সন্ধ্যে নামার আগে পর্ব-০৭

0
438

#সন্ধ্যে_নামার_আগে
#পর্ব_০৭
#লেখিকা_সুমাইয়া_জাহান

১৪)

রুমাইসাদের বাড়ির উঠোনে হঠাৎ করেই মানুষের ছোটখাটো একটা ভিড় জমে গেলো। রুমাইসা রুসুইঘরে চুলায় রান্না চাপিয়েছিল সে সময় বাড়ির উঠোনে কয়েকজন লোককে একসাথে কথা বলতে শুনে কি হয়েছে তা দেখার জন্য সে রসুইঘর থেকে বেরিয়ে আঙ্গিনায় এসে দাঁড়াল।

তিন চারজন লোক ধরাধরি করে করিম সাহেব কে ভ্যানগাড়ি থেকে নামাচ্ছেন। তাদের মাঝে দুজন রুমাইসার শিক্ষক অন্য দুজন অচেনা যুবক।
রুমাইসার চোখ সবার আগে গিয়ে পড়ল অচেনা যুবকদের মাঝে একজনের উপর যে কিনা তার বাবাকে সযত্নে ভ্যান থেকে নামাতে সাহায্য করছে। রুমাইসা তৎক্ষণাৎ কিছুই বুঝতে পারছিলো না। হতবুদ্ধি হয়ে তাকিয়ে আছে বাবার অচেতন শরীরটার দিকে। এ যেনো সে নিজের চোখকে বিশ্বাস করাতে পারছে না। অসাড় হয়ে জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে সে দেখতে পেলো নিলুফার বেগম ভ্যানের সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বিলাপ করছেন। কয়েকজন মহিলা তাকে আগলে ধরে আছেন। রিমা, সমীর দুজনেই নীরব দর্শক তারা কেউই বাবার কাছে যাচ্ছে না।

রুমাইসাকে অসাড় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একজন মহিলা ভিড়ের মাঝখান থেকে এগিয়ে এসে বলল,

“তুই এখানে খাড়ায়া আছোস ক্যান ছেমড়ি। তাড়াতাড়ি বাপের লাইগা বিছানা কর।”

মহিলাটির কথা রুমাইসার কান অবধি পৌঁছাল কিনা কে জানে। সে শুধু অস্ফুটভাবে একটি বাক্যই উচ্চারণ করে বলল,

“বাবা বেঁচে আছেন তো?”

রুমাইসার চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। বুকে চাপা কষ্ট অনুভব করছে সে। ভিতরটা বারবার ধুমড়ে মুচড়ে উঠছে। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে দশ বছর আগেকার চিত্র চোখের সামনে ভেসে উঠতে দেখলো সে।

সময়টা ছিলো শরৎ কালের শেষের দিক। বাতাসে তখন শিউলি ফুলের তীব্র সুবাস ছড়াছড়ি করছে। হিন্দুপাড়া থেকে ক্ষণে ক্ষনে ভেসে আসছে ঢাক আর শাঁখের ধ্বনি। দিন ও রাতের সন্ধিক্ষণে যখন পশ্চিমাকাশ বেগুনী রঙ ধারণ করে ঠিক সে সময়ে রুমাইসাদের বাড়ির উঠোনে এসে থামে একটি কালো কাঁচের আবরণে ঢাকা সফেদ রাঙা গাড়ি। রুমাইসা সবে ঘুম থেকে উঠে সদর দরজায় এসে দাদীর পেছনে আঁচল ধরে দাঁড়াল। লাল নীল লাইট আর সাইরেন বাজানো সফেদ রাঙা গাড়িটি দেখে রুমাইসা অজানা কারণে পুলকিত হয়ে উঠেছিলো। পুলকিত হবেই না বা কেনো এমন গাড়ি তো সে আগে কখনো দেখেনি। রুমাইসা আগ্রহভরে তাকিয়ে দেখছিলো গাড়িটাকে। তার ইচ্ছে হচ্ছিলো ছুটে যায় গাড়ির কাছে কিন্তু কেনো যেনো পা এগোতে চাইলো না।

মনোয়ারা বেগম মুখে আঁচল চেপে কাঁদছিলেন। রুমাইসা অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখে দাদীকে কিন্তু ভেবে পায় না দাদীর কান্নার আসল কারণ।
একটু পর রুমাইসা তার বাবা আর নানীকে দেখলো সফেদ রঙের গাড়িটা থেকে নেমে আসতে। তাদের সাথে তার নানাভাই আর মামাও আছে। রুমাইসা ডেব ডেব করে সে দিকে তাকিয়ে থাকে আর মনে মনে পুলকিত হয়ে ভাবে সাইরেন বাজানো গাড়ি করে বুঝি তার নানাভাই নানী আর মামাকে নিয়ে তাদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছে। কিন্তু পরক্ষণেই তার ভুল ধারণা ভেঙে গেলো যখন সে দেখল গাড়ির ভেতর থেকে একটা খাটিয়া নেমে আসছে আর তাতে মুখ ঢেকে শুয়ে আছে তার মা।

রুমানার মৃত্যুতে কাঁদেনি এমন কেউ ছিলো না সেদিন একমাত্র রুমাইসা ছাড়া। মেয়েটার চোখে কেউ সেদিন এক ফোঁটা জল দেখতে পায় নি। মায়ের মৃত্যুর শোক যেনো মেয়েটাকে পাথর বানিয়ে দিয়েছিলো। আট বছরের ছোট্ট রুমাইসা মায়ের লাশের পাশে বসে ছিলো পুরোটা সময়, কোথাও এক মুহূর্তের জন্য নড়ে নি। রুমানাকে যখন দাফন করার জন্য নিয়ে যাওয়া হলো তখনো কাঁদেনি নি মেয়েটা। দূর থেকে দেখেছিলো বাবা,নানাভাই আর মামা সহ একজন কাঁধে করে তার মাকে নিয়ে যাচ্ছে চিরনিদ্রায় শায়িত করতে।

রুমানাকে কবরে রেখে সবাই যখন যে যার মত বাড়ি ফিরে এলো তখন করিম সাহেব লক্ষ্য করলেন তার মেয়ে রুমাইসাকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। পুরো বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজেও যখন কেউ রুমাইসাকে খুঁজে পেল না তখন রুমাইসার নানাভাই আজমল সাহেব লাইট হাতে বেড়িয়ে পড়লেন নাতনীকে খুঁজতে।

গভীর রাতে কবরস্থানের কাছ থেকে কারো কান্নার শব্দ শুনতে পেয়ে আজমল সাহেব এবং করিম সাহেব দুজনেই লাইট হাতে সে দিকে এগিয়ে যান। তারা যত কবরস্থানের দিকে এগিয়ে গেলেন ততোই কান্নার শব্দটা ঘাঢ় হয়ে কানে আসতে লাগে। কবরস্থানের কাছাকাছি এসে আজমল সাহেব কান্নার শব্দ ঠাহর করে লাইটের আলো সেদিকে ধরেন আর তখনি তিনি দেখতে পান রুমাইসা কবরের পাশে বসে চিৎকার কাঁদছিছে। রুমাইসার কান্নার শব্দ আর্তনাদের মতো শুনাচ্ছিল চারদিকে। সেদিন রুমাইসার কান্না দেখে প্রকৃতিও যেনো কেঁদে উঠেছিলো। হাহাকার করে উঠেছিলো রাতের পরিবেশ।

(১৫)

বাড়িতে প্রবেশ করার সাথে সাথে শিউলি ফুলের কড়া সুবাস এসে স্মরণের নাকে লাগলো। ঠিক সেদিনের চিঠির ভাঁজে পাওয়া সুবাস পুরো বাড়ির উঠোন জুরো মো মো করছে। করিম সাহেবকে ভ্যান থেকে নামিয়ে দেয়ার পর ভ্যান চালকের সাথে কথা বলে তাকে বিদায় দিয়ে ফেরার সময় স্মরণ পুরো বাড়িটাকে একবার দেখলো। বাড়ির অবস্থা বেশ ভালো। বাড়ির চারপাশ ইটের তৈরী দেয়াল ঘেরাও। পুরো বাড়িতে তিনটি দালান ঘর। একটি থাকার একটি কাছারি অন্যটি রসুইঘর। স্মরণ চারদিকটা আরো একবার চোখ বুলিয়ে দেখলো। বেশ সাজানো গুছানো বাড়িটা। নিশ্চই গৃহকর্ত্রী অতি সযত্নে বাড়িটাকে সাজিয়ে গুছিয়ে রেখেছেন।

স্মরণকে বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সাত বছরের একটি ছেলে ঘর থেকে বেড়িয়ে দৌড়ে তার কাছে এলো। টুকটুকে ফর্সা ছেলেটির গাল দুটো রোদে চকচক করছে।

“বাবার জ্ঞান ফিরেছে আপা কইছে আপনেরে ভিতরে আইতে।”

ছেলেটার কথা শুনে স্মরণের ঠোঁট দুটো আপনা আপনি নেচে উঠলো। শুদ্ধ অশুদ্ধ মিলিয়ে কথা বলছে বাচ্চা ছেলেটি। স্মরণ ছেলেটার চুলে নাড়া দিয়ে জিজ্ঞাস করলো,

“করিম সাহেব তোমার বাবা?”

সমীর মাথা দুলিয়ে জবাব দিলো।

“আচ্ছা চলো যাই দেখি উনার এখন কি অবস্থা।”

সমীর আবারো একি ভাবে মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ জানালো। স্মরণ লক্ষ্য করলো সমীর দুই হাত দিয়ে তার মুখ চেপে ধরে আছে আর মাথা দুলিয়ে তার সব কথার উত্তর দিচ্ছে। ব্যাপারটা দেখে স্মরণ কি বুঝলো কে জানে সে সমীরকে তৎক্ষনাৎ কোলে তুলে নিলো। সমীর অবাক হয়ে স্মরণের দিকে ডেব ডেব করে তাকিয়ে আছে।

স্মরণ কিছুটা সময় মৌন থেকে তারপর জিজ্ঞাস করলো,

“তোমার নাম যেনো কি?”

“সমীর।”

“বাহ বেশ ভালো নাম তো। তা কিসে পড় তুমি?”

এবার আর সমীর উত্তর করলো না আগের বারের মতো দুইহাত মুখে চেপে ধরেছে। সমীরের এমন অদ্ভুত আচরণ দেখে বেশ অবাক হলো স্মরণ। সে ব্যাপারটাকে বুঝতে স্বাভাবিক ভাবে বলল,

“তুমি তো বেশ সুন্দর করে কথা বলতে জানো তবে কেনো আমার কথার জবাব দিচ্ছো না?”

এবার সমীর মুখ থেকে হাত সরিয়ে নিলো আর বলল,

“আপা কইছে শুদ্ধ ভাষায় কথা কইতে না হয় আমার কান মলে দিবে। আমি তো শুদ্ধ ভাষাতেই কথা বলি তবুও ক্যান আপা রাগ করে?”

স্মরণ এবার ব্যাপারটা ধরতে পারলে।

“তোমার আপার নাম নিশ্চই রুমাইসা?”

সমীর এবারো মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ জানালো। স্মরণ আর কথা বাড়ালো না সমীরকে কোল থেকে নামিয়ে তার পিছু পিছু চলল।

করিম সাহেবের জ্ঞান ফিরেছে ঠিকই কিন্তু অবস্থা খুব একটা ভালো না। স্মরণ তাকে চেক আপ করে যতটুকু বুঝলো তাতে করিম সাহেবকে অতি দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করা প্রয়োজন। বেশি দেরি হলে হয় তো ভালোমন্দ কিছু একটা ঘটে যেতে পারে। স্মরণের মুখে কথা টা শুনে আবারো বিলাপ জুড়ে দিলো নিলুফার। মনোয়ারা বেগম বার বার তাকে শান্ত হতে বললেও তিনি কিছুতেই শান্ত হতে চাইলেন না। কিছু সময় আগে তিনি করিম সাহেবের অসুস্থতা সম্পর্কে জানতে পেরেছেন। আর জানতে পেরেই তিনি রুমাইসাকে গাল মন্দ করা শুরু করে দিয়েছেন। তার ভাষ্য মতে করিম সাহেবের এই অবস্থার জন্য রুমাইসা দায়ী। রুমাইসা করিম সাহেবের অসুস্থতার কথা জেনেও কেনো জানাল না তাকে।

চলবে,,,।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here