সত্য পিঞ্জর পর্ব-২০

0
1009

‘সত্য পিঞ্জর’
পর্ব ২০.
তাবিনা মাহনূর

__________

ভোর হয়েছে। রিশতাকে তাহাজ্জুদের সময়ে ফোন করে জানানো হয়েছে আরশকে পাওয়ার কথা। সে আজ দশ দিন পর প্রশান্ত মনে গভীর শ্বাস নিয়ে ভার মুক্ত হয়েছে। আরশ এখানে আসতে চাইছে শুনে সে বলেছে, ‘আসতে দিন। এসে একটু দেখা করে তারপর হাসপাতালে নিবেন। নাহলে মন শান্ত হবে না।’

অল্প এই কথা বলার পর থেকে সে আবার চুপচাপ বসে রইলো। সালাত শেষে নাজিফার ঘরে গিয়ে বললো, ‘মা, ইফতিখার আসছেন।’

নাজিফা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে ছিলেন কিছুক্ষণ। তারপর রিশতাকে জড়িয়ে উচ্চস্বরে কেঁদে উঠেন তিনি। সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে এসে নাজিফাকে এমন অবস্থায় দেখে ভেবেছিল আরশ বেঁচে নেই! তাই আনিকা সেখানেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। জামিল সেটা সামলে নেয়। রিশতা সবাইকে অশ্রু চোখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলে, ‘কাঁদছেন কেন আপনারা?’

তারা যখন আরশের বেঁচে থাকার খবর জানতে পারলো তখন খুশিতে দ্বিতীয় দফা কেঁদে ফেললো সবাই। রিশতা নাজিফাকে ছেড়ে বললো, ‘আমি স্যুপ আর জুস তৈরি করে রাখি মা। আপনি বিশ্রাম নিন।’

নাজিফা শুনলেন না। তিনিও রান্নাঘরে গেলেন। তিনি চিকেন স্টক তৈরি করবেন আর তরল জাও ভাত রাঁধবেন। রিশতাকে জোর করে ঘরে পাঠিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘ঘর গুছিয়ে রাখো। আমার ছেলে যেন তোমাকে আর তার ঘরকে যেমন রেখে গিয়েছিল, তেমনি পায়।’

এ কথা দ্বারা তিনি রিশতাকে স্বাভাবিক হতে বলছেন। কিন্তু রিশতার এখনো কোনো চঞ্চলতা কিংবা প্রফুল্লতা কাজ করছে না। বরং অদ্ভুত এক অভিমান জমেছে। তার অনুভূতির প্রকাশ সে নিজেই বুঝতে পারে না। নিজেকে মাঝে মাঝে পাগল মনে হয়!

আরশ প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছে। রিশতার খুব ঘুম পেয়েছে। এমন ঘুম এর আগে কখনোই পায়নি। যেন ঘুম রাজ্যের রাজা তাকেই তার সকল ঘুমের দায়িত্ব দিয়ে দিয়েছে। একে বলে মনঘুম। মনের মতো ঘুমাতে পারা, শান্তির মাঝে বিশ্রাম নেয়া।

আরশ বাসার গলিতে ঢুকেছে। এখন রিশতাকে ইহসানের সাথে কথা বলতে হচ্ছে না। আমান ফোন নম্বর নিয়ে নিজেই একটু পর পর যোগাযোগ করছে। গলির কাছে চলে আসায় তারা দরজা খুলে রাখলো। এমন সময় রিশতা বললো, ‘আমার খুব ঘুম ধরেছে। আমি একটু ঘুমাই?’

প্রশ্ন করলেও উত্তরের অপেক্ষা করলো না সে। ঘরে গিয়ে বিছানার এক কোণে শুয়ে পড়লো। মুহূর্তেই ঘুম সাগরে ডুব দিলো সে।

_____

কপালে উষ্ণ স্পর্শ। রিশতার ঘুম আরো গাঢ় হলো। পরিচিত একটা সুগন্ধ অনুভব করছে সে। পুরো ঘরে নতুন প্রাণ ফিরে পাওয়ার অস্তিত্ব টের পাচ্ছে সে ঘুমের মাঝেই। মুখটা এগিয়ে দিয়ে নাক ঠেকালো আরশের বুকের উপর। আরশ হাত দিয়ে তার মাথা নেড়ে বললো, ‘ঘুমাও। অনেকদিন ঘুম হয়নি তোমার।’

রিশতার পনেরো মিনিটের ঘুম এতটাই প্রশান্তির ছিল যা তার কাছে পনেরো দিন ঘুমানোর সমান। চোখ বুজে সে বললো, ‘ঘুম হয়েছে। আপনি ঘুমান।’

– আমাকে একবার দেখবে না?
– না।
– কেন?
– জানি না।

রিশতার আচরণ দেখে আরশ অনুমান করলো তার মানসিক অবস্থা এখনো ভারসাম্যহীন। সে ভেবেছিল তার নূরজাহান তাকে দেখে কান্নায় ভেঙে পড়বে। জড়িয়ে ধরে বসে থাকবে বেশ কিছুক্ষণ। কিন্তু এই বৈশিষ্ট্য যে রিশতার সাথে মানানসই নয়, তা সে ভুলেই গিয়েছিল। এই রিশতা আবেগে তুমি করে বলছে না। এখন তার শঙ্কা জাগছে, তার স্ত্রী কি আবারো পূর্বের রূপে ফিরে গেল? যেই রিশতা ছিল যন্ত্রের মতো?

অনেকক্ষণ পর রিশতা চোখ মেলে তাকিয়ে তার ইফতিখারকে দেখতে পেলো। আরশ যেমন নির্নিমেষ তাকিয়ে আছে, রিশতা তেমন করেই তাকিয়ে থাকলো। হাত এগিয়ে আরশের গালে রেখে সে বললো, ‘খুব ব্যথা করছে?’

আরশ নিস্তেজ স্বরে বললো, ‘সবখানেই ব্যথা পেয়েছি। শুধু গালে নয়।’

হঠাৎ রিশতার মনে পড়লো আরশের পায়ের কথা। সে উঠে বসে আরশের দুই পা হাত দিয়ে ধরে সব আঙ্গুল অক্ষত দেখতে পেয়ে বললো, ‘আমাকে ওরা আঙ্গুল কাটার ছবি দিয়েছিল।’

আরশ রিশতাকে দেখছে। শেষের বাক্যটা বলার সময় রিশতার মুখ কুঁচকে এসেছিল। সে কল্পনা করলো সেই মুহূর্ত, যখন রিশতা ভেবেছিল তার আঙ্গুল কেটে ফেলা হয়েছে। কতই না কষ্ট পেয়েছে তার নূরজাহান!

– ওটা ভয় দেখানোর জন্য করেছিল।
– বুঝেছি।
– ইহসান স্যারের কথা মাথায় এসেছিল কার?
– আমার।
– আলহামদুলিল্লাহ।

আর কোনো কথা নেই। রিশতা বসে থেকে আরশের আঘাতের চিহ্ন গুনছে। ময়লা শরীর দেখে সে বললো, ‘পানি দিয়ে গা মুছে দিব?’

আরশ উপর নিচ মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানালো। রিশতা বাথরুমে যেতে যেতে বললো, ‘হাসপাতালে যেতে দিব না। এখানে ডাক্তার আসবে, নার্স আসবে। এখানেই সব চিকিৎসা হবে।’

আরশ এর কারণ বুঝতে পেরেছে। ডাক্তারদের বিশ্বাস করছে না রিশতা। যদি ঔষধের সাথে বিষাক্ত কিছু মিশিয়ে দেয় তাহলে টের পাওয়া যাবে না অথচ ধীরে ধীরে ভেতরের সব অঙ্গ নষ্ট হয়ে যাবে। তাই রিশতা এই ঝুঁকি নিতে রাজি নয়।

পানি আর তোয়ালে নিয়ে আরশের পাশে বসলো রিশতা। আরশের হাতে ছোপ ছোপ কালচে দাগ পড়ে আছে। একটা দাগে অধোর যুগল বসিয়ে আরশের দিকে তাকালো সে। দেখতে পেলো, তার ইফতিখারের চোখে তৃষ্ণা।

_____

– পুরো স্যুপ না খেলে গায়ে ঢেলে দিব একদম!

আজ কতদিন পর মায়ের শাসন শুনতে পেলো আরশ। মোটেও রাগ হচ্ছে না তার। কড়া কন্ঠ শুনে সে বারবার মুচকি হেসে উঠছে। নাজিফা স্যুপ খাইয়ে দিচ্ছেন। এরপর জুস খাওয়াবেন। এতকিছু হঠাৎ করে খেতে কষ্ট হচ্ছে আরশের। খেতে না চাওয়ায় নাজিফা বকলেন।

– তোর আব্বু অভিমান করেছে। তোকে দেখতে আসবে না বলে দিয়েছে।
– আমিই যাবো।
– তোর যাওয়ার মতো অবস্থা আছে? একটুও হাঁটতে পারছিস না, আবার সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামবি কি করে? যেতে হবে না। আমি পাঠিয়ে দিব। আমানের চেহারা দেখেছিস?
– হুম। ভাইয়াকে দেখে মনে হলো তার উপর বিশাল ঝড় বয়ে গিয়েছে।

নাজিফা চামচ বাটিতে রেখে আরশের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এতগুলো দিন তোর ভাই ঘুমায়নি। চিন্তায় প্রেসার বেড়ে গিয়েছিল। তোর বাবার ডায়াবেটিস বেড়ে গিয়েছিল। তবু তোর বাবাকে সামলানো গিয়েছে আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু আমানের যা হয়েছিল রে! আলহামদুলিল্লাহ, ইমারজেন্সি ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম। এদিকে বৌমা গর্ভবতী। আনিকাও ভারী হয়ে যাচ্ছে। সব সামাল দিয়েছে জামিল। এই ছেলেটার উপরেও অনেক চাপ গিয়েছে। আনিকাও অভিমান করেছে তুই যাওয়ার সময় দেখা না করে গিয়েছিলি বলে।’

– আমি কি বিদেশ চলে যাচ্ছিলাম আম্মু? দেখা করতেই হবে!
– এটাই তো বলবি। তুই কি বুঝতে পারছিস না তোকে সবাই কত ভালোবাসে?

আরশ মুচকি হেসে বললো, ‘এটা প্রমাণ সহ কেন দেখাতে হবে আম্মু? আমি কি জানি না?’

– না, জানিস না। জানলে এই চাকরি জীবনেও করতি না। তুই ভাবিস তোর কিছু হয়ে গেলে আমাদের কিছুই মনে হবে না। এজন্যই তুই এমন বিশ্রী চাকরি করিস। সব ছেড়ে দিবি। হয় চাকরি ছাড়বি, আর নাহলে বনবাসী হবি। এখানে তোকে থাকতে দিব না।
– চাকরি এমনিতেই থাকবে না আম্মু।
– আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন। আলহামদুলিল্লাহ।

চাকরি না থাকায় নাজিফা খুশি হলেন। আরশকে পুরো স্যুপ খাইয়ে দিয়ে বললেন, ‘পরে জুস খা। এখন একবারে খেতে হবে না। তোর ইহসান স্যারকে আজ বিকেলে আসতে বলেছে আমান। লোকটা খুবই ভালো মানুষ। সারা রাত তোকে নিয়েই ছিল বলে তোর আব্বু এখানে বিশ্রাম নিতে বলেছিল। কিন্তু উনি বললেন, আপনারা আরশকে আগলে রাখুন। আমি অবশ্যই আসবো একদিন। আজই আসবেন, তোকে কি যেন জানাতে হবে বললেন।’

আরশ কিছুটা ধারণা করতে পারলো ইহসান স্যার তাকে কি বলতে আসবেন। তবু সে চুপ করে থাকলো। প্রথমে স্যারের সাথে একান্ত আলাপ করতে হবে। তারপর বিষয়টা সবাইকে জানাতে হবে।

কথা রাখতে ইহসান আসলেন বিকেল বেলা। ড্রইং রুমে বসে সবার সাথে কুশল বিনিময় করলেন। নাজিফা আর ফাতিহা রান্নাঘরে নাস্তা সাজানোয় ব্যস্ত। আনিকা ঘুমিয়ে আছে। তার গর্ভাবস্থার জটিলতার কারণে তাকে সবসময় বিশ্রামে থাকতে হয়।

ইহসানের সাথে বাড়ির পুরুষ সদস্যদের কথোপকথন শেষে ইহসান বললেন, ‘আরশ বাবার সাথে কথা বলতে পারলে ভালো হতো। ঘুমাচ্ছে সে?’

আমান বললো, ‘না স্যার। চলুন আপনাকে নিয়ে যাই।’

আজ কেউ অফিসে যায়নি। জামিল ছুটি নিয়েছে আর আমান অফিসের সবাইকে ছুটি দিয়েছে দুদিনের জন্য। আরশের ঘর পর্যন্ত পৌঁছানোর আগেই আমান ডেকে উঠলো, ‘আরশ, তোর বউ আছে ঘরে?’

আরশ উচ্চস্বরে উত্তর দিতে পারছে না। রিশতা বললো, ‘আসুন আপনারা। আমি বারান্দায় আছি।’

রিশতা বারান্দায় যাওয়ার পর ইহসান ভেতরে ঢুকলেন। তিনি একাকী কথা বলতে চাইছিলেন। আমান থাকায় আলোচনাগুলো সংক্ষিপ্ত হলো। আরশ সরাসরি বললো, ‘ভাইয়া, তুমি বরং নিচে গিয়ে দেখো স্যারের ড্রাইভার আছে কিনা। তাকেও নাস্তা খেতে ডাকো।’

আমান এই কথাতেই বুঝে নিলো আরশ কি বলতে চাইছে। সে মুচকি হেসে চলে গেল। ইহসান বললেন, ‘তোমার হাতের চেকআপ করাবে না? তুমি বলেছিলে বাম হাতের উপরের অংশ অবশ মনে হচ্ছে তোমার।’

– জি স্যার। এই হাত উঠাতে পারছি না ঠিকমতো। আর মাথাও প্রচন্ড ব্যথা করে।
– তোমার কন্ঠ শুনেই বুঝেছি। যাই হোক, আজ ডাক্তার আসবেন। সব সমস্যার কথা বলবে। এখন মূল কথায় আসি। তোমাকে হিজরত করতে হবে।

আরশ মুচকি হেসে বললো, ‘অনুমান করেছিলাম।’

– হ্যাঁ বাবা, তুমি বিচক্ষণ ছেলে। নিশ্চয়ই বুঝতে কষ্ট হচ্ছে না কেন হিজরত করবে?
– জি।
– ওরা তোমাকে দেশে দেখতে চায় না। যদি দুই তিন মাসের মধ্যে দেশ না ছাড়ো তাহলে তোমার জীবন নিয়ে ঝুঁকি বাড়বে। ওরা এখনো তোমাকে টার্গেট করে রেখেছে কেননা ওরা জানে না প্রমাণ কোথায় আছে। অবশ্য আমি ভাবছি বলে দেব সত্যটা। উসমানের জীবন নিয়ে আর আশংকা নেই আলহামদুলিল্লাহ।

আরশ প্রশ্ন করলো, ‘সংবাদ মাধ্যমের কি খবর স্যার?’

– ওহ! ওটা বলতেই ভুলে গিয়েছি। এখন সব চ্যানেলে তোমাকে খুঁজে পাওয়ার খবর এসেছে। পুরো দোষ একজন মাদক পাচারকারী আসামিকে দেয়া হচ্ছে। হাস্যকর বিষয় কি জানো? সেই পাচারকারীকে অনেক আগেই জেলে ঢোকানো হয়েছিল। তাকে জেল থেকে বের করে আবার ঢোকানো হয়েছে। যেন মানুষ ভাবে সে জেল পালিয়ে মাদক ব্যবসা আবার শুরু করেছিল। এবং তোমাকে সে-ই আটকে রেখেছিল।

আরশ তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললো, ‘সত্যিই হাস্যকর! কিন্তু আমি অবাক হচ্ছি এতো সূক্ষ্ম পরিকল্পনাগুলো কে সাজিয়েছে?’

ইহসান বললেন, ‘মিলন।’

অবাক হলো আরশ, ‘মিলন স্যার! কিন্তু উনি কাজের মাঝখানে সরে দাঁড়ালেন যে। তারপর উনি…’

– তারপর উনি কক্সবাজার গিয়েছিলেন মাদকের বিষয়টা দমাতে। তাই তো? শোনো বাবা, উনি নিজেই মাদক চোরাচালানের একজন বড় মাফিয়া। এই কেসে নিজেকে নিরাপদ রাখতে সরে দাঁড়িয়েছিলেন। এরপর তুমি যেন এর সাথে কোনোভাবেই না জড়াও সেই চেষ্টাই করছিলেন। কেননা তুমি যদি জেনে যাও বড় বড় মাফিয়া কারা, তাদের তথ্য তুমি কখনোই গোপন করবে না। ফাঁস একদিন করবেই। এই আশংকায় তিনি তার রাস্তা পরিষ্কার রাখতে চেয়েছেন। এমনকি, এখনো তিনি বেশ নিরাপদ অবস্থানে আছেন। কেননা, তোমার গু-ম হওয়ার ঘটনায় তিনি একবারের জন্য সামনে আসেননি।

মিলনের কুবুদ্ধি জেনে বিস্মিত হলো আরশ। এই মানুষটা নিজেকে আড়াল রেখে কূটচাল চেলেছে। আরশ বললো, ‘কিন্তু স্যার, আপনার শত্রু বেড়ে গেল না?’

হেসে উঠলেন ইহসান, ‘এরা আবার কি এমন শত্রু! তুমি জানো না আমার কাছে কি আছে আরশ। আমার পুরো পৃথিবী জুড়ে শত্রু কিন্তু কেউ কোনো আঘাত করতে পারে না।’

স্যারের রহস্যময় কথার অর্থ খুঁজে পেলো না আরশ। ইহসান অবশ্য মোটামুটি একটা ধারণা দিয়ে বললেন, ‘আমি জানি বড় বড় মাফিয়া কারা। শুধু দেশে নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও কারা মুসলিম জাতির জন্য ভাইরাস স্বরূপ। সব কিছুর একটা তালিকা আমার আছে। কিন্তু এই তালিকা আমার কাছে নেই। তাদেরকে বলে দিয়েছি, আমার মৃত্যুর সাথে সাথে তালিকা ফাঁস হয়ে যাবে। তাই আমাকে মেরে ফেলার হুমকি দিলেও, মারতে পারে না। সরি আরশ, তোমাকেও বলতে পারবো না কোথায় কি রেখেছি আমি।’

আরশ মুচকি হেসে বললো, ‘তা না বলাই ভালো স্যার। আল্লাহ আপনার সহায় হন।’

– এটাই বড় কথা। আল্লাহ চান বলেই বেঁচে আছি এতদিন আলহামদুলিল্লাহ। আর, যেহেতু আমার কোনো পরিবার নেই, তাই পিছুটানও নেই।

আরশ প্রতিবারই মুগ্ধ হয়ে এই অসাধারণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষটাকে দেখে, তার কথা শোনে। পুরো জীবন একাকী পার করে গেলেন ইহসান। বিয়েও করেননি। অবশ্য লোকমুখে শোনা যায়, বিয়ে করেছিলেন তিনি। কিন্তু বেশিদিন না যেতেই স্ত্রী মারা যান। তারপর আর কোনো নারীর সংস্পর্শে যাননি তিনি। তাই তো তাকে এ নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি শুধুই হাসেন।

কথাবার্তা শেষে আরশ বললো, ‘অনেক সাহায্য করেছেন স্যার। একটা ছোট্ট সাহায্য চাইছি।’

– অবশ্যই! বলো আরশ।
– সজল নামের রক্ষীর কারণে আমরা এতদূর এগিয়ে গিয়েছি। তার একটা খোঁজ পেলে ভালো হতো। আর রাজীব ভাইয়ের বিষয়টাও জানতে চাই।

ইহসান উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আজ রাতের মধ্যেই জেনে যাবে ইন শা আল্লাহ। এখন বিশ্রাম নাও। আর হ্যাঁ, তোমার স্ত্রী কিন্তু তোমার অনুপস্থিতিতে পর্দা ভুলে যায়নি। অবশ্যই তার দিকটা চিন্তা করবে আরশ। সবসময় শুধু নিজেকে নিয়ে ভাবলে হয় না। তখন মরে যেতে বাধা থাকে না। তাই বেঁচে থাকতে নির্ভরতা প্রয়োজন। রিশতার মতো ভালো মেয়েটাকে ভুলে যেও না। আসছি!’

আরশ সালাম দিয়ে মুচকি হাসলো। হেসে বললো, ‘রিশতা আপনাকে সালাম জানাতে বলেছে। আপনার ঋণ শোধ করার মতো নয়।’

_____

রাত হতেই ইহসান ফোন করলেন। আরশ রিশতার কোলে মাথা রেখে ঘুমানোর চেষ্টা করছিল। ডাক্তার এসে ঔষধ দিয়ে গেছে এবং অনেকগুলো টেস্ট করতে বলেছে। স্যারের ফোন আসায় সে ভ্রু কুঁচকে বললো, ‘একটু দেখেন তো কে ফোন করেছে।’

– ইহসান স্যার।
– লাউড স্পিকার অন করে দিন।

ফোন ধরতেই স্যার বললেন, ‘আরশ?’

– জি স্যার, আসসালামু আলাইকুম।
– ওয়া আলাইকুমুস সালাম। ঘুমাচ্ছিলে মনে হচ্ছে? আমি বেশিক্ষণ কথা বলবো না।
– সমস্যা নেই স্যার।
– রাজীব জানতো না তোমার বিষয়টা। সে ভেবেছিল সত্যিই রাশেদকে উদ্ধার করতে যাওয়া হচ্ছে। পরে তোমার পরিণতির কথা জেনে সে একটু বিরোধিতা করেছিল। কিন্তু তাকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে চুপ করে রাখা হয়েছিল। এমনকি, সে এখনও কারো সাথে স্বাভাবিকভাবে কথা বলছে না। মনে হয় তাকে ঢাকার বাইরে পাঠিয়ে দেয়া হবে।
– রাজীব ভাইকে কোনো দোষ দিতে পারছি না। সবার মন সবল হয় না।
– হ্যাঁ। আল্লাহ ওকে সুবুদ্ধি দিন।
– আমিন। আর সজলের কি খবর?

চুপ করে আছেন ইহসান। আরশ অপেক্ষা করছে উত্তরের জন্য। দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি বললেন, ‘আরশ, সজল ছেলেটাকে জেল থেকে বের করা হয়েছে। এরপর, তাকে মেরে টুকরো করে বুড়িগঙ্গায় ভাসিয়ে দেয়া হয়েছে।’

আরশের চোখ দুটো বন্ধ হয়ে এলো। মৃদু স্বরে সে বলল, ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। আল্লাহ মাগফিরাত দান করুন!’

_____

(চলবে ইন শা আল্লাহ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here