শেহজাদী পর্ব-bonash part

0
890

#শেহজাদী
বোনাস পার্ট
Arishan_Nur (ছদ্মনাম)

একে অপরের অনেকটা নিকটে এসে গেছে ইমান-মিরা। দুইজনেই মগ্ন দুজনাতে। চোখে চোখ রেখে হারিয়ে যাচ্ছে অদ্ভুত সুন্দর এক জগতেন।যে জগতের প্রাণ কেবল প্রেম। প্রেমের জগতের সবকিছুই প্রেমময়!

দুজনেই দুজনার নিশ্বাস, হৃদপিণ্ডর ধুকপুক আওয়াজ শুনতে পারছে। ইমানের এক হাত মিরার চিকন কোমড়ে গিয়ে থেমে আছে। চোখে চোখ রেখে অপলক নয়নে চেয়ে আছে তারা। এ যেন নিরবে দৃষ্টিবিলাস চলছে দুজনার! কখনো কথা না বলেও অনেক কথা বলা হয়ে যায়। আজ তারা নিরব থেকেও চোখের ভাষায় একে অপরকে অনেককিছুই জানিয়ে দিচ্ছে। মান-অভিমান ভাঙ্গছে তো, নতুন করে মান-অভিমান গড়ে উঠছে।

মিরার আঙুলের ভাঁজে, নিজের হাতের আঙুল গুজে দিয়ে, ইমান বলে উঠে, তোমার উপর কিন্তু শোধ তোলা বাকি আছে।

মিরা আদুরে গলায় বলে, কিভাবে শোধ তুলবেন? হু?

ইমান হেসে দিয়ে বলে, আপাতত অসুস্থ জন্য তোমাকে সাময়িক ভাবে ক্ষমা করে দিচ্ছি। প্রতিশোধ কিন্তু নিবই! শাস্তি তুমি পাবাই। ছাড় পাবে না একবিন্দু! শাস্তি পেন্ডিং এ থাকলো।

মিরা নাক ফুলিয়ে বলেন,কি শাস্তি দিবেন?

ইমান দুষ্ট হেসে মিরার কানের পাশ থেকে চুল সরিয়ে, কানের ওপাশে গুজে দিয়ে, নিজের মুখটা মিরার কানের কাছে এনে ফিসফিস করে বলে, বাসাতেই ফুটবল টিম বানাবো!

মিরার ভ্রু কুচকে গেল। তার কথার আগা-মাথা কিছুই বুঝলো না সে। ইমান তার গালে হাত রেখে বলে, শাস্তিটা কেমন? জোশ না?

— এটা আবার কেমন শাস্তি? আপনি কি ফুটবল খেলার কোচ যে টিম বানাবেন?

ইমান তার কথায় হতাশ হলো। মেয়েটা কেন যে এতো ডাম্প! মাঝে মাঝে একারণেই বিরক্ত লাগে। বোকা মেয়েদের সঙ্গে ভাবের কথা বলে মজা পাওয়া যায়না এটা যেমন সত্য তেমনই আরেকটা সত্য হলো বোকা মেয়েরা সংসারী হয়!

কেবিনের দরজা খুলার শব্দে ইমান ছিটকে আসে মিরার নিকট থেকে। ঘটনাটা ঘটতে দুই সেকেন্ড লাগালেও তাদের কাছাকাছি অবস্থান করাটা একজোড়া চোখকে আড়াল করতে পারেনি।

কেবিনে সাদ আর ইরা ঢুকেছে। ইরা হালকা হলেও আভাস পেয়েছে। সে বুঝে পাচ্ছে না হুট করে আপু আর ইমানের মধ্যে কি হলো যে তাদের এতোটা কাছাকাছি অবস্থান করতে হবে?

মিরা তাদের দেখে মাথা নিচু করে ফেলে। আজ চোখে চশমা নেই তার।

ইমান সরে আসলেও ডান হাতটা দিয়ে মিরার ডান হাত এখনো ধরে আছে তবে তাদের দুইজনের হাতের উপর বালিশ রাখা। দেখা যাচ্ছে না। ইমান দূরে এসে চেয়ারে বসলেও, হাত ছেড়ে দিতে ইচ্ছে করছে না। বহুদিন পর হাতটা ধরার অধিকার পেয়েছে আর ছাড়া যাবে না।

মিরা হাতটা ছাড়াবার জন্য চেষ্টা করছে, কিন্তু লাভ হচ্ছে না। ইমান আগের তুলনায় আরো শক্ত করে ধরে বসে আছে। সে একবার তার দিকে করুন চোখে তাকালো। তাতেও লাভ বিশেষ হলো না। ইমান হাত ছাড়বে না মানে ছাড়বে না!

ইরা মৃদ্যু গলায় বলে, তোমাদের ডিস্টার্ব করলাম বুঝি?

ইরার কণ্ঠ আর বলার ধরনটা ইমানের কাছে ঠিক লাগলো না। সে যথাসম্ভব বিনীত গলায় বলে, ডিস্টার্ব করার কি আছে?

ইরার প্রচুর রাগ লাগছে। ইমান যে তার বোনের হাত ধরে বসে আছে সেটা তার চোখ এড়ায়নি। সাদ না দেখলেও সে ঠিকই দেখে ফেলেছে। এ দৃশ্যপট দেখার পর থেকে তার বুকে যেন কেউ পাথর নিক্ষেপ করছে।বড়-ছোট সব সাইজের পাথর ছোঁড়ার মতো তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছে তার।

ইমানের কথায় সে চুপ মেরে গেল। সামনে বসে থাকা মানুষটাকে পাওয়ার কোন আশাই সে রাখে না তবুও মনের কোথায় যেন একটা সুক্ষ্ম ভরসা বা সান্ত্বনা ছিল যে মানুষটার সঙ্গে তার কিছু একটা হলেও হতে পারে।

এই “হলেও তো হতে পারে” অনুভূতিটা করাতের ন্যায় ধারালো, যার আঘাতে সব সুখ চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়।

ইরা মুখ কালো করে আপুর দিকে তাকালো। অসুস্থ থাকার পরও আপুকে আজকে একটু বেশিই রূপবতী লাগছে যেন। কারনটা কি ইমান?

আজ হুট করে এই মূহুর্তে ইরার মনে হতে লাগলো, মিরা আপু খুব ভাগ্যবতী। আপু হাজার টা ভুল করলেও, তাকে ভালোবাসার মানুষের অভাব নেই, অথচ সে কোন ভুল করেনা তারপরও যাকে ভালোবাসে, তার দিকে তাকানোর স্পর্ধা নেই।

ইমান হালকা গলায় বলে, জুস খাবে?

মিরা বলে, না। কিছু খাব না৷ আমি বাসায় যাব।

— রিলিজ দেয়নি।

— আপনি ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলুন। আমি বাসায় যেতে চাই। হাসপাতালে থাকতে মন চাচ্ছে না।

— বেশ। রোগী যা চাইবে তাই হবে।

ইমান এবারে আস্তে করে মিরার হাত ছেড়ে উঠে দাড়িয়ে বলে,মামাকে দেখে আসি। ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে রিলিজের ব্যবস্থা করছি।

ইমান যেতে ধরলে, সাদও দুই বোন কে একলা ছেড়ে ভাইয়ের পিছু নিলো।

কেবিনের বাইরে আসতেই সাদ মুখ কাচুমাচু করে বলে, ভাইয়া?

— কি?

— আমি ভাবীকে সব বলে দিয়েছি। সর‍্যি হ্যাঁ!

ইমাম ভ্রু কুচকে বলে, কোন ভাবী? আর কি বলেছিস?

সাদ মাথা উঁচু করে গর্বের সঙ্গে বলে, মিরা ভাবীকে বলে দিয়েছি সব।

— কি বলে দিয়েছিস?

— তুমি যে টিউশন পড়াতে গিয়ে তার প্রেমে পড়েছো সেটা বলে দিয়েছি। তুমি যে তাকে ভালোবাসো এটাও বলেছি। মোদ্দা কথা ভাবী তোমার মনের সব কথা জানে এখন।

ইমান বিষ্ময়কর চোখে তার দিকে তাকিয়ে বলে, তোকে মানা করছিলাম কিন্তু?

— দুই-এক আদেশ মান্য না করলে কিছু হবে না।

ইমান তার পেটে কিল মেরে দিল একটা। এরপর দুই ভাই একসাথে হেসে উঠে৷ হাসপাতালে খুব কম মানুষই হাসে। ইমানের ছোট্ট বেলা থেকেই হাসপাতাল খুব অপছন্দ। কিন্তু আজকে হাসপাতালও ভালো লাগছে।

সে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেল ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলার জন্য। ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে মিরাকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ করিয়ে তারা সবাই বাসার উদ্দেশ্য রওনা হলো। মিরাদের গাড়ি হাসপাতালেই ছিল। শুধু মামাই হেঁ
টে বাড়ি ফিরলেন৷ এতে মিরার খানিকটা মন খারাপ হলো।

বাসায় ফিরতেই সোনালী আপু তাকে জড়িয়ে ধরে বলে, বোন কি হয়েছিল তোর? তোকে দেখার জন্য আমার কলিজা ছিঁড়ে যাচ্ছিল।

উনি মিরা গাল ধরে বেশ কিছুক্ষণ আদরে করে ইমানের দিকে তাকিয়ে রাগী গলায় বলে, তুই কাল সারারাত বাসায় ফিরিস নি কেন? আমার আর ভালো লাগে না। তোদের জন্য অস্থির আর টেনশনে আমার বাচ্চাটা শুকায় যাচ্ছে। আমি ঠিকঠাক ভাবে খেতেই পারছি না কিছু।

ইমান অসহায় মুখে বলে, সর‍্যি আপু। তুমি রেস্ট নাও। মামী বললো তোমার প্রেসার বেড়ে গিয়েছিল। এখন কেমন লাগছে?

সোনালী আপু রেগেমেগে ফায়ার হয়ে বলে, ভালো নেই। তোরা আমাকে সুখে থাকতেই দিস না। সবসময়ই আমাকে জ্বালাচ্ছিস।

— কি করলে তুমি সুখে থাকবে?

— আমার ডেলিভারী হওয়া অব্দি তোরা সবাই আমার সঙ্গে থাকবি। তোরা আশেপাশে থাকলে সাহস পাই।

— তোমার কথা অক্ষরে অক্ষরে পূরণ করা হবে৷

সুপ্তি বেগম নাস্তা দিয়ে টেবিল সাজিয়ে সবাইকে খেতে ডাকলেন। মিরার জন্য স্যুপ আর বাকিদের জন্য নুডুলস, পিয়াজু, বিস্কুট, পরেটা আর আলুর দম। সবারই কম-বেশি ক্ষুধা লেগেছে। টেবিলে সবাই বসে খাচ্ছে৷

ইমান মিরার বিপরীতে বসেছে। সে পরোটা খাচ্ছিল। হুট করে পায়ে যেন কেউ খোঁচা মারলো। তার তো নাকে-মুখে খাবার উঠে যাওয়ার উপক্রম।

সে মাথা নিচু করে দেখে মিরা পা দিয়ে খোঁচা মারছে তাকে। রোগী মানুষের কাজ দেখো! মিরাকে রোগী বললে সত্যিকারের রোগীরা কেঁদে বুক ভাসাবে। স্যুপ খাচ্ছে আর তাকে জ্বালানো হচ্ছে?

ইমানও কম না, সেও মিরার পায়ে গুতো মারার জন্য পা এগিয়ে দিয়ে, তার পায়ে বেশ জোরেই গুতো মারলো। ইমান তাকিয়ে ছিল মিরার দিকে। মিরার প্রতিক্রিয়া দেখার আশায় ছিল। কিন্তু গুতো দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মিরার বদলে বড় মামা ও বাবা বলে চেচিয়ে উঠলো।

ইমানের চোখ বড় বড় হয়ে গেল। মামার পাশেই মিরা বসেছে। সবার চোখ এখন মামার দিকে।

মামা বলে উঠে, আমার পায়ে গুতা দিল কেন?

ইমান পানি পান করে আমতাআমতা করে বলে, বিড়াল গুতা দিয়েছে মামা।

বড় মামা ভ্রু কুচকে বলে, ফ্ল্যাট বাসায় বিড়াল আসবে কোথা থেকে?

মামার কথায় পুরা টেবিলের মানুষ হাসলো।

ইমান চুপসে গিয়ে বলে,কথা ঠিক।

সে মিরার দিকে তাকালো। মিরা সঙ্গে সঙ্গে তাকে চোখ টিপ মারলো এবং দুষ্টু হাসলো। তা দেখে ইমানের মুখ হা হয়ে গেল। মিরা তো এমন দুষ্ট কিসিমের নয়। হুট করে মেয়েটার হলো কি?

যাইহোক খাওয়া শেষ করে সব কাজিনরা ড্রয়িং রুমে বসলো। সোনালী আপুর বেবি শাওয়ারের প্লানিং চলছে। সবাই অনেক এক্সাইটেড। বিশেষ করে মিরা।

আড্ডার কিছু সময় পর ইরা উঠে চলে গেল। তার নাকি মাথা ধরেছে। সে যাওয়াতে মিরা বার কয়েক তাকে ডাকলো৷ সাড়া পেল না। এদিকে সাদ ও ঝিমিয়ে কাটালো।

ওমন সময় ইমান মিরাকে ম্যাসেজ দিল, আড্ডা শেষ করে ছাদো আসো। কথা আছে।

মিরা ম্যাসেজটার দিকে তাকিয়ে রইল খানিকক্ষণ। ইমান ম্যাসেজ সেন্ড করেই উঠে বাইরে চলে যায়।

তারও আধ ঘন্টা পর সোনালী আপু শুতে গেলে, সে লুকিয়ে বের হলো ছাদে যাওয়ার জন্য। বাসায় পড়া কাপড় পরেই সঙ্গে স্কার্ফ নিয়ে ছাদে উঠতে লাগলো।

ছাদে উঠতেই মিরা হতভম্ব হয়ে গেল। ছাদের মাঝখানে মোমবাতি দিয়ে আই লাভ ইউ লেখা৷

সে সামনে আগাতেই কেউ তাকে পাজকোলে তুলে নিল। সে ভয় পেয়ে যায়। চিৎকার করতে গেলে পরিচিত সুরটা ভেসে আসলো কানে।

— ভয় পেয়ো না৷

মিরা তার গলা জড়িয়ে ধরে বলে, এসব কখন করলেন?

— এইতো তুমি যখন আপুর সঙ্গে গল্প করতে ব্যস্ত ছিলে তখনই করলাম।

মিরা অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। কি অদ্ভুত সুন্দর সবকিছু! সে মুগ্ধ। খোলা আকাশে তার ভালোবাসার মানুষ তাকে এভাবে চমকে দিবে সে ভাবতেও পারেনি৷

ইমান তাকে কোল থেকে নামিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে, পকেট থেকে লাল গোলাপ ফুল বের করে তার সামমে ধরে বলে,আমার তিন হালি হতে এক কম বাচ্চাদের মা হবে? আমার বাবুদের সর্দি হলে, নিজের ওড়না দিয়ে নাক মুছিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব নিবে? রাতে ঘুম না এলে, বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তারা গুনতে সাহায্য করবে আমাকে?

কথাগুলো ইমান খুবই আস্তে কিন্তু স্পষ্ট গলায় বললো। বলার সময় খানিকটা কেঁপেছে তার কণ্ঠস্বর।

মিরার চোখ বেয়ে পানি পড়তে লাগে। সবকিছুই তার স্বপ্নের মতো লাগছে। সে ভীষণ আবেগী হয়ে, ফুলটা ছোঁ মেরে হাতে নিলো। এবং গোলাপটাকে বুকে চেপে কাঁদো স্বরে তিনবার হ্যাঁ বললো।

ইমান উঠে দাঁড়ালো এবং বলল, গোলাপটাকে বুকে না জড়িয়ে, আমাকে জড়িয়ে ধরলেও পারতে শেহজাদী।

মিরা সঙ্গে সঙ্গে তার বুকে হুমড়ি খেয়ে পড়ে কেঁদে দিল।

কি অদ্ভুত সুখ খেলে যাচ্ছে তাদের দুইজনের হৃদয়ে! এমন সুখ,অনাবিল আনন্দ আর কবে পেয়েছিল তারা?

খোলা আকাশে, বিশটা মোমবাতির টিমটিমে আলোয় ইমান তার শেহজাদীকে একেবারে আপন করে পেল। এবারে আর হারাবার ভয় নেই কারন মনের মিলন ঘটে গেছে।

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here