সন্ধ্যে নামার আগে পর্ব-০১

0
1982

(১)

সন্ধ্যে নামতে আর কিছুমাত্র সময় বাকি। চারদিক ঘণ কুয়াশায় মোড়ানো। শীতের আমেজ প্রকৃতিতে তখনো খুব একটা প্রভাব ফেলতে পারে নি। হেমন্তের অস্তমান সূর্যের শেষ আলোটুকু এখনো গাছের মগডালে এসে আছড়ে পড়ছে। গোধূলির ম্লান আলোয় পশ্চিমাকাশ ধূসর বাদামী রঙ ধারণ করেছে। মাঠে আধপাকা বিন্নি ধানের নরম শীষে উপর হেমন্তের মৃদু সমীরণ ঢেউ খেলিয়ে বেড়াচ্ছে। বিন্নি ধানের সুমিষ্ট গন্ধে চারপাশ মো মো করছে । দিনের আলো নিভে আসার সাথে সাথে বিন্নি ধানের মিষ্টি সুভাস আরো তীব্রভাবে বাতাসের সাথে ছড়িয়ে পড়ছে চারিদিকে।

গ্রামের পিচঢালা সুরু রাস্তা ফেলে খেতের আইল ধরে গুটিগুটি পায়ে হেঁটে বাড়ির দিকে অগ্রসর হচ্ছে রুমাইসা। মৃদু হাওয়া আর সন্ধ্যের ম্লান আলো গায়ে মাখিয়ে হাঁটতে বেশ লাগছে তার। এক অন্যরকম স্নিগ্ধতায় তার শরীর মন ভরে উঠতে লাগলো। চোখ বুজে নাক টেনে বাতাসে লেগে থাকা বিন্নি ধানের অবশিষ্ট সুমিষ্ট গন্ধের রেশ টুকু শুকে নিলো সে। আহ! কি আশ্চর্য রকমের মাদকতা ছড়িয়ে আছে ধানের গন্ধে। রুমাইসা আবারো চোখ বুজে ঘ্রান নিলো। সঙ্গে সঙ্গে এক অন্যরকম আবেশে জড়িয়ে গেলো সে। বিন্নি ধানের গন্ধটা তার খুব প্রিয়। কেমন কাছের কাছের বলে মনে হয় তার এই গন্ধটা। রুমাইসা মনে মনে প্রশান্তি অনুভব করলো। হেমন্তের প্রিতিটা দিন প্রতিটা সন্ধ্যে তার খুব প্রিয়। আর তার ছেয়ে প্রিয় কুয়াশা ঝড়া এমন সন্ধেবেলায় সুনীল আকাশের নিচে সারিসারি ধান খেতের আইল ধরে খালি পায়ে হাঁটতে। চারপাশে নতুন ধানের মিষ্টি গন্ধ, আহ! কি শিহরণ জাগানো সে অনুভুতি এক নিমিষে তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে দূর থেকে দূরান্তের পথে। চিরচেনা পৃথিবী অচেনায় পাড়ি দিবে। রুমাইসা একমুহূর্তের জন্য কল্পনার জগতে হারিয়ে গিয়েছিলো কিন্তু বাতাসের সাথে আজানের ধ্বনি কানে বাজতে সে সচকিত হয়ে উঠলো। চারপাশে অন্ধকার নেমে আসছে। দিকে দিকে আজানের ধ্বনি ভেসে উঠছে। রুমাইসা ছোট্ট করে নিশ্বাস ছাড়ে, চারপাশটায় আরেকবার চোখ বুলিয়ে মাথার অর্ধগোমটা টা পুরোপুরি টেনে নিয়ে দ্রুতপায়ে হাঁটা শুরু করলো।

রুমাইসাদের বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে একটা বড় শ্মশানঘাট আছে আর তার থেকে পাঁচ কদম এগিয়ে এলে একটা বড় বট গাছ। সেটা পেরিয়ে তাদের বাড়ি পৌঁছাতে হয়। রুমাইসা শ্মশান ঘাটের কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে পড়লো। ততোক্ষণে চারপাশ আধারে তিলিয়ে গেছে। ঝোপ ঝাড়ের ভিতির থেকে ঝিঁঝিঁপোকা ডাকছে। চারপাশ নিস্তব্ধ, কোথাও জনমানবের চিহ্নটুকু নেই। রুমাইসার হঠাৎ করেই মনে পড়লো তার দাদী তাকে সাবধান করে বলেছিলো সন্ধ্যেবেলায় শ্মশান ঘাটের উপর দিয়ে চলাচল না করতে বিশেষ করে মেয়েদের। কিন্তু দাদীর কথাটা সে বেমালুম ভুলেই বসেছিলো। আজ স্কুলে যেতে পারেনি বলে রুমাইসা রাত্রিদের বাড়ি গিয়েছে পড়া আনতে। কিন্তু তাতে করে যে এতটা সময় লেগে যাবে সেটা সে বুঝতে পারে নি। রুমাইসা ভয়ে ভয়ে শ্মশাঘাটের দিকে একবার তাকালো। অন্ধকার শ্মশানঘাট টাকে যেনো প্রেতাত্মাদের আশ্রয়স্থল বলে মনে হলো তার। এদিকে অন্ধকার ঘাঢ় হয়ে উঠছে আবার আশেপাশে কাউকে দেখাও যাচ্ছে না বাড়ি ফেরার তাড়ায় রুমাইসা অস্থির হয়ে উঠলো। এমনিতেও আজ তার কপালে শনিরদশা ঘুরছে। তার উপর বাড়ি ফিরতে এত দেরি না জানি কি আছে কপালে ভেবেই রুমাইসার ভিতরটা ভয়ে শুকিয়ে উঠলো।

“জানি না আজ কপালে কি আছে? বাড়ি ফিরলে কি কান্ডটাই না বাঁধে আবার,বাবা নিশ্চই আমার জন্য চিন্তা করছে।ইশ! কেনো যে এতটা দেরি করতে গেলাম? আজ নিশ্চই আমার জন্য বাবাকে অনেক কথা শুনতে হবে।” মনে মনে বিড়বিড় করে বলল রুমাইসা। সন্ধ্যে পার হয়ে গেছে অথচ সে এখনো বাড়িতে পৌঁছাতে পারে নি তার উপর এই শ্মশান ঘাট, সেটা পেড়িয়ে যে সে বাড়ির পথ ধরবে তারো সাহস পাচ্ছে না সে। ভয়ে রুমাইসার আত্না কেঁপে উঠতে লাগলো বার বার। এই মুহূর্তে তার শ্মশানঘাটের চেয়ে বাড়ির পরিস্থিতির কথা চিন্তা করে বেশি ভয় হতে লাগলো। জানি না এই মুহূর্তে বাড়িতে ঠিক কি হচ্ছে এটা ভেবে রুমাইসা যেনো ভয়ে চুপসে যেতে লাগলো। মনে সাহস সঞ্চয় করে সামনে অগ্রসর হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো কিন্তু শ্মশানের দিকে চোখ পড়তেই তার বুক ধক করে উঠলো। এক কদম পা সামনে এগিয়ে দেবার মতো শক্তি সে পেলো না। পা দুটো যেনো অসাড় হয়ে আছে তার পক্ষে এই ঘোর অন্ধকার ডিঙিয়ে শ্মশান ঘাট অতিক্রাম করা কোনো ভাবেই সম্ভব নয়। রুমাইসা আরো কিছু সময় সেখানে দাঁড়িয়ে রইলো। দুইহাতে বইগুলো বুকের সাথে ঝাঁপটে ধরে চোখ বুজে বিড়বিড় করে আয়াতুল কুরছি পড়তে লাগলো।আর বলল,

“আল্লাহ সাহায্য করুন আমাকে। বাড়ি যাবার একটা পথ তৈরী করে দিন।”

” কে খাড়ায়া আছে এখানে? করিম চাচার মাইয়া রুমাইসা নাকি?
হঠাৎ কারো পুরুষালী কণ্ঠস্বর কানে এসে ঠেঁকতে চমকে উঠলো রুমাইসা। কণ্ঠটা তার পরিচিত সঙ্গে সঙ্গে চোখ মেলে সামনে তাকালো।
তার থেকে দুই হাত দূরে সাইকেল নিয়ে হাসি হাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে রমিজ। রমিজকে দেখে পুলকিত হয়ে উঠলো রুমাইসা। এই যেনো স্বয়ং আল্লাহর পাঠানো কোনো ফেরেস্তা। রমিজ রুমাইসাকে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল,

“কিরে রুমাইসা কথা কস না ক্যান? কই গেছিলি আর এই অন্ধার রাইতে এখানে একলা খাড়ায়া আছোস ক্যান? মায়ের লগে আবার কাইজ্জা হইছে বুঝি?”

রুমাইসা তৎক্ষণাৎ কোনো জবাব দিতে পারলো না। রমিজ রুমাইসার হাতে থাকা বইয়ের দিকে লক্ষ্য করে বলল,

“ওহ আইচ্ছা পড়া আনবার গেছিলি?”

রুমাইসা কোনো জবাব না দিয়ে মাথা নাড়ালো। রমিজ ঘাড় ঘুরিয়ে শ্মশান ঘাটের দিকে একবার দেখলো তারপর ফিরে রুমাইসার দিকে তাকিয়ে বলল,

“এই রস্তা দিয়া যখন যাইতে ডর করে তহন বেলা থাকতে থাকতে আইয়া পড়লেই তো পারতিস ক্যান খালি খালি সন্ধ্যা করলি?”

“এতটা দেরি হবে বুঝতে পারি নাই রমিজ ভাই।”

“হ তা তো বুঝবার পারছি। চল তোরে বাড়ি পর্যন্ত আগায়া দিয়া আসি। নয় তো একলা যাবি ক্যামনে।”

রুমাইসা কোনো কথা বলল না। চুপচাপ রমিজের পিছন পিছন হাঁটতে শুরু করলো।
রমিজ গ্রামের ডাকপিয়ন। গ্রামে গ্রামে চিঠি পৌঁছে দেয়াই তার কাজ। বয়স পঁয়ত্রিশ কি চল্লিশ এর কাছাকাছি হবে কিন্তু দেখলে বয়স পঞ্চাশ বছরের উর্ধে বলে মনে হবে। বেটে, কালো, মোটা ভুঁড়িওয়ালা রমিজ সহজ সরল প্রকৃতির মানুষ। মানুষকে খুব সহজে আপন করে নিতে জানে সে।

হাঁটতে হাঁটতে দুজন রুমাইসাদের বাড়ির খুব কাছাকাছি চলে এসেছে। রমিজ নানান কথা বলতে বলতে পুরো পথ এসেছে কিন্তু রুমাইসা পুরোটা সময় একটা কথাও বলে নি। তার মনে অজানা আতঙ্ক ভর করেছে। হাত পা শীতল হয়ে উঠছে। যত বাড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ততোই তার বুকের ভিতর ধুক ধুক করছে। হৃদপিন্ড দ্রুতগতিতে চলাচল করেছে। তার অচঞ্চল মনে কু গাইছে। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানান দিচ্ছে বাড়িতে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে ঠিক কি হতে চলেছে।

রুমাইসাদের বাড়ির সামনে এসে রমিজ সাইকেল দাঁড়া করালো। রুমাইসা কিছুটা পিছনে ছিলো এগিয়ে এসে রমিজের সাইকেলের সামনে নিশ্চুপে দাঁড়াল। রমিজ রুমাইসার নিশ্চুপতার অর্থ বুঝতে পেরে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

“যা রুমাইসা বাড়ি যা। আমরা আইসা পড়ছি।”

রুমাইসা কোনো কথা বলল না মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানিয়ে বাড়ির ভিতরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। রমিজ তখনো জায়গায় দাঁড়িয়ে রুমাইসার চলে যাওয়া দেখছিলো। হঠাৎ কি জানি ভেবে রুমাইসা দাঁড়িয়ে পড়ল, ফিরে এসে রমিজকে বলল,

“রমিজ ভাই তোমারে অনেক ধন্যবাদ। তুমি ঠিক সময় না পৌঁছাইলে আমি বাড়ি ফিরতে পারতাম না। অনেকটা সময় নষ্ট করলাম তোমার।”

তারপর রমিজের কাঁধে ঝুলানো ব্যাগের দিকে তাকিয়ে আবার বলল,

“এখনো অনেক চিঠি তোমার ব্যাগে সবার দ্বারেদ্বারে পৌঁছাতে রাত হইয়া যাইবো তাই না রমিজ ভাই?”

“হ! তা তো হইবো ই। এই আর নতুন কি রোজই তো অয়।”

“আজ আমার জন্য আরো দেরি হইয়া গেলো।”

“আরে হেইডা কোনো ব্যাপার না। তুমি টেনশন লইয়ো না। আমার অভ্যাস আছে। তুমি তাড়াতাড়ি বাড়ি যাও না হয় কপালে যে কি আছে হেইডা আল্লাহই ভালো কইতে পারবো।”

রুমাইসা আর কিছু বলল না। চুপচাপ রমিজের দিকে কয়েক মুহূর্ত দৃষ্টি নিব্ধ করে চেয়ে রইলো। অন্ধকারে বেটে রমিজকে দেখা যাচ্ছে না শুধু তার তার চোখ দুটো চকচক করতে দেখলো রুমাইসা।

বাড়ির ভিতর হতে মেয়েলী কর্কশ কণ্ঠস্বর ভেসে আসতে রুমাইসা চমকে উঠলো কিন্তু বাহিরে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। রমিজ কান খাড়া করে শুনার চেষ্টা করে বলল,

” নিজের মা না থাকলে যে পোলাপান মাইনষের কি কষ্ট হেইডা শুধু মা মরা পোলাপান গুলাই বুঝে। যাই হোক আর দেরি করিস না বইন তাড়াতাড়ি যা।”

রুমাইসা আর সময় নষ্ট করলো না। ধীরেধীরে বাড়ির গেইট পেড়িয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলো। রমিজ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সাইকেলে চড়ে বসতে বসতে বলল,

“আল্লাহ তোমার এই কোন লীলাখেলা? নারীজাত মায়ের জাত হইয়াও ক্যান সতীনের সন্তানরে নিজের সন্তান মনে কইরতে পারে না। সতীনের সন্তান আর নিজের সন্তান কি এক হইতে পারে না? তারগো মধ্যে বিভেদ হওনই লাগবো? মা তো মা তার কাছে তো সকল সন্তান ই এক হওনের কথা। কি জানি সব তোমারই লীলাখেলা দয়াল তুমিই সব কিছুর মালিক।”
বলে রমিজ সেখান থেকে বিদায় নিলো।

চলবে,,,।

#সন্ধ্যে_নামার_আগে
#লেখিকা_সুমাইয়া_জাহান
#পর্ব-০১

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here