#সন্ধ্যে_নামার_আগে
#লেখিকা_সুমাইয়া_জাহান
#পর্ব-০৪
(৭)
চিঠির ভাঁজ খুলতেই চোখের সমূখে টানা হাতে লিখা ভেসে উঠলো। স্মরণ তাতে একবার চোখ বুলিয়ে আবার সেটা ভাঁজ রেখে দিলো। ইতিমধ্যে তার চেম্বারে রমিজ সহ করিম সাহেব এসে ডুকলেন। স্মরণ করিম সাহেবকে বসতে বলে রমিজকে বেড়িয়ে যেতে ইশারা করলো। রমিজ চলে গেলে স্মরণ কোনো ভণিতা ছাড়াই বলল,
“আপনি মিস.রুমাইসার বাবা রাইট?”
“জ্বী আমি রুমাইসার বাবা কিন্তু সেটা আপনি জানেন কিভাবে?”
স্মরণ ভাঁজ করা চিঠিটা করিম সাহেবের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
“আপনার বুকে কবে থেকে ব্যাথা হচ্ছে?”
করিম সাহেব চিঠিতে চোখ বুলিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন তারপর বললেন,
“আপনি তো সবই পড়লেন চিঠিতে। আমি আর কি বলবো। মেয়ে যে আমায় এত টা চোখে চোখে রেখেছিলো সেটা আমি কখনো বুঝতে পারি নি।”
“হুম সেটা তার লিখা পড়েই বুঝতে পেরেছি। দেখুন উনার কথা অনুযায়ী আমি যতটুকু বুঝতে পেরেছি তাতে আপনার হার্টে কিছু প্রব্লেম আছে বলে আমার মনে হচ্ছে। তবে পুরোপুরিভাবে সিউর হওয়া পর্যন্ত আমি আপনাকে কিছুই বলতে পারছি না। আপনি আপনার প্রব্লেম গুলো আমাকে ক্লিয়ার করে বলুন প্লিজ।”
করিম সাহেব গত ছয় মাস ধরে অসুস্থ। বুকের বা পাশে চিনচিন করে ব্যাথা অনুভব করছিলেন তিনি। মাঝে মাঝে বুক ব্যাথায় অস্তির হয়ে উঠতেন। একদিন স্কুলে ক্লাস চলাকালীন সময় প্রচণ্ড বুকে ব্যাথা শুরু হয়। ব্যাথায় তিনি একটা সময় জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। রুমাইসা সেদিন স্কুলেই ছিলো বাবার অসুস্থতার কথা শুনে অফিসে কক্ষে ছুটে যায় সে। স্কুলের আরো কয়েকজন শিক্ষক শিক্ষিকা সহ গ্রামের একজন ডাক্তার সেখানে উপস্থিত ছিলো। ডাক্তার করিম সাহেবকে দেখে বললেন তার বুকের ব্যাথাটা খুব একটা জটিল রোগ নয়। গ্যাস্ট্রিক এর কারণেই এমনটা হয়েছে কিন্তু সেদিন রুমাইসা তার বাবার অবস্থা দেখে ডাক্তারের বলা কথাগুলো বিশ্বাস করতে পারে নি। তার মনে কিছু একটা খটকা লেগেই ছিলো। সেদিনের পর রুমাইসা সব সময় বাবাকে নজরে নজরে রাখতো। করিম সাহেবের অনুরোধে রুমাইসা নিলুফারকে এই কথা জানতে দেয় নি তবে রিমাকে সে সব জানিয়েছিলো।
গত দুদিন ধরে করিম সাহেব আবারো বুকে প্রচণ্ড ব্যাথা অনুভব করছিলেন। নিজের অসুস্থতার কথা নিজের মাঝেই চেপে রাখতে চেয়েছিলেন তিনি। তবে সবার চোখ ফাঁকি দিলেও রুমাইসার চোখকে ফাঁকি দিতে পারেন নি তিনি। ঠিক ধরা পড়েছিলেন মেয়ের হাতে।
(৮)
রাত্রিদের বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে রুমাইসা। ভেতরে প্রবেশ করবে কি করবে না ভেবে আরো কয়েক মুহূর্ত সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। রাত্রিদের থাকার ঘরের সামনে অনেক মানুষের ভিড় জমেছে। কি হয়েছে বুঝতে না পেরে সে ইতিউতি করে দেখতে লাগলো। না তাতেও সে কিছু বুঝতে পারলো না। একটু পর রাত্রিদের ঘর থেকে একজন মহিলার ক্রন্দনরত সুর ভেসে আসতে শুনলো রুমাইসা। মহিলার কান্না বিজোড়িত কণ্ঠস্বর শুনে বুঝতে বাকি রইলো না যে যিনি কান্না করছেন তিনি রাত্রির বড় ফুফু। রুমাইসা একবার ভাবলো ভিড় ঠেলে দেখতে যাবে বাড়িতে ঠিক কি ঘটেছে কিন্তু পরোক্ষণেই আবার কি যেনো ভেবে নিজেকে দমিয়ে নিলো।
বাড়ির ভিতর হতে দুই একজন মহিলাকে বেড়িয়ে আসতে দেখে একটু সামনে এগিয়ে এলো রুমাইসা। মহিলাগুলো নিজেদের মধ্যে যা বলাবলি করছিলো তাতে সে এতটুকু বুঝতে পেরেছে যে বাড়ির কেউ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছে তাই নিশ্চিন্দপুরের মেডিকেল ক্যাম্পে থেকে দুজন বড় ডাক্তারকে ডেকে আনা হয়েছে বাড়িতে। রুমাইসা ঘটনা আরো তলিয়ে দেখার জন্য ভিড় ঠেলে ভিতরে যাওয়ার জন্য অগ্রসর হচ্ছিলো আর ঠিক তখনি সে ওড়নায় মৃদু টান অনুভব করে।
ওড়না টান পড়তে থেমে গেলো রুমাইসা। পেছন ফিরে তাকানোর পূর্বেই সে কারো বলিষ্ঠ কন্ঠস্বর শুনতে পেলো।
” ভিড় ঠেলে সামনে যাবার চেয়ে এখানে দাঁড়িয়ে আরো কিছুটা সময় অপেক্ষা করাই কি বুদ্ধিমানের কাজ হবে না?”
বলিষ্ঠ পুরুষালী কণ্ঠস্বর কানে বাজতে রুমাইসার বুক ধক করে উঠলো। লোকটি যে তাকেই উদ্দেশ্য করে কথাটা বলেছে এই ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। তবে তার ওড়না ধরে টান দেয়া এ তো ঘোর অপরাধে চেয়েও বেশি কিছু। হুট করেই রুমাইসার মাথায় রাগ চেপে বসলো। পেছনে কে তা না দেখেই কড়া বাসায় জবাব দিলো,
“এতই যদি মস্তিষ্ক ভর্তি বুদ্ধি, তবে একজন অপরিচিত মেয়ের ওড়না ধরে টান দেয়াটা যে বুদ্ধিহীনের কাজ সেটা নিশ্চই আপনার বুদ্ধিসম্পন্ন মস্তিষ্কে থাকার কথা ছিলো।”
বলেই ক্রুদ্ধদৃষ্টিতে পেছন ফিরে তাকালো রুমাইসা। তার থেকে কিছুটা অদূরে ছয় ফুট লম্বা দীর্ঘদেহী একজন বলিষ্ঠ যুবককে বাহুতে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার ক্রুদ্ধদৃষ্টি নিমিষে শীতল হয়ে গেলো। লজ্জা আর ভয় উভয়ে তার মুখের বর্ণ পাল্টে নীল রঙ ধারণ করলো। রুমাইসা কি বলবে কি করবে বুঝতে পারছিলো না। তার ওড়না যে এই মুহূতে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা যুবকটি টান দেয় নি এই ব্যাপারে আর কোনো সংশয় নেই। যুবকটি গম্ভীর দৃষ্টিতে একবার রুমাইসাকে দেখলো তারপর উঠোনের একপাশে পড়ে থাকা পরিত্যক্ত বাঁশের কঞ্চির সাথে আটকে থাকা ওড়নাটা ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
” এই জন্যই বলে উপকারীকে বাগে খায়। কথাটা যে নিতান্তই মিথ্যে নয় তার প্রমাণ আজ পেলাম।
বাই দ্যা ওয়ে পরের বার চলতে গেলে ওড়না সামলে রাখবেন।”
বলে রুমাইসার পাশ কাটিয়ে বাড়ির ভেতরে চলে গেলো যুবকটি। ততোক্ষণে বাড়িতে ভিড় অনেকটা কমে গেছে। রুমাইসা তখনো একিভাবে দাঁড়িয়ে রইলো। লজ্জায় যেনো সে মাথা তুলতে পারছিলো না।
রুমাইসাকে দেখতে পেয়ে রাত্রি ঘর হতে দৌড়ে বেড়িয়ে এলো।
“কি রে রুমাইসা তুই কখন এলি?”
“বেশ কিছুক্ষণ।”
“এখানে দাঁড়িয়ে ছিলি,ভেতরে এলি না কেনো?”
“ভিড় ঠেলে যেতে ইচ্ছে করে নি।”
“কি হয়েছে তোর মন খারাপ ? ওই মহিলা আবার তোকে কিছু বলেছে?”
“সে আর নতুন কি! এসব নিয়ে এখন আর আমার মন খারাপ হয় না। ”
“চল ঘরে চল।”
“না এখন আর যাবো না অনেক দেরি হয়ে গেছে। আচ্ছা কার কি হয়েছে বল তো বাড়িতে এত ভিড় দেখে তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।”
“আর কি হবে বুড়ির আবার হাঁড় ভেঙেছে। বড় ফুফু সে খবর শুনে বাড়ি এসে মরা কান্না জুড়ে দিয়েছে দেখলি না?”
“রাত্রি উনি বৃদ্ধ মানুষ, উনাকে এভাবে বলাটা তোর ঠিক হচ্ছে না।”
“বৃদ্ধ হলে কি হবে বুড়ি কুচুটে আছে। আমি বাবাহ তোর মত এত সরল না যে কেউ আমাকে মেরে ফেললেও তার ভালো চাইবো আবার তার সাথে ভালো ভালো কথাও বলবো।”
রাত্রির কথা বলার ভঙ্গি দেখে হেসে ফেললো রুমাইসা। তারপর বলল,
“ঠিক আছে আমি তাহলে যাই অনেক দেরি হয়ে গেলো।”
“যাবো মানে? পড়া নিয়ে যাবি না?”
“না আজ থাক। বেলা প্রায় পড়ে এসেছে সন্ধ্যের আগে বাড়ি ফিরতে হবে না হয় মা বকবে।”
“চল আমি এগিয়ে দেই।”
“উহু আমি একাই যেতে পারবো।”
রুমাইসা উঠোন পেরিয়ে গেলে রাত্রি আবার পিছন থেকে ডেকে জিজ্ঞাস করলো,
“কাল স্কুলে যাবি তো?”
রুমাইসা ফিরে রাত্রিকে দেখলো তারপর ঠোঁটে মলিন হাসি ফুটিয়ে শেষে রাস্তায় নেমে গেলো। রাত্রি রুমাইসা যাওয়া পথে তাকিয়ে থেকে পরে দাঁত কিড়মিড় করে বলতে লাগলো,
“রিমার মা টা পুরোই আমার দাদীর মতো কুচুটে। শয়তান দুটো যেনো যমেরও অরুচি।”
আজও রুমাইসা খেতের আইল ধরে হাঁটছে। হাল্কা সমীরণে তার এলো চুলগুলো হাওয়ায় দুলছে। রুমাইসা নাক ভরে পাকাধানের গন্ধ নিতে নিতে একটু আগের ঘটনা মনে নাড়াচাড়া করতে লাগলো। ইশশ কি লজ্জায় না পড়তে হলো তাকে আজ। কথাটা ভাবতে ভাবতে রুমাইসার দু’কান কান গরম হয়ে উঠলো। সে জানে না যুবকটি কে। তবে তার পোষাক দেখে মনে হলো শহর থেকে এসেছে।
” রাত্রিদের কোনো আত্নীয় হবে? হতেও পারে। রাত্রির বড় ফুফু ঢাকায় থাকে নিশ্চই উনার সাথেই এসে।”
বলে রুমাইসা নিজের মতো হাঁটতে থাকে। এদিকে বিকেলের আলো নিভে আসছে। পশ্চিমাকাশে রক্তিমাভা ফুটে উঠেছে। পাখিরা ফিরে চলেছে আপন নীড়ে। কুয়াশায় ঢাকা হেমন্তে এমন গোধূলি বেলায় চোখ বুজে নিশ্বাসে ধানের সুবাস নিতে বেশ লাগছে রুমাইসার। সারাদিনের সকল কর্মব্যস্ততা শেষে সন্ধ্যে নামার আগে এই সময়টুকুই যেনো তার বড্ড আপন। অবশ্য তার জীবনে একান্ত নিজের বলে এতটুকু সময় আদৌ আছে কিনা সে জানে না। অন্যের নিয়মে বাঁধা তার এই ছোট্ট জীবনে অন্যের শাশন ই চলে। সেখানে তার ব্যাক্তিগত সময় বলতে কিছু নেই, আছে শুধু সারাদিনের হাঁড় ভাঙা খাটুনী আর পাতিলের তলায় পড়ে থাকা খাবারের উচ্ছিষ্ট অংশ।
চলবে,,,।