#শেহজাদী
Part–6
Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
ইমান ভাইয়ার কান্ড দেখে মিরা না চাইতেও ফিক করে হেসে দিলো। পড়াশোনার প্রতি এতোটা সিরিয়াসনেসের জন্যই ওনাকে বাড়ির সব বড়রা এতো ভালোবাসে। এদিকে মিরাকে বকা দিয়ে দিয়ে, গুতো মেরে মেরে, পড়াতে বসাতে হয়। অপর দিকে মশা মশাই নিজের বিয়ের দিনও অনলাইন ক্লাস করছে। ভাবা যায়! কতো পড়ুয়া উনি!
মিরা লক্ষ করলো, সবাই তাদের দিকে আসছে। মিরা নড়াচড়া শুরু করে দিলো। ইমানের হাতটা নিজের কোমড় থেকে ছাড়িয়ে নেয়ার খুব করে চেষ্টা করছে কিন্তু লাভ হচ্ছে না। মিরা যতোই চেষ্টা করে, তার বাঁধন ততই শক্ত হয়। মিরা বিড়বিড়িয়ে বলে উঠে, আপনার হাত পঁচে যাক।
তখনই ইরার আগমন ঘটে, সে বেশ উত্তেজিত হয়ে হড়বড় করে বলে, “মিরা আপু জানো নিচে মিউজিক ইন্সট্রুমেন্ট এসেছে! এরপর সে ইমানের দিকে দৃষ্টি তাক করে বলে, ভাইয়া আমাদের ছাদে কি গানের আসর বসবে? ”
ইমান ভাইয়া হালকা হেসে বলে, হ্যাঁ ইরা।
ইরার খুশি দেখে কে! সে যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছে! মুখে এক ফালি হাসি ঝুলিয়ে সে আবারো ছাদের ওইদিকে চলে গেল।
এবারে মিরা বলে উঠে, আপনি ভারী অসভ্যতা করছেন তো কিন্তু ! সবাই এদিকে আসছে। আমার কোমড় ধরে কেন বসে আছেন? কেউ দেখে ফেললে আমি আর কারো সামনে মুখ দেখাতে পারব না।
ইমান দুষ্টু হেসে মিরার কানের কাছে এসে ফিসফিস স্বরে বলে, তার মানে কেউ যদি না দেখে তাহলে তুই আমাকে কোমড় জড়িয়ে বসে থাকতে দিবি?
মিরার চোখ মার্বেলের ন্যায় গোল হয়ে গেল। বেশ ঝাঝ গলায় বলে, এইকথা কখন বললাম? ছাড়ুন প্লিজ।
— ছেড়ে দিলে কি দিবি আমাকে?
— কি দিব মানে?
— উফ মিরা! তোকে সবকিছুর এতো এক্সপ্লেইন কেন করে দিতে হয়? আমি ইমান খান কিছু পাওয়ার আশা বাদে নিশ্বাস পর্যন্ত ফেলি না। সেখানে তোর কোমড় ছেড়ে হাত নিজের পকেটে গুটানো কতো কঠিন কাজ। ভেবে দেখ, যে মানুষ বিনা কারণে শ্বাস অব্দি নেয় না সেই মানুষ অকারণেই কেন এতো কঠিন কাজ করবে? হু?
মিরা দেখলো বড় আব্বু আসছে। বড় আব্বু ইরার মতো না যে খেয়াল করবে না। উনি বিচক্ষণশীল মানুষ। বুঝে ফেলবে। বড় আব্বুর কাছে তার সব সম্মান পানি ধোয়া হয়ে যাবে। ভাবতেই মিরার কান্ন পাচ্ছে।
সে দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠে, তো আমার কোমড় জড়িয়েই বা কি লাভ হলো?
উনি নিজের মুখ অন্য দিকে ফিরিয়ে নিয়ে নিচু গলায় বলে, তোকে ছুঁয়ে দিয়ে অসাধ্য সাধন করেছি আর মানুষ জন্মেই অসাধ্য সাধন করার জন্য!
— আপনি কিন্তু এবার বাড়াবাড়ি করছেন। বড় আব্বু আমাদের দিকেই হলুদ ছোঁয়া দিতে আসছেন। উনি দেখে ফেললে কি হবে?
এবারে উনি কান থেকে ইয়ারফোন টা সরিয়ে নিয়ে একটা হাই তুলে বললেন, আমি আগেই বলেছি, তোর বাপ-চাচাদের আমি ভয় পাইনা। আর উনি দেখলে সমস্যা টা কোথায়? স্ট্রেঞ্জ! আমি আমার বউয়ের কোমড় কেন, পুরা বউকেই কোলে তুলে নিয়ে বসে থাকলেও ওনার কিছু বলার অধিকার নেই৷
মিরা থম মেরে গেলো। ব্যাটার শখ কতো রে বাবা! তাকে কোলে নিয়ে বসে থাকার ইচ্ছা কেন এতো এই খচ্চরটার!
এবারে মিরা দুঃসাহসিক একটা কাজ করলো।তাহলো নিজের হিল স্যান্ডেলের গোড়া দিয়ে ইমানের পায়ে বেশ জোরেই খোঁচা দিলো। ইমান সঙ্গে সঙ্গে ব্যাঙের মতো লাফ মেরে মিরার থেকে প্রায় এক হাত দূরে সরে এসে ব্যথাময় গলায় বলে, অহহহ! মিরা তুই মানুষ না! ডাইনী একটা! দেখিস গজব পড়বে তোর উপর!
মিরা মিস্টি করে একগাল হেসে বলে, বেশী বাড়াবাড়ি করার শাস্তি এটা৷
ইমান পায়ে ব্যথা পেয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। মিরার বড় আব্বু আজমল হোসেন তাদের দিকে এগিয়ে এসে ইমানকে উদ্দেশ্য করে বলে, ইমান কি হয়েছে তোমার? দাঁড়িয়ে আছো কেন?
ইমান তার মামার কণ্ঠ শুনে নিজে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে এবং জোরপূর্বক হেসে বলে, মামা বসে থাকতে থাকতে মাথা ব্যথা হয়ে গিয়েছিলো এইজন্য দাঁড়ালাম।
আজমল হোসেন ভ্রু কুচকে বলে, বসে থেকে কারো যে মাথা ব্যথা হয় তা এই প্রথম শুনলাম তোমার কাছ থেকে।
ইমানের এই মাত্র হুশ এলো সে আসলে মিথ্যা বলতে গিয়ে কি বড় ভুল কথাই না বলে দিয়েছে! কি লজ্জা!
মিরা পারলে দম ফেটে হেসে দেয়। কিন্তু ভদ্রতার জন্য হাসতে পারছে না সে। বড় আব্বু যখন মিরার গালে হলুদ লাগালেন তখন তার চোখে যে জল এসে নয়ন ছলছল করছিলো তা দিব্যি টের পেল মিরা। এই মানুষ টা কঠিন রাগী হলেও তাকে খুব ভালোবাসে। সম্ভবত নিজের মেয়ে দুটোর মতোই ভালোবাসে৷
মিরার ও কেমন যেন এক স্নেহময় অনুভূতি বয়ে যাচ্ছে মন বেয়ে!! ইমান চুপচাপ বসে আছে। মাঝে একবার কালো জাম খেয়েছে।
এরপর মিরার মা-বাবা এলো। মিরার মা সুপ্তি বেগম একদফা কেঁদেও দিলো। তাকে দেখে মিরাও নিজেকে আটকাতে না পেরে কেঁদে দেয়।
ওই সময় ইমান বলে উঠে, ওহো! মামী এইসব কি শুরু করলেন? আপনাদের মেয়েকে কি গুম করে ফেলছি নাকি আমি। আপনার মেয়ে আপনারই থাকবে। আগে যেমন ছিলো সব তেমনই থাকবে। আমার বৌ হওয়াতে কোন কিছুই পরিবর্তন হবে না৷
ইমান ভাইয়ার বলা এই কথাটা মিরার ভালো লাগলো। ব্যাটা বজ্জাত হলেও বড়দের সম্মান করতে জানে। এটাও বা কম কিসে? সত্যি বলতে মিরার তেমন একটা কষ্ট হচ্ছে না৷ কারণ আকদ হলেও সে এই বাড়িতেই থাকবে। ইমানের সেমিস্টার শেষ হলে সে চার মাসের ইন্টার্ণ করে যখন চাকরি পাবে, নিজের পায়ে দাঁড়াবে তখনই মিরার বাবা মিরাকে ইমানের হাতে তুলে দিবে, এর আগে না। এমন শর্ত মেনেই এই বিয়ে সম্পন্ন হচ্ছে। মিরার ভাবতেই ভয় লাগে, ইমান ভাইয়ার সঙ্গে সে একা এক বাসায় কিভাবে থাকবে? মুখে মুখে যতোই সে তার সঙ্গে ঝগড়া করুক না কেন! সত্য এটাই সে ইমানকে প্রচুর ভয় পায়। ইমান ভাইয়ার রাগ-ক্ষোভ, জেদ ঘৃণা সে নিজ চোখে দেখেছে জন্যই তাকে সমীহ করে চলে।রেগে গেলে ছেলেটা ভয়ংকর হয়ে উঠে। আজো সেই অতীতের স্মৃতি মনে পড়লেই কেঁপে উঠে সে।
ইমানের হাতে টাকার নোট গুজে দিলো মিরার বাবা রাতুল সাহেব। ইমান উঠে দাঁড়িয়ে পা ধরে সালাম করতে চাইলে তাকে বাধা প্রদান করেন তিনি।
এরপর একে একে সব কাজিনরা হলুদ লাগালো। এরপর ছাদেই ইমানের চার-পাঁচ জন বন্ধু মিলে গান-বাজনার ব্যবস্থা করলো। ততোক্ষনে ছাদ থেকে সব বড়রা নিচে নেমে গেছেন। সায়েমা আপা বেশ ব্যস্ততা দেখিয়ে মিরার পাশে বসে তার হাতে মেহেদী পড়াতে লাগলো।
সায়েমা আপা বলে উঠে, মিরার হাতে তোর পুরা নাম লিখব নাকি শুরু ই লিখব?
ইমান মুখ কাচুমাচু করে বলে, দাও আমি লিখে দিচ্ছি।
সায়েমা আপা মুখ দিয়ে ওওঅঅ টাইপের শব্দ বের করলো এরপর বললো, তুই তো অনেক রোমান্টিক রে। নে বউয়ের হাতে মেহেদী পড়া।
ইমান মেহেদীর টিউব হাতে নিয়ে বলে, মেহেদী পড়াতে পারব না। শুধু নামটা লিখে দিচ্ছি।মিরা পুরোটা সময় যাবত নিরব শ্রোতা হয়ে বসে রইল।
ইমান বেশ আগ্রহ দেখিয়ে মেহেদীর টিউব নেড়ে-চেড়ে মিরার ডান হাতটা নিজের বাম হাতের তলায় গিয়ে ঠেকালো। মিরা নিজের হাতটা সরিয়ে নিতে গেলেই ইমান তার হায় চেপে ধরে আটকে নেয় তার নিজের মুঠির মধ্যে। এরপর হাতের ঠিক মাঝ বরাবর ইংরেজিতে ইমান লিখে সে৷ বেশ সময় নিয়েই লিখলো। মিরা স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। উনি না এই বিয়ে মানে না? দাদীর চাপে পড়ে বিয়ে করছে তাইলে তার মনে এতো রং-ঢং কিসের?
উনি নিজের নাম লিখে মিরার মেহেদী লাগানো হাতটার উল্টো পিঠে চুমু খেল সায়েমা আপার সামনেই!
কারেন্ট শক খাওয়ার মতো অবস্থা মিরার। এ মুহূর্তে তার ইমানের চুল ধরে টান মারতে মন চাচ্ছে। মিরার যখন অনেক রাগ লাগে তখন তার অন্য কারো মাথার চুল টেনে ছিঁড়ে ফেলতে মন চায়৷
সায়েমা আপা মিটমিট করে হেসে বলে, তোরা দুটো একসাথে সুখে থাক এটাই আমার প্রার্থনা! দেখি ইমান তোর বউয়ের হাত দে আমার কাছে। নাকি আমি তোর বউয়ের হাত ধরলেও তোর জ্বলে রে?
ইমান হাসলো শুধু। এরপর উঠে দাঁড়ালো এবং তার বন্ধুদের কাছে চলে গেল। উনি গেলেই মিরা হাফ ছেড়ে বাচলো। ব্যাটা মশা যতোক্ষণ আশেপাশে থাকে মিরা ঠিকঠাক ভাবে শ্বাস নিতে পারে না।
আপার সঙ্গে টুকটাক কথা বলছে আর বসে আছে মিরা। উঠার জো নেই। আপা মেহেদী পড়াচ্ছে। এমনকি সামান্য একটু নড়তেও পারছে না সে। খুব বিরক্ত লাগছে তার! সাউন্ড বক্সে গান বাজছে এই জন্যই রক্ষা পাওয়া। এট লিস্ট গান শুনে সে টাইম তো পাস করছে৷
আচমকা যখন গান বন্ধ হলো মিরার মেজাজ সপ্তম আকাশে পৌঁছে গেল৷ কি দরকার ছিল গান বন্ধ করার? সে বিরক্ত ভাব নিয়েই আপার মেহেদী পড়ানো দেখতে লাগে।
মিরা খেয়াল করে দেখলো, তার কানে সবার চেচামেচির আওয়াজে আসছে।সবার আগে তার নিজের বোনের চিৎকার কানে আসছে। হয়েছে কি সেটা দেখার জন্য মিরা আপাকে নিয়েই উঠে দাঁড়িয়ে ছাদের বা’পাশে যেতে লাগলো।
মিরার গায়ে এখন বলতে গেলে টিকলি বাদে আর কোন গহনা নেই। শাড়ির আঁচল মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। সে হেঁটে হেঁটে ছাদের ওই পাশে যেতেই নজরে এলো, ইমান ভাইয়া সবার মাঝখানে একটা চেয়ারে টেনে বসে আছে। তার হাতে মাইক ও!
মিরা কিছু বুঝে উঠার আগে বেশ শব্দ করেই ইমানের কণ্ঠে গান ভেসে এলো। মিরার রন্ধ্রে রন্ধ্রে সেই গানের সুর ঢুকে যেতে লাগলো। মাথা ঘুরাতে লাগে তার। শূন্যে ভাসার মতো মনে হচ্ছে তার কাছে। নিজের শরীরের ভারসাম্য লোপ পেল যেন তার!
ইমান খালি গলায় গান গেতে লাগে,
আমার অজানায় হলো কি,
তোমাকে তা কখনো
বুঝতে দেবো না।
দৃষ্টির পানে আকাশে চেয়ে
তোমাকে আমি খুঁজবো না।
আকাশের পানে চেয়ে চেয়ে
ভালোবাসি তা বলবো না।
তুমিও কি আমার মতো করে,
একটু ভালো বাসবে না?
তুমিও কি আমার মতো করে,
একটু কাছে ডাকবে না।
তুমিও কি আমার মতো করে,
একটু ভালো বাসবে না?
তুমিও কি আমার মতো করে,
একটু কাছে ডাকবে না।
আগেও তো ভালো বাসতে তুমি,
আগেও তো কাছে ডাকতে তুমি।
তবে আজ কেনো দূরত্বটা সব চেয়ে কাছের,
ভালোবেসে কি ভুল…
সম্পূর্ণ গানটা কর্ণপাতের সময় মিরা যেন অন্য কোন গ্রহে চলে গিয়েছিল। এতো মধুর তার গানের গলা! এমন কণ্ঠে গাওয়া গান তো
মিরা রোজ রাতে গায়কের বুকে মাথা রেখে আজীবন শুনতে ও রাজী। সঙ্গে সঙ্গে তার বুক ধক করে উঠে। আচ্ছা সে কি খুব বাজে একটা মেয়ে? নাহলে এমন চিন্তা মোটেও মাথায় আসত না!
ইমান গান গাওয়ার পুরাটা সময় এক ধ্যানে মিরার দিকে তাকিয়ে রইল। মেয়েটা আপন মনে কি যে বিড়বিড় শুরু করেছে কে জানে?
সে মিরার দিকে হাঁটা ধরে। মিরার কাছে এসে দাঁড়ালো এবং বলল, মিরা কোন সমস্যা?
মিরা মাথা ঝাকালো৷ যার অর্থ তার সমস্যা হচ্ছে কোথাও৷
— কি সমস্যা তোর?
— চুলকাচ্ছে।
— কি চুলকাচ্ছে?
মিরা নিষ্পাপ মুখ করে বলে, গাল চুলকাচ্ছে আমার। কিন্তু মেহেদী পড়া!
ইমান কিছু একটা ভেবে বলে, তোর গাল দুটো তো চুমু খাওয়ার জন্য! চুলকা-চুলকি করার জন্য নয়। তোর চুমু খেতে মন চাইলে বল চুমু দিচ্ছি।
চলবে৷
[ ইমান-মিরার বিয়েতে সবার দাওয়াত রইল। তার আগে বলুন তো, গল্পটা কি সবার ভালো লাগছে? ]