‘সত্য পিঞ্জর’
পর্ব ৬.
তাবিনা মাহনূর
__________
হিশামের দাফন কাজ সম্পন্ন হওয়ার পর একে একে লোকের সংখ্যা কমতে শুরু করলো। বিদেশ থেকে মেঘের আসার কথা ছিল। সে না আসা পর্যন্ত হিশামকে দাফন করতে রাজি হচ্ছিলেন না আজমেরী। মর্জিনা সহ আত্মীয় স্বজন অনেকেই বললেন এতে লাশের কষ্ট বাড়ে। যত দ্রুত সম্ভব লাশ দাফনের ব্যবস্থা করা উচিত। মেঘ যখন জানলো তার বাবাকে সে দেখতে পাবে না, তখন দেশে আসার আর কোনো চেষ্টা করলো না সে। তার স্ত্রী একবার আজমেরীর সাথে কথা বলেছে। শুধু একটাই কথা, ‘আমাদের পরিবারের ছায়া চলে গেল মা।’
পরিবারের ছায়া যাকে বলা হচ্ছে, তার খোঁজ খবরও নেয়নি তারা। তথাকথিত ‘ফর্মালিটি’ দেখাতে একটু কথা বলতে হলো। মেঘকেও তেমন ব্যথিত হতে দেখা গেল না। শুধু একবার বললো, ‘রিশতার দিকে খেয়াল রাখবেন মর্জিনা খালা। মেয়েটা বাবাকে খুব ভালোবাসতো।’
রিশতাকে সবাই স্নেহ করে তার আন্তরিকতার জন্য। সেই হিসেবে নিজের মায়ের কথা মনে না করে রিশতার দেখভাল করতে নির্দেশ দিল মেঘ। মর্জিনার অবশ্য আজমেরীর প্রতি কোনো খেয়াল নেই। স্তব্ধ রিশতার দিক দেখতে গিয়ে হিশামের মৃত্যু শোকও তাকে স্পর্শ করেনি।
এদিকে আজমেরী বেগমের মায়া কান্না দেখে সকলের চোখে অশ্রুর ফোয়ারা। হিশামের বোন চামেলি বেগম ভাবীকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছেন। আজমেরীর বান্ধবী, বোন- সকলেই এসেছে। সবার অশ্রু বলে দিচ্ছে, জীবন নিশ্চয়ই ক্ষণস্থায়ী।
বাড়িতে আসা লোকজন বেশিরভাগ আজমেরী বেগমের জন্য শোক প্রকাশ করছেন। মর্জিনা একবার বিরক্ত হয়ে মহিলাদের ঘরে গিয়ে বললো, ‘হইছে হইছে, আপা ভালোই থাকবেন। আপনারা শুধু শুধু উনাকে আরো বেশি কষ্ট দিচ্ছেন মরা কান্না কেঁদে।’
মর্জিনাকে অকথ্য ভাষায় কটু কথা শুনিয়েছে আজমেরীর বান্ধবী। হিজড়া, প্রতিবন্ধী- এমন আরো কিছু কথা শোনার পর মর্জিনা চোখের জল আড়াল করতে রিশতার কাছে গেল। মেয়েটাকে দেখলে নিজের কষ্ট কিছুই মনে হয় না তার। সে জানে, বাবা মা না থাকার কষ্ট কতটা পোড়ায়। তার আর রিশতার তফাৎ এতোটুকুই যে, রিশতার বাবা মা তাকে ছেড়ে পরকালে গমন করেছে। আর তার বাবা মা তাকেই ছেড়ে যেতে বাধ্য করেছে।
রিশতার পাশে পুরো শরীর ঢেকে রেখে বসে আছে আনিকা। বাড়িওয়ালার মৃত্যুর খবর শুনে জামিল অফিস থেকে ছুটি নিয়ে আনিকার কাছে গিয়েছিল। ছয় বছর ধরে তারা এই বাড়িতে থাকছে, সেসময় হিশাম ছিলেন সদা হাস্যোজ্জ্বল মানুষ। তাদের অবস্থানের এক বছরের মাথায় হিশাম বড় ধরণের স্ট্রোক করলেন। আল্লাহর রহমতে সেবার বেঁচে গেলেও শরীরের সকল ক্ষমতা হারিয়ে ফেললেন তিনি।
দুজনের মায়া পড়ে আছে বাড়িটার উপর, বাড়ির মানুষগুলোর উপর। জামিলের ইচ্ছে ছিল জানাজায় অংশ নেয়ার। তাই অফিসের বসকে অনুরোধ করে কাজ রেখেই চলে এসেছে। আনিকা এসেছে রিশতার জন্য। আজমেরীকে দেখার অনেকেই আছে, রিশতার কেউ নেই। এমনকি তার চাচা চাচিও আসেনি।
আনিকার সামনে বসে মর্জিনা বললেন, ‘এই মেয়ের কি হবে বলেন তো আম্মা? শশুরটা অসুস্থ হলেও বৌমাকে চোখে হারাতো। ওর বিয়ের কথা শুনলেই বারবার চোখের পলক ফেলে বুঝাতো, বিয়ে যেন না দিই। এখন মেয়েটার কি হবে? আল্লাহ! তুমি কোন বিপদে ফেললা!’
আনিকা ভেজা কণ্ঠে বললো, ‘এসব বলতে হয় না খালা। আল্লাহ বিপদ দেন, আল্লাহই রক্ষা করেন। তিনি শুধু সবরের পরীক্ষা নেন। এই পরীক্ষায় জিততে পারলে আখিরাত জয় করা যায় খালা। সবর করেন। মনে করেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা। কতই না কষ্ট পেয়েছিলেন তিনি একের পর এক আপনজন হারিয়ে।’
মর্জিনা শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছে বললেন, ‘তিনি তো রাসূল, আমরা সাধারণ মানুষ। তাঁর সাথে তুলনা চলে?’
– তুলনা চলে না খালা। কিন্তু তাঁর কষ্ট ভেবে নিজের কষ্ট কিছুই মনে হয় না।
– আম্মা, তুমি তো জানো না এ বাড়িতে কি চলতেছে। আজমেরী আপা কি শুরু করছে, হায় আল্লাহ!
অন্যসময় রিশতা মর্জিনাকে থামিয়ে দিতো ভেতরের খবর বাইরে বলার কারণে। কিন্তু আজ তার কানে কোনো কথা প্রবেশ করছে না। তার মনে এখন ভিন্ন জগৎ। সেই জগতে সে খুব একা। তার কেউ নেই, শূন্যতায় হাত বাড়িয়ে বারবার ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে তাকে। বলা হচ্ছে, ‘কেউ তো নেই! বিরক্ত করছো কেন?’
_____
মিলনের সামনে বসে আছে আরশ। তার পাশে বসে আছেন কার্তিক। তিনজন আজিমপুর কবরস্থানের বিষয়টা নিয়ে বিশেষ আলোচনা সভা বসিয়েছে। কার্তিক একটু কেশে বললেন, ‘ইমামের সাথে কথা বলেছি। মেয়েটা প্রতি শুক্রবার আসে শুনে তার মনে হয়েছে সে সাধারণ। স্বামীর কবরের কাছে আসে, কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে চলে যায়।’
মিলন এটাকে আগের বারের মতোই তেমন গুরুত্ব দিলেন না, ‘আমি চিন্তিত ইনজেকশনে পাওয়া অজানা মানুষের ফিঙ্গারপ্রিন্ট নিয়ে। আফজাল, তার ড্রাইভার আর সেক্রেটারির ডিএনএ ম্যাচ হয় কিনা এটা জানতে পারলে ভালো হতো। এক কাজ করুন, উনাদেরকে ভিন্ন ভিন্ন দিন এখানে ডেকে আনুন। কথার ছলে পানি খেতে দিবেন আর গ্লাসে লেগে থাকা ফিঙ্গারপ্রিন্ট মিলিয়ে নিবেন। তিনজনের একজনও না হলে বিষয়টা নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে।’
আরশ বললো, ‘এই তিনজনকেই কেন সন্দেহ হলো স্যার?’
– আফজাল একজন ড্রাগ এডিক্টেড মানুষ। আর তার সেক্রেটারিও। শুধু ড্রাইভারের খোঁজ নেয়া হয়নি। আজই খোঁজ নিয়ে নিব।
– লাবিব কিংবা তার গুপ্তচরও তো হতে পারে?
– হতে পারে। কিন্তু আমাদেরকে এগিয়ে যেতে হবে ধাপে ধাপে। এখনই দুইদিকে দেখতে গেলে বিষয়টা আরো গোজামিল পেকে যাবে। তবে সব দিক চোখ কান খোলা রাখবে। পুলিশের একটা টিম কাল আফজালের বাড়িতে যাবে। তারা সেখানে গিয়ে কাজের ছেলের বিষয়ে তদন্ত করবে কোনো ড্রাগের দেখা মিলে কিনা খুঁজে দেখবে। দুআ করো যেন সবটা সহজে হয়ে যায়।
বেশ কিছু আলোচনার পর আরশের একটা পরিকল্পনা কার্তিক ও মিলনের খুব পছন্দ হলো। তার পরিকল্পনা অনুযায়ী, লাবিবের বাড়িতে যেদিন সাংবাদিকদের ভিড় জমবে, সেদিন ক্যামেরাম্যান কিংবা সাংবাদিকের ছদ্মবেশে সিআইডি ডিপার্টমেন্ট এর কেউ যাবে। পুরো বাড়ি সার্চ করবে কৌশলে। দরকার হলে বাড়ির সামনে গোপন সিসিটিভি ক্যামেরা লাগিয়ে দিবে। সেই হিসেবে তারা আরশকে এই দায়িত্ব দিলো। আরশের সাথে একজন সিআইডি থাকবেন, জাহাঙ্গীর।
কথাবার্তা শেষে আরশ রাশেদকে ফোন দিয়ে জানতে পারলো, লাবিবের বাড়িতে আগামী পরশু দিন সাংবাদিক সম্মেলন বসবে। যা পরিকল্পনা সব আজ কালের মাঝে সেরে রাখতে হবে। বাড়িতে পৌঁছে আরশ বেশ সময় নিয়ে গোসল করলো। যুহরের সালাত অফিসে আদায় করেছে সে। এখন আসরের সময়। সালাত আদায় করে ক্ষুধা অনুভব করলো সে। ডাইনিং টেবিলে তেমন কোনো খাবার না দেখে শুধু পানি খেলো। সেসময় লুকমান বেরিয়ে এলেন।
– ক্ষুধা পেয়েছে?
আরশ পানি খাওয়া শেষে লুকমানকে সালাম দিয়ে বললো, ‘জি আব্বু। আম্মুকে বাসায় দেখছি না যে?’
– শুধু তোর আম্মু না, কেউই নেই। আনিকা, জামিল আর তোর মা গেছে সিদ্ধেশ্বরী। আনিকাদের বাড়িওয়ালা মারা গিয়েছে।
– ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রজিউন। কীভাবে?
– আগে থেকেই অসুস্থ ছিল। আজ স্ট্রোক করেছেন। আমান অফিসে। আর বৌমার বড় ভাই বিদেশ থেকে আসায় ছেলেমেয়ে সাথে নিয়ে দেখা করতে মায়ের বাড়ি গিয়েছে।
– তুমি খেয়েছো আব্বু?
– হুম, তুই দুপুরে খাসনি?
– খেয়েছি। এখন অল্প খাবার হলেই হতো। সমস্যা নেই, আম্মু আসলে খাবার দিবে।
লুকমান ফ্রিজ থেকে পুডিং বের করে আরশের সামনে রাখলেন। চেয়ারে বসে বললেন, ‘বৌমা বানিয়েছে।’
আরশ খেতে শুরু করলো। লুকমান বললেন, ‘তুই নাকি এই বিয়েতেও না করে দিয়েছিস?’
আরশের নির্বিকার মুখভঙ্গি। সে বললো, ‘জি আব্বু।’
– এবারের কারণটা জানতে পারি? দুদিন পর এসে এমন সিদ্ধান্ত দেয়া কি উচিত হয়েছে তোর?
– আব্বু, শিমুল মেয়েটাকে আমার এর আগে দেখা সব মেয়ের তুলনায় অনেকটা পারফেক্ট মনে হয়েছিল। কিন্তু, ইস্তিখারা করে মনে শান্তি পাইনি।
– কি স্বপ্ন দেখেছো?
– স্বপ্ন না, সরাসরি প্রমাণ পেয়েছি।
– মানে?
আরশ চামচ বাটিতে রেখে খাওয়া ছেড়ে বাবার দিকে তাকালো, ‘গতকাল রাতে মেয়েটা আমাকে ম্যাসেজ করেছিল। বলেছিল, আমি কিছু জানাচ্ছি না কেন।’
– এটা সে জানতে চাইতেই পারে। এখানে খারাপ কিছু দেখছি না আমি।
– জি আব্বু। আমি তাকে বলেছিলাম আমি এখনো সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি। সে কি বলেছে জানো?
– কি?
– বলেছে সিদ্ধান্ত যা-ই নিই না কেন, উত্তর যেন হ্যাঁ হয়।
এবার লুকমান দমে গেলেন। একটা মেয়ে হঠাৎ এমন কথা বললে তাকে নিয়ে সংশয় হওয়া স্বাভাবিক। আরশ বললো, ‘তবে সে এই ম্যাসেজ পাঠানোর সাথে সাথে আনসেন্ড করেছে। মানছি তাকে সেসময় শয়তানের প্ররোচনা ঘায়েল করেছিল। এজন্য সে ম্যাসেজ পাঠিয়ে তাড়াতাড়ি ডিলিট করে দিয়েছে। আমি সেটা দেখে ফেলেছি কারণ ম্যাসেজ নোটিফিকেশন আনসেন্ড হয় না।’
লুকমান অবুঝের মতো মুখভঙ্গি করে বললেন, ‘এতকিছু আমি বুঝি না।’
হেসে ফেললো আরশ, ‘এটুকু বুঝলেই হবে যে মেয়েটা ম্যাসেজটা আনমনে দিয়ে ফেলেছিল।’
– তাহলে সমস্যা কি?
– কিন্তু মেয়েটা আবেগী যেটা তার সাথে কথা বলার সময় বুঝতে পারিনি আমি।
লুকমান উঠে দাঁড়ালেন। বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘তুই এই জীবনে আর বিয়ে করবি না। তোর মতলব বুঝে গিয়েছি আমি। এজন্য একটা না একটা অজুহাত দেখিয়েই যাচ্ছিস। আল্লাহ তোকে সুবুদ্ধি দিক। এছাড়া আর কিছুই বলার নেই আমার। আমি কি বলবো? আমি কিছু বলার অধিকার রাখি নাকি?’
বলতে বলতে তিনি ঘরে চলে গেলেন। তার এমন রাগ দেখানো আরশের ভালোই লাগে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মায়েরা এমন অভিমানী হয়ে থাকে। তার বেলায় উল্টো হয়েছে। লুকমান বেশ অভিমানী মানুষ। আরশ মুচকি হেসে ঘরে ঢুকতেই তার মনে পড়লো, বাড়িওয়ালা মানে রিশতার শশুর। চিন্তা হলো তার, রুদ্রর পরিবারটা এমন ভঙ্গুর হয়ে যাচ্ছে কেন? মনে মনে তাদের ধৈর্য কামনা করে কাজে বসে পড়লো আরশ। অনেক কাজ বাকি তার।
______
হিশামের ফাঁকা ঘরে এখন শুধু রিশতা বসে আছে। মর্জিনা বাসায় থাকা মানুষদের জন্য রুটি বানাচ্ছেন আর গরুর মাংস রাঁধছেন। এই আদেশ এসেছে আজমেরীর পক্ষ থেকে। তার বান্ধবী ও বোনেরা আজ এ বাসায় থাকবে। হিশামের পরিবারের লোকজন বলতে শুধু বোন চামেলি ঢাকায় থাকেন। বাকি ভাই বোন এ দেশে নেই। সবাই পৃথিবীর আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন এবং যোগাযোগ হয় খুবই কম। চামেলির নিজের সংসার আছে, এই বলে তিনি চলে গিয়েছেন।
আনিকা আজমেরীর সাথে দেখা করে মায়ের হাত ধরে রিশতার কাছে এলো। রিশতাকে ঠিক আগের অবস্থানে একইভাবে বসে থাকতে দেখে তার হৃদয় কেঁপে উঠলো। নাজিফা রিশতার পাশে বসে আদুরে কণ্ঠে বললেন, ‘মামণি, এভাবে বসে থাকলে সময় কি বসে থাকবে তোমার জন্য? এখনো তোমার শাশুড়ি বেঁচে আছে। তার সাথে নতুন করে জীবন গড়তে হবে। আল্লাহকে ভরসা করো মা।’
রিশতার মাথায় হাত রাখতেই রিশতা ছোট শিশুর মতো নাজিফার ঘাড়ে মাথা গুঁজে দিলো। নাজিফা তার কোমল পরশে রিশতাকে সান্তনা দিচ্ছেন। আনিকা মনে মনে ভাবছে, মেয়েটার শাশুড়িও আর কয়দিন পর চলে যাবে। কোথায় কার সাথে থাকবে এই মেয়ে?
জীবন সংসারের বাস্তবতা উপেক্ষা করা যায় না, তাই আনিকা আর নাজিফাকে এই স্থান থেকে যেতেই হলো। নির্জন ঘরে রিশতা মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে শুয়ে আছে। মর্জিনা এসে তার হাতে মোবাইল ধরিয়ে বললেন, ‘মেঘ বাবা কথা বলতে চাইছে আম্মা। তোমার কথা বলতে হবে না, তুমি শুধু শুনে যাও।’
রিশতার কানে মোবাইল ধরিয়ে চলে গেলেন মর্জিনা। তার রান্নাঘরে অনেক কাজ পড়ে আছে। মেঘ শুরুতে অপেক্ষা করলো রিশতার কন্ঠ শোনার জন্য। কিন্তু রিশতার কণ্ঠস্বর শুনতে না পেয়ে সে বললো, ‘রিশতা?’
– হু।
– আমি জানি আমার বাবার মৃত্যুতে তুমি আমার চেয়েও বেশি কষ্ট পেয়েছো। আর আমি এটাও জানি, তুমি ভবিষ্যৎ নিয়ে বিচ্ছিন্ন চিন্তায় স্তব্ধ হয়ে আছো। মর্জিনা খালা আমাকে সব বলেছে।
রিশতা কিছু বললো না। মেঘ আবার বললো, ‘রিশতা, ওই মহিলা অনেক আগে থেকেই এমন। জুয়েল নামের কুলাঙ্গারের সাথে বহু আগে তার একটা সম্পর্ক ছিল। সেসময় আমি স্কুলে যাতায়াত শুরু করেছি, রুদ্রর বয়স প্রায় দুই বছর। সেই ঘটনার কারণে বাবা আর ওই মহিলার মাঝে বাজে সম্পর্কের শুরু হয়। আমি রুদ্রকে নিয়ে এক রুমে চুপ করে বসে থাকতাম, যখন দুজনের তুমুল ঝগড়া চলতো। মাঝে মাঝে মনে হতো, যদি রুদ্রকে নিয়ে বাসা ছেড়ে কোথাও চলে যেতে পারতাম! একদিন উনাকে অনুরোধ করেছিলাম আমার স্কুলের প্যারেন্টস মিটিং এ যেন উনি উপস্থিত থাকেন। মহিলা সেদিনও গেল না। তারপর থেকে অনুরোধ করা ছেড়ে দিয়েছিলাম। বুঝতে পারছো রিশতা? একটা ছয় বছরের বাচ্চা ছেলে তার জন্মদাত্রীর কাছে অনুরোধ করা ছেড়ে দিয়েছিল!’
রিশতা কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। মেঘ বলে যাচ্ছে, ‘এরপর একদিন উনি কান্নাকাটি করলেন, ক্ষমা চাইলেন। বাবা ক্ষমা করে দিলেন। মহিলা চাকরি ছেড়ে দিয়ে উদ্যোক্তা হলেন, জামা কাপড়ের দোকান দিলেন। গুলশানের মহিলাদের মতো তিনিও একটা চ্যারিটি ফান্ড খুললেন। গরিব মানুষকে দান করার নাম করে সেখানে বান্ধবীদের নিয়েই পরে থাকলেন। আমরা দুই ভাই মর্জিনা খালার কাছে যত আবদার করেছি, তার এক বিন্দুও এই মহিলার কাছে করেছি কিনা সন্দেহ।’
এবার রিশতা বলে উঠলো, ‘এতদিন বলেননি কেন?’
– বললে কোনো লাভ হতো রিশতা? এখন বলছি কারণ, জুয়েলের ব্যাপারটা নতুন নয়। আমি ধারণা করছি, রুদ্রর মৃত্যুর পরপরই এই সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। বাবার অসুস্থতার পরই হওয়ার কথা ছিল, রুদ্রর জন্য হয়তো আগাতে পারতো না মহিলা। রুদ্র চলে গেল, তার রাস্তাও পরিষ্কার হয়ে গেল।
রিশতা চুপ করে সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে আছে। কথা শুনতে ভালো লাগছে না। মেঘ বলছে, ‘আমি এসবের জন্য আগেই ঠিক করে রেখেছিলাম এই দেশে থাকবো না। রুদ্রকে খুব স্নেহ করতাম। কিন্তু ছেলেটা ওই মহিলার চামচা ছিল। মহিলা তাকে সিগারেট, ড্রাগস খেতে মানা করতো না। যা ইচ্ছে তাই করতে বলতো। বাধ্য হয়ে ওকে ঐ নোংরা জায়গায় রেখে আসতে হলো। আর এর বলির পাঠা হয়ে গেলে তুমি। তুমি এতিম জেনে খুব কষ্ট পেয়েছিলাম তোমার জীবনটা নরক হবে ভেবে। পরে জানলাম, তুমিও মুক্তমনা ধরণের।’
– রুদ্র আমাকে ভালোবাসতো।
– হ্যাঁ, এজন্যই সে অন্য নারীতে আসক্ত ছিল।
রিশতা চমকে উঠেনি, তার স্নায়ু এখন শিথিল। সে নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললো, ‘আপনি জানলেন কি করে?’
– আমার স্পাই আছে, মর্জিনা খালা।
– কাজটা ঠিক হয়নি।
– জানি, খালার এই স্বভাবটা ভালো না। কিন্তু খালাকে আমি অনেক সম্মান করি। আর আমি জানি, তুমি সবচেয়ে ভালো থাকবে এই একজনের কাছেই। রিশতা, নিজের জন্য বাঁচো। এই পৃথিবীতে কেউ কারো না। নতুন জীবন শুরু করো। I think you will lead a better life if you marry someone.
– একটু আগেই বললেন পৃথিবীতে কেউ কারো নয়।
– এই পুরো জগৎটা আপেক্ষিক। কারো বাবা মা পাওয়ার ভাগ্যটা খারাপ, কারো জন্য তাদের চেয়ে আপন আর কেউ নাই। কারো জীবনসঙ্গী তার জীবনটা সঙ্গীহীন করে তোলে, কারো সেই জীবনসঙ্গী হয়ে যায় হৃদয়সঙ্গী। এই যেমন আমাকে দেখো, আমার বাবা-মাকে আমি আপন করে না পেলেও আমার স্ত্রী অত্যন্ত যত্নশীল। আমরা দুজনেই দুজনার সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপ করি। এতে আমরা দুঃখী নই, অনেক সুখী।
রিশতা কিছুই বললো না। মেঘ এবার কথা শেষ করলো, ‘যেটা বলতে চেয়েছিলাম তা হলো, বাবার মৃত্যুর কারণে সকল সম্পত্তি নিয়ে একটা ঝামেলা শুরু হতে চলেছে। আমি বাংলাদেশে আসবো সামনে মাসে। তুমি রুদ্রর অংশ থেকে যা পাবে তা একদম ছাড়বে না। এটা তোমাকে জানিয়ে রাখলাম। তুমি আরেকটু স্ট্যাবল হলে আবার কথা হবে। এখন রেস্ট নাও, খাওয়া দাওয়া করো। নিজের খেয়াল রেখো।’
মেঘ ফোন কেটে দিয়েছে। রিশতার কানে এখনো ফোন ধরে রাখা। সে চোখ বন্ধ করে সময় গুনছে। ইশার আজান শুনে সে উঠে বসলো। সালাতের জন্য ওযু করে মুসাল্লা বেছানোর সময় মৃদু কণ্ঠে বললো, ‘আমার জন্য যা নির্ধারণ করেছো, তা মেনে নেয়ার তৌফিক দান করো আল্লাহ। ধৈর্য দাও আমাকে, ধৈর্য দাও।’
__________
(চলবে ইন শা আল্লাহ)