সন্তান পর্ব- ১ -লাবিবা ইরম

0
1155

বিয়ের মাত্র একদিনের মাথায় শিউলির স্বামী রফিক রোড এক্সিডেন্টে মারা যায়। মূলত ওদের বৌভাত অনুষ্ঠানের জন্য কিছু প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করে বাইকে করে বন্ধুর সাথে ফিরছিলো। রফিকের সাথে সাথে ওর বন্ধু সোয়েবেরও মৃত্যু হয়। ভুল পথে চলে আসা এক ট্রাক কেড়ে নেয় দু’টো তরতাজা জীবন। যাদের একজন সদ্য শুরু করেছিলো জীবনের আরেক নতুন অধ্যায়। শিউলির ও বয়স বেশি ছিলো না। মাত্র ২০ বছর। আর রফিকের ২৪।
এই মর্মান্তিক ঘটনায় সবাইই বাকরুদ্ধ ছিলো। পেপারে পড়ে অথবা খবরে শুনেও কেঁদেছে প্রচুর লোকজন। শিউলি টানা তিনদিন কোন হুশে ছিলো না। থাকার কথা না। ৬ বছর বয়সে মা কে হারানো মেয়েটির জীবন বেশ সংগ্রামের ছিলো। বিয়ের সময় ভেবেছিলো হয়তো কিছু ভালো দিন আসবে। তবে ভালো দিনের শুরুর আগেই শেষের দেখা পাবে তা কেউ দু:স্বপ্নেও ভাবে নি।
তবে এ ঘটনায় অবিচল ছিলো রফিকের মা জাহানারা। কোন একটা অদ্ভুত কারনে তিনি এক ফোঁটাও চোখের পানি ফেলেন নি। সবাই অবাক হয়েছে এই ঘটনায়। উলটো তিনি সবাইকে সামলে নিয়েছেন। একদিন শুধু খাবার খান নি। তারপর থেকে নিজেই রান্না চড়িয়েছেন, সবাইকে খাইয়েছেন, শিউলিকে সামলেছেন। তাকে কেউ সান্ত্বনা দিতে আসলে চোখমুখ শক্ত করে বলেছেন, “আল্লাহ ওর হায়াৎ এই পর্যন্ত রেখেছেন, আমার কোন আফসোস নাই। আল্লাহ ওকে শহীদের কাতারে নিক।” মুটামুটি আশেপাশের পাড়ায় সবাইই অবাক হয়েছে জাহানারার এরকম লৌহকঠিন রুপ দেখে। উল্টাপাল্টা কথা ছড়াতেও দেরি হয়নি। তাছাড়া জাহানারা প্রাইমারী স্কুলের প্রিন্সিপাল ছিলেন, তাই আগেও তার সাথে এই পাড়াগেঁয়ে মানুষদের সাথে চিন্তাভাবনায় মেলেনি। তবে শিউলিও অবাক হয়ে কয়েকবার ভেবেছে আসলেই কি জাহানারা রফিকের আসল মা? একমাত্র ছেলের মৃত্যুতে এভাবে অবিচল কিভাবে আছেন তিনি?
জাহানারা আর আমিনের ঘরে একমাত্র সন্তান ছিলো রফিক। দাদা দাদী চাচা ফুপু সবার আদরের ছিলো। জাহানারার অনেকগুলো মৃত সন্তান হওয়ার পর একমাত্র সন্তান ছিলো রফিক। কাজেই নিজের আঁচল ছাড়া করতেন না তিনি কখনো তাকে। একটা মেয়ের ভীষণ ইচ্ছায় রফিকের পরও বাচ্চা নেয়ার চেষ্টা করেছেন তবে আর কেউই বাঁচে নি। ৮ম বারের মত মৃত সন্তান হলে তারা সিদ্ধান্ত নেন আর সন্তানের চেষ্টা করবেন না। তাছাড়া সবাই বললো, ছেলে তো আছেই, বিয়ে দিয়ে আরেক মেয়ে নিয়ে আসবা।
জাহানারাও সে কথা বুকে রেখে রফিককে নিয়ে দিন কাটালেন। রফিকের বিয়েও দিলেন আগে আগে। খুঁজে খুঁজে শিউলিকে আনলেন, যার মা নেই ছয় বছর বয়স থেকে। বাবা আর বড় বোনের কাছে মানুষ। সবাই যদিও তেমন রাজি ছিলো না, মা মরা মেয়ে, কে জানে কেমন স্বভাবের! মা না থাকলে কি আর সন্তানের ঠিকমতো লালন পালন হয়! তবে জাহানারা এসবে ভ্রুক্ষেপ করেননি। তার ধারনা ছিলো যে মা মরা মেয়ে বুঝবে মায়ের কদর। তাকে নিজের মেয়ের মত পালতে পারবেন।
রফিকের মৃত্যুর ১০ দিন পর শিউলির বাবা, বড়বোন এবং দুলাভাই আসলো শিউলিকে নিতে। জাহানারা বারান্দায় বসে শিউলির বাবাকে বললেন, “ভাই, যেটা ঘটেছে এটা আমাদের তকদিরে ছিলো। আমি বিশ্বাস করি আল্লাহ এর মাঝেও কোন কল্যাণ রেখেছেন। আমি আপনার কাছে অনুরোধ করি শিউলিকে কি আমাকে দিবেন? এমনি তে আমার ছেলে বেঁচে থাকলে তো ও থাকতোই। আমার তো আর ছেলেমেয়ে নেই, মেয়ে পাবো ভেবেই শিউলিকে এনেছিলাম। যদি আপত্তি না থাকে আর শিউলি রাজি থাকে আমি ওর দায়িত্ব নিতে চাই। শিউলি আমার কাছে থাকবে, আপনারা যখন ইচ্ছা আসবেন বা ওর যখন ইচ্ছা যাবে কোন অসুবিধা নেই।”
জাহানারার এমন কথায় তিনজনেই একটু অবাক হলো। হওয়ারই কথা, সাধারণত এরকম কম বয়সে স্বামীর মৃত্যুর পর শ্বশুর শাশুড়ি দায়িত্ব নিতে চায় না। শিউলিও দাঁড়িয়ে ছিলো দরজার কোনায়, আড়চোখে বাবাকে তার সম্মতি জানালো। শিউলির বাবা বেশ বিভ্রান্তি নিয়ে বললেন, “আপা, আপনার এ অনুরোধ ফেলতে পারছি না। সদ্য সন্তান হারিয়েছেন। থাক তবে শিউলি আপনার মেয়ে হয়ে।”
এই ঘটনার ছয় বছর পর, শিউলি তখন ডাক্তার হওয়ার পথে, হয়তো আর এক দুই বছর লাগবে ডাক্তার তকমা পেতে, এরকম সময়ে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে জাহানারা। স্ট্রোক করে অবস্থা খুবই খারাপের দিকে যায়। শিউলির মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। এই ছয়টা বছরে ও মায়ের ভালোবাসা কি জিনিস জানতে পেরেছে এই মহিলাটির কারনে। কোনদিকে কোন অভাব না রাখা এই মানুষটার অসুস্থতায় শিউলি বেশ ভেঙে পড়ে মানসিকভাবে। শহরের নাম করা এক প্রাইভেট হাসপাতালের সুসজ্জিত এক কেবিনে আধশোয়া হয়ে আছে জাহানারা। শিউলি পাশেই এক চেয়ারে বসে আছে তার এক হাত ধরে।
“মা, তোকে একটা জিনিস দেয়ার ছিলো, আগলে রেখেছি অনেকদিন ধরে, ভেবেছিলাম রফিকের হাতে দিব সময় হলে। ও যেহেতু নেই তবে তোর হাতেই দিই।”

-“কি জিনিস মা?”

“দিলেই বুঝবি। তোকে একটা দায়িত্ব দিলাম। জানিনা আমি বেঁচে থাকতে পুরন করতে পারবি কি না! তবে আমি বেঁচে না থাকলেও কাজ টা করিস। একটু কঠিন হবে। টাকা পয়সা সহ আমার নামে যে সকল সম্পত্তি ছিলো তোর নামে উইল করেছি। খরচের কথা চিন্তা করিস না!”

-“মা কি বলো এগুলো! আমার টাকা পয়সা সম্পত্তির দরকার নেই। তুমি থাকলেই হবে!”

জাহানারা মুচকি হেসে নিজের হাতের ব্যাগটা এগিয়ে নেন। এই ব্যাগের ভেতর থেকে বড় একটা চ্যাপ্টা চারকোনা বাক্স বের করেন। যেটার উপরে পানের সব জিনিস সাজানো। উপরের তাকের মত জিনিসটা সরাতেই বের হয়ে আসে মাঝারী সাইজের একটা ডায়রী। শিউলির হাতে দিয়ে জাহানারা বলেন, “মা, টাকা পয়সা সম্পত্তি এমন কি সন্তানাদি থাকলেই সুখী হওয়া যায় না সবসময়। সুখ অনেক দামী জিনিস, কে কিসে পাবে, কার জন্য কে সুখ হারাবে বলা কঠিন। এই ডায়রীটা গোপনে রাখিস। আর তোর শ্বশুর যেন কখনো জানতে না পারে এটার কথা। আমি সব ডিটেলস এ লিখে রেখেছি এই ডায়রীতে। পড়লেই বুঝবি!”

রাতে বাসায় এসেই শিউলি ডায়রীটা নিয়ে বসে। ডায়রীটায় সাল লেখা ১৯৯০। তবে শুরুর পাতায় তারিখ দেয়া ০১.০২.৯২। ঝকঝকে হাতের লেখা দেখেই বোঝা যাচ্ছে এটি জাহানারার হাতে লেখা। শিউলী আরো খেয়াল করলো লেখাটা কালির কলমে লেখা, তাই একটু কালি একটু লেপ্টে গেছে এতদিনের ব্যবধানে। লেখা পড়তে শুরু করলো-

০১.০২.৯২
সরকারি প্রাইমারী স্কুলে শিক্ষকতায় চাকরী পাওয়া সত্ত্বেও বাবা অশিক্ষিত খালাতো ভাই আমিনের সাথে বিয়ে দিলেন। ভাইকে বিদেশে পাঠাতে ধার নেয়া শোধ না করতে পেরে বড়লোক এই খালার ছেলের কাছে বিক্রি করে দিলেন আমাকে। আমি ভাবতাম অন্তত শিক্ষিত একজন মানুষের সাথে আমার বিয়ে হবে। যাই হোক, এটি নিয়ে আর অভিযোগের জায়গা নেই। কিন্তু আমার খালা বা স্বামীর ব্যবহার আমাকে তিলে তিলে শেষ করে দিচ্ছে। টাকাপয়সা, অনেক সম্পত্তি থাকলেই কেউ ভালো মানুষ হতে পারেনা তার প্রমান বার বার পাচ্ছি। এর মাঝে আজকেই জানতে পারলাম, আমি একা নই। আমাদের মাঝে নতুন অতিথি আসতে যাচ্ছে। কেন যেন খুব ভালো লাগছে।

০৪.০৫.৯২
আমার স্বামী এবং শাশুড়ির মতে প্রথম সন্তান তাদের ছেলে চাই। আমি যখন তাদেরকে বোঝাতে গেলাম যে এখানে আমাদের কারো হাত নেই, আল্লাহই ভালো জানেন, আর বিজ্ঞান মতে এটি বাবাদের উপর নির্ভর করে তখনই আমার সাথে যা-তা ব্যবহার শুরু হলো। এমন কি আমিন আমার গায়ে হাত পর্যন্ত তুলতে এসেছিলো। আমি ডাক্তারকে সিচুয়েশন বলে জানিয়েছি যেন বাচ্চা ছেলে না মেয়ে তিনি প্রকাশ না করেন। ডাক্তার আমাকে আশ্বস্ত করেছেন এ বিষয়ে।

০৮.০৬.৯২
ডাক্তার আজকে আমাকে জানালেন আমার গর্ভের সন্তানটি মেয়ে। আমার অত্যন্ত আনন্দ লাগছে। তবে আমার স্বামী বা শাশুড়িকে জানাতে বেশ ভয় লাগছে। আপাতত তারা না জানলেও চলবে। শুধু দোয়া করছি আমার সন্তানটি যেন সুস্থ হয়।

০৫.০৯.৯২
সময় যত ঘনিয়ে আসছে, আমার শাশুড়ি এবং স্বামী ততই যেন পাগল হয়ে আছে গর্ভের সন্তানের কথা জানার জন্য। বার বার ডাক্তারকে, আমাকে জোর করছে৷ কেন তারা এমন করছে আমি বুঝতে পারছি না। দিনে না হলেও কয়েক শতবার আমাকে শুনতে হয় তাদের ছেলে সন্তান চাই প্রথম বারে। আমাকে কি কি যে খেতে হচ্ছে আর কি কি যে নিয়ম কানুনের মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে ছেলে সন্তানের জন্য সেটা আমি আর আল্লাহই জানেন শুধু৷ তবুও চুপ করে সহ্য করে যাচ্ছি আমার মেয়েটার কথা ভেবে।
২৭.১১.৯২
কি যে ভয়াবহ দিন পার করছি তা আল্লাহ জানেন। আমার জীবনে এমন ঘটনার সম্মুখীন হবো তা আমি ভাবতে পারিনি। গত মাসের ২৮ তারিখে আমি ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়লে আমাকে দ্রুত হাসপাতালে নেয়া হয়৷ সেখানে আমার কন্যাটি পৃথিবীতে আসে৷ যেহেতু স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় সে এসেছে, আমার জ্ঞান ছিলো। নার্স তার জন্মের পর আমার বুকের উপর দিয়েছিলো। সে বড় বড় চোখ করে তাকাচ্ছিলো। আমি তাকে দেখলাম, তার হাত ধরলাম। ডাক্তার জানালেন, বাবু সম্পূর্ণ সুস্থ আছে, কোন সমস্যা নেই। এটি শোনার পর এতক্ষনের কষ্টের ক্লান্তিতে আমি ঘুমিয়ে পড়ি। ওষুধ ও অন্যান্য কারনেই হয়তো, আমার ঘুম ভাঙে ৮ ঘন্টা পর। তখন বেলা ১ টা। আমি ঘুম ভেঙে দেখি আমার পাশে আমিন বসা, তার চোখমুখ রাগে লাল। আমি জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছে? বাবু কোথায়? সে খুব বাজেভাবে বললো, “কিসের বাবু? মরা বাচ্চা জন্ম দিয়ে বাবু খুঁজতেছিস?” আমি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলাম না। নিজে আমার বাবুকে বুকের উপর নিয়েছি সে মৃত হবে কি করে?! আমি স্বাভাবিক হতে পারছিনা, মেনেও নিতে পারছিনা। হাসপাতালের ডাক্তার নার্স কারো সাথে আমি যোগাযোগ করতে পারিনি৷ এই হাসপাতালের মালিক আমিনের বন্ধু। আমিন কে বার বার অনুরোধ করেও লাভ হয়নি। আমার বদ্ধমূল ধারনা আমিন আর আমার শাশুড়ি কিছু একটা করেছে আমার মেয়েটার সাথে। আল্লাহ জানেন কি হয়েছে। আমি হয়তো আর কখনো স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবো না।

এ পর্যন্ত পড়ে শিউলি বেশ হতভম্ব হয়ে গেলো। জাহানারা, আমিন এদের সাথে এতদিন রয়েছে কিন্তু তাদের মাঝে এ ধরকম ধারণা বা এরকম ঘটনা ঘটেছে তা কল্পনাও করা যায় না৷ কি আশ্চর্য, জাহানারা এতদিন ধরে এসব লুকিয়ে রেখেছে কিভাবে?

সন্তান
পর্ব- ১
-লাবিবা ইরম

(পর্ব করে লেখা আমার পোষায় না, নিজেই বেশি বড় গল্প পড়িনা। এটা একটু বড়ই হবে, তবে চেষ্টা করবো বেশি না টানার। আপনাদের মতামত জানাবেন, কেমন লাগছে পড়তে?)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here