#শেহজাদী
Part–7
Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
ইমান ভাইয়ার কথা শুনে মিরার চোখ যেন কোটর থেকে বের হয়ে আসতে চাইছে! ব্যাটা এতো বজ্জাত কেন কে জানে? মিরার এই মূহুর্তে লজ্জায় ছুটে পালিয়ে যেতে মন চাচ্ছে। কেন যে নিজের সমস্যার কথা ওনাকে বলতে গেল সে! ব্যাটা যে তাকে কোন দিনই হেল্প করবে না তা মিরা খুব ভালো করেই জানে!
আচমকা কি যেন হলো। ইমান তার মুখের সামনে এসে দাঁড়ালো। মিরা ঘাবড়ে যায়। ছেলেটার স্বভাব ভালো না। ওই দিকে কতো মানুষ! অথচ ব্যাটা এভাবে তার মুখের উপর হুমড়ি খাচ্ছে। বেয়াদবের চার স্কেল উপরের শ্রেণির বেয়াদব!
ইমান আরো একটু মিরার দিকে ঝুঁকে আসল৷ মিরার অবস্থা যায় যায়। সে ঝুঁকে এসেই মিরার মুখে ফুঁক দিলো। গরম বাতাস অনুভব করতেই মিরার শ্বাস আটকে আসার উপক্রম। সে সরে পালিয়ে যেতে চাইলে ইমান সঙ্গে সঙ্গে খপ করে তার বাহু আঁকড়ে ধরে। মিরা শিউরে উঠে।
এবারে ইমান হালকা হেসে বলে, মিরা তোর এতো চুলকানি ক্যান রে? আচ্ছা বল, কোন গালে চুলকাচ্ছে?
মিরা ফ্যালফ্যাল করে তার দিকে তাকালো। এতে সে মুখ টিপে হেসে বললো, কসম চুমু খাব না পাবলিক প্লেসে! ইউ নো না! পাবলিক প্লেসে সিগারেট আর চুমু খাওয়া যায় না। সেভটি ফার্স্ট!
মিরার বিড়বিড় করে বলে, বেয়াদব!
— আমি জানি আমি কেমন! তোকে বলে দিতে হবে না।
ইমান মিরার অতি নিকটে চলে আসায়, সে বেশ অস্বস্তিবোধ করছিলো না। মিরা যেই না নড়ে উঠলো। ইমান ধমকে বলে, খবরদার পায়ে খোঁচা মারবি না বলে দিলাম! নাহলে সবার সামনে সেভটিকে অপশনাল রেখে তোকে চুমু খাব!
মিরা একথা শুনে একেবারে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে গেল। নিজের মান-মর্যাদা খোয়ানোর ইচ্ছা নেই তার!
ইমান মিরার দুইগালে নিজের হাত আলতো করে চেপে ধরে। এতে মিরার যেন কি হলো! সে কেঁদে দিলো।
ইমান ভড়কে যায়। সে হচকচিয়ে গিয়ে বলে উঠে, কি হয়েছে তোর মিরা? কান্না করছিস কেন?
মিরা নাক টেনে বলে উঠে, প্লিজ দূরে সরুন। আমার কেমন যেন লাগছে!
ইমানের কি যেন হলো! সম্ভবত এমন কিছু শোনার প্রত্যাশায় ছিল না তার।মিরার কাছ থেকে অপমান বোধক কথা শুনেও সে মিরার গাল থেকে হাত সরালো না৷
মিরা এবারে শব্দ করে কেঁদে বলে উঠে, আমি বিয়ের জন্য প্রস্তুত না।
এবারে ইমানের টনক নড়লো। সে মিরাকে ছেড়ে দিয়ে তার কাছ থেকে প্রায় এক হাত দূরে সরে এসে দাঁড়ালো এবং নিজের দুই হাত বুক বরাবর গুটিয়ে নিয়ে বলে, মানে কি বলতে চাস তুই?
— আপনি কি জানেন? একটা মেয়ে ঠিক কতোটা অসহায় হলে নিজের বাসা থেকে পালানোর চেষ্টা করে? জানেন কিছু?
ইমান থম মেরে দাঁড়িয়ে থেকে বলে উঠে, তার মানে বলতে চাচ্ছিস তুই এই বিয়ে করতে চাস না তাই তো?কথা এতো প্যঁচানোর দরকার নাই সোজাসুজি বল!
— করতে চাই না মানে কি?আমার কাছ থেকে তো মত নেয়াই হয়নি? আর কলেজে থাকতে এই যুগে কখনো কাউকে বিয়ে করতে দেখেছেন? আমার সব বান্ধবীরা হাসবে শুনলে! আমাকে নিয়ে ক্লাসে মজা নেওয়া হবে! আপনি তো ইউনিভার্সিটি তে যান? দেখেছেন কোন মেয়েকে বিবাহিত ? বিবাহিত থাকলেও হাতে-গোনা দুই-এক জন! আমি সেই দুই-এক জনের মতো হতে চাই না! আমি খুব সাধারণ ভাবে চলতে চাই।
— দ্রুত বিয়ে করা কোন অন্যায় না! আর তোকে তো সংসার করতে হবেনা।
— সংসার করতে না হলেও আপনার চাহিদা তো মেটাতে হবে! এই পরিস্থিতি তো সংসার করার চেয়েও জঘন্য!
ইমানের মুখ লাল হয়ে এলো। সম্ভবত লজ্জায় বা রাগে। সে দাঁতে দাঁত চেপে বলে, আমাকে কি তোর পার্ভাট মনে হয়? তোর যদি বিয়ে করতে সমস্যা হয় তাহলে যা ভেঙে দে এই বিয়ে।
— আপনি বলুন বাবাকে।
— তার মানে তুই চাস বিয়েটা না হোক?
— খুব সম্ভবত হ্যাঁ!
ইমান আর কিছু বললো না। সে চুপচাপ আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে উঠে, আমার পক্ষে এই মূহুর্তে কিছু করা সম্ভব না! এখন ঝামেলা করলে সবাই আমাকে দোষ দিবে। এক কাজ করা যেতে পারে, দুপুর তিনটার দিকে তুই কোথাও যাওয়ার নাম করে পালিয়ে যাস। আমি বাসের টিকিট কিনে দিব। তুই পালিয়ে যা। কালকে তো একা পালাতে চেয়েছিলি। আজকে নাহয় আমিই সহায়তা করব!
মিরা হতভম্ব হয়ে গেল। এই প্রথম বুঝি কোন বর তার হবু বউকে পালাতে সাহায্য করবে! জগতের অষ্টম আশ্চর্য যেন এই কাহিনি! ইতিহাসের পাতায় লিখে রাখা উচিত।
ইমান বলে উঠে, বাসায় সবাইকে আমি হ্যান্ডেল করে নিব। জোর করে আসলে প্রেম ভালোবাসা যেমন হয় না তেমনিই সংসার করাও যায় না। যাকে অপছন্দ তার চেহারা প্রতি মূহুর্তে দেখা নরক যন্ত্রণাসম আর আমি কখনোই তোকে নরক যন্ত্রণা দিতে চাই না!
মিরার চোখ খুশিতে জ্বলজ্বল করে উঠে। মিরার চিন্তামুক্ত মুখশ্রী দেখে ইমান আহত হলো। জোর করে মিরাকে পেয়ে তার কোন লাভ নেই। এই পাওয়ার মধ্যে কেবল তৃপ্তি থাকবে, সুখ না। আর শারিরীক তৃপ্তি আপেক্ষিক কিন্তু সুখ চিরস্থায়ী। ইমান সুখ চায়! শৈশবটা তার মোটেও ভালো কাটেনি। বিবাহিত জীবন সে শান্তির চায়।
ইমান মিনিট দুই চুপ থাকে। এরপর পকেট থেকে টিস্যু বের করে মিরার ডান হাতটা নিজের চোখের সামনে এনে, হাতে মেহেদী দিয়ে লেখা ইমান নামটা টিস্যু দিয়ে উঠিয়ে ফেলে।নিজের অভিমান মেহেদীর উপর ঝেড়ে দিলো কিন্তু যার উপর অভিমান সে তো বুঝলো না!
মিরা আপত্তি করতে গিয়েও থেমে যায় না। যার জন্য মনে কোন জায়গা নেই তার নামটা হাতে থেকেই বা কি ফায়দা? মুছে যাওয়াই শ্রেয়!
ইমান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে উঠে, বেস্ট অফ লাক মিরা। দুপুর তিনটার মধ্যে বাসার নিচে আসবি। কিন্তু যাবি কই?
— কক্সবাজার।
— কক্সবাজার কেন?
— আমার এক খালাত বোন সেখানে থাকে।
— হানিমুনে কক্সবাজার যাওয়ার জন্য টিকিট কেটে রেখেছিলাম।
একথা শুনেও মিরার কোন ভাবান্তর হলোনা। সে শুধু মাত্র মুক্ত পাখির ন্যায় উড়ে যেতে চায়। কারো সঙ্গে দায়িত্বের শিকলে বন্দী হতে চায় না।
ইমান ছাদের ওইপাশে চলে গেল। মিরা ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। কিছুক্ষণের মধ্যে গান থেমে যায়। গান থেমে যাওয়াতে মিরার মনটা কেমন উদাসিন হয়ে পড়ে। হুট করে কি যেন খালি খালি লাগতে শুরু করলো তার। কিন্তু কিসের শূন্যতা সেটা আর বুঝে উঠতে পারলো না সে।
★★★
দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর সবাই বেশ ক্লান্ত। সকাল থেকে হৈচৈয়ে সবাই কান্ত। আবার রাতে আকদ এজন্য যে যার রুমে খানিকটা বিশ্রাম নেওয়ার জন্য চলে যায়। শুধুমাত্র মিরার মা আর তাদের বাসার সাহায্যকর্মী রান্নাঘরে ব্যস্ত রইল।
মিরা একটা কালো সালোয়ার কামিজ পড়ে হাতে ব্যাগ নিয়ে বের হলো। রান্নাঘরের সামনে আসতেই মায়ের কণ্ঠ ভেসে আসে তার কানে। সে সর্তক হয়ে যায়। উঁকি মেরে মায়ের অবস্থান দেখে নিয়ে প্রায় নিঃশব্দে রান্নাঘরের পাশ দিয়ে পাড় হয়ে যায় সে।
নিঃশব্দে বাসার বাইরে বের হয়ে সে ইমানের অপেক্ষা করতে লাগে। ঘড়িতে তিনটা পনের তাও জনাবের আসার নাম নেই৷ মিরা বুঝে পাচ্ছে না ইমান কি তাকে ওই সময় মিথ্যা বলেছিল? কে জানে?
কিন্তু নাহ! মিরাকে মিথ্যা প্রমান করে দিয়ে ইমান সত্যি সত্যি সাড়ে তিনটার দিকে কক্সবাজারের একটা টিকিট হাতে নিয়ে প্রায় হাঁপাতে হাঁপাতে তার সামনে উপস্থিত হলো।
মিরা টিকিট হাতে নিয়ে বলে, ইমান ভাইয়া! আপনি নিঃসন্দেহে মহান! কিন্তু বিশ্বাস করুন আমার পক্ষে আপনাকে বিয়ে করা অসম্ভব! তবে দোয়া রইল, আপনি যাকে ভালোবাসেন তার সঙ্গেই আপনার বিয়ে হবে।
— তোমার দোয়া দিতে হবেনা।
— আমি জানি আপনি আমার প্রতি রেগে আছেন কিন্তু বিশ্বাস করুন, এই সিদ্ধান্তটা আমাদের দুইজনের জন্যই উত্তম।
— বড়রা কিন্তু আমাদের ভালোই চায় সবসময়৷
— তা আমি জানি৷ কিন্তু তারা যে কোন ভুল সিদ্ধান্ত নিবে না এটা ভাবাও ভুল। মানুষ মাত্রই ভুল করবে। তারাও মানুষ!
— এতো বকবক করবি না। যা দূর হো
আর কোন দিন আমার সামনে আসবি না।
মিরা এক গাল হাসলো। সেই হাসি দেখে ইমানের কান্না চলে এলো। সে কান্না আটকিয়ে বলে উঠে, যদি কোন দিন তুই নিজ ইচ্ছায় আমার সঙ্গে যোগাযোগ করিস, দেখিস সেদিন আমি তোকে জিন্দা কবর দিব।
মিরা একথার পিঠেও হাসলো।
— হাসবি না। তোকে হাসতে দেখলে রাগ লাগছে আমার!
মিরা হাত নেড়ে বিদাই জানিয়ে বলে, ভালো থাকবেন।
চলবে।