সন্ধ্যে নামার আগে পর্ব-০২

0
696

#সন্ধ্যে_নামার_আগে
#লেখিকা_সুমাইয়া_জাহান
#পর্ব_০২

(২)

সামনে যত দূর চোখে গেলো শুধু সারি সারি ধান খেতই দেখতে পেলো স্মরণ। হেমন্তের কুয়াশা ঝড়া সন্ধ্যে বেলায় এই বিস্তর ধান খেতের আইল ধরে অনেকটা পথ তাকে হেঁটে পার করতে হচ্ছে । এখনো প্রায় আর্ধ মাইল পথ হেঁটে অতিক্রম করা বাকি। স্মরণ গভীর শ্বাস ছেড়ে আবার হাঁটার আরম্ভ করলো যত দ্রুত সম্ভব তাকে মেডিকেল ক্যাম্পে গিয়ে পৌঁছাতে হবে।

জ্যোৎস্নার আলোয় স্নানকৃত ধানের নরম শীষে জমে থাকা শিশির বিন্দু মুক্তার মত জ্বলজ্বল করছে। স্মরণ আলতো হাতে ছুঁইয়ে দিতেই শিশিরের জল ঝর ঝর করে ঝড়ে পড়লো। মৃদু সমীরণ বইছে চারপাশে। কঁচি ধানের গন্ধে আশপাশ ভরে আছে। স্মরণ কি ভেবে পকেট থেকে রুমাল বের করে নাকে চেপে ধরল। তারপর প্রচণ্ড বিরক্তিতে ভ্রুকুঞ্চিত করে বলল,

“এমন একটা সুন্দর পরিবেশ নষ্ট করার জন্য ধানের বিচ্ছিরি গন্ধই যথেষ্ট। ”

বাঁশবনে আচ্ছন্ন ছোট্ট একটি বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল স্মরণ। দূর থেকে বাড়িটির অস্তিত্ব বুঝা না গেলেও কাছাকাছি আসায় সেটির অস্তিত্ব গভীরভাবে জানান দিলো। বাঁশবনের মাথার উপর একফালি চাঁদ তখনো জ্যোৎস্না বিলিয়ে যাচ্ছে। ঘনকুয়াশায় সেই আলো ফিকে হয়ে কুঁড়েঘরের চালায় এসে পড়েছে। স্মরণ চারপাশ ইতিউতি করে দেখলো। আবছা আলোয় তার বুঝতে খুব একটা অসুবিধা হলো না যে বাড়িতে দুটো মাত্র কুঁড়েঘর এবং একটি গোয়ালঘর রয়েছে। একটি কুঁড়েঘরে হারিকেনের আলো জ্বলতে দেখা গেলো। স্মরণ বাড়ির গৃহকর্তাকে ডাকার পূর্বে কিছুটা সময় ব্যয় করলো তারপর গলাভারী করে ডাক ছেড়ে বলল,

” বাড়িতে কেউ আছেন?”

স্মরণের কথা শেষ হতে না হতে খট করে কুঁড়েঘরের দরজা খোলার শব্দ হলো। হারিকেন হাতে মোটা বেঁটেখাটো একজন লোক বেড়িয়ে দোরগোড়ায় এসে দাঁড়ায়। বাড়ির মাঝ উঠোনে লম্বা বলিষ্ঠ সুঠাম দেহের অধিকারী একজন যুবকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দৌড়ে বেড়িয়ে এলো লোকটি। হারিকেন উঁচু করে ধরতেই একজন সুদর্শন যুবকের ফর্শা চেহারা ভেসে উঠে হারিকেনের লাল আলোয়। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা, কপালের বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে আর তাতে লেপ্টে আছে সামনে একগাছি চুল। কপালের শেষপ্রান্তে সুরু ভ্রু যুগল বেয়ে এক ফোঁটা ঘাম টপ করে ঝরে পড়লো। যুবকটি রুমাল বের করে সেটা মুছে নিতে নিতে লোকটিকে উদ্দেশ্য করে বলল,

“আপনি রমিজ সাহেব রাইট?”

“হ! আমিই রমিজ। তয় লোকে রমিজ পিয়ন বইলা ডাকে।”

“সেটা বুঝতেই পেরেছি। গ্রামের কয়েকজন লোককে জিজ্ঞেস করে বাড়ি চিনে নিতে হয়েছে কিনা।”

” আইজ তো আপনার মেলা খাটুনী হইছে আবার আমার বাড়ি খুঁজে পাইতেও যে আপনার খুব একটা কষ্ট হয় নাই হেইডা মিছা কতা।”

“তা একটু হয়েছে। তবে সঠিক জায়গায় এসেছি কিনা সেটা নিয়ে একটু সন্দেহ ছিলো।”

স্মরণের শেষের কথায় লাজুক হাসি দিলো রমিজ। রমিজের এমন হাসির কারণ বুঝতে পারলো না স্মরণ। তবে রমিজ যে অকারণে একটু বেশি কথা বলে প্রথম দর্শনেই সেটা বুঝতে পারলো সে।

” তো রমিজ সাহেব এইবার তবে যাওয়া যাক।”

“ওমা এইডা কি কথা কন আপনি? এত দূর থেইকা রাতবিরাইতে আইলেন আর এখনি আবার কামে যাইবেন হেইডা কিন্তু হইবো না কইয়া দিলাম। আইজ আপনি আমার বাড়ির অতিথি গরীবের বাড়ি পা রাখছেন দুইডা ডাল ভাত না খাইয়া গেলে কষ্ট পামু।”

” আপনার আতিথেয়তার জন্য ধন্যবাদ কিন্তু আমি এখন ক্যাম্পে না পৌঁছালে প্রবলেম হবে। আপনার বাড়ি অন্য একদিন এসে পেটভরে না হয় খেয়ে যাবো।”

স্মরণের কথায় যে রমিজ খুব একটা খুশি হলো না সেটা তার মুখ দেখেই বুঝা গেলো। লোকটা বেশি কথা বললেও মন ভালো। একেবারে সরল প্রকৃতির একজন।

” ডাক্তার সাহেব মেডিকেল ক্যাম্প কিন্তু এইখান থেইকা মেলা দূর। প্রায় তিন ক্রোশ রাস্তা হাঁটা লাগবো এত রাইতে কোনো গাড়ি পাওন যাইবো না কিনা।”

স্মরণ ক্ষণকাল মৌন থেকে কিছু একটা চিন্তা করলো পড়ে হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল,

“মাত্র সন্ধ্যে সাড়ে সাতটা বাজে এই মুহূর্তে গেলে নিশ্চুই কিছু না কিছু পাওয়া যাবে।”

“আপনি শহরের মানুষ তাই জানেন না, গ্যারামে সাড়ে সাতটা মানে মেলা রাইত। আর এহন তো রাইত অনেক লম্বা অইছে সাতটা মানেই মধ্যরাইত এই সময় আপনি গরুর গাড়িও পাইবেন না।”
বলে স্মরণের পরবর্তী জবাবের অপেক্ষা করতে লাগলো সে কিন্তু স্মরণ তেমন কিছুই বলল না ইশারায় বুঝিয়ে দিলো দরকার প্রয়োজনে তারা পায়ে হেঁটে যাবে তিন ক্রোশ পথ। রমিজ স্মরণের এমন নাছোড়বান্দা আচরণে হতাশ হলো অগত্যা তাকেও স্মরণের সহচর হিসেবে যোগ দিতে হলো। ততোক্ষণে সে বেশ ভালো করে বুঝতে পেরেছিলো যে স্মরণ নিজের কথায় অটল, যে কোনো পরিস্থিতিতেও নিজের অবস্থানে অবিচল সে ।

(৩)

সন্ধ্যে হওয়ার পর পরই গ্রামে বেশির ভাগ সময় লোডশেডিং হওয়ার নিয়ম আছে। প্রায় প্রতিদিনই মাগরিবের কিছুক্ষণ পর লোডশেডিং হয় তারপর আর কখন কারেন্ট আসবে সেটা হয় তো বিদ্যুৎ অফিসের কর্মকর্তা কর্মচারীরাও জানে না। প্রতিদিনের মতো আজও একি ঘটনা ঘটলো রুমাইসা বাড়ি ফেরার কিছুক্ষণ পরই লোডশেডিং হলো তারপর থেকে তিন ঘন্টা সময় কেঁটে গেছে তবুও বিদ্যুৎ এর মুখ দেখা গেলো না। মুখে একরাশ বিরিক্তির ছাপ টেনে হারিকেনের আলোয় বই খুলে বসলো রুমাইসা। পাশেই তার ছোট বোন রিমা আর ছয় বছরের ভাই সমীর বই খুলে বসে আছে।

রুমাইসা বই খুলে বসলেও পড়ায় মন বসছে না তার। না চাইতে চোখ বারবার জানালার বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকা শিউলি ফুল গাছটার উপর চলে যাচ্ছে। শিশিরস্নাত শিউলি ফুলগুলো মৃদু হাওয়ায় দুলছে। রুমাইসা কিছু সময় চুপচাপ সে দিকে তাকিয়ে থেকে পরে উঠে জানালার কাছে এসে দাঁড়াল। হাত বাড়িয়ে শিউলি ফুলের সবচেয়ে নিচের ডালটা ছোঁয়ার চেষ্টা করলো কিন্তু পারলো না। তাদের মাঝে প্রায় এক হাত দূরত্ব। রুমাইসা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবার পড়ার টেবিলে ফিরে এসে বসলো। জানালা দিয়ে শিউলি ফুলের সুবাস বিনাবাধায় ঘরে প্রবেশ করছে। রুমাইসা চোখ বুজে নাক টেনে সুবাস নিলো। ধানের গন্ধের মতো শিউলি ফুলের সুবাসও তার খুব প্রিয়,খুব কাছের বলে মনে হয়। এই দুটোর সুবাস যখন তার নাকে লাগে তখন তার ভিতত এক অদ্ভুত অনুভূতি কাজ করে। মনে হয় খুব কাছের কেউ তার আশে পাশে
বিচরণ করছে। সে সুবাসের সাথে সাথে বাতাসেও কারো অস্তিত্ব অনুভব করে রুমাইসা।

বইয়ের পাতা উলট পালট করতে করতে হাতের কব্জিতে থাকা কালো দাগটার উপর এসে দৃষ্টি স্থির হয়ে গেলো রুমাইসার। সঙ্গে সঙ্গে সন্ধ্যে বেলার কথা মনে পড়ে গেলো। বাড়িতে পা রাখার সাথে সাথেই তার উপর ঝাড়ু, খুন্তি, চামুচের বর্ষণ হতে থাকে। নিলুফার বেগম রেগে রান্না ঘর হতে যা পেরেছেন তার দিকে ছুড়ে মেরেছেন। এতেও যেনো তিনি ক্ষান্ত হন নি অতি ক্রুদ্ধ হয়ে শেষে কাঠের বেলুন ছুঁড়ে মারলেন রুমাইসার দিকে আর সেটা এসে রুমাইসার হাতের কব্জিতে লাগে। প্রচণ্ড ব্যাথায় যখন সে কাঁকিয়ে উঠেছিলো তখনি চুলে টান অনুভব করে। একটা ব্যাথা সামলে না উঠতেই আরেকটা তীব্র ব্যাথার সম্মুখীন হলো সে। কিছু বুঝে উঠার আগেই পিঠের উপর কয়েক গা কিল ঘুষি খেয়ে সামলাতে না পেরে মাটিতে বসে পড়ে রুমাইসা। ব্যাথা যন্ত্রণায় যখন তার চোখ ফেটে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিলো তখনি সে শুনতে পেলো তার মৃত মায়ের নাম ধরে নিলুফার অশ্রাব্য গালাগাল করছে।

রুমাইসার এমন বেহাল দশা দেখে কলপাড় হতে দৌড়ে আসেন মনোয়ারা বেগম। বৃদ্ধ শরীর নিয়ে খুব একটা দ্রুত চলতে পারেন না তিনি তবুও নাতনী এমন দশা দেখে একপ্রকার ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলেন ওকে। রিমা ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে নীরবে সব দেখছিলো কিন্তু তার কিছুই করার ছিলো না। মায়ের ভয়ে সে তার কলিজার টুকরা বোনকে বাঁচাতে আসতে পারলো না। নিলুফার বেগম আগেই তাকে বারান্দায় দরজা আটকে রেখেছিলেন। বোনের এমন অশহায় অবস্থা দেখে তার বুক ফেটে যায়। কান্না গুলো দলা পাকিয়ে আসতে চায়। সে জানে না কেনো তার মা তার আপার সাথে এমন ব্যবহার করেন। কেনোই বা তার আপাকে সহ্য করতে পারে না। শুধু কি সতিনের মেয়ে বলেই এত কষ্ট দেয় তার মা আপাকে? জবাব খুঁজে পায় না রিমা। তবে সে খুব করে চায় রুমাইসা যেনো খুব ভালো থাকে সবাই যেনো তাকে খুব ভালোবাসে।

চলবে,,,।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here