‘সত্য পিঞ্জর’
পর্ব ১৪.
তাবিনা মাহনূর
__________
সজলের সাথে দেখা করার সুযোগ মিললো আজ। কারাগারে ঢুকে সজলের মলিন মুখ দেখলো আরশ। বেচারা একটা চাদরের উপর শুয়ে তাকিয়ে আছে উদাস মনে। আরশকে ঢুকতে দেখে সে উঠে বসলো। আরশকে একটা চেয়ার দেয়া হয়েছে। সে সেখানে বসে বললো, ‘জেল খাটতে ভালো লাগছে? হুম?’
সজল কিছু বললো না। আরশ বললো, ‘আফসোস!শরিয়াহ আইন কার্যকর হয় না, মানব রচিত আইন নিয়েই মানুষ আসল বিচার পেতে চায়। আর এর উপর নির্ভর করেই জীবিকা তৈরি করতে হচ্ছে। অথচ আমরা মুসলিম, আমাদের অবশ্যই শরিয়াহ আইন মেনে চলতে হবে। তুমি কি জানো চুরি করার শাস্তি হাত কেটে ফেলা?’
সজল এবারও চুপ করে থাকলো তবে তার মুখে ভীতির ছাপ। আরশ প্রসঙ্গ বদলে বললো, ‘সজল, আমাকে তুমি একটু সাহায্য করবে?’
সজল কেমন নিরস হয়ে বললো, ‘জেলে বইসা সাহায্য ক্যামনে করে?’
– এইযে আমি তোমার সামনে বসে আছি। যা প্রশ্ন করবো সব ঠিকঠাক উত্তর দিবে তুমি।
– একজন তো জিগায় গেছে হেইদিন। হ্যায় কইলো আর কেউ আইবো না এইহানে।
– আমি এসেছি, দেখছোই তো।
– কিন্তু হ্যায় আমারে কইয়া গেছে যেন আমি কাউরে কিছু না কই।
কতটা বোকা হলে এই কথাও মানুষকে বলে! লোকটার সাদাসিধা কথাবার্তা শুনে আরশ আফসোসের সুরে বললো, ‘নফস তোমাকে কোথায় নিয়ে এসেছে দেখো সজল। তুমি প্রফেশনাল চোর নও। তারপরও তোমাকে এখানে থাকতে হচ্ছে চুরির অপরাধে। অবশ্য দুনিয়ায় শাস্তি পেয়ে গেলে আখিরাতে শাস্তির ভার কমে আসে।’
সজল যেন একটু শান্তি পেলো। আরশ তার মুখের উজ্জ্বলতা দেখে প্রশ্ন করলো, ‘তুমি আল্লাহকে বিশ্বাস করো?’
সজল আঁতকে উঠলো, ‘নাউযুবিল্লাহ! কি কইতেছেন? বিশ্বাস করুম না ক্যা?’
– আমি তো সেটাই বলছি যে বিশ্বাস করো কিনা। আচ্ছা শোনো তাহলে, তুমি মৃত্যুর পর জান্নাত জাহান্নামে বিশ্বাস করো?
– জে।
আরশ এবার নম্র কণ্ঠে বললো, ‘তাহলে আমাকে একটু বলবে তুমি কবরস্থানে কি কি দেখেছো? এমন কিছু কি দেখেছো যেটা বলতে মানা করা হয়েছে?’
চুপ করে আছে সজল। আরশ আবার বললো, ‘সজল, ভাই আমার, তুমি যদি কোনো সূত্র বলতে পারো তাহলে হয়তো আমরা আসল অপরাধী খুঁজে বের করতে পারবো। আল্লাহ চাইলে এটা তোমার নাজাতের কারণও হতে পারে। তাই না?’
সজলের চোখ ভরে উঠেছে অশ্রু দিয়ে। সে শার্টের কোণে তা মুছে বললো, ‘আমারে বলছিল যদি কাউরে কিছু না কই তাইলে তিন বছরের জায়গায় তিন মাস সাজা পামু। আমার লাগবো না হ্যাগো দয়া। আমার আল্লাহর দয়া চাই।’
আরশের ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো। সজল নিজেকে শান্ত করে বললো, ‘আমার ইমাম সাবরে সন্দেহ হয়।’
এক অপরাধী আরেক অপরাধীকে সন্দেহ করছে। কথাটা ভেবে আরশের হাসি পেলেও তা প্রকাশ করলো না। সজল অপরাধী হলেও সে বহুবার ক্ষমা চেয়েছে। আল্লাহ চাইলে সে ক্ষমা লাভ করতেও পারে।
আরশ প্রশ্ন করলো, ‘তোমার কেন সন্দেহ হচ্ছে?’
সজল সেই রাতের ঘটনা বললে আরশ ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘তুমি কি দেখেছো কোন কবরে তারা তাবিজ পেয়েছে?’
– না স্যার। আমার খালি জায়গাডা মুনে আছে।
– কোন দিকে?
– আমার ঘর থেইক্যা বাইর হইয়া সুজা যাওনের পর ডানে চাইর পাঁচডা কবর আছে। দুইডা নতুন হইছিল। অহন আমি কইতে পারি না কুনডায় তাবিজ ছিল।
আরশ গম্ভীর হয়ে বললো, ‘তুমি আতিকের ফোন নেয়ার সময় ভুবনের ফোন খোঁজনি?’
– খুঁজছিলাম স্যার। আমি যখন যাইতেছিলাম হেই সময় মুনে হইতেছিল কেউ পলাইতেছে। আমি গিয়া শুধু একখান ফোন পাইছি।
– ইমামকে জিজ্ঞেস করোনি সে সত্যিই ছিল কিনা?
– করছি। হ্যায় কইছে সত্যি।
আরশ মনে মনে পরিকল্পনা সাজিয়ে ফেলেছে। সে উঠে দাঁড়িয়ে চলে আসতে গিয়েও বললো, ‘সজল, আমি আল্লাহর কাছে তোমার জন্য দুআ করবো যেন তিনি তোমাকে আবার সুযোগ দেন ভালো মানুষ হওয়ার।’
_____
রাত সাড়ে দশটা। আরশ তৈরি হচ্ছে তার নতুন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য। গায়ে একটা ধূসর রঙা শার্ট আর সাধারণ কালো প্যান্ট পরে তৈরি হলো সে। তাকে দেখে সাধারণ পথচারী মনে হচ্ছে। রিশতা তার প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো এগিয়ে দিয়ে বললো, ‘সাবধানে যাও।’
আরশ বিছানায় বসে পায়ে মোজা পরছিল। রিশতার কথা শুনে সে উপরে তাকিয়ে বললো, ‘প্রেম প্রেম পাচ্ছে?’
রিশতা মুখ গম্ভীর করে রেখেছে। গম্ভীর স্বরে সে বললো, ‘প্রেম না, আবেগ পাচ্ছে।’
– আবেগ পেলেও তুমি তুমি করবেন?
চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলো রিশতা। আরশ তার কাছে গিয়ে দুই কাঁধে হাত রেখে বললো, ‘তুমি দুআ করো নূরজাহান।’
– তোমার প্রেম পাচ্ছে?
– না, আবেগ।
– তুমি আমাকে নকল করো অনেক।
– তুমি যে আমি।
রিশতা আরশকে জড়িয়ে ধরে বললো, ‘তুমি সাবধানে থেকো দয়া করে। এমন কাজ করো না যেন শত্রুর নজরে সবার আগে তুমি পড়ে যাও।’
আরশ তার চিবুক রিশতার মাথায় ঠেকিয়ে বললো, ‘হাসবুনাল্লাহু ওয়া নি’মাল ওয়াকিল।’
রিশতা বললো, ‘অর্থ?’
– আল্লাহই আমাদের জন্য যথেষ্ট এবং তিনিই উত্তম সাহায্যকারী, কার্যসম্পাদনকারী। সূরা আল ইমরান এর আয়াত নং ১৭৩।
রিশতা ভরসা পেলো। আরশকে জড়িয়ে ধরা অবস্থায় তার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘তাই তো! আল্লাহ থাকলে আর কিছু লাগে কি?’
_____
সজলের দেয়া দিক নির্দেশনায় রাজীব আর আরশ এগিয়ে যাচ্ছে কবরের দিকে। সঙ্গে আছে চাচা আক্কাস। রাত এখন সাড়ে এগারোটা। তারা আগেই পৌঁছে গিয়েছিল কিন্তু অপেক্ষা করছিল মানব শূন্য হওয়ার জন্য। মেশিন দিয়ে কবরের উপর থেকে খোঁজা হচ্ছে ভেতরে লৌহ জাতীয় পদার্থ আছে কিনা। ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক আর মেশিনের শব্দ ছাড়া পরিবেশ নিস্তব্ধ।
সজলের দেখানো জায়গায় দুটো নতুন কবর আক্কাস নিজে খুঁড়েছেন। বাকি কবরগুলোর মাটি শুকনো। আল্লাহর রহমতে নতুন কবরের একটিতে মেশিন ধরলে সেটা জোরে শব্দ করতে শুরু করলো। আরশ বলে উঠলো, ‘এই কবর খুঁড়তে হবে।’
প্রথম কবর খুঁড়ে একটা সোনা ও রুপার তৈরি ঘড়ি দেখা গেল। আক্কাস মাথা চুলকে বললেন, ‘ওহ! মুনে আইছে। এই লোকটার শখ আছিলো ঘড়ি পিন্দা কব্বরে যাওনের।’
মানুষের শখের বাহার দেখে আরশ কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেললো। হতাশ হয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, ‘আক্কাস চাচা আপনাকে আরেকটু কষ্ট করতে হবে।’
অদ্ভুত বিষয়, পরের কবরেও অনেক শব্দ হতে শুরু করলো। আরশ এই কবর খুঁড়তে বললে আক্কাস চাচা সেটা খুঁড়তে শুরু করেন। বেচারার একদিনে কয়েকটা কবর খুঁড়তে খুব কষ্ট হয়। হঠাৎ আরশ বললো, ‘চাচা, আমাকে দিন।’ বলেই সে চাচার অনুমতির অপেক্ষা না করে কোদাল হাতে নেমে পড়লো। চাচা পাশে বসে এই শীতের মাঝেও ঘাম মুছলেন।
অনেকটা গভীরে সাদা কাপড় দেখা গেল। সজল বলেছিল সেও সাদা কাপড় দেখেছে। তার মানে শত্রু পক্ষ বেশ গভীরে তাদের প্রাণ ভোমরা রেখেছে। রাজীব নেমে গিয়ে বললো, ‘তুমি খুঁড়তে থাকো। আমি দেখি পাওয়া যায় কিনা।’
রাজীবের বেশিক্ষণ খুঁজতে হলো না। একটু হাতড়েই সে পেয়ে গেল কাঙ্ক্ষিত বস্তু। ভুবনের ফোনটা অক্ষত আছে। এটাকে তারা ধ্বংস করেনি, নিশ্চয়ই কোনো কারণে। রাজীব গ্লোভস পরে ফোন হাতে নিয়ে সেটা পলিথিনে রাখলো। আরশ হেসে উঠে বললো, ‘আলহামদুলিল্লাহ! প্ল্যান সাকসেসফুল। ফোর্স রেডি আছে তো?’
– হ্যাঁ আছে। ইমামের বাড়ির চারপাশে তারা লুকিয়ে আছে।
– চলুন তাহলে। আর দেরি করা যাবে না।
মসজিদের পাশে একটু দূরে একটা ঘর আছে। সেখানে ইমাম থাকেন। ইমাম তারিক ঘুমাচ্ছিলেন। আরশ সেদিকে গিয়ে বললো, ‘আসসালামু আলাইকুম। কি ব্যাপার ইমাম? আপনি আজ এতো তাড়াতাড়ি ঘুমাচ্ছেন?’
তারিক চোখ ডোলে উঠে বসলো। মাথার টুপি টেবিল থেকে নিয়ে মাথায় দিলো। গায়ের জামা ঠিক করে উঠে দাঁড়িয়ে বললো, ‘আপনি?’
– সালামের উত্তর দিলেন না?
তারিক গম্ভীর কণ্ঠে উত্তর দিলো, ‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম। রাতে তাহাজ্জুদ পড়তে উঠতে হয়। তাই তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে যাই।’
আরশ মুচকি হেসে বললো, ‘তাহাজ্জুদ? কার নামে পড়েন? আল্লাহ নাকি ক্ষমতা?’
– ক্ষমতা মানে?
– ক্ষমতা মানে বুঝতে পারছেন না ইমাম? ছাত্র রাজনীতি করা মানুষ বোকার মতো কথা বললে তাকে তা মানায় না।
ইমামের হাত পিছে চলে গেল। আরশ খেয়াল করে দ্রুত রিভলবার হাতে নিয়ে বললো, ‘কোনো চালাকি চলবে না। স্বীকারোক্তি এখান থেকেই শুরু করুন নাহলে থানায় গেলে লাল মরিচ পিঠে পড়বে।’
ইমাম হুট করে একটা ছুরি ছুঁড়ে মারলো আরশের দিকে। আরশ পিছিয়ে সরে গেল। সঙ্গে সঙ্গে রাজীব এসে ইমামের পায়ের কাছে ফাঁকা গুলি চালিয়ে বললো, ‘এক পাও নড়বে না।’
পুলিশের লোকজন আগে থেকেই ছদ্মবেশে ছিল যেন ইমাম পালানোর চেষ্টা করলে তারা তাকে ধরতে পারে। ইমাম তারিক কিছুতেই স্বীকার করলো না সে কার হয়ে কাজ করছে এবং সেদিন কাকে সাথে নিয়ে কবর খুঁড়েছিলো। হ্যান্ডকাফ পরিয়ে তাকে গাড়িতে তোলা হলো। আরশের কাঁধ চাপড়ে রাজীব বললো, ‘মা শা আল্লাহ! আরশ তুমি খুবই বুদ্ধিমানের কাজ করেছো। এই ইমাম পড়াশোনার পাশাপাশি কীভাবে এখানে ইমামতি করার সুযোগ পেলো তা আমাদের দৃষ্টির বাইরে ছিল।’
আরশ হেসে বললো, ‘ইমাম ছাত্র রাজনীতি করে। আফজাল ইমামকে খুনের ঘটনার দুদিন পরই নিযুক্ত করেছিল এসব বিষয়ে তদারকি করার জন্য। কার্তিক স্যার এটা প্রথম প্রথম বুঝতে পারতেন। এরপর বুঝেও না বোঝার ভান করে থাকলেন। আর তখনই আমার মাথায় বিষয়টা খেলে গেল।’
রাজীবের সাথে আরো কথোপকথন করতে করতে তারা থানায় পৌঁছে গেল। ইমামকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে আরশ নিজে। রাশেদকে খবর পাঠানো হয়েছে। তিনি থানার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছেন।
ইমাম তারিক রক্তিম মুখে বসে আছে। আরশ তার সামনে চেয়ারে বসে বললো, ‘তারিকুল ইসলাম কমল। ওরফে ইমাম তারিক। ইমাম হিসেবে তারিক নাম দিয়ে যুক্ত হয়েছেন, অথচ রাজনীতিতে কমল নাম দেয়া। নামের পলিটিক্সও ভালো খাটিয়েছেন।’
চুপ করে আছে ইমাম। আরশ নানান রকমের প্রশ্ন করা সত্ত্বেও যখন ইমামের মুখ থেকে একটাও শব্দ বের হলো না, তখন রাজীব এসে কষিয়ে চড় মারলো তারিকের গালে। তার ঠোঁট ফেটে রক্ত বের হওয়া শুরু করেছে। তারিক বললো, ‘মেরে লাভ নেই।’
রাজীব পা দিয়ে অনবরত আঘাত করলো ইমামকে। আরশ উঠে দাঁড়িয়ে বললো, ‘আমরা সবই জানতে পারবো। ভুবনের ফোন ফরেনসিক ডিপার্টমেন্টে পাঠানো হয়েছে। আর ইনজেকশনে ড্রাইভার মকবুলের যেই নকল ছাপের রিপোর্ট এসেছে সেটাও প্রমাণ করা হবে আপনার আঙুলের ছাপ মিলে যাওয়ার পর ইন শা আল্লাহ।’
তারিক জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। হঠাৎ সে বাঁকা হেসে আরশকে বললেন, ‘তোকে আমি কিছুই বলবো না। অন্য কাউকে বলবো তাও তোকে না। আমার জিনিস তুই নিয়েছিস।’
ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলো আরশ, ‘আমাকেও তুই করে বলতে হচ্ছে। তোর কোন জিনিস আমি নিয়েছি মুনাফিক?’
তারিক অদ্ভুত কথা বলে বসলো, ‘আহ! কি সুন্দর হাসি ছিল মেয়েটার। নরম গালে লাল আভা। তোর বউটা একটা মাল জানিস?’
এরপর সে রিশতাকে নিয়ে নিকৃষ্ট মন্তব্য করলে আরশ চেয়ার উঁচিয়ে তার গায়ে ফেলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। রাগে তার শরীর কাঁপছে। নোংরা মন্তব্য শুনে তার শরীরে জ্বলন বেড়ে গেছে। ওদিকে তারিককে অবিরাম মারছে রাজীব। তবু সে হাসছে আর নোংরা কথাটা বারবার বলছে। পুলিশ কনস্টেবল, দুজন কারা রক্ষী আর রাজীবের সামনে নিজের স্ত্রীকে নিয়ে বাজে মন্তব্য সহ্য হচ্ছে না আরশের। তারিক খুব ভালো করেই জানে সে এখান থেকে বের হতে পারবে না। তবু সে আরশকে জ্বালিয়ে দিতে বাজে ভাষায় কথা বলছে আর হাসছে, এতটা আঘাতের পরও! সে জানে, একজন দায়িত্ববান ও দ্বীনদার স্বামীর গাইরত বোধ প্রবল।
আরশ চুপ করে থানার বাইরের বেঞ্চে বসে আছে। ভেতরে যাওয়া যাচ্ছে না তারিকের কথার অত্যাচারে। মাথা থেকে কিছুতেই গালিটা বের হচ্ছে না। এমন সময় রিশতার ফোন এলে তার রাগ বেড়ে গেল। ফোন ধরেই সে উচ্চস্বরে বলে উঠলো, ‘সমস্যা কি? ফোন দিচ্ছেন কেন? ন্যাকা ন্যাকা ভাব আমার একদম পছন্দ না!’
ওপাশ থেকে ফোন কেটে দেয়ার আওয়াজ ভেসে আসলো।
_____
বাসায় ফেরার পথে রওনা হয়েছে আরশ। তার মন ভালো নেই। ইমামের রাগটা সে রিশতার উপর ঝেড়েছে। রিশতা আর একবারও ফোন করেনি। তবে ম্যাসেজ করেছিল দুটো শব্দ লিখে। ‘চিন্তা হচ্ছিলো’ ম্যাসেজটা তখনই পাঠায়নি রিশতা। ফোন করার আরো আধা ঘণ্টা পর পাঠিয়েছে। ম্যাসেজটা পাওয়ার পরপরই রওনা হয়েছে আরশ। থানায় তার কাজ শেষ। বাকিটা রাশেদ আর রাজীব করবে।
দরজা খুললো রিশতা। কোনো কথা না বলে সরে দাঁড়ালো সে। বাড়ির সবাই যার যার ঘরে। তবে ফাতিহা আর লুকমান ঘুমিয়ে গেলেও বাকিরা জেগে ছিল। আরশের আসার শব্দ পেয়ে তারা বেরিয়ে এলো। নাজিফা আরশের হাত ধরে বললেন, ‘যা যা, তাড়াতাড়ি ঘরে গিয়ে হিটার ছেড়ে দে। হাতটা ঠান্ডা হয়ে আছে।’
আমান ভাইকে অক্ষত দেখে স্বস্তির শ্বাস ফেললো। তবে আরশকে সে কিছু জিজ্ঞেস করলো না। ভাইয়ের ক্লান্ত মুখ দেখে একবার বললো, ‘গায়ে কাদামাটি লেগে আছে। গোসল করে ঘুমিয়ে পড়। সকালে কথা হবে ইন শা আল্লাহ।’
আনিকাকে জেগে থাকতে দেখে আরশ একটু বকলো, ‘আপু, তুমি অসুস্থ। জেগে থাকার কি দরকার ছিল?’
আনিকা ভাইকে একবার আলতো করে জড়িয়ে ধরতেই আরশ আবার রাগ করলো, ‘আহা আপু! আমি নোংরা হয়ে আছি।’
– আমার চিন্তায় ঘুম আসেনি, আর তুই শুধু বকেই যাচ্ছিস।
হেসে ফেললো আরশ, ‘এখন ঘুমাতে যাও আপু। তোমাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে জোর করে ঘুম আটকে রেখেছিলে।’
আরশ কাজে যাওয়ার পূর্বে রাতের খাবার খেয়ে গিয়েছিল। তাই এখন খাবারের ঝামেলা নেই। মাকে একবার জড়িয়ে সে উপরে উঠলো। নাজিফা ঘরে চলে গেলেন। রিশতা উপরে উঠলো না। রান্নাঘরে কফির প্যাকেট আর প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো নিয়ে কাজ করতে শুরু করলো।
আরশ অপেক্ষায় আছে রিশতা কখন উঠবে। ঘরে ঢুকলেই সে রিশতাকে জড়িয়ে ধরে হাজার বার ক্ষমা চাইবে। আরশ ক্ষমা চাইতে জানে না। কারো সাথে তার রাগারাগি হলে সে বিব্রত বোধ করে ক্ষমা চায়। তখন অপর মানুষটা মনে করে, এই ক্ষমা হলো অহংকারী ক্ষমা! অর্থাৎ, আরশ ক্ষমা মন থেকে চাইছে না। কিন্তু আরশের নিজেকে বড় অপরাধী মনে হয় যখন কেউ তার কাজে কষ্ট পায়। তাই ক্ষমা চাওয়ার সময় সে খুব অস্বস্তি বোধ করে মানুষটার সামনে দাঁড়িয়ে। অথচ সে খুব করে চায়, মানুষটা যেন তাকে ক্ষমা করে দেয়। সে নিজের দোষ স্বীকার করে।
এবারও তাই রিশতা উপরে ওঠা সত্ত্বেও সে কিছু বলতে পারলো না। তবে রিশতাকে স্বাভাবিক দেখাচ্ছে। সে বলে উঠলো, ‘আপনি গোসল করবেন না?’
মাথা দুলিয়ে আরশ জামা নিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেল। রিশতার কাছে কীভাবে ক্ষমা চাইবে তা ভাবতে ভাবতে গোসল শেষে সে বেরিয়ে এলো। রিশতা বারান্দার চৌকাঠের উপর দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখে বললো, ‘কফি খাবেন?’
– হুম।
রিশতা নীচে চলে গেল। সে আগে থেকেই জানতো আরশ শীত অনুভব করল কফি খাবে। কফি নিয়ে উপরে উঠে আরশকে বারান্দায় বসে থাকতে দেখলো সে। সেখানে গিয়ে আরশের হাতে কফি দিতেই আরশ বলে উঠলো, ‘আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন।’
রিশতা চুপ করে আরশের পাশে বসলো। কফির কাপে এক চুমুক দিয়ে সেটা আরশের দিকে এগিয়ে দিলো। আরশ সেখানে এক চুমুক দিলে রিশতা বললো, ‘মন একটু খারাপ হয়েছিল। কিন্তু অভিমান করার সময় পাইনি। কারণ অভিমানের চেয়ে চিন্তাটাই বেশি হচ্ছিলো।’
আরশ তাকিয়ে আছে রিশতার দিকে। মেয়েটা কত সুন্দর করে কথা বলে! রিশতা তার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘আপনি যখন রাগ করলেন, আমি তখন কষ্ট পেয়ে ফোন কেটে দিয়েছিলাম। কিন্তু এরপর আমার মনে হলো, আপনি বিনা কারণে রাগ করবেন না নিশ্চয়ই? তখন আমার ভয় হতে শুরু করলো। আপনি কি মিশনে সাকসেস হননি? আপনি কি কোনো বিপদে পড়েছেন? এসব চিন্তায় ভুলেই গেলাম আপনি রাগ দেখিয়েছেন। আবার ফোন করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু মনে হলো আপনি অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিতে থাকলে ফোনের আওয়াজ ঝামেলা করতে পারে। তাই ম্যাসেজ করলাম। আলহামদুলিল্লাহ, আপনি যখন লিখলেন আপনি বাসায় আসছেন, তখন খুব শান্তি পেয়েছি।’
রিশতার চিন্তাধারায় অভিভূত হলো আরশ। এমনই একজন মনের সঙ্গিনী সে চেয়েছিল। নিজেকে নিজের চেয়ে ভালো কেউ বুঝবে না। তাই সে আল্লাহর কাছে চাইতো, সে যেন নিজেকেই খুঁজে পায়। সে পেয়েছে। রিশতার মাঝে নিজেকে সে খুঁজে পেয়েছে।
আরশ ইমামের বিষয়টা রিশতাকে এখনই বলবে না ভেবে রাখলো। এখন রিশতা জানলে খুব কষ্ট পাবে। হাতের কফির মগ টেবিলে রেখে আরশ রিশতার মুখ দুই হাতের মাঝে নিয়ে তার কপালে আদর বুলিয়ে দিলো। তারপর রিশতার চোখে চোখ রেখে বললো, ‘আলহামদুলিল্লাহ!’
রিশতা হেসে উঠলো। পরক্ষণেই সে মুখ গোল করে রাগী ভঙ্গিতে বললো, ‘কিন্তু আমার অভিমান হয়েছে। আপনি বাসায় আসছেন শুনে খুশির পাশাপাশি অভিমান আবার ফিরে এলো।’
আরশ হেসে ফেললো। কারো রাগ হলে এমন অকপটে স্বীকার করবে সে এই প্রথম দেখলো। রিশতার দিকে তাকিয়ে সে হেসে বললো, ‘কি করলে রাগ কমবে নূরজাহান? আমাকে তুমি যা বলবে তাই করবো।’
রিশতা গালে হাত দিয়ে কিছুক্ষণ ভাবতে থাকলো। তার এমন অভিনয় দেখতে আরশের ভালো লাগছে। রিশতার চোখে দুষ্টুমির আভাস। আরশ বললো, ‘কি করবো বলো?’
রিশতা দোলনায় রাজকীয় ভঙ্গিতে শুয়ে পড়লো যেভাবে পুরোনো দিনের জমিদাররা আয়েশ করতো। এক গোছা চুল ঠোঁটের উপর রেখে সে বললো, ‘আমাকে নাচ প্রদর্শন করো হে বৎস!’
__________
(চলবে ইন শা আল্লাহ)