সন্ধ্যে নামার আগে পর্ব-০৬

0
460

#সন্ধ্যে_নামার_আগে
#লেখিকা_সুমাইয়া_জাহান
#পর্ব_০৬

(১১)

নিশুতি রাতের আকাশে মেঘে ঢাকা একফালি চাঁদ তখনো ধরনীর বুকে আলো বিকিয়ে যাচ্ছে। চারপাশে শুনশান নীরবতা আর ঝিঁঝিঁপোকা ডাক সব মিলিয়ে গা ছমছমে একটা পরিবেশ। রুমাইসা একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে খিড়কি দরজা দিয়ে বেড়িয়ে এসে পথে নামলো। নিকষকালো আধারি ঠেলে মোমবাতির টিমটিমে আলো জোনাকিপোকার মতো এক চিলতে আলো ছড়িয়ে পথিককে তার পথের দিশা দেখিয়ে যাচ্ছে।

হাঁটতে হাঁটতে একটা খোলা জায়গায় এসে দাঁড়াল রুমাইসা। সমুখে শুধু বড় বড় গাছ আর ঝোপঝাড়। রুমাইসা হাতের মোমবাতিটা নামিয়ে রেখে আরো দুই পা সামনে এগিয়ে গেলো। এখান থেকে মায়ের কবরটা অবছা দেখা যায়। রুমাইসা চাঁদের শান্ত আলোয় মায়ের কবর খানা দুচোখ ভরে দেখতে লাগলো। দেখতে দেখতে তার চোখের কোণ ঘেঁষে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে। আজ তার বড্ড মন খারাপ। অজান্তেই তার মন বারবার মায়ের জন্য হু হু করে উঠছে। মায়ের দেয়া শেষ স্মৃতিটুকুও জীবন থেকে হারিয়ে গেলো। নিলুফার বেগম শুধু আজ তার মায়ের গয়না কেড়ে নেন নি বরং রুমাইসার হৃদপিন্ডটা শরীর থেকে ছিনিয়ে নিয়েছেন। ভাবতে ভাবতে রুমাইসার চোখ ঝাপসা হয়ে এলো।

” মা আমি তোমার শেষ স্মৃতিটুকু আমি ধরে রাখতে পারি নি আমায় ক্ষমা করো। দাদীর দেয়া তোমার সীতাহারটা আর আমার গলায় পড়া হলো না। তুমি তাতে কষ্ট পেয়ো না মা! দেখবে একদিন আমি নিজেই একটা সীতাহার গড়িয়ে নিবো।”
বলে রুমাইসা হাটু গেড়ে মাটিতে বসে পড়ে। মাথার উপর দিয়ে দুই তিনটা বাদুর ডানা ঝাপটে উড়ে চলে গেলো রুমাইসা আজ আর তাদের ভয় পেলো না। অন্তঃকরণ আজ বেদনাহত তাই বাহিরের কোনো ভয় আজ তাকে ছুঁতে পারছে না।

খানিকটা সময় পেড়িয়ে গেলে রুমাইসা ধীরেধীরে উঠে আসে। মোমবাতি হাতে তুলে বাড়ির দিকে যাবার জন্য পা বাড়ায় আর ঠিক সে মুহূর্তে সে অনুভব করলো কেউ যেনো তাকে নিভৃতে অবলোকন করছে।

(১২)

গ্রামের মেঠো পথ ধরে হাঁটছে স্মরণ। নিশ্চিন্দপুর গ্রামের বাহিরে একজন মুমূর্ষ রুগীকে দেখতে এসেছিলো সে। কিন্তু ফিরতে যে এত রাত হবে বুঝতে পারে নি। পেন্টের পকেটে একহাত গুঁজে সারিসারি তালগাছ ঘেরা গ্রামের রাস্তা দিয়ে হাঁটছে সে। ঘন কুয়াশা আর চাঁদের শীতল আলোয় এক অন্যরকম পরিবেশ তৈরী হয়েছে চারপাশে। বেশ লাগছে স্মরণের। প্রকৃতিতে শীত শীত ভাব দূরে কোথাও থেকে শিউলি ফুলের সুবাস ভেসে আসছে। স্মরণ বুক ভরে বাতাসের সাথে সে সুবাস গ্রহন করে। শিউলি ফুলের সুবাস গ্রাহন করতে তার মনে পড়লো রুনাইসা নামক মেয়েটির লিখা একটুকরো চিঠির কথা। চিঠির ভাঁজে ভাঁজে শিউলি ফুলের সুবাস ছড়াচ্ছিল। টানা হাতের লিখায় মেয়েটি পরম যত্নে বাবার অসুখের কথা লিখে গেছে চিঠিতে। অজান্তেই স্মরণে ঠোঁট দুটো প্রসারিত হয়ে উঠে। মেয়েটা প্রচণ্ড বুদ্ধিমতী না হয় এমন কাজ সচরাচর কেউ করতে পারে না।

নিশ্চিন্দপুর পৌঁছানো পূর্বে তাকে অলকানন্দপুর গ্রাম অতিক্রম করতে হবে। এই গ্রামে প্রবেশ করলেই স্মরণে ভেতর অদ্ভুত রকমের অনুভূতি হয়। স্মরণ বুঝে উঠতে পারে না এমন অনুভূতি হওয়ার কারণ তবে এটা বুঝতে পারে গ্রামে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে সে একপ্রকার প্রশান্তি অনুভব করে। স্মরণ পূর্বে কখনো গ্রামটিতে এসেছিলো বলে মনে পড়ে না তবে যতবারই সে অলকানন্দপুর গ্রাম অতিক্রাম করেছে মনে হয়েছে যেনো কোনো অদৃশ্য শক্তি তাকে খুব করে টানছে। যেনো তাকে ঘিরে কতশত বছরের পুরোনো স্মৃতি জড়িয়ে আছে গ্রামটিতে।

হাঁটতে হাঁটতে একটা জায়গায় এসে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে স্মরণ। দূরে ঝোপের কাছে মোমবাতির টিমটিমে আলো জ্বলতে দেখা যাচ্ছে। স্মরণ ক্ষণকাল সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে কিছু বুঝার চেষ্টা করলো তারপর কোনো ভাবনা চিন্তা ছাড়াই শসান ঘাট পেরিয়ে কিছুটা সামনে এগিয়ে এলো।
মোমবাতির স্বল্প আলোয় তৎক্ষণাৎ কিছু ঠাহর করতে না পারলেও ক্ষণিকের মাঝে একজোড়া চোখ মোমের আলোয় ভেসে উঠতে দেখলো স্মরণ। কুহেলিকার ঘন আবরণ আর ক্ষীণ আলোয় দূর থেকে রমনীর মুখ দেখা না গেলেও অশ্রুসিক্ত দুটি ঠিকই দেখা গেলো। অজান্তেই স্মরণের অন্তঃকরণে দ্রুত হাওয়া বইতে শুরু করলো। অজানা কারণেই তার হৃদ স্পন্দন থেমে যেতে চাইলো। এই তো সেই আঁখিজোড়া! যা দেখা মাত্রই স্মরণের বুকে উথালপাতাল ঢেউ উঠেছিলো। স্মরণ বেশিসময় সে দিকে তাকিয়ে থাকতে পারলো না অনিচ্ছাকৃতপূর্বক চোখ সরিয়ে নিলো।
তিমির আধারিতে এমন শুনশান নীরব জায়গায় অপরিচিত কোনো রমনীকে লুকিয়ে দেখা ঘোর পাপ করার মতো অপরাধ। স্মরণ নিজ স্বভাবের বহির্ভূত কাজ করে নিজের অন্তঃকরণে নিজেকেই ধিক্কার দিতে লাগলো।

“কে ওখানে?”
একটা রিনিরিনে মেয়েলী কন্ঠস্বর কানে বাজতে সচকিত হয়ে উঠলো স্মরণ। ধরা পড়ে গেলো কিনা ভাবতে ভাবতে সেখান থেকে সরে পথে এসে দাঁড়াল। ইশশ! আর একটু হলেই ধরা পড়ে যাচ্ছিলো সে মনে করে প্রশস্ত শ্বাস ছাড়লো স্মরণ।

(১৩)

বাড়ি ফিরে কলপাড়ে এসে অজু করে ঘরে দু’রাকাত নামাজ আদায় করলো রুমাইসা। রীমা টেবিলে বসে বই পড়ছিলো। রুমাইসাকে নামাজ আদায় করে উঠতে দেখে গলা নামিয়ে জিজ্ঞাস করলো,
“এত রাতে কোথায় গিয়েছিলে আপা? আম্মা তোমাকে খুঁজছিলো আমি কোনো রকম বুঝিয়ে অন্য কথায় কথা ঘুরিয়ে নিয়েছি।”

“মায়ের কাছে গিয়েছিলাম।”
রুমাইসার কথা শুনে চোখ বড় বড় করে তাকায় রিমা। যে মেয়ে অন্ধকার এত ভয় পায় সে নাকি রাতের বেলায় একা একা কবরস্থানে গিয়েছে! কথাটা যেনো বিশ্বাস করতে পারলো না রিমা। সে আবারো অবাক হওয়ার ভঙ্গিমায় বলল,

“সত্যিই তুমি এত রাতে কবরস্থান গিয়েছিলে? ভয় করে নি তোমার।”

রিমার কথায় ঠোঁটে মলিন হাসি টেনে বলল রুমাইসা,

“মায়ের কাছে যেতে কোনোকালেই আমার ভয় করে নি।”

রিমা অবাক হয়ে রুমাইসাকে দেখে। দেখে তার কষ্ট হয় সে জানে আজ এত দিন পর কেনো তার আপা কবরস্থানে গিয়েছিলো।

রুমাইসা জায়নামাজ রেখে বই নিয়ে বসে টেবিলে।
তাকে মন দিয়ে পড়াশুনা করতে হবে বড় মানুষ হতে হবে। বাবার বলা ছোট বেলার সেই কথা আজ বড্ড বেশি মনে পড়ছে। সেদিন যে কথাগুলোর অর্থ সে বুঝতে পারে নি আজ সেগুলো সে বুঝতে পারে। বাবার বলা প্রতিটা কথা সে মনে নাড়াচাড়া করতে থাকে।

বাবার কথা মনে পড়তেই রুমাইসা ব্যাস্ত হয়ে উঠে। ডাক্তার কি বলেছিলো সেটা তার জানা ই হয় নি। সারাদিন এত কর্মব্যস্ততার পর নিজের জন্য এতটুকু সময় পায় রুমাইসা আর এই সময় টুকুও আজকাল নিলুফার অগোচরে বাবার সেবায় ব্যয় করে।

রুমাইসা বই বন্ধ করে বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। ঘর থেকে বেড়িয়ে যাবার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালে রিমা তাকে বাঁধা দিয়ে বলল,

“বাবার কাছে যাচ্ছো আপা?”

“হ্যাঁ,কেনো?”

“যেয়ো না। বাবা মায়ের সাথে ঝগড়া করেছে এই নিয়ে মা রাগ করে ঘরে দরজা আটকে বসে আছে।”

রিমার কথা শুনে আকাশ থেকে পড়লো রুমাইসা। এই এতকিছু কখন ঘটলো বুঝতে না পেরে রিমার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো। রিমা কোনো ভণিতা না করেই বলল, সে যখন খিড়কির দরজা দিয়ে বেড়িয়ে যায় তার কিছু সময় পর করিম সাহেব বাড়ি ফেরেন। বাড়ি ফিরে তিনি মাকে বিষণ্ণ মনে ঘরের দরজার কাছে বসে থাকতে দেখে প্রশ্ন করেন কি হয়েছে? বৃদ্ধা তখন ছেলেকে রুমানার রেখে যাওয়া শেষ আমানত টুকু হারিয়ে যাবার কথা বলেন।
ঘরে ঢুকে করিম সাহেব যখন দেখলেন নিলুফার সেসব গয়না পড়ে আছেন তখনি তিনি প্রশ্ন ছুড়ে দেন নিলুফারকে। এই নিয়ে তাদের মাঝে নানান বাকবিতণ্ডা হয় পরিশেষে নিলুফার রাগে টিকতে না পেরে ঘরে দরজা আটকে দেন।

সব শুনে রুমাইসা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। এই পরিস্থিতিতে তার কিছুই করার নেই। সে এবাড়িতে থাকে ঠিকই তবে বাড়ির কোনো ব্যাপারে তার কথা বলার অধিকার নেই।

চলবে,,,।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here