিরা মাত্র কলেজে পড়ে। তাছাড়া ইমানের পড়া শেষ হয়নি। প্রতিষ্ঠিত না। কিন্তু পরবর্তীতে নিজের মায়ের ইচ্ছা পূর্ণ করার জন্য তিনি রাজী হন। দাদীর সঙ্গে মিরার দিনে যতোবারই দেখা হয়, উনি মিরার হাত ধরে বলে, বোনু অভাগা ছেলেটাকে বিয়ে করে তুই ওকে সামলা। নিজের রক্ত দূর দূর থাকলে সহ্য হয় না রে।

দাদীর আকুলতা দেখে তার মায়া লাগত কিন্তু ওই যে আবিরের মোহে আটকা পড়ে দাদীর মায়া অগ্রাহ্য করে সে। কিন্তু যেদিন বাবা এবং বড় আব্বু রাজী হলেন,মিরা ভয়ে কিছু বলতে পারেনি।কারণ তাদের উপর কথা বলার সাহস মিরার নেই। এরপর কথা-বার্তা চলতে লাগলো। অতঃপর আগামীকাল নাকি তার বিয়ে!

— কি এতো ভাবছিস? পালানোর নতুন পায়তারা করছিস নাকি?

মিরা কিছু বললো না। ইমান উত্তরের আশা রাখেনি কারণ চোর চুরি করার আগে কখনোই বলে-কয়ে চুরি করতে যায় না।

মিরাদের বাসার সামনে যখন গাড়ি থামায় সে, তখন মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে।

ইমান বলে উঠে, যাহ তোকে বাঁচিয়ে দিলাম। আজকে যদি বড় মামা জানত তার আদরের মিরা-মামণি বিয়ের আগের দিন পালানোর চেষ্টা করেছিলো তাইলে মনে কর, তোকে এই মূহুর্তে মেরে তক্তা বানিয়ে ছাড়ত৷

মিরা ভয়ে ঢোক গিললো। সে পিটপিট করে কাঁচের জানালার দিকে তাকিয়ে থেকে বলে উঠে, আপনি ধানমণ্ডি তে কি করছিলেন?

মিরা লক্ষ করে এই প্রশ্নে ইমান ভাইয়া কিছুটা হচকচিয়ে গেল। কিন্তু খুব দ্রুত সে নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, আমার রেডিও স্টেশন টাই তো ধানমন্ডিতে।

— ওহহ!

— তুই কি ভেবেছিস আমি তোর পিছে পিছে ঘুরঘুর করি? শোন আমাকে এতো সস্তা ভাববি না।

মিরার আর কিছু শোনার অপেক্ষা না করে গাড়ি থেকে বের হয়ে গেল। ইমান পেছন থেকে চেচাতে লাগে, আরে ভিজে যাবি তো!

মিরা নিরুত্তর থেকে বাসার গ্যারেজে ঢুকে পড়ে। নিজের ব্যাগটা ইচ্ছা করেই গাড়িতে রেখে এসেছে সে।

সে বাসায় আসতেই মা এবং বড় আব্বুর সম্মুখীন হলো। আম্মু তাকে দেখেই স্মিত হেসে বলে।,যাওয়ার আগে একবার বলে তো বের হবি।তোকে রুমে না পেয়ে কতো ভয় পাচ্ছিলাম আমরা। আর ভিজে গেলি কিভাবে তুই? কালকে সকালে যে তোর গায়ে হলুদ সেই খেয়াল আছে তোর? যা যা রুমে গিয়ে গোসল সেড়ে নে। আমি হেয়ার ড্রাইয়ার নিয়ে আসছি৷

মিরা জোরপূর্বক হেসে নিজের রুমে গিয়ে সোজা বাথরুমে গেল। গোসল করে ফিরে এসেই দেখে, মা রুমে ইতিমধ্যে চলে এসেছে৷ উনি মিরাকে আয়নার সামনে বসিয়ে চুল মুছে দিতে লাগে। এদিকে অশ্রু সিক্ত নয়নে মিরা আয়নার ভেতর দিয়ে মাকে দেখছে৷ তার খুব করে মাকে জড়িয়ে ধরতে মন চাচ্ছে। মিরা করলোও তাই। মাকে নিমিষেই ঝাপ্টে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে দেয়। মিরার মা সুপ্তি বেগম ভাবলেন বিয়ের আগের দিন জন্য বুঝি মেয়ে আবেগী হয়ে কাঁদছে। সেও মেয়েকে আগলে নিয়ে বলে উঠে, কান্না করিস না মা।

— আম্মু আমি খুব খারাপ মেয়ে তাই না?

সুপ্তি বেগম মেয়ের মাথায় হাত দিয়ে বলে, তুই আমার লক্ষী মেয়ে। আর কাঁদিস না মা। মেয়েদের তো বিয়ে হবেই। তোর নাহয় এক-দুই বছর আগেই হলো। আর ইমান তো ঘরের ছেলে। আমরাও দুশ্চিন্তামুক্ত থাকতে পারব তোকে নিয়ে৷

মিরা কান্না থামালো। উনি মেয়ের চুল মুছে দিয়ে চলে যান। মা যাওয়ার পর পর মিরা বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়লো। মোবাইলে একবার দেখে নিল আবির আনব্লক করেছে কিনা! কিন্তু না আবির তাকে আনব্লক করেনি। মিরার ফোনে সীম নেই৷ সে এক গুচ্ছ হতাশা নিয়ে শুয়ে থাকে। সে ভেবে নেয় এটাই নিয়তি। হয়তো আল্লাহ এটাই চায়!

★★★

পরদিন চারপাশে থেকে ঘুটঘাট আওয়াজে মিরার ঘুম ভেঙে যায়। সে চোখ কচলে দেখে বাসার অর্ধেক মানুষ তার রুমে। দাদী তার মাথায় কাছে বসে আছে। সোনালী আপা হাতে হলুদ শাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। মিরা চট করে উঠে বসে৷ এক মিনিট সময় লাগলো তার সবটা বুঝতে।

সায়েমা আপা ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলে, এই তুই ওতো ঘুমকাতুরে কেন রে? আজকে তোর বিয়ে! বিয়ের আগের রাতেও যে কোন মেয়ে ঘুমাতে পারে তোকে না দেখলে আমার বিশ্বাস হতো না।

মিরা চুপ থাকলো। তার মন ভালো নেই। আপা জোর করে তাকে গোসলে পাঠায়। রাতে গোসল করার জন্য এখন আর তার গোসল করতে মন চাচ্ছে না তাও অনিচ্ছা সত্ত্বেও করতে হলো।

“জীবনে অনেককিছুই আমাদের অনিচ্ছায় করতে হয়। বরং খুব কম কাজই আমরা নিজ ইচ্ছায় করি। মানুষ নিজ ইচ্ছায় বেশিক্ষণ চলতে পারেনা। তার অবচেতন মন বারবার চায় কেউ তার প্রতি আধিপত্য স্থাপন করুক!”

মিরা কাঁচা হলুদ রঙের শাড়ি পড়ে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। জীবনে বহুবার সে শাড়ি পড়েছে। কিন্তু আজকে তাকে দেখতে একেবারেই অন্যরকম লাগছে। সে নিজেই মুগ্ধ হলো। ফ্রেন্ডরা তাকে প্রায় বলে যে, মিরু তুই দেখতে এতো সুন্দর কেন? তুই বিশ্বসুন্দরী ঐশরিয়ার মতো সুন্দরী। সে এসব কথা কোন কালেই বিশ্বাস করেনি। কিন্তু আজকে মনে হচ্ছে কথাগুলো কিছুটা হলেও সত্য!

সোনালী আপা তাকে চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে তার মুখের উপর বুলডোজার চালালো। মানে মেকাপ করাতে লাগলো। সময় যতোই গড়াচ্ছে মিরা ততোই অবাক হচ্ছে। তার জন্য দোকান থেকে সতেজ ফুলের গহনা স্পেশালি ওর্ডার দিয়ে আনা হয়েছে। মিরার চুলে ফ্রেঞ্চ বেণী করে চুলের বেনীর প্রতি ভাঁজে সাদা রঙের ফুল গুজে দিল৷

এরপর তাকে রেডি করিয়ে ছাদে নিয়ে যাওয়া হয়।ছাদে যেতেই মিরা হতভম্ব। ছাদটা কি সুন্দর করে ডেকোরেশন করা হয়েছে।
এগুলো কখন করলো?কালকে সন্ধ্যা অব্দি তো এসবের অস্তিত্ব ছিল না। মিরাকে চেয়ারে বসানো হলো। মিরা দেখলো চেয়ারটার পেছনে বড় করে লেখা ইমান ও মিরার হলুদ সকাল।

তখনই কালো পাঞ্জাবি পড়ে ইমানের সাক্ষাৎ পেল মিরা। মিরা একবার দেখেই চোখ নামিয়ে নেয়। এমনিতেই ব্যাটার কণ্ঠ কাকের মতো। আর আজকে কালো পড়ায় কাকেরাও কনফিউশানে পড়ে যাবে তাকে দেখে! হুহ!

ইমান তার পাশের চেয়ারে এসে বসে পড়ে এবং হাসি হাসি মুখ করে বলে, শুভ সকাল মিরা। মিরা উত্তরে ভেংচি কাটে।

ইমান অন্যদের উদ্দেশ্য করে বলে উঠে, এই আমার অনলাইন ক্লাস আছে। দ্রুত অনুষ্ঠান শুরু করো না — বলেই উনি ফোন বের করে জুম ক্লাসরুমে ঢুকে পড়লেন,হেডফোন মোবাইলের সঙ্গে সেট করে কানে গুজে দিলো।

প্রথমে দাদী এসে দুইজনের মুখে হলুদ মাখিয়ে দিল। দাদী যাওয়ার পর ওইদিকে কি হলো কে জানে? সবাই ছাদের ডান দিকে যেতে লাগলো। এই ফাকে ইমান ভাইয়া হলুদের বাটি থেকে হলুদ তার হাতে নিয়ে হুটহাট মিরার শাড়ির পেছনের ফাকা অংশ দিয়ে কোমড়ের উম্মুক্ত জায়গায় হলুদ লাগিয়ে দিল। মিরা কেঁপে উঠে।তার ছোয়া পেতেই সে শিউরে উঠে। খুব রাগ উঠে যায় তার! মনে হতে লাগে, শরীর বেয়ে চারশ চল্লিশ ভোল্টের বিদ্যুত প্রবাহিত হয়েছে। চোখ বড় বড় করে ইমান ভাইয়ার দিকে তাকালো সে।

ইমান বাকা হেসে এমন ভান ধরলো যেন কিছুই হয়নি। বরং হলুদে লেপ্টানো হাতটা দিয়ে মিরার কোমড় আরেকটু নিবিড় ভাবে ধরে আরাম করে গা এলিয়ে বসে সে।

মিরা বাজখাই গলায় বলে, বেয়াদবের বেয়াবদ!

ইমাম হোহো করে হেসে আচমকা চুপ হয়ে গিয়ে হেডফোনের স্পিকারের সামনে মুখ এনে বলে,প্রেজেন্ট স্যার!

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here