সন্তান পর্ব- ৫ (সমাপ্তি পর্ব) লাবিবা ইরম

0
996

সন্তান
পর্ব- ৫ (সমাপ্তি পর্ব)
লাবিবা ইরম

১৮.০৯.৯৬
শরীরে এত ঝুঁকি নিয়েও অপারেশন করিয়েছি৷ আর সন্তানের ঝামেলা নেই৷ আমিন বা আমার শাশুড়ি কোনকিছুই বলছেনা এ ব্যাপারে৷

২০.১২.৯৬
একটা জিনিস জানলাম। বাবা এসেছিলো কয়েকদিন আগে। আমার ঘরে এসে অনেক কথা বলছিলো, তার শরীরটাও ভালো নেই। ভাইয়ের কোন খোঁজ খবরই তেমন পান না, লজ্জায় ও বাসায় যানও না। খালাও আর আগ্রহ দেখান না তেমন। যেন আপদ বিদায় করেছেন। বাবা জানালেন, বাবা যখন আমাকে সন্তানের জন্য বলেছিলেন, আমিন আর আমার শাশুড়ি বাবাকে বলেছিলো আমি যদি সন্তান না নিই, তাহলে আমিন আবার বিয়ে করবে, আমাকে তালাক দিবে। আর বাড়ি থেকে বেরও করে দিবে। আমি আর বাবা রাস্তায় রাস্তায় ঘুরবো৷ বাবা নিজের চিন্তা করেন নি, আমার খারাপ অবস্থার ভয়ে ঐ আচরন করেছিলেন। এটা শুনে আমি আর কান্না থামাতে পারিনি। বাবাকে জড়িয়ে ধরে বেশ কেঁদেছি। এদের এই অন্যায়গুলোর শেষ কোথায় আমি দেখতে চাই।

এরপর ডায়রীর ৬ পৃষ্ঠা ফাঁকা একবারেই শেষের আগে একটা পৃষ্ঠায় লেখা:

“বাবা রফিক,
তুমি এই ডায়রীটা পড়ছো মানে হয়তো তুমি উপযুক্ত হয়েছো এগুলো বোঝার নাহলে আমি আর জীবিত নেই। এই ডায়রীতে তুমি দুটো ঠিকানা পেয়েছো, আমার দুই মেয়ের, এতদিনে হয়তো ঠিকানা অনেকটা বদলেছে, তবুও কিছু তো জানা যাবে। আমি চাই তুমি তোমার বোনেদের খুঁজে বের করো। আরো একটি ঠিকানা তোমায় দিচ্ছি-
বাড়ি নং- ১৬, রোড নং: ৪০, মিস্ত্রিপাড়া লেন, মধ্য বাড্ডা।
বহুদিন আগে একজন মারফত জানতে পেরেছিলাম, এই ঠিকানায় আমার প্রথম সন্তান আছে৷
তুমি আমার নিজের ছেলে না হলেও আমি তোমাকে কখনো কম ভালোবাসিনি, বরং আরেকজনের আমানত হিসেবে তোমাকে আমি কাচের পুতুলের মত করে আগলে রেখেছি। আশা করি এটি নিয়ে তোমার দু:খ নেই জীবনের। তবুও কষ্ট পেলে ক্ষমা করিও। আর তোমার বোনেদের খুঁজে বের করিও৷ আমি পরিস্থিতির জন্য পারিনি। বেঁচে থাকতে তাদের কথা জানতে পারলে আমার চেয়ে সুখী আর কেউ হবেনা।
ইতি
মা”

বোঝাই যাচ্ছে জাহানারা এই ডায়রীটি পরবর্তীতে রফিকের জন্যই রেখেছিলো। দুপুর হয়ে আসায় শিউলি তড়িঘড়ি করে জাহানারাকে দেখতে যায়। ওর তখনো বিশ্বাস হচ্ছেনা এসব সত্যি।

কেবিনে ঢুকতেই জাহানারা বলে ওঠেন “তোর চোখমুখ এমন শুকনো কেন রে? ঘুমাসনি?”

“না, ডায়রী পড়ে শেষ না করা পর্যন্ত শান্তি হচ্ছিলো না। আমাকে একটা কথা বলবে? ডায়রীর ঘটনাগুলো সত্যি?” ধরা গলায় শিউলি জিজ্ঞেস করে।

জাহানারা শুষ্ক হাসি হেসে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ায়। “আমি গল্প লিখে কি করবো রে?” শিউলিকে ভাঙা গলায় বলে।

শিউলি জাহানারার পাশে বসতে বসতে বলে, “ভালোই হয়েছে রফিক এসব জানেনি৷ জানলে মরার আগে আরেকবার মরে যেতো। যাকে নিজের মা, নিজের দুনিয়া বলে জানতো, এক পাতার ডায়রীর ব্যবধানে তার সাথে কোন সম্পর্ক না থাকাটা সুখের কিছু না”- বলতে বলতে শিউলির কান্না পেয়ে যায়।

“খালি জন্ম দিলেই যে মা হয় না- এটা তুইও জানিস। হ্যা রফিকের মানসিক কষ্ট হতো। তবে হয়তো ঠিক করে ফেলতে পারতাম ভালোবাসা দিয়ে। যতই হোক আমি ওর মা!” জাহানারা একটু শক্ত গলায় বলে ওঠেন। “তুই ভাবিস না এইজন্য আমি রফিকের মৃত্যুতে শোক পালন করিনি, আমি আসলে আর শোক পালন করতে পারিনা। শোক পালন বহু আগেই ভুলে গেছি আমি৷ শোকের সাথেই আমার বসবাস।“

শিউলি জাহানারার দিকে একমনে তাকিয়ে থাকে। জাহানারা একটু হেসে আবার বলে ওঠে, “তারপর, কাজটা করে দিতে পারবি?”

শিউলি মাথা নেড়ে বলে, “হ্যা, আমি করবোই। তুমি চিন্তা নিও না।“
জাহানারা বলে, “এইজন্যই বেঁচে আছি। যদি পারিস করতে, আমার জীবনে যতবার মোনাজাত ধরবো তোর নাম সবার আগে থাকবে তাতে!”

এর এক সপ্তাহ পর সুস্থ হয়ে জাহানারা ঘরে ফেরেন। শিউলিও তার ব্যস্ততা আর অন্য সব কিছু সামলে বেরিয়ে পড়ে জাহানারার সন্তানদের খুঁজতে।
একবারে প্রথমে আশাকে খোঁজার চেষ্টা করে। ফোন নাম্বার তো ভ্যালিড ই নেই এখন, ঠিকানামতো গিয়ে দেখে ওখানে একটা ফ্যাক্টরী হয়েছে কাপড়ের। বাড়িটি বিক্রি করে চলে গিয়েছে মালিকেরা। আগের মালিকদের নাম ঠিকানা যোগাড় করে, যোগাযোগ করতে করতে দুই মাস চলে যায়। একদিন তাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারে, তারা জানায় তারা ৮ বছর আগে এটি কিনেছিলো আরেক মালিকের কাছ থেকে। তাদের ঠিকানা যোগাড় করে যোগাযোগ করে শিউলি। জানতে পারে এই বাড়িটি তাদের ছিলো, ওই সময়ে। তবে তারা এখন সবাই আমেরিকা প্রবাসী। অনেক কষ্টে ফোন নাম্বার যোগাড় করে কথা বললে, বাড়ির বৃদ্ধা কথা বলতে চান না। তবে তাকে সব জানানো হলে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়ে জানান যে জিনিয়া নামের এই মেয়েটিই জাহানারার আশা। একমাত্র মেয়ে তাদের, আমেরিকাতেই তাকে বড় করেছেন ওনারা, এখন বিয়ে করে দুটো বাচ্চাও আছে। বহু কষ্ট হলেও একজন কে খুঁজে পেয়েছে এই আনন্দে শিউলি আত্মহারা হয়। মেয়েটির সাথে যোগাযোগ করতে চাইলে বৃদ্ধা প্রথমে রাজি হন না। শিউলি কথা দেয় মেয়েটি কিছু জানবেনা। উনি যেন মেয়েটিকে জানায় যে জাহানারা উনার ছোটকালের বান্ধবী, হঠাৎ যোগাযোগ হয়েছে, মেয়েটির সাথে কথা বলতে চায়। এই শর্তে বৃদ্ধা রাজি হন।
শিউলি জাহানারাকে সব জানায়, জাহানারা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেন। নির্দিষ্ট দিনে জিনিয়ার সাথে ভিডিও কলে কথা হয় জাহানারার। শিউলি দেখে মেয়েটির চেহারার সাথে জাহানারর এত মিল, হুট করে দেখলেও যে কেউ বলবে এরা মা-মেয়ে। মেয়েটিও অবাক হয় জাহানারাকে দেখে একটু। মেয়েটি ভালো বাংলাও বলতে পারেনা। কথায় আমেরিকান টান। বাচ্চা দুটো অসম্ভব সুন্দর। অনেকক্ষণ কথা বলে জাহানারা আর জিনিয়া। ফোন কল শেষে জাহানারা কান্নায় ভেঙে পড়ে।

এর কিছুদিন পর জাহানারাকে সাথে নিয়ে আশীপুরে রওনা হয় শিউলি। যদিও আমিন এটা জানেনা। আমিন জানে, ওরা ঘুরতে যাচ্ছে জাহানারার একটু চেঞ্জের জন্য। আশীপুরের বাড়িটি পোড়োবাড়িতে পরিনত হয়েছে। সেই চাচা মারা গেলে বেদখল হয়ে যায় বাড়িটি। জাহানারার সাথে তো আর যোগাযোগ করতেই দেয়নি ওরা, নিজেরাও আর খোঁজ রাখেনি। আলেয়া খালাও গত হয়েছেন বেশ আগে। তবুও খুঁজতে খুঁজতে এক বৃদ্ধ লোক কে পাওয়া গেলো যিনি চিনতে পারলেন জাহানারাকে। তিনি জানালেন দুই গ্রাম পর আলখেলা নামের একটি জায়গা ছিলো, ওখানে অনেক গরীবেরা মূলত চরের উপর থাকতো, তাদের কারো থেকে রফিক কে নিয়ে আঁখিকে দিয়েছিলো জাহানারার শাশুড়ি। তবে কাকে, কি নাম এসব কিছুই জানা গেলো না। আলখেলা জায়গাটাও নেই, চরের সাথে সাথে বিলীন হয়েছে নানা দুর্যোগে। পাওয়া গেলো না আঁখির খোঁজ।

এবার চললো জাহানারার প্রথম সন্তানের খোঁজ। যে বাড়ির ঠিকানা দেয়া, সেটি মূলত যার নামে ছিলো, সে ছিলো ভাড়াটিয়া। তার ঠিকানা পাওয়া হয়ে উঠলো দুষ্কর। বাড়ির মালিকের সহায়তায় কিছু কাগজপত্রের বিনিময়ে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে, অনেকগুলো বাসাবাড়ি ঘুরে, সেই লোকের গ্রামের ঠিকানা যোগাড় করা হলো। সেই বাড়ি যেয়ে জানা গেলো সেই লোক মৃত। তার একটি মেয়ে আছে, তবে সে কোথায় কিভাবে আছে কেউ জানেনা। লোকটির মৃত্যুর পর এই বাড়িতে একা থাকতো মেয়েটি, নাম ছিলো স্মৃতি। কিন্তু খারাপ লোকেদের যন্ত্রণায় সে নিজের ভিটা ছেড়ে যায়। কোথায় গেছে কেউ জানেনা।

জাহানারা তার সন্তানদের সবার অবস্থা জানতে পারেনি। জিনিয়ার সাথে আরো দুইবার কথা বলেছে। তবে জিনিয়া ব্যস্ত থাকে, আর হুট করেই উড়ে এসে জুড়ে বসা মায়ের এই বান্ধবীর সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলতেও তার অস্বস্তি হয়৷ এটা বুঝেই জাহানারাও কল দেননি আর।

এক সকালে শিউলি উঠে দেখে জাহানারা ওঠেন নি তখনো, অথচ ফজরের পর পরই উঠে যান তিনি আর ঘুমান না। ডাকতে যেয়ে দেখে বেশ আরামে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছেন। কাছে যেতে দেখে মাথার কাছে একটা কাগজ, কলম দিয়ে রাখা। উপরে বড় বড় করে লেখা, “শিউলির জন্য”

তাড়াতাড়ি খুলে দেখে একটা চিঠি-
“মা,
সারাজীবন একটা মেয়ের জন্য জান আনচান করতো। মা ডাকবো তাই। তোকে পেয়ে সেই ব্যথা ভুলতে চেয়েছিলাম। তবে আমি অভাগী তাই তুই আমার জীবনে আসতেই তোর জীবনের হাসিখুশী কেড়ে নিলেন আল্লাহ। নিজের সন্তানদেরকে জানার জন্য বেঁচে ছিলাম৷ একজন কে পেয়েছি এতেই খুশি। এই জীবনের আর কোন লক্ষ্য নেই৷ এই বিষে ভরা জীবনটা আর টানবো না৷ ভালো থাকিস৷ নিজের জীবনটা সুন্দর করে সাজাস। কাউকে বলিস না আমি নিজেই নিজের জীবন শেষ করেছি৷ হাজার সত্যের মত এটাও তোর আর আমার মাঝেই থাক।
-তোর হতভাগী মা”

চিঠিটা পড়েই শিউলি জাহানারার পালস চেক করে, স্থবির সব। হাত পা ও ঠান্ডা। আশেপাশে খুঁজতেই ঘুমের ওষুধের দুইটা খালি পাতা পায়। কাঁদতে কাঁদতে দ্রুত সরিয়ে ফেলে।

সবাই জানতে পারে, সেই সকালে জাহানারা কার্ডিয়াক এরেস্টে মারা গেছে।

(সমাপ্ত)

(গল্পের চরিত্র, পটভুমি, ঠিকানা সবকিছুই কাল্পনিক। বাস্তবে কারো সাথে মিলে গেলে তা নিতান্তই কাকতালীয়।)

(আমরা সবসময় সাক্সেসের গল্প শুনতে ভালোবাসি৷ কিন্তু বাস্তবে হাজার হাজার জাহানারা কোন এক ঘরের নিভৃত কোণে বসে জীবন শেষের অপেক্ষায় থাকে। যারা অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারেনা, যারা বেঁচে থাকতে তাদের সাথে হওয়া অন্যায়ের বিচারও পায় না। এমন কোন জাহানারাকে পেলে আপনারা সাহায্য করবেন। জীবন যেন একটু হলেও সহজ হয় তাদের।
গল্পটি কেমন লাগলো জানাবেন। আপনাদের অনুপ্রেরণাই আমার লেখার উৎস)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here