#গল্প—
#সখি ভালোবাসা কারে কয়?
পর্ব—-১
কানিজ ফাতেমা
হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গিয়ে আলোয় ঝলমল করা বিয়ে বাড়িটা একটা ভূতের বাড়িতে পরিণত হয়েছে। আমি স্টেজে বিয়ের কনে মানে আমার চাচাতো বোন মিথিলা আপুর পাশে ভয়ে একটা মূর্তি হয়ে বসে রয়েছি। স্টেজের চারপাশে সবাই হইচই শুরু করে দিয়েছে বিদ্যুৎ চলে গেছে বলে।আমি চুপচাপ বসে সবার গলার স্বর বোঝার চেষ্টা করছি। এর মধ্যে হঠাৎ মনে হলো আমার হাতে কারো আলতো হাতের ছোঁয়া লাগলো। আমি ভাবলাম পাশে আম্মু বসে ছিল তাই অন্ধকারের মধ্যে আম্মু বলে ডেকে উঠলাম।
কিন্তু আম্মু কোন উত্তর না দিয়ে আমার বাম হাতে একটা চিরকুট ধরিয়ে দিল। না এটা আম্মুর হাত না বুঝে উঠতেই ভয়ে আমি কে? বলতেই পাশে বসে থাকা মীরা আপু বলল কি রে নিধি ভয় পাচ্ছিস?
না না আপু কিছুট আতঙ্ক নিয়ে কথাটা বললেও বুকের মধ্যে হৃৎপিন্ডের গতি একশো আশি বিটে পৌঁছে গেছে। মনে হচ্ছে এই মুহুর্তে কারেন্ট না আসলে আমি হার্ট অ্যাটাক করে মারা যাবো।
আমি মীরা আপুকে বলতে গিয়েও থেমে গেলাম। কারণ এই মুহুর্তে বলার অর্থ সারা পাড়ার লোকজনকে জানানো যে কেউ আমাকে একটা চিরকুট জাতীয় কিছু হাতে দিয়েছে। তাই ভয়ে বরফ হয়ে চুপচাপ স্টেজেই বসে রইলাম আমি।
এদিকে সারা বাড়িতে হুল্লোর পড়ে গেল এমন বেকুবের মত কাজ কেউ কীভাবে করতে পারে। বিয়ে বাড়িতে কারেন্ট চলে গেল তো জেনারেটর চালানো হচ্ছে না কেন? যে কোনো মুহুর্তে বরযাত্রী চলে আসতে পারে এই কারণে বাড়ির পুরুষ মানুষেরা লাইটিং ও ডেকোরেশনের দায়িত্বে থাকা রুনজু মিয়াকে চিৎকার করে গালিগালাজ করছে সাথে তাড়াতাড়ি জেনারেটর চালাতে বলছে।
আজ আমার চাচাতো বোন অর্থাৎ বড় চাচার বড় মেয়ে মিথিলা আপুর বিয়ের দিন। ছেলে বিদেশে থাকে অনেক ভালো চাকরি করে। সে কারণে চাচাজান বেশ আয়োজন করেছেন বড় মেয়ের বিয়েতে। বড় চাচার দুই মে্য়ের মধ্যে ছোট মেয়ে মীরা আপু জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটিতে নাট্যকলা বিভাগে পড়াশোনা করছে। আর বিয়ের পাত্রী মিথিলা আপু ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে পড়াশেনা শেষ করে তার ডিপার্টমেন্টেরই সিনিয়র জুয়েল ভাইয়ের সাথে আজ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে চলেছে।
যাই হোক, বাড়ি ভর্তি মেহমান বরযাত্রী এখনো পৌঁছেনি বলে রক্ষা। আমার আবার এত মানুষের ভিড় ভালো লাগে না। কিন্তু যেহেতু মিথিলা আপুর বিয়ে তাই সব অনুষ্ঠানে আমার ও মীরা আপুর উপস্থিতি লক্ষ্যণীয়। আমি সারাজীবনে যতটা সাজগোজ করিনি মীরা আপুর পাল্লায় পড়ে এবার লেহেঙ্গা থেকে শুরু করে পুরো মেকাপ করে বসে রয়েছি। প্রথমে মানা করেছিলাম কিন্তু মিথিলা আপু জোর করে বলল আমার বিয়েতে আমার দুই বোনকে রাজকুমারীর মত দেখতে না লাগলে ভালো লাগবে? অগত্যা সে বৌ সাজতে যাওয়ার সময় আমাদেরও সাথে নিয়ে গিয়ে সেমি বৌ সাজিয়ে নিয়ে আসলো।
আম্মু অবশ্য দেখে মহাখুশি। বড় ভাইয়া অবশ্য দেখে ভেঙচি কেটে বলল এই মিথিলা আপু এই দুই শ্যাওড়া গাছের পেত্নীকে কোথায় পেলে?
আমার একমাত্র বড় ভাই নির্ঝর বুয়েটের স্টুডেন্ট বলে ভীষণ ভাব। তবে মীরা আপুর সামনে সব ভাব পানি হয়ে যায়। সেই ছোটবেলা থেকে দেখছি মীরা আপু ভাইয়াকে যা বলবে সে অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলে। খুব সম্ভবত মিথিলা আপুর বিয়ের পর মীরা আপু আর নির্ঝর ভাইয়ার বিয়ে হবে- যদি কোনে ঝামেলা না হয়।
আর আমার বিয়ে সে যত দেরিতে হবে ততই খুশি আমি। এভাবে বাড়ি ভর্তি লোকজনের মধ্যে সেজেগুজে বৌ সেজে বসে থাকতে আমার অন্তত ভালো লাগবে না।
আমি বুঝি না মানুষ বিয়ে করার সময় এত ঢাক ঢোল বাজিয়ে সবাইকে জানান দিয়ে বিয়ে করে কেন যে আজ আমার একজনের সাথে বিয়ে হচ্ছে। বরং এখন সোশ্যাল মিডিয়ার যুগ ইচ্ছে মত সেজে বর বৌ ছবি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট দিলেই তো জেনে যাবে কে কার বর-বৌ।
যাই হোক, আমি বললে তো আর হবে না। এই যেমন আমার বিয়ের সময় আমি নিষেধ করলেই কি বাবা-মা শুনবেন। তারা ঠিকই তাদের মনের মত আয়োজন করে সবাইকে জানিয়ে দেবেন আজ তাদের মেয়েকে আনুষ্ঠানিকভাবে অন্য একটি বাড়ির সদস্যপদ দান করা হলো। সে মেয়ের পছন্দ অথবা অপছন্দের পরিবার হোক না কেন আর বাকি কাহিনি বিস্তারিত বলতে গেলে আপনারাও আমার মায়ের মত বলে উঠবেন নিধি তোর কি লজ্জা শরম কিছু নেই। কিন্তু আসল কথা হলো আমি ইমোশনের চেয়ে লজিক দিয়ে আমার জীবনটাকে চালাতে চাই কিন্তু আমার পরিবার আর বন্ধু-বান্ধব আমাকে ইমোশনাল ফুল বানানোর জন্য উঠে পড়ে লেগেছে।
তাদের মধ্যে কোন এক অদৃশ্য কিশোর-যুবক অথবা ব্যাটা আমার প্রেমে নাকি হাবুডুবু খাচ্ছে। প্রতিদিন আমার হাতে কোনো না কোনো ভাবে একটা চিঠি চলে আসে কখনো কখনো আম্মুর হাতেও পড়ে চিঠিগুলো। না পড়লেও আমিই দিয়ে দেই কারণ চিঠিতে একটা লাইনই লেখা থাকে “ভালেবাসা কারে কয়?” নইলে দু’চার লাইন কবিতা।
এখন আমার মত একটা সুপার প্রাক্টিকাল মেয়ে কাউকে না দেখে প্রেমে পড়বে এটা কী করে সম্ভব? যত সব অবাস্তব ন্যাকামি। আমার এই জন্য যে সব ছেলে মেয়েরা প্রেম করে তাদের অর্ধেককেই ভালো লাগে না। দেখলেই মনে হয় এক বস্তা মিথ্যার নথি নিয়ে বসেছে। যাদের বাইচান্স বিয়ে হলে দেখা যাবে সত্তর পার্সেন্ট মিথ্যা সামনে চলে আসবে। তারপর বলবে প্রেমের বিয়ে অথচ এখন আর আমাকে ভালো লাগে না।
আমিও বোকা অযথাই হাজার কেচ্ছা মনের মধ্যে গুছিয়ে রেখেছি। যাই হোক, আমার আবার অন্ধকারে ভীষণ ভয় করে তাই বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার আগে যেভাবে মিথিলা আপুর স্টেজের এক কোনায় চুপচাপ শান্ত শিষ্ট মেয়ে হয়ে বসে ছিলাম এখনো সেভাবেই বসে রয়েছি, তবে ভয়ে আমার শরীর পাথর হয়ে গেছে। বিশেষ করে আমার হাতটা যে হাতে কাগজটা ধেরে রেখেছি।
কিছুক্ষণের মধ্যে কারেন্ট চলে আসলে আমি মীরা আপুর দিকে চিরকুটওয়ালা হাতটা এগিয়ে ধরতেই মীরা আপু জিজ্ঞেস করলো এটা কি?
জানি না আপু।
মানে।
অন্ধকারে কে যেন হাতে ধরিয়ে দিল।
মীরা আপু আমার চেহারা দেখে কি বুঝলো কে জানে আমার হাতটা ধরে বলল এদিকে আস তো- বলে তার সাথে করে মিথিলা আপুর রুমে নিয়ে এসে বিছানায় বসিয়ে দিল। তারপর কাগজটা খুলে পড়ে জিজ্ঞেস করলো – কে দিয়েছে?
আমি জানি না।
জানিস না তো কাঁপছিস কেনো?
কই কাঁপছি বলে নিজের দিকে তাকিয়ে খেয়াল করলাম আমার হাত পা রীতিমত কাঁপছে।
আর আমার কাঁপাকাঁপি দেখে মীরা আপু মুচকি মুচকি হাসছে।
এর মধ্য বাইরে হইচই পড়ে গেলো বরযাত্রী এসে গেছে।
হইচই শুনে মীরা আপু বলল ইন্টার পাশ করে শেরে বাংলা কৃষি ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছিস। দুদিন পর একা একা হলে থাকবি। এমন কত চিঠিপত্র আসবে। তখন কী করবি?
আচ্ছা এখন থাক । বরযাত্রী এসে পড়েছে চল এখন যায়। পরে এই মিস্টেরিয়াস ম্যানকে খুঁজে বের করা যাবে। আর এই নে তোর সম্পত্তি- বলে কাগজটা আবার আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, এই নিধি এবার কাঁপাকাঁপি বন্ধ কর বোকা। তোর মুখেই যত ফটর ফটর আসলে তুই একটা ভীতুর ডিম।
আমি কোনো উত্তর দিলাম না মীরা আপুর কথা মত তার সাথে গেট ধরতে চলে গেলাম।
বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হতে হতে রাত দুইটা। তবুও আমার সব কাজিনরা জেগে জেগে আড্ডা দিয়ে যাচ্ছে । আমি মনে মনে ভেবেই চলেছি অন্ধকারে কে আমার হাতে কাগজটা দিল। আর কী-ই বা লেখা আছে এই কাগজের মধ্যে ভেবে বাম হাতে শক্ত করে ধরে রাখা কাগজটা খুলে অবাক হয়ে গেলাম॥ সেই একটামাত্র লাইনে লিখেছে – “সখি ভালোবাসা কারে কয়?”
চলবে———