সন্ধ্যে নামার আগে পর্ব-২৬

0
452

#সন্ধ্যে_নামার_আগে
#লেখিকা_সুমাইয়া_জাহান
#পর্ব_২৬

(৬১)

রুমাইসার মেট্রিক পরীক্ষার মাত্র কয়দিন বাকি। করিম সাহেব মারা যাবার বেশ কিছুদিন কেঁটে গেলেও রুমাইসা এখনো গ্রামেই অবস্থান করছে। বাবার রেখে যাওয়া স্মৃতি আর পুত্রশোকে অসুস্থ হয়ে পড়া মনোয়ারা বেগমকে একা রেখে স্মরণের সঙ্গে শহরে ফিরে যাবার তেমন কোনো আগ্রহ সে দেখায় নি। স্মরণ নিজেও খুব একটা জোর করে নি এই ব্যাপারে কারণ সে চায় না রুমাইসার ব্যাক্তিগত সিদ্ধান্তে সে হস্তক্ষেপ করুক। তাছাড়া মেয়েটা পিতৃবিয়োগে যথেষ্ট শোক পেয়েছে এই সময় তার উপর নিজের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়াটা বোকামি। তাছাড়া কয়েকটা দিন বাদে রুমাইসার মেট্রিক পরীক্ষা এই সময় তাকে এতটা চাপে রাখা ঠিক হবে না ভেবেই স্মরণ তাকে রেখে নিজেই একা শহরে ফিরে গেছে।

করিম সাহেবের মৃত্যুর পর থেকে নিলুফার বেগম একেবারেই চুপচাপ হয়ে গেছেন। কারো সাথে খুব একটা বেশি কথা বলেন না তিনি। নিজের মতো একটা ঘরে পড়ে থাকেন। মাঝে মাঝে রিমা কিংবা রুমাইসা গিয়ে তার কি লাগবে না লাগবে জিজ্ঞেস করে আসে। প্রয়োজন ছাড়া তিনি তাদের সাথেও কথা বলতে খুব একটা আগ্রহ দেখান না। রিমা অবশ্য বিষয়টাকে হাল্কাভাবে নিলেও রুমাইসার কাছে সেটা মোটেই সুবিধার মনে হলো না। বেশ কয়েকদিন যাবত সে লক্ষ্য করছে বাড়ির সকলে যখন ঘুমিয়ে পড়ে তখন নিলুফার বেগমের ঘর থেকে কারো কথার আওয়াজ ভেসে আসে। যেহেতু সে অনেকটা রাত জেগে পড়াশুনা করে তাই বিষয়টা আপনা আপনি তার নজড়ে পড়েছে।

প্রতিদিনের মতো আজও রুমাইসা পড়ার টেবিলে বসে বইয়ের পাতা উলট পালট করছে। ঘড়িতে তখন রাত বারোটা কি সাড়ে বারোটা বাজে। নিজের ঘরে হারিকেনের আলো মৃদু বাড়িয়ে সে মনোযোগ দিয়ে বই পড়ছে আর ঠিক সে সময় সে ঘরের বাহিরে কারো চাপা কন্ঠস্বর শুনতে পেলো। কেউ একজন তার ঘরের পাশে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে কথা বলছে। রুমাইসা ক্ষণকাল কান পেতে বুঝার চেষ্টা করলেও তেমন কিছুই সে শুনতে পেলো না। তাই সে বই বন্ধ করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দরজার দিকে এগিয়ে গেলো। দরজার খোলার জন্য সে দুই পায়ের আঙ্গুলে ভর দিয়ে ছিটকিনি খুলতে যাবে তখনি রিমা ঘুম জেগে উঠে বলল,

“আপা এত রাইতে তুমি কই যাও?”

রিমার কথায় কিঞ্চিৎ চমকে উঠলো রুমাইসা। ফিরে দরজার কাছ থেকে সরে এসে রিমার কাছাকাছি গিয়ে বসে গলা নামিয়ে বলল,

“চুপ আসতে কথা বল।”
রিমা কিছুটা অবাক হয়ে রুমাইসার দিকে তাকাতেই রুমাইসা আবার বলল,

“দরজার বাহিরে কাউকে কথা বলতে শুনছিস রিমা?”

রিমা তৎক্ষণাৎ ঘুম থেকে উঠায় কিছু বুঝতে পারলো না তবে ক্ষানিকটা সময় অতিবাহিত হতে সেও ব্যাপারটা লক্ষ্য করলো।

“এত রাতে কে কথা কয় আপা?”

“আমিও সেটা ভাবছি। চল দরজা খুলে দেখি।”
বলে রুমাইসা এগোতে লাগলে রিমা তার ওড়না একপাশ টেনে ধরলো। রিমার কাছ থেকে বাধা পেয়ে রুমাইসা ঘুরে দাঁড়াতেই রিমা বিছানা ছেড়ে নেমে বলল,

“আপা এত রাইতে আমাগো দরজা খোলা উচিৎ হইবো না। একটা কাজ করি চলো আমাগো এই আলমারির পেছনে যে দরজা আছে ওইটার পেছন দিক দিয়ে বাহির হই তাইলে আর কেউ বুঝবার পারবো না।”

“কিন্তু এই দরজাটা তো বন্ধ। তাছাড়া আলমারি সরাতে গেলে অনেকটা দেরি হয়ে যাবে।”

“তাহলে কি করন যায়?”

“আচ্ছা চল দুজন মিলে চেষ্টা করে দেখি আলমারিটা সরানো যায় কিনা।”

রুমাইসার সাথে সাথে রিমাও আলমারি সরানোর চেষ্টা করলো। প্রায় কয়েক মিনিটের চেষ্টায় দুজনই সেটা সরাতে সফল হলো।

“আপা এবার যাই চলো।”

“না দাঁড়া এখন নয়।”

“ক্যান?”

“আমার মনে হয় যে এখানে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল সে এখান থেকে সরে গেছে।”

“তাইলে কি করমু এহন?”

” তুই এখানেই দাঁড়া আমি আসছি।”

“আপা!”

“কিচ্ছু হবে না। আমি এক্ষুনি আসছি।”

বলে রুমাইসা ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলো।

(৬২)

চেয়ারম্যান বাড়ির দোতলার কাছারিঘরের সামনে একটা চেয়ার পেতে বসে আছে স্মরণ। সামনে বিস্তর জুড়ে নিশুতি রাতের আঁধার। আকাশে গুটিকতক তারা টিমটিম করে জ্বলছে। বাতাসে সিগেরেটের দোয়া উড়িয়ে দিতে দিতে স্মরণ পাশে বসে থাকা রমিজকে লক্ষ্য করলো। বেচারা তার থেকে কয়েক হাত দূরে গায়ে চাদর জড়িয়ে পাটিতে বসে ঝিমাচ্ছে। স্মরণ একবার ভাবলো তাকে ডেকে বলবে ভেতরে গিয়ে শুতে কিন্তু পরক্ষণে কি ভেবে আর বলল না।

“রমিজ সাহেব এত কষ্ট করে এত দূর পর্যন্ত না এলেও পারতেন।”

স্মরণের কথায় কিছুটা নড়েচড়ে বসলো রমিজ কিন্তু কিছু বলতে পারলো না। ঘুমের রেশ এখনো তাকে ছেড়ে যায় নি। স্মরণ একবার তার দিকে তাকিয়ে কিঞ্চিৎ হাসলো, বলল,

“ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ুন রমিজ সাহেব। অযথা এখানে বসে শীতে কষ্ট করতে হবে না।”

“না ডাক্তার সাহাব আমি এহানেই ঠিকাছি, আপনে গিয়া ঘরে ঘুমান।”

স্মরণ আর কথা বাড়ালো না অন্ধকার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বসে রইলো। এই তো ঘন্টা দুইয়েক আগে সে নিশ্চিন্দপুর এসে পৌঁছেছে। ভাগ্যক্রমে ট্রেন থেকে নামতেই তার রমিজের সাথে দেখা হলো। রমিজ তাকে স্টেশন দেখে কিছুটা অবাক হয়েছিলো। কাউকে কোনো খবর না দিয়ে হঠাৎ মাঝ রাতে স্মরণের গ্রামে উপস্থিত হওয়ার কারণ প্রথমে বুঝতে না পারলেও কথায় কথায় খানিকটা পর জানতে পারলো। স্মরণ আর কেউ নয় রুমাইসার জন্যই গ্রামে ফিরে এসেছে। মেয়েটাকে সে এখানে একা রেখে গিয়ে খুব একটা স্বস্তি পাচ্ছিলো না। মনের মাঝে অজানা ভয় কাজ করছিলো। তাই সে রাতে হাসপাতাল থেকে ফিরে আর একমুহূর্ত দেরি করে নি গ্রামের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়েছিলো। স্মরণ আসতে আসতে রমিজকে প্রায় সকল কথাই বলে। শহরে যাবার আগে তাকেই সে পরোক্ষভাবে রুমাইসাকে দেখে রাখার দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছিলো।

বারান্দায় বসে থাকতে থাকতে স্মরণের ঘোর লেগে এলো। হঠাৎ উপর থেকে কিছু পড়ার শব্দে চমকে উঠে পাশে তাকাতে দেখলো রমিজ নেই। স্মরণ ইতিউতি করে চারপাশে তাকাতেই সিঁড়ির কাছে কাউকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো। আবছা অন্ধকারে লোকটার ছায়া দেখে সে বলল,

“রমিজ সাহেব ওখানে কি করছেন।”

একটু পর রমিজ গলা খাদে নামিয়ে বলল,

“ডাক্তার সাহাব মনে অয় এইহানে কেউ আইছিলো। আপনে যখন ঘুমে আচ্ছন্ন হইয়া পড়লেন তখন আন্ধার দিয়া কাউরে সিঁড়ি বাইয়া উপরে উইঠা আইতে দেখলাম। আমি জাইগা আছি লক্ষ্য কইরা লাফাইয়া নিচে পড়ছে।”

“এত রাতে এখানে কে আসবে? ভুল দেখেছিলেন নিশ্চই।”

“না ডাক্তার সাহাব ভুল দেহি নাই। আমি আন্ধারে মানুষ দেখলে চিনিবার পারি। এই লোকটা কেডা আমি কিছুডা হইলেও ধরবার পারছি।”

রমিজের কথায় স্মরণ কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়লো। এখন তার সন্দেহটাই যেনো ঠিক বলে মনে হচ্ছে। ভাগ্যিস সে এসে পড়েছিলো না হয় খারাপ কিছুও ঘটতে পারতো।

হারিকেনের আলোয় রমিজ কাছারিঘরের চারপাশ ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে দেখে এলো। স্মরণ ঘরে পায়চারি করতে করতে শেষে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। মাথায় তার হাজারটা চিন্তা, না চাইতেই সে নানান জটিলতায় জড়িয়ে যাচ্ছে। একটা মেয়ের পুরো দায়িত্ব তার কাঁধে। তাকে আগলে রাখা, বিপদ থেকে রক্ষা করা, তার স্বপ্নগুলোকে নিজের করে নেয়া যেনো এখন তার প্রধান কর্তব্যে পরিণত হয়েছে। মাঝে মাঝে মানুষ না চাইতেই কিছু অঘোষিত দায়িত্ব কর্তব্যের শেকলে বাঁধা পড়ে, স্মরণেরও তাই হয়েছে। যে মেয়েটাকে সে কয়েক মাস আগেও চিনতো না, যার সাথে তার পূর্বে কখনো দেখা পর্যন্ত হয় নি সেই মেয়েটার প্রতি যে তার এতটা দায়িত্ববোধ তৈরী হবে কে জানতো। স্মরণ মাঝে মাঝে নিজেই ভেবে পায় না রুমাইসা নামের সদ্য যৌবনে পদার্পণ করা মেয়েটি কেনো তার এতটা জুড়ে জড়িয়ে রয়েছে। কেনোই বা সে বার বার ছুটে আসে তার টানে আর কেনোই বা তাকে আগলে রাখার এত চেষ্টা? কই এর আগে তো তার সাথে এমনটা কখনো ঘটেনি। জীবনে চলার পথে তো কত নারীর সাথেই তার দেখা হয়েছে, বন্ধুত্ব হয়েছে কই তাদের কারো জন্যই তো সে স্বার্থহীনভাবে নিজের সবটুকু দিয়ে আগলে রাখার চেষ্টা করে নি কিংবা তাদের সুখে সুখ অথবা দুঃখে ব্যতীত হয় নি তবে কেনো এই একটি নারীতেই সে তার সকল কিছু উজার করে দিচ্ছে। কেনোই বা তার সকল যন্ত্রণা, কষ্ট নিজের করে নিতে ইচ্ছে করে, না ভেবে পায় না সে।

কাছারিঘরের নিচতলায় এসে রমিজ হাঁক ছেড়ে স্মরণকে ডাকলো। স্মরণ রাশভারী গলায় রমিজকে জিজ্ঞাস করলো,

“কিছু বুঝতে পারলেন রমিজ সাহেব?”

“হ ডাক্তার সাহাব আপনে যেইডা ধারণা করছেন ওইডাই হইছে। তবে আমি ভাবি তার এত সাহস কেমনে হইলো চেয়ারম্যান বাড়িতে আইসা,,,।”

“সে আপনি বুঝবেন না। উপরে উঠে আসুন আজ আর সে এখানে আসবে না তবে আমি যদি ঠিক হই তবে সে অন্য পথে হাঁটতে শুরু করবে। তবে তার আগে আমাকে কাল মিস রুমাইসার সাথে একবার দেখা করতে হবে।”

“কিন্তু আপনে তো কইলেন আপনে রুমাইসার লগে দেখা করবেন না, জানতে দিবেন না যে আপনে এইহানেই আছেন।”

“ডিসিশন চেইঞ্জ করেছি। কালই সকালেই আমরা অলকানন্দপুর যাচ্ছি।”

(৬৩)

বাড়ির পেছনের গেইট দিয়ে কেউ একজন দ্রুত বেড়িয়ে যেতে দেখলে রুমাইসা কিছুটা আড়াল হয়ে বুঝার চেষ্টা করে লোকটা কে। কিন্তু অন্ধকারের আবছা আলোয় সে লোকটাকে চিনতে পারলো না। তার যতদূর ধারণা লোকটা নিলুফার বেগমের ঘর থেকে বেড়িয়ে সোজা বাড়ির পেছনের গেইট দিয়ে বেড়িয়ে গেছেন।

রুমাইসা কিছু সময় সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে পরে অন্ধকারে পা টিপে টিপে নিলুফারের ঘরের দিকে এগিয়ে গেলো। অধিক রাত হলেও নিলুফার বেগমের ঘরে এখনো আলো জ্বলছে। ঘরের কাছাকাছি এসে দরজার কবাট খুলতে গেলেই হঠাৎ চমকে উঠে। নিলুফার বেগম সাদা শাড়ি পরে তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। এত রাতে তাকে নিজের ঘরের সামনে দেখে সন্দেহ ভাজন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে জিজ্ঞাস করে বললেন,

“এত রাইতে তুই এইহানে কি করিস রুমাইসা।”

রুমাইসা নিলুফারকে এভাবে ঘরের বাহিরে দেখে ঘাবড়ে গেলো তাই সে সঙ্গে সঙ্গে কিছু বলতে পারলো না। নিলুফার বেগম তাকে ক্ষীণ দৃষ্টিতে পরখ করে দেখে বললেন,

“এত রাইতে আমার ঘরের সামনে কি তোর।”

“না আসলে তোমাকে দেখতে এসেছিলাম ঘুমিয়েছো কি না, আর কিছু লাগে কি,,,।”

“তোরে এত কইছে কে আমার খবর নিতে? আমি নিজেই নিজের খেয়াল রাখতে পারি আগ বাড়াইয়া তোরে কিছু করতে হইবো না। যা নিজের ঘরে গিয়া ঘুমা।”

রুমাইসা আর কোনো কথা বাড়াল না চুপচাপ নিলুফারের কথা মেনে নিয়ে সেখান থেকে প্রস্থান করলো। তবে তার মনে এখন সন্দেহ টা আরো জোড়াল হয়ে উঠেছে। নিলুফার বেগমের আচরণ তার মোটেই ঠিক লাগছে না। তাছাড়া এত রাতে তিনি না ঘুমিয়ে বাহিরে কি কিরছিলেন আর ওই লোকটাই বা কে যে উনার ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলো?”

চলবে,,,।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here