(পূর্ববর্তী পর্বের পর)
পরদিন সকালে জাহানারার অবস্থার অবনতি হয়৷ শিউলি হাসপাতালে ছোটাছুটি করতে থাকে। বিকেলের দিকে জাহানারা একটু সুস্থ হয়। শিউলি কাছে যেয়ে বসে। জাহানারা মুচকি হাসে।
“মা, তুমি তো এসব কথা কখনো বলোনি, কেউ জানেনা এসব কথা?” শিউলির কন্ঠে কৌতুহল।
জাহানারা একটু হেঁয়ালির স্বরে বলে, “কোন সব কথা?”
শিউলি: “আরে গতকাল যে ডায়রীটা….”
কথা শেষ করতে পারেনা, জাহানারা চোখ পাঁকিয়ে হাত চেপে ধরে শিউলির। এর মধ্যেই ঘরে ঢোকে আমিন। একটু নার্ভাস কিন্তু মুখে হাসির রেশ ধরে বলে, “কি কথা হচ্ছে বৌ শাশুড়ির?”
শিউলি উত্তর দেয়, “এই তো বাবা, মা তো নিজের যত্নই নিতে চায় না। এভাবে অসুস্থ হয়ে গেলে আমাদের চলবে বলেন? এসবই বোঝাচ্ছিলাম!”
আমিন বেশ ধরা একটা গলায় প্রত্যুত্তর করে, “হ্যা তোমার শাশুড়ি আজীবনই নিজের খেয়াল রাখেনা, ওকে তো আমিই…”
আমিন কথা শেষ করার আগেই জাহানারা মুখ ঘুরিয়ে বাইরের দিকে দৃষ্টি নেয়। রুমটিতে একটা কেমন যেন নীরবতা নেমে আসে।
রাতে শিউলি ফিরে আসে। দ্রুত সব গুছিয়ে নেয়, ডায়রীটা পড়ার তাড়া৷ কি আছে পরবর্তীতে?
ডায়রী খুলে আবার পড়তে শুরু করে-
১৭.০১.৯৩
আমিন আর শাশুড়ির যন্ত্রনায় অতিষ্ঠ হয়ে বাবার বাড়ি গিয়েছিলাম। সময় খারাপ হলে যে সবাই মুখ ঘুরিয়ে নেয় তার প্রমান পেলাম। বাবা যাচ্ছেতাই ব্যবহার করে তাড়িয়ে দিলেন। আমার কথা শুনে বললেন আমি পাগল হয়ে গেছি। আর কখনো ও বাড়িতে যেতে না করলেন। এদিকে আমাকে স্কুল থেকে জানালো আমার ট্রান্সফার হতে পারে। আমি ভেবেছিলাম বেঁচে যাবো, কিন্তু আমিন বলেছে ট্রান্সফার নিলে আমার চাকরির দরকার নেই৷ এদিকে আবারও সন্তানের জন্য মরিয়া উঠেছে ওরা। আমি যতবারই বলি আমার আগের সন্তানের কি হয়েছে আগে জানতে চাই আমি, ততবারই ওরা রেগে যায়। একটাই কথা আমার সন্তান মৃত ছিলো। এটা নিয়ে আমিন আমার গায়ে হাত পর্যন্ত তুলেছে। একমাত্র এই ডায়রীটা ছাড়া আর কিছুকেই এখন নিজের মনে হয় না। আমার দিনগুলো থাকুক এখানে।
২১.০২.৯৩
আজ স্কুলের একুশে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানে হঠাৎ করেই মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যাই। সন্দেহ যা করছিলাম সেটাই হলো, আবারও কেউ আসতে চলেছে। আমি পরিষ্কারভাবে ভাবতে পারছিনা। শুধু আল্লাহর কাছে দোয়া করছি সব যেন ঠিক থাকে। ওদেরকে এখনো ঘটনাটা জানাইনি। তবে লুকাতে তো পারবোনা, কি হবে সামনে ভেবেই ভয় লাগছে।
২৮.০৩.৯৩
শরীর ক্রমাগত খারাপ হতে থাকায় আবারও আগের হাসপাতালে এনেছে৷ মনোয়ারা ক্লিনিক নামে পরিচিত এই হাসপাতালটাকে আমার এখন কেমন যেন লাগে। ওরা জেনেছে আসল ঘটনা। আবারও আমাকে বলছে এবার যেন ছেলে হয়। আমিও আল্লাহর কাছে দোয়া করছি তাই যেন হয়।
০৫.০৪.৯৩
ডায়রীটাকে লুকিয়ে রাখা বেশ কঠিন হয়ে যাচ্ছে তবে এটা ছাড়া আমার কেউ নেই। অনেক কিছু লিখতে ইচ্ছা হচ্ছে যে সব দিন পার করছি তা নিয়ে। কিন্তু লেখার সময় সুযোগ করতে পারছি না।
১৬.০৫.৯৩
ডাক্তার জানালেন আবারও কন্যাসন্তান হবে৷ শুনেই আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছে৷ আমি চিন্তা করছি এবার ওদেরকে জানাবো, দেখি কি হয় ঘটনা।
১৮.০৫.৯৩
আমার জানানোটা বড় ভুল ছিলো। আরো বড় ভুল ছিলো লড়াই করা ওদের সাথে৷ ওরা আমার সন্তানকে মেরে ফেলতে চাইছে। আমি যখন বললাম আমি তাহলে এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো তখন জানলাম যে আমাদের বাড়িটা বাবা ওদের কাছেই বন্ধক রেখেছিলো৷ আমার ভাই বেকার অবস্থায় ফিরে এসেছে বিদেশ থেকে৷ আমি উল্টাপাল্টা কিছু করলে আমিন, আমার শাশুড়ি এরা বাড়ি দখল নিয়ে আমার বাবা, ভাইকে বের করে দিবে। আজকে আমি বুঝতে পারছি বাবা কেন আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। আমি আসলেই জানিনা এখন আমি কি করবো? সৃষ্টিকর্তার কাছে সাহায্য চাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই আমার।
১৩.০৭. ৯৩
আমার সন্তান কে মারতে ওরা উঠেপড়ে লেগেছে৷ ডাক্তার মানা করা সত্ত্বেও ওরা বলছে সিজার করুন৷ ডাক্তার জানালেন বাচ্চা সম্পুর্ন সুস্থ, এখন এভাবে সিজার করা সম্ভব না। আমিন তার পরিচিত এক ডাক্তারকে এনেছে, সেই ডাক্তার অপারেশন করতে রাজি হয়েছে কিন্তু আমার তুমুল আপত্তিতে ও পুলিশের ভয় দেখানোতে সে আর পরবর্তীতে এটা করেনি। টাকা দিয়ে এরা সবকিছু কিনে ফেলেছে। আমার বাবা, ভাই, হাসপাতাল, ডাক্তার, নার্স, আমাকেও
২০.০৯.৯৩
এইবারে আমি নিশ্চিত হলাম যে আমার সন্তানদের সাথে কিছু একটা করছে আমিন আর আমার শাশুড়ি। গত মাসের ১৮ তারিখে আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি, আমাকে নিয়ে আবারও সেই মনোয়ারা ক্লিনিকেই যায়৷আমাকে পথের মাঝে তারা দুইজন সরাসরিই বলে যে এই বাচ্চা তারা রাখবেনা। তারা চায় সবাই জানুক তাদের পরিবারের প্রথম সন্তান ছেলে। ভয়াবহ ব্যথায়
অবশ হয়ে আসা শরীর নিয়েও জানতে চাইলাম তারা কি করবে আমার বাচ্চাটাকে? আমিন জানালো সে একজন মহিলার সাথে কথা বলেছে, যার কখনো সন্তান হবেনা, তাকে দিয়ে দেবে৷ আমার বুক ভেঙে কান্না পেলো। মনে হলো পুরো দুনিয়াটা ধ্বংস হয়ে যাক। হঠাৎ মনে হলো, তবুও ভালো, আমার সন্তান টা তো ভালো থাকবে, অন্তত বেঁচে আছে সেটা তো জানবো। আমি আমিন কে বললাম আমাদের প্রথম সন্তানকেও কি কাউকে দিয়েছে কিনা? আমিন আমার গালে রীতিমতো চড় মেরে বসলো এই অবস্থায়ও। বললো আর কখনো যেন আর এই কথা না বলি। এবারও স্বাভাবিক ভাবেই আমার দ্বিতীয় মেয়ের জন্ম হলো। তবে এবারে আর আমার বুকে তাকে দিলোই না নার্স। সোজা নিয়ে চলে গেলো। আমি তার নাম রেখেছিলাম “আশা”।
২৫.০৯.৯৩
আমি অনেক খুঁজে, হাসপাতালের নার্স ও আয়া মহিলাকে টাকা ও সোনার একটা চেইন দিয়ে আমার মেয়েটাকে দত্তক নেয়া মহিলার নাম ঠিকানা বের করতে পেরেছি৷ আমি ভাবিনি পারবো তবে মনোয়ারা ক্লিনিকে এই সার্ভিস আছে, তারা অবৈধ ও ফেলে দেয়া সন্তানদেরকে দত্তক দেয় অনেক পরিবারের কাছে, বিনিময়ে টাকা নেয়। আমার “আশা”র ঠিকানা পেয়েছি তবে হয়তো কখনো যেতে পারবো না ওর কাছে। তবু ঠিকানা লিখে রাখছি-
বাড়ি নং: ৩৬
রোড নং: ১২৮, ওলিয়ার লেন।
পুরান ঢাকা।
ফোন: ০২৭৬১৭৫৪
এ পর্যন্ত পড়ে শিউলির মাথা চক্কর দিয়ে ওঠে। ও খেয়ালও করেনি কখন কাঁদতে শুরু করেছে। ডায়রীর এই লেখাগুলোর অনেক জায়গাতেই কালি লেপ্টে আছে পানিতে, বোঝা যায় লেখার সময় জাহানারার চোখের পানি পড়েছে।
পরদিন সকালে আবার জাহানারার কাছে যায় শিউলি। যেয়ে দেখে জাহানারা বেশ হাসিখুশি মুখে বসে আছে।
শিউলিকে দেখেই বলে ওঠে, “আমাকে দুইটা পান দিতে পারিস?”
শিউলি বলে, “ না মা, হাসপাতালে রোগীকে পান দেয়া নিষেধ!”
জাহানারা একটু মুচকি হেসে বলে, “শোন আমার হায়াৎ যেদিন শেষ হবে আমি এমনিই মরে যাবো, তার আগে এসব আমাকে কিছু করতে পারবেনা। কতকিছু গেলো এই শরীরের উপর থেকে, মরে তো গেলাম না!” অনেকটা আক্ষেপের সুর জাহানারার কন্ঠে।
শিউলি তার হাতটা ধরে বললো, “মা, ডায়রীর ঘটনাগুলো সত্যি? কখনো কাউকে বলোনি কেন?”
জাহানারা কন্ঠ নীচু করে বললো, “এখানে বলিস না, ডায়রী সব পড় না, বুঝতে পারবি! তাড়াতাড়ি পড়িস। আমি চাই আমি বেঁচে থাকতে তুই এটা পড়ে শেষ করিস!” বলে দু:খী দু:খী একটা হাসি দিল, যেই হাসিতে ঠোঁট দুটো বেঁকে যায় শুধু, তবে প্রাণ থাকেনা।
শিউলি অনেক্ষন থাকলো জাহানারার কাছে। বিকেলে বাসায় ফিরে গেলো। ওরও মন পড়ে আছে ডায়রীতে। তবে রাতের আগে ওটি নিয়ে বসার আর সময় পেলো না। আবার রাত হতেই নিজের রুম লক করে বসে গেলো রহস্যময় ডায়রীটা নিয়ে-
১৩.১০.৯৩
আমি রীতিমতো এদের কাছে জিম্মি হয়ে গেছি। আমি কিছু করলেই আমার বাবা আর ভাইকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়ার কথা বলে। এমন কি তাদেরকে মেরেও ফেলতে পারে এমন কথা বলে। এই বাড়িটাই আমার বাবা ভাইয়ের শেষ উপায়। এর ভাড়া দিয়ে তারা চলে, নিজেরাও থাকে। আমি কোথায় যাবো ভেবে পাই না। আমার শরীরেরও অবনতি হচ্ছে৷ এখন কোন এক পীরবাবার কাছে ওরা নিয়ে যেতে চায়, সে নাকি জানে কোন তদবীরে ছেলে সন্তান হয়।
সন্তান
পর্ব- ২
-লাবিবা ইরম
(গল্পের প্রয়োজনে ঠিকানা, ফোন নাম্বার বানানো, এ ধরনের ঠিকানা বা ফোন নাম্বার বাস্তবে নেই। এই গল্পের কোন ঘটনার সাথে কিছু মিলে গেলে তা নিতান্তই কাকতালীয়। আমি গল্পে অনেক সময় অবাস্তব কিছু লিখি, কারন সব যদি বাস্তব হয় তবে গল্প কেন আর? কেমন লাগছে জানাবেন কিন্তু!)