সন্তান
পর্ব- ৪
লাবিবা ইরম
১৭.০৯.৯৪
আজকে হঠাৎ আমার মাথায় একটা চিন্তা খেলে গেলো৷ আমিন আমার খালা খালুর একমাত্র সন্তান। ওর কোন ভাই, বোন নেই। আবার কোন চাচা, ফুপুও নেই। আবার খালুরও আর কোন ভাই বোন নেই৷ এই পীরের কথা মাথায় রেখে কি বংশ পরম্পরায় এসব কাজ চলে আসছে নাকি অন্যকিছু? অবশ্য খালার কখনো কোন সন্তান হয়ে মারা গেছে বা এমন কিছু শুনিনি। ঘটনা কি বোঝা বা জানার কোন উপায় নেই৷ কারন সঠিকটা জানা যাবেনা এতদিন পর এসে। তাছাড়া জানানোর মত কেউ বেঁচেও নেই।
০৩.১২.৯৪
একঘেয়ে জীবনে এ ক’দিনে তেমন কিছু ঘটেনি। তবে গতকাল হঠাৎ ই আমিন আর আমার শাশুড়ি মিলে আমাকে নিয়ে আশীপুর নামের এক গ্রামে গিয়েছিলো। বিরাট এক জমিদার বাড়ির মত বাড়িতে, এটি নাকি আমিনের দাদীর বাবার বাড়ি৷ মানে খালুর মামাবাড়ি। বর্তমানে এই বাড়িতে খালুর এক মামাতো ভাই মানে আমিনের এক চাচা ছাড়া কেউ থাকেন না। উনি বিয়ে থা করেননি, এই বাড়িটিকে আগলে বসে আছেন। এখন এই বাড়ি কারা যেন দখল করতে চায় নাকি। তাই আমিন আর আমার শাশুড়ি এসেছেন মীমাংসা করতে। আমার ঘুরতে বেশ ভালো লাগলো। আলেয়া নামের একজন খালা আমাকে গ্রামের আশেপাশে ঘুরিয়ে আনলেন। এই এলাকায় আমিনদের বেশ একটা প্রভাব আছে, বোঝা গেলো। এখনো সবাই এক নামেই চেনে।
০১.০১.৯৫
আবারও নতুন বছর। জানিনা এবার কি আছে নতুন বছরে। আমি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি ভালো কিছু যেন হয়। ডিসেম্বরের ১৩ তারিখ শাশুড়ি সেই পরিচিত লোকের মেয়ের সাথে আমার ভাইয়ের দেখা করিয়েছে। শাশুড়ি বাবা আর ভাইকে বলেছেন সব দায়িত্ব তিনি নিবেন। আমি জানিনা এর আড়ালে তাদের কি অভিসন্ধি আছে।
১৪.০২.৯৫
হুট করে আজকে ভাইয়ের সাথে সেই মেয়ের বিয়ের আয়োজন শুরু করেছে আমার শাশুড়ি। বাবা বলেছেন তার কাছে টাকা নেই। শাশুড়ি বললেন, দুলাভাই সব আমি দেখবো৷ বাবার সামনে যাই না বহুদিন। আজ হুট করে বাবা আমার ঘরে আসলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, যেন আবার সন্তান নিতে আমি অমত না করি। সন্তান না থাকলে ভবিষ্যতে কি করবো। সন্তান হয়ে না বাঁচলে এটায় কারো হাত নেই। আমি অবাক হলাম, বাবা আরো কত নিচে নামবেন? এরপর বাবা নিজে থেকে আবার বললেন, জীবনে বন্দি হয়ে গেলে বুঝবি, কেউ কখন নিজের সন্তান কে কোনকিছুর জন্য চাপ দেয়। আমার কিছুই বলার ছিলো না। ইদানীং আমাকে জোর করে সন্তান নেয়ার জন্য রাজি করাতে পারছিলো না আমিন আর আমার শাশুড়ি। আমার চাকরির কারনে আমি একটু হলেও স্বাধীনতা পাই, সেটিকে কাজে লাগাচ্ছিলাম। আরও একটা ব্যাপার এই যে আমিন এখনো বেকার, খালুর সম্পত্তি, দোকান পাট, ধানের জমির টাকা দিয়ে চলে। আমার বেতনের উপর তাদের লোভের শেষ নেই। জোর করে পারছিলো না তার জন্যই বুঝি এরকম একটা মোক্ষম চাল চাললো তারা।
১৭.০২.৯৫
আমিন কে বললাম আমি আবার সন্তান নিতে রাজি আছি একটাই শর্তে, যদি মেয়ে হয় তার কোন ক্ষতি করতে পারবেনা। এটা একটা স্ট্যাম্পে আমাকে সই করে দিতে হবে। আমিন রাজি হলো। আজকে স্ট্যাম্পে সইও করেছে, শাশুড়িও করেছে। ওরা এত সহজে রাজি কেন হয়ে যাচ্ছে এটা আমার কাছে একটু অবাক লাগছে।
১১.০৩.৯৫
আমার ভাইয়ের বিয়ে আগামী ১৭ তারিখে। অনেক ধুমধামের আয়োজন করছেন আমার শাশুড়ি। আমার এটি মোটেও সুবিধার লাগছে না। ঘটনা কিছু তো একটা আছে। একে তো আমার বাবার কাছে তিনি অনেক টাকা পান, তার উপর আমাদের বাড়িও বন্ধক তারই কাছে। এই সুযোগে আমাকে আটকে ফেলেছেন এখানে। আবার আমার ভাইয়ের বিয়ে দিচ্ছেন এভাবে- ঘটনা আমি ঠিক মেনে নিতে পারছিনা।
২০.০৩.৯৫
ভাইয়ের বিয়েতে আমাকে কিছু করতে দেয়নি। সব শাশুড়ি নিজ হাতে করেছেন। বিয়ের দিন জানা গেলো আসল ঘটনা। আমার ভাই ঘর জামাই থাকবে। এই মেয়েটির আগে একবার বিয়ে হয়েছিলো, যেকোন কারনে হোক, তালাক হয়ে গেছে। এখন সে তার বাবার বাড়ি ছেড়ে যাবেনা। আমার ভাই যে ঘরজামাই থাকবে এটি আমার ভাই জানতো। অকর্মা এই লোকটার তাতে আরো সুবিধা হয়েছে। আমি জানার পর বললাম, আমার বাবাকে কে দেখবে? বাবা নির্দ্বিধায় বললো, আমার ব্যবস্থা আমি করবো, তোকে ভাবতে হবেনা, তুই আমাকে একটা নাতি, নাতনীর মুখ দেখা। আমি বিশ্বাস করতে পারছি না, এই মানুষটা কি আমার বাবা?
০৫.০৫.৯৫
আমি আবারও মা হতে চলেছি। এবারে আমার একটু ভয় কম লাগছে কারন স্ট্যাম্পে সই করিয়ে নিয়েছি। এবার আশা করি আইনী ব্যবস্থা নিতে পারবো কোন দরকার হলে।
১৬.০৬.৯৫
ডাক্তার জানালেন হয়তো এবারও মেয়ে হবে। হোক। আশা করি এবার আমার সন্তান আমার কোলে থাকবে। সুস্থ থাকুক আমার সন্তান।
১৮.০৮.৯৫
আশীপুরের বাড়িটি নিয়ে কিছু একটা গন্ডগোল হচ্ছে। আমিন আর শাশুড়ি দৌড়াদৌড়ি করছেন। আমাকে জানালেন কিছুদিন ওখানে সবাই মিলে যেয়ে থাকতে হতে পারে দখলের জন্য। আমার কাছে বাড়িটি ভালোই লেগেছে। তবে হাসপাতাল আর ডাক্তার নার্সের সুবিধা কেমন এটি নিশ্চিত হতে চাচ্ছিলাম। শাশুড়ি জানালেন এসবের নাকি সমস্যা নেই, কাছেই সদর হাসপাতাল। আমি মাতৃত্বকালীন ছুটি নিয়ে যেয়ে থাকবো এমন কথাবার্তা বললেন। আমি ভাবছি ভালোই হবে। এই জাহান্নামের পরিবেশ থেকে একটু আলাদা হবো।
পড়তে পড়তে কখন ফজরের আযান দিয়েছে শিউলির খেয়ালই নেই। শিউলী ভাবলো আজকে সে ডায়রী পড়ে শেষ করে তবেই উঠবে। ক্লাসে আজকে আর যাবেনা। ফাঁকে জাহানারাকে দেখে আসবে। টুকটাক বাসার কাজ করে ফেলবে। নামাজ পড়ে এসেই আবার বসে পড়লো ডায়রী নিয়ে-
১২.১০.৯৫
দুইদিন হলো আমরা আশীপুরের বাড়িটিতে এসে পৌছেছি। বাড়িটির চারপাশে ফুলে ফুলে ছেঁয়ে আছে। নানারকম গাছ-গাছালী আর পাখির কোলাহল- শহর থেকে অন্যরকম। বাড়িটির ঘরগুলো এত বড় বড় যে ঘরের মাঝেই প্রতিধ্বনি হয়। আলেয়া খালা সবসময় আমার সাথে আছেন। আসার পর একবার সদর হাসপাতালে ঘুরে এসেছি। একজন দাই এর সাথেও পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন আমার শাশুড়ি। তার মতে এই দাইয়ের হাতে নাকি ছেলে সন্তান হয়। শুনে এমন হাসি পেলো আমার। আল্লাহ আমার গর্ভে মেয়ে দিলে দাই কি জন্মের সময় পালটে দেবে?
০৫.১১.৯৫
বাড়িটি নিয়ে কি ঝামেলা বুঝতে পারছিনা। কেউ আসেও না, বা শাশুড়ি, আমিন এরা কেউ কোথাও যায়ও না। আমি জিজ্ঞেস করলাম, আমিন বললো সময় হলে দেখবে। ওর সাথে আমি এমনিতেও বেশি কথা বলিনা। কথায় কথায় আজকাল আমাকে চড় থাপ্পড় মেরে দেয়া ওর অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। তাই একটু সাবধানতা বজায় রেখে চলি।
১৭.১১.৯৫
গত ১০ তারিখে আল্লাহ আমাকে আবার একটি কন্যাসন্তান দান করেছেন। মনে হচ্ছে আমার হাতে একটি পুতুল। বড় বড় চোখ আমার মেয়েটার। আমি ওর নাম রেখেছি “আঁখি”। আমিন আর আমার শাশুড়ি মুখ কালো করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমিন এ পর্যন্ত দুইবার মাত্র কোলে নিয়েছে মেয়েকে। আমার এতে কোন দু:খ নেই। মেয়েটা যে আমার কোলে আছে এটিই আমার জন্য সবচেয়ে আনন্দের।
০৭.১২.৯৫
আগামীকাল আমরা আবার নিজেদের বাসায় চলে যাবো। এই বাড়িটিকে আমার অনেক আপন লাগছে। আঁখিকে কোলে পেয়েছি এখানে এসে এইজন্যও হতে পারে। তাছাড়া চাচাও বেশ ভালো মানুষ। উনি আঁখিকে কি যে আদর করেন। আলেয়া খালাও আমার অনেক খেয়াল রেখেছেন। কোন একটা বিশেষ কারনে চাচা আমিন আর আমার আমার শাশুড়িকে মোটেই পছন্দ করেন না। তাদের সাথে খুব একটা কথাও বলেন না। আমার শাশুড়ি বলেন উনি নাকি পাগল। অথচ আমার এমন মনে হয়নি। অনেক বই পড়েন, নিজের মত থাকেন। দারুন সব অভিজ্ঞতা উনার, সেগুলোও গল্প করেন। দেশ, বিদেশ ঘুরেছেন, লন্ডন, আমেরিকা থেকেছেন। পেশায় ছিলেন সাংবাদিক, বেশ নাম করা। বয়স শেষে এসে এই বাড়িটা ধরে বসে আছেন। বলেন এই বাড়ির মত সুখ কোথাও নাকি নেই। আমার কাছেও এই বাড়িটিকে এত সুখের লেগেছে।
০৯.১২.৯৫
আজকে আমি এইখানে কিভাবে লিখছি আমি জানিনা। আমি শুধু জানি আমি কোন মানুষের সাথে বসবাস করিনা, আমি বসবাস করি দুইটা পশুর সাথে, বা পশুর চেয়েও অধম কিছুর সাথে। ৭ তারিখ রাতে আমার ওষুধের সাথে ঘুমের ওষুধ জাতীয় কিছু খাওয়ায় আমিন। আমি জানিনা ওরা কিভাবে আমাকে বাইরে এনেছে, ৮ তারিখ বিকাল ৫ টায় আমার ঘুম ভাঙে নিজেদের বাসায়। আমি ঘুম থেকে উঠেই বাচ্চার কান্নার আওয়াজ পাই তবে এটা আমার আঁখির শব্দ না। আমি আশেপাশে তাকাতেই আমিন কাঁথায় মোড়া একটা বাচ্চাকে এগিয়ে দেয়, বলে বাবু কাঁদছে। আমি বললাম, কার বাবু? এটা কে? আমিন হাসিমুখে বলে আমাদের বাবু। আমি কোলে নিতেই দেখি একটা ছেলে বাচ্চা। বয়স আমার আঁখির মতই কয়েকদিন। আমি জানিনা এই অসভ্য মানুষগুলো কোন মায়ের কোল খালি করে এনেছে, কেন এনেছে? এরকম পাগলামো কেন করছে। বাচ্চাটার দিকে তাকাতেই আমার কান্না পেয়ে যায়। আমি না পেরে বাচ্চাটাকে নিই। বাচ্চাটা যেভাবে কাঁদছে, আমি কিভাবে ফিরিয়ে দিব বাচ্চাটাকে? না জানি আমার আঁখিকে কি করেছে। আমি আমিন কে স্ট্যাম্প এর কথা বললাম, পুলিশের কাছে যাবো বলতেই ও বললো আমাকেই পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে বাচ্চা চুরির অপরাধে। তার উপর এই বাচ্চাটার কিছু হলে খুনের দায়ও আমার হবে। আমি কি করবো কোথায় যাবো কিছুই বুঝতে পারছি না। আমিন আর আমার শাশুড়ি বাচ্চাটাকে রফিক রফিক ডেকে অজ্ঞান হচ্ছে।
১৭.১২.৯৫
আল্লাহ এটিই চাচ্ছেন? আরেকজনের আমানত কে আমার হাতে দিতে? আমিও রফিক কে নিজের সন্তানের মতই লালন পালন করবো। কোন কমতি রাখবো না। বিনিময়ে আমার সন্তানেরা যারা পৃথিবীতে বেঁচে আছে তাদেরও এমন আদর ভালোবাসাই চাইবো আল্লাহর কাছে। আমি আবার কখনো আশীপুর যাবো, আমার আঁখি নিশ্চয়ই সেখানেই আছে। চাচা আর আলেয়া খালা বেঁচে থাকলে আমি সেদিনের ঘটনা হয়তো বের করতে পারবো।
আশীপুরের ঠিকানা-
সর্দার বাড়ি, আমতলা, আশীপুর।
এ পর্যন্ত পড়ে শিউলীর দম বন্ধ হয়ে আসে, পুরো পৃথিবী যেন দুলে ওঠে। হঠাৎ আমিনের ডাক পড়ে। শিউলি যেন আমিনের সামনে আর যেতেই পারছেনা, ঘুমের ভাণ ধরে বিছানায় পড়ে থাকে৷ আমিন কয়েকবার ডেকে চলে যায়।
শিউলি দেখে ঘড়িতে কেবল সকাল ৮ টা। আবার বসে পড়ে ডায়রীটা নিয়ে-
১৩.০৬.৯৬
আজকাল রফিক কে নিয়ে, স্কুল নিয়ে সময় কেটে যায়। রফিক এখন আমার দুনিয়াতে একমাত্র সুখের উৎস। তবুও কখনো কখনো ওকে দেখলে আমার বুকের মাঝে হাহাকার ওঠে। না জানি আমার আঁখি কত বড় হয়েছে, ও কি হাসে? আমার আশা? সে কোথায়? আমার নাম না রাখা প্রথম সন্তান? সে কি আদৌ বেঁচে আছে। এদিকে আমিন আর আমার শাশুড়ি রটিয়ে বেড়াচ্ছে আমার নাকি ৬/৭ টা সন্তান মৃত হয়েছে, তারপর ছেলে রফিক হয়েছে। আমি ডাক্তারের সাথে কথা বলে আমার সন্তানধারনের জন্য যে অঙ্গ, সেটি ফেলে দিতে বলেছি। সাধারণত সমস্যা না হলে কেউ এটি অপারেশন করতে চায় না। তবে টাকার বিনিময়ে রাজি করিয়েছি। সেই ডাক্তার আমিন আর আমার শাশুড়িকে জানিয়েছে আমার জরায়ুতে সমস্যা, অপারেশন করে ফেলে দিতে হবে। তারা এটি নিয়ে খুব একটা ভ্রুক্ষেপ করছেনা আর। আমি অবাক হই, তাদের নিয়ম অনুযায়ী রফিকও তো ঠিক নয়। কারন সে আমার আর আমিনের সন্তান না। সে এই বংশের কেউ হবে কি ভাবে? তারা তবু এতেই সন্তুষ্ট, এ কি নিয়ম? এ কি পাগলামো? সবই খালি লোকে জানলেই হবে?
(এবারের পর্বটি একটু বড় দিলাম। এরপরই সমাপ্তি পর্ব। কেমন লাগলো?
যদি পড়তে পড়তে ভুলে যান চরিত্রদের আমি একটু মনে করিয়ে দিই:
জাহানারা: গল্পের একটি প্রধান চরিত্র। যার ডায়রী থেকে তার জীবনের গল্প জানা যাচ্ছে।
শিউলী: গল্পের আরেকটি প্রধান চরিত্র, জাহানারার পুত্রবধূ, যে ডায়রী পড়ছে।
আমিন: জাহানার স্বামী, শিউলির শ্বশুর।
খালা/শাশুড়ি: জাহানারার খালা এবং শাশুড়ি, আমিনের মা।
খালু: জাহানারার শ্বশুর এবং খালু, আমিনের বাবা।
রফিক: জাহানারার ছেলে, শিউলির স্বামী।)