‘সত্য পিঞ্জর’
পর্ব ৮.
তাবিনা মাহনূর
__________
আনিকার পাশে রিশতা বসে আছে। মনোযোগ দিয়ে আনিকার কথাগুলো শুনছে সে। আনিকা সাধারণ আলাপ শেষ করে মূল কথায় গিয়ে বললো, ‘এই হলো পর্দার বিষয়। এখন বুঝেছো মুখ না ঢাকা আসলে পর্দার খেলাপ?’
রিশতা মুচকি হেসে বললো, ‘জি আপু। আমি ইন শা আল্লাহ, পরিপূর্ণ পর্দা শুরু করবো।’
আনিকা হেসে বললো, ‘আলহামদুলিল্লাহ। মেয়েদের সম্ভ্রম রক্ষা করা অনেক কঠিন কাজ বোন। তোমার সকল সৌন্দর্য ঢাকা থাকলেও তোমার সুন্দর মুখশ্রী দেখলে মানুষের মনে এমনিতেই কুচিন্তা জাগবে। বুঝেছো রিশতা?’
– জি আপু।
– এবার আসি আসল কথায়।
এতক্ষণেও আসল কথা বলেনি ভেবে অবাক হলো রিশতা। সে ভেবেছিল তাকে পর্দা ও চরিত্র হেফাজত নিয়ে বলবে বলে আনিকা ডেকেছে। কিন্তু পরের বাক্যটা শুনে চমকে উঠলো সে।
– তুমি কি বিয়ে নিয়ে কিছু ভেবেছো রিশতা?
রিশতা এ বিষয়ে তেমন গুরুত্ব দিয়ে ভাবেনি, তবে ইদানিং তার নিজেকে নিরাপদ মনে হয় না। আল্লাহর প্রতি তার ভরসা আছে, কিন্তু একজন নারী হিসেবে নিজের অসহায়ত্ব সে বুঝতে পারে। সে তো চাইলেই সুগার ড্যাডি খুঁজে নিজেকে গোল্ড ডিগার বানাতে পারে না। কারণ সে একজন মুসলিম নারী। সে জানে নিজের সম্মান রক্ষা করতে, সে জানে নিজেকে সম্মানিত করতে। তাই বিয়ের কথা শুনেও তার মনে কোনো ক্রোধ জন্ম নেয়নি। নির্লিপ্ত কণ্ঠে সে বললো, ‘না আপু। কেন?’
– আমি মনে করি তোমার বিয়ে করা প্রয়োজন। যেহেতু আজমেরী আন্টিও এ বাসায় বেশিদিন থাকবেন না।
অবাক হলো রিশতা, ‘আপনি জানলেন কীভাবে?’
আনিকা বললো, ‘মর্জিনা খালা বলেছে। তোমার সামনেই বলেছিল, কিন্তু তুমি খেয়াল করোনি।’
বিরক্ত হলো রিশতা, ‘খালা যে কি করেন!’
– থাক রাগ করো না। আমারও শোনা উচিত হয়নি। উনি যখন বললেন হিশাম আংকেল সব শুনে ফেলেছিলেন বলে স্ট্রোক করেছেন, তখন আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম আসল কাহিনী কি। উনার দোষ সম্পূর্ণ দেয়া যায় না।
– জি আপু। আমরা বুঝতেই পারিনি বাবা কখন জেগে গিয়েছিলেন।
আনিকা বললো, ‘মৃত্যু কোনোভাবেই থামানো যায় না রিশতা। নিজেকে দোষারোপ করো না। এবার শোনো, তোমাকে একটা প্রস্তাব দিতে চাই আমি। বলি?’
– বলুন।
– আমি আমার ভাইয়ের জন্য তোমাকে পছন্দ করেছি।
রিশতা হেসে ফেললো যেন এটা রম্য কথা। হাসতে হাসতে বললো, ‘আরশ ভাই অবিবাহিত মানুষ। আর আমি নিশ্চিত উনি এই বিয়েতে রাজি হবেন না।’
– তুমি আরশকে চেনো?
– রুদ্রর বন্ধু বলবো না, তবে পরিচিত মানুষ ছিলেন তিনি। আর আমি যে রুদ্রর কাছের কেউ ছিলাম এটা ভার্সিটির সবাই জানতো।
– সেও তোমাকে চেনে রিশতা। জেনেশুনেই বলছি আমি, তুমি যদি মনে করো এখন তোমার বিয়ে করা উচিত তাহলে আমার ভাইকে আজ আসতে বলবো। তোমরা কথা বলে সিদ্ধান্ত নিবে।
কিছুক্ষণ চুপ করে মনের সমীকরণ মেলানোর চেষ্টা করলো রিশতা। মন কি চায় তা জানা খুব জরুরি। হুট করে কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে সে আবারো কালো আঁধারে হারিয়ে যেতে চায় না। তার মেঘের বলা কথাগুলো মনে পড়ছে। কারো জীবনসঙ্গী হতে পারে হৃদয়সঙ্গী। সে মুচকি হেসে বললো, ‘আসতে বলুন।’
_____
আরশ হাতের কাজ সেরে আনিকার বাসায় চলে এলো। আজ অফিসে যায়নি সে। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, সিআইডি ডিপার্টমেন্টের লোকজন এই কেস নিয়ে খুব হেলাফেলা করে চলছে। আরশের ধারণা, এরা জানে আসল অপরাধী কে। শুধু নির্বাচনের আরো কাছাকাছি গিয়ে সেটা প্রকাশ করতে চাইছে তারা। যেন অপরাধীকে ফাঁদে ফেলা যায়।
আরশ তার শত সহস্র চিন্তার একটা সমাধান করতে এসেছে। তাই ঘাবড়ে না গিয়ে স্বস্তির শ্বাস নিলো সে। আজ অন্তত একটা ঝামেলা মিটে যাবে। কলিং বেল চাপলে আনিকা দরজা খুলে দিলো।
– হাত মুখ ধুয়ে কিছু খেয়ে নে। রিশতা আমার ঘরে আছে।
আরশ পরিষ্কার হওয়ার পর কিছু খেলো না। সরাসরি রিশতার সাথে দেখা করতে চাইলো। আনিকা প্রথমে ঘরে ঢুকে রিশতাকে আরশের আসার কথা জানালো। তারপর আরশ গেল ভেতরে। আনিকা বারান্দার দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থাকলো।
রিশতা যেমন এসেছিল তেমনই আছে। সাদা রঙের কামিজ আর সাদা রঙের পায়জামা। ওড়নায় নানান রঙের কারুকাজ। এমন পোশাকে তাকে মলিন নয়, বরং আরো মোহনীয় দেখাচ্ছে। আরশ একবারও তাকায়নি। এমনকি চেয়ারে বসেও তাকায়নি সে। রিশতা সালাম দিলে উত্তর দিলো সে। রিশতাই প্রথম প্রশ্ন করলো, ‘আপনি কি আমাকে চিনেছেন?’
আরশ তবু তাকালো না। এমন কাজের কারণে সে নিজেই অবাক হচ্ছে, সেই সাথে নিজের উপর বিরক্ত বোধ করছে। সে উত্তর দিলো, ‘জি। আপনি রিশতা।’
– রুদ্রর খবর জানেন?
– জি। আল্লাহ ওকে ক্ষমা করুন।
– আমিন।
এরপর আর কোনো কথা নেই। আরশ বললো, ‘আর আপনি আমার সম্পর্কে জানেন?’
– জি। আপনি দ্বীনের আলোকে ন্যায় প্রতিষ্ঠায় নিজেকে সপে দিয়েছেন।
অনন্য উত্তর পেয়ে আরশ উপরে তাকালো। সেই সবুজ চোখ। এবারও প্রথমবারের মতো অপলক তাকিয়ে থাকলো সে। রিশতা সংকুচিত হয়ে মুখ নামালে সেও দৃষ্টি ফেরালো।
– তারমানে আপনি জানেন আমি কতটা ঝুঁকির মধ্যে থাকতে পারি।
– জি।
– আমার জীবন অনিশ্চিত।
– প্রতিটা মানুষের জীবন অনিশ্চিত। মৃত্যু কি সম্ভাষণ বাণী নিয়ে মানুষের কাছে আসে?
অসাধারণ উত্তরগুলো আরশকে মুগ্ধ করছে বারবার। আড়চোখে একবার রিশতাকে দেখে দৃষ্টি ফিরিয়ে সে বললো, ‘আমি চাই আমার স্ত্রী আমাকে সাহায্য করবে, আমার কাজকে ভয় না পেয়ে জয় ভেবে নিবে।’
– আল্লাহ তা কবুল করুন।
অদ্ভুত বিষয়, মেয়েটা একবারও নিজেকে প্রমাণ করার কোনো চেষ্টা করছে না। এ পর্যন্ত যত নারীকে সে দেখেছে, সবাই তার কাছে নিজেকে নিখুঁত প্রমাণ করতে অনেক রকম চেষ্টা করেছে এবং এটাই স্বাভাবিক। এখানে সে বলতে পারতো, আমি তেমন হওয়ার চেষ্টা করবো। তা না বলে উল্টো দুআ করে দিলো। মেয়েটা কি বিয়েতে রাজি নয়?
মনের প্রশ্নটা আরশ প্রকাশ করলো, ‘আপনি কি বিয়ে করতে আগ্রহী নন?’
– আগ্রহী না হলে এখানে বসে থাকতাম না।
– আমি আমার স্ত্রীকে নিয়ে যা আশংকা করি তা হলো, বিয়ের পর হয়তো সে আমাকে চাকরি করতে বাধা দিবে। প্রাণ নাশের আতংকে সে ভেঙে পড়তে পারে। আমিও হয়তো সেসময় আবেগে তার জন্য পিছিয়ে যেতে পারি। আমি তাই দৃঢ় মনের কাউকে চাই।
রিশতা নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে বললো, ‘আমি দুআ করি আপনি এমন কাউকে যেন সঙ্গী করে পান। তবে, আপনি যেহেতু আমাকে দেখতে এসেছেন সেই হিসেবে আপনাকে আমার অবস্থান জানানো জরুরি। আরশ ভাই, আমার বাবা মারা গিয়েছিলেন ছিনতাইকারীর ছুরির আঘাতে। এটার শোক আমার মা নিতে পারেননি। তিনি বাবার আকস্মিক মৃত্যুর খবরে হার্ট অ্যাটাক করেন। তারপর বড় চাচার কাছে থাকতে শুরু করি।’
একটু থেমে আবার বললো রিশতা, ‘আমার দাদি ছিলেন পা-কিস্তা-নি। দেশ ভাগের পর তিনি দাদার সাথে এখানেই থেকে গেলেন। তার গর্ভে তিন পুত্র আর তিন কন্যার জন্ম হলো। সবচেয়ে ছোট সন্তান হলেন আমার বাবা। দাদির চুল ছিল লালচে, চোখ সবুজাভ। দাদির কোনো সন্তান তার রূপ পায়নি। কিন্তু আমার বাবা ছিলেন দাদির মতো দেখতে। কালো চুলের মাঝে লাল আভা, সবুজ চোখ। তার এমন রূপের কারণে দাদি প্রায়ই বলতেন, বাবা হলেন পা-কিস্তা-নের সন্তান। এজন্য বাবাকে তিনি বেশি ভালোবাসতেন। এমন না যে বাকি সন্তানদের অযত্নে রাখতেন। মূলত দেশের প্রতি যেই টান সেটা বাবার প্রতি চলে আসায় বাবা বেশি ভালোবাসা পেলেন। আর তাই, বাবাকে তার ভাই বোনেরা তেমন স্নেহ করতো না।’
আরশ মন দিয়ে শুনছে। কথার পৃষ্ঠে বিস্তারিত এই আলাপ শান্ত শিষ্ট রিশতার বৈশিষ্ট্যের সাথে যায় না। নিশ্চয়ই এর মাধ্যমে সে নিজের সম্পর্কে ধারণা দিতে চাইছে। তাই আরশের সম্পূর্ণ মনোযোগ রিশতার সুমধুর কণ্ঠে।
– বাবা-মার মৃত্যুর পর আমাকে এতিম খানায় রাখতে চাইলে দাদি বেশ নারাজ হলেন। দাদা ততদিনে বেঁচে নেই। দাদি চাইলেন আমি যেন তার কাছে থাকি। বড় চাচার বাসায় দাদি থাকতেন বলে আমিও ঠাঁই পেলাম। কলেজে পড়াকালীন অবস্থায় দাদি মারা গেলেন। খুব কষ্টে দিন কাটতে থাকলো আমার। বাকি চাচা-ফুপুরা সবাই যে যার সংসারে ব্যস্ত। কোনোরকম কলেজ পার করে ভার্সিটিতে ভর্তি হলাম। সেখানে রুদ্রর দেখা পেলাম। এরপর রুদ্রর সাথে বিয়ে, রুদ্রর মৃত্যু, তারপর তো দেখলেনই কি হচ্ছে আমার সাথে।
রিশতা একটু বিশ্রাম নিলো। আরশ চুপ করে আছে। সে জানে রিশতার কথা শেষ হয়নি।
– এইযে এত বড় বড় ধাক্কা আমাকে সহ্য করতে হয়েছে, এর জন্য আমি বিন্দুমাত্র অভিমান করি না। আমি এর মাধ্যমেই আল্লাহর সান্নিধ্যে যাওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছি। তাই এসব আমার কাছে এখন অমূল্য রতন। আমি এখন একটা যন্ত্রে পরিণত হয়েছি। যার মূল লক্ষ্য ইবাদতে। নারীরা চারটা কাজ ঠিকমতো করলে জান্নাত পাবে। ফরজ সালাত আদায় করা, রমাদানের সিয়াম রাখা, নিজের লজ্জাশীলতা হেফাজত করা আর স্বামীর আনুগত্য করা। আমার প্রথম দুটো করার সামর্থ আছে আলহামদুলিল্লাহ। আর আজ আনিকা আপু তৃতীয়টার ব্যাপারে বুঝিয়ে বলেছেন। শুধু চতুর্থ বিষয়টা থাকলে আমার কোনো কিছুই অপূর্ণ থাকবে না।
অনুপম উত্তরের পৃষ্ঠে আরশের বলার কিছুই থাকলো না। শুধু একবার মনে হলো, আরো আগে কেন তাকে পেলো না সে! পেয়েছিল, কিন্তু তার দুআয় ছিল তাকে ভুলে যাওয়ার কথা। একবারও সে চায়নি রিশতাকে। অথচ আল্লাহ এই রিশতাকেই এনে দিলেন তার কাছে। আল্লাহ সর্বোত্তম পরিকল্পনাকারী। তিনি জানেন রিশতার পরিবর্তন কবে হবে, আরশের কল্পকন্যা কখন প্রয়োজন।
আরশ বললো, ‘আমি আপনাকে কাল জানাতে চাই আমার সিদ্ধান্ত। আর আপনি চাইলে আমাকে প্রশ্ন করতে পারেন।’
– আপনি কখনো প্রতারণা করবেন না তো?
কথাটা শুনে রিশতার চোখে চোখ রাখলো আরশ। রিশতা বললো, ‘আমি কিছুই ভয় পাই না। শুধু প্রতারণা ভয় পাই। এবার যদি ধোঁকার শিকার হই, তাহলে এক আল্লাহ ছাড়া এই পৃথিবীর কাউকে বিশ্বাস করবো না আমি। লোকালয় ছেড়ে চলে যাবো অনেক দূরে।’
ভারী কণ্ঠে বললো আরশ, ‘বিশ্বাস রাখুন। ইন শা আল্লাহ, কখনো ধোঁকা দেব না। আপনার আস্থার জায়গা হবো আমি।’
রিশতা মুখ নামিয়ে নিলো। অর্থাৎ তার আর কোনো প্রশ্ন নেই। আরশ উঠে দাঁড়িয়ে চলে গেল। তার আশি ভাগ সম্মতি আছে এই বিয়েতে। শুধু আল্লাহর সাথে পরামর্শ করা বাকি।
_____
তিন দিনের মাঝে বিয়ে হয়ে গেল রিশতা আর আরশের। আরশ পরেরদিনই রিশতাকে জানিয়েছে সে এই বিয়েতে শত ভাগ মত রাখছে। রিশতার কোনো সুখ অনুভূতি হয়নি। তবে বারবার মনে হয়েছে, তার আরেকটা আশ্রয় তৈরি করে দিলেন আল্লাহ।
নাজিফা ঝামেলা করেননি। ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে সব মেনে নিয়েছেন। আর রিশতার জন্য তার অন্যরকম এক মায়া কাজ করে। তাই বিয়েতে মৌন সম্মতি জানিয়েছেন।
সবাই রিশতার বাসায় এসে কাজী দিয়ে কবুল পড়িয়ে রিশতাকে আরশের নামের সাথে জুড়ে দিয়েছে। আজমেরী প্রথমে প্রচন্ড রেগে গিয়েছিলেন তাকে না জানিয়ে এমন বড় সিদ্ধান্ত নেয়ার কারণে। ঝগড়া করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু রিশতা কোনো কথা বলেনি। সে শুধু মর্জিনার চিন্তা করছিল। মর্জিনার যাওয়ার জায়গা কোথায়?
তবে বিয়ের দিন আজমেরী খুব খুশি ছিলেন। আনিকার পরিবারের সবাই বেশ অবাক হয়েছিল, বউয়ের প্রাক্তন শাশুড়ি নিজের বৌমাকে বিয়ে দিচ্ছে হাসিমুখে! এর কারণ তারা জানে না। রিশতার বড় চাচা আর চাচী এসেছিল। বিয়ের আগে রিশতাকে চাচী বলেছিলেন, ‘বাহ! বাড়িওয়ালা দেখেই পছন্দ করো তুমি। প্রথম স্বামীও বাড়ির মালিকের ছেলে, এটাও তাই!’
রিশতার কিছুই মনে হয়নি। বিয়ে নিয়েও তার আগ্রহ ছিল না। সব সময় শুধু মর্জিনার কথা ভেবেছে সে। বিদায়ের সময় আজমেরী হঠাৎ উচ্চস্বরে কেঁদে ফেলেন। এই কান্না মিথ্যে ছিল না। এটা রিশতা বুঝতে পেরেছিল কারণ আজমেরী একটা ছবি বুকে ধরে রেখেছিলেন। ছবিটা রুদ্র আর রিশতার বিয়ের ছবি। তবু রিশতার মন গলেনি। সে এতটুকু কান্না করেনি। মর্জিনা খালা জোরে কাঁদতে না পারলেও ঘরের কোণে গিয়ে বসে ছিলেন। নিঃশব্দে কেঁদেছেন। শেষ সময়ে রিশতাকে একবারও দেখেননি। তিনি জানেন, দেখলেই তিনি নিজেকে সামলাতে পারবেন না।
_____
মলিন সময়ে রাত্রির শুরু। নিশ্চুপ ঘরে দুজন শান্ত মানুষ। সকল সুন্নত মানার পর দুজনেই নির্বাক বসে আছে। আরশ অবশ্য ফোনে রাজীবের সাথে কথা বলছে। তার বিয়ে হওয়া সত্ত্বেও সে কোনো ছুটি নিতে চাইছে না। রাজীব তবু ছুটির ব্যবস্থা করবে বলে জানিয়েছে। রাজীব হেসে বলেছে, ‘আরশ, মনে করো এই ছুটিটা আমার পক্ষ থেকে তোমার জন্য উপহার। যেহেতু কিছুই দিতে পারছি না, ছুটির ব্যবস্থা করে দিতে পারি।’
আরশ চায়নি ছুটি, একবার রিশতার দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভেবে সে একটু হেসে বলে, ‘যদি পারেন তাহলে দেখেন ভাই কি করা যায়। আর নাহলেও সমস্যা নেই। কাজ আগে শেষ করতে হবে।’
আরশ ফোন রেখে দেখলো, রিশতা ঘরের বড় জানালার সামনে দাঁড়িয়ে। নভেম্বর মাসের গরম কেটে গিয়ে শীতের আবির্ভাব জানান দিচ্ছে হিমশীতল বাতাস। রিশতা তার শাড়ির আঁচল ঘুরিয়ে কাঁধের উপর নিয়েছে। খোঁপা করা চুল খুলে ফেলে পিঠের শীত কমানোর চেষ্টা করছে। তাকে দেখে আরশের মনে হলো, এই দৃশ্যটা শুধু তারই। আর কারো নয়! তার হৃদয়ের চিত্রপটে আঁকা ছবিতে তার আপন কান্তা। যা শুধু সে-ই দেখছে, সে-ই অনুভব করছে।
রিশতা একবার পেছনে তাকিয়ে আরশকে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে আবার সামনে ফিরে গেল। আরশের মনোযোগ নষ্ট হলো। সে রিশতার পাশে দাঁড়িয়ে বললো, ‘ঘুম পেলে ঘুমিয়ে যান। আমার কাজ আছে।’
রিশতা দাঁড়িয়ে থাকলো। তার সবুজ চোখ জোড়া উজ্জ্বল, ছলছল অথৈ জলের মতো। সে মায়া মাখা কণ্ঠে বললো, ‘ইফতিখার, আপনাকে এই নামে ডাকা যাবে?’
আরশ জানালা আরো বেশি খুলে দিয়ে বললো, ‘যাবে। কিন্তু আরশ ছোট নাম, এটা ডাকতে সুবিধা বেশি।’
– আরশ অর্থ সিংহাসন। আপনি তো মানুষ। আর ইফতিখার অর্থ সম্মান। আপনি সম্মানিত মুসলিম।
আরশের ভালো লাগলো তার নাম নিয়ে রিশতার বিশ্লেষণ শুনে। সে একবার রিশতাকে দেখে বাইরে তাকিয়ে বললো, ‘নূরজাহান!’
রিশতা আরশের দিকে তাকালো। সে বুঝতে পেরেছে নামটা তাকেই দেয়া হয়েছে। আরশের ধারালো চিবুকের কাঠিন্য ইফতিখার নামটাকে ধারণ করেছে। রিশতা সেদিকে তাকিয়ে বললো, ‘আসলেই কি জাহানের নূর আমি?’
আরশ শুরুতে উত্তর দিলো না। কিছুক্ষণ পর সে বললো, ‘রিশতা জাহান সবার জন্য, নূরজাহান আমার জন্য।’
ঘরের এই কোণে দুজনের একান্ত আলাপে মুগ্ধতা ছেয়ে আছে। রিশতার সংকোচ বেড়েই চলছে আর আরশের জড়তা কাটছে। রিশতার আরক্ত মুখে আরশের চোখ জোড়ার দৃষ্টি বিচরণ করছে। তাতে রিশতা বেশ শঙ্কায় নিজেকে স্বাভাবিক করতে প্রশ্ন করলো, ‘কাজের অনেক চাপ?’
আরশ ভারী কণ্ঠে বললো, ‘হুম। খুব বেশি।’
– আপনি ক্রিমিনলোজি বিভাগের ছাত্র ছিলেন। তাই না?
– জি।
– আমি আইন বিভাগে পড়তাম। যদি আমাকে সমস্যাগুলো বলতেন তাহলে আমি সমাধান দিতে না পারলেও সাহায্য করতে পারবো।
আরশ বুঝতে পারলো মেয়েটা প্রসঙ্গ বদলে ফেলতে চাইছে। আরশ জানালার কাছ থেকে সরে গিয়ে ল্যাপটপ নিয়ে সোফায় বসলো। রিশতাকে ঘটনার আদ্যোপান্ত বর্ণনা করার পর রিশতা ভ্রু কুঁচকে বললো, ‘আপনারা বিরোধী দলকে কেন সন্দেহ করছেন না?’
_____
(চলবে ইন শা আল্লাহ)