সন্ধ্যে নামার আগে পর্ব-২৯

0
732

#সন্ধ্যে_নামার_আগে
#লেখিকা_সুমাইয়া_জাহান
#পর্ব_২৯

(৬৭)

শহরে আসার পর থেকেই রুমাইসার জীবনে নতুন বিপত্তির আগমন ঘটলো। আর তার সূত্রপাত হলো স্মরণের মায়ের হাত ধরেই। ভদ্রমহিলা কিছুতেই রুমাইসাকে সহ্য করতে পারেন না। কারণে অকারণে তিনি কাজে কর্মে বুঝিয়ে দেন এই বাড়িতে উনার ছেলে তাকে দয়া করে থাকতে দিয়েছে। অবশ্য রুমাইসা তাতে খুব একটা বেশি কিছু মনে করে না, কারণ ভদ্রমহিলা এমন মনে করা অস্বাভাবিক কিছুই নয়। যেখানে তার আপন মানুষরাই তাকে মানুষ হিসেবে গণ্য করে না। এমন অনাত এতিম একটা মেয়েকে স্মরণ গ্রাম থেকে শহরে নিয়ে এসে নিজের বাড়িতে থাকতে দিয়েছে এমন কি তার পড়াশুনা থেকে শুরু করে যাবতীয় দায়িত্ব সে একাই বহন করছে এসব কিছু পরিবারের অন্য সদস্যরা মেনে নিতে পারলেও ভদ্রমহিলা তা মানতে নারাজ।

এই বাড়ির দোতলার উত্তরে শেষের দিকের ঘরটায় রুমাইসা থাকে আর তার পাশের ঘরটায় অর্শা। অর্শা নিজেও একজন মেডিকেলের ছাত্রী। রুমাইসার সাথে তার খুব ভাব। সময় অসময়ে সে নিজে দায়িত্ব নিয়ে রুমাইসাকে উচ্চতর গণিত পড়ায়। অবশ্য রুমাইসাকে পড়ানোর দায়িত্বটা স্মরণ নিজেই নিয়েছিলো। আলাদা করে কয়েকজন টিউটরও রেখেছিলো বাসায় কিন্তু রুমাইসা টিউটরের কাছে পড়তে আপত্তি জানায়। সে চায় না ওর কারণে স্মরণ কোনো বাড়তি ঝামেলায় পড়ুক।

দেখতে দেখতে অনেকটা সময় অতিবাহিত হয়ে গেলো। রুমাইসার কলেজ জীবন বেশ ভালোই চলছে। স্মরণ যখন সময় পাচ্ছে তখনি বই নিয়ে রুমাইসার পড়া ধরছে। সময়ের সাথে সাথে তাদের বুঝাপড়াটাও বেড়েছে। যদিও স্মরণ নিজের দূর্বলতা রুমাইসার কাছে প্রকাশ করে না তবে ভেতরে ভেতরে সে তাকে প্রচন্ড ভালোবাসে। স্মরণ চায় রুমাইসা আগে ইন্টার পরীক্ষাটা ভালোয় ভালোয় দিক তারপর সে নিজেই তার মনের সকল অনুভূতির কথা রুমাইসার কাছে ব্যক্ত করবে।

প্রতিদিনের ন্যায় আজও স্মরণ হাসপাতাল থেকে এসে সোজা রুমাইসার ঘরের দিকে এগিয়ে গেলো।
রুমাইসা তখন মনোযোগ দিয়ে অংক করছে। স্মরণকে হুট করে ঘরে ডুকতে দেখে সে কিছুটা চমকে উঠলো। স্মরণ সচরাচর তার অনুমতি ব্যাতিত ঘরে ডুকে না অথচ আজ তাকে জিজ্ঞাস না করে ঘরে ডুকে পড়েছে দেখে কিছুটা অবাক হলো সে।

ঘরে ডুকেই স্মরণ সোজা রুমাইসার মুখোমুখি দাঁড়াল। তার হাতে একটা চিঠির খাম। রুমাইসা সরাসরি খামের দিকে একনজর দেখে আবার স্মরণের দিকে তাকালো। স্মরণ চিঠিটা রুমাইসার হাতে দিয়ে বলল,

“গ্রাম থেকে রিমা আপনার নামে চিঠি দিয়েছে। অবশ্য চিঠিটা আরো তিনদিন আগে এসে পৌঁছেছে দারোয়ান সেটা দিতে ভুলে গিয়েছিলো।”

“কি আছে চিঠিতে?’

“খুলেই দেখুন।”
বলে স্মরণ চিঠি রুমাইসার হাতে দিয়ে নিজে একটা চেয়ার টেনে বসলো।

আজ অনেকদিন পর গ্রাম থেকে তার নামে কোনো চিঠি এসেছে। রুমাইসা কাঁপা কাঁপা হস্তে খাম ছিঁড়ে সেটা বের করলো। সে জানে না এই চিঠিতে রিমা কি লিখেছে তবুও চিঠির ভাঁজ খুলতে তার হাত কাঁপছে। সেদিন স্মরণের সঙ্গে গ্রাম ছেড়ে আসার পর থেকে আর কারো সাথেই তার সেভাবে যোগাযোগ হয় নি। মাঝে মাঝে রিমা দুই একটা চিঠি পাঠালেও পরবর্তীতে সেটাও বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তবে রমিজের সঙ্গে স্মরণের মাঝে মাঝে আলাপ হয় কিন্তু কি কথা হয় স্মরণ কখনো সেটা তাকে জানায় নি। আর রুমাইসা নিজেও জানার এতটা আগ্রহ দেখায় নি কখনো।

চিঠি খুলে রুমাইসা পুরো চিঠিতে চোখ বুলিয়ে নিলো। স্মরণ কিছুটা অদূরে চেয়ারে বসে গালে হাত রেখে রুমাইসার দিকে তাকিয়ে রইলো। এবাড়িতে আসার পরও যে রুমাইসা খুব একটা ভালো নেই স্মরণ সেটা বুঝতে পারে। অবশ্য তার কারণ যে একমাত্র তার মা এটা কারো অজানা নয়। মেয়েটার পোড়া কপাল কোথাও গিয়ে এতটুকু সুখ পায় নি কখনো। প্রথমে নিজের বাড়ি তারপর নিজের আপন মামার কাছ থেকে আর এখন স্মরণের মায়ের কাছে প্রতিনিয়ত কথা শুনতে হয়। অবশ্য স্মরণ তাতে প্রতিবাদ করেছে কতবার, দুবার বাড়ি ছেড়ে রুমাইসাকে নিয়ে আলাদা বাসায় উঠেছিলো কিন্তু তাতেও রুমাইসার আপত্তি করে। সে চায় না তার কারণে মা ছেলের মাঝে দূরত্ব তৈরি হোক। আসলে কিছু কিছু মানুষের ভাগ্যটা বোধ হয় এমনি হয় আর রুমাইসা তাদের দলেরই একজন।

চিঠি পড়ে রুমাইসা ধপ করে খাটের এক কোণে বসে পড়লো। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে স্মরণকে উদ্দেশ্য করে বলল,

“দাদী মারা গেছেন আপনি সেটা জানতেন?”

“আপনার কি মনে হয় মিস রুমাইসা আমি সেটা জেনেও আপনার কাছ থেকে গোপন করেছি?”

“রমিজ নিশ্চই আপনাকে জানিয়েছিলো।”

“রমিজ সাহেব আমাকে জানিয়েছিলেন তবে সেটা আপনার দাদী মারা যাবার দুদিন পর। সে চিঠি আজ এসে পৌঁছেছে।”
বলেই স্মরণ রুমাইসার দিকে আরেকটা খাম এগিয়ে দিলো। রুমাইসা সেটা হাতে নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ধীরেধীরে আপন মানুষগুলো সবাই তাকে ছেড়ে চলে গেছে। অবশ্য তার আপন বলতে গুটিকয়েক জনই আছে। তাদের মধ্যে বাবা তো কিছু মাস আগেই তাকে ছেড়ে গেছে এবার দাদীও চলে গেলো। নিজেকে বড্ড অশহায় বলে মনে হচ্ছে রুমাইসার। পৃথিবীতে তার আর আপন বলতে কেউ রইলো না। রক্তের সম্পর্ক গুলো থেকেও নেই। অন্তঃকরণে সে চাপা কষ্ট অনুভব করলো কন্তু সেটা কাউকে বুঝতে দিলো। স্মরণ স্থির চাহনিতে রুমাইসকে দেখছে। মেয়েটা এবারো আরেকটা ভালোবাসার মানুষকে হারিয়ে ফেলেছে অথচ কি ভাগ্য সে মানুষটার মৃত্যু কালে সে তার পাশে থাকতে পারে নি এমন কি মারা যাবার সপ্তাহ খানেক পর জানতে পেরেছে।

চোখের কোণে লেগে থাকা শেষ অশ্রুবিন্দু মুছে রুমাইসা উঠে দাঁড়ায়। এখন আর তার হারানোর মতো কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। জীবনে সে অনেক হারিয়েছে। পিছুটান যা ছিলো তার আর কোনো অস্তিত্ব নেই। নিজেকে সে এগিয়ে নিয়ে যাবে অনেক দূর। যে মানুষটা সব সময় ছায়ার মতো তাত পাশে আছে তার জন্য হলেও এখন সে অনেক দূর এগিয়ে যেতে চায়।

(৬৮)

প্রায় দুবছর অতিক্রম হয়ে গেছে। এর মাঝে রিমা এবং সমীর দুজনেই বড় হয়ে উঠেছে। আজ রিমার বিয়ে। ঘরে কয়েকজন আত্নীয় স্বজন আর রিমার নানার বাড়ির লোকজন। নিলুফার বেগম একা হাতে বিয়ের সব দায়িত্ব পালন করছেন। দুপুরের পর বরযাত্রী আসবে তাই রিমার মামা নুরুজ্জামান এদিক ওদিক ছুটোছুটি করছে। বার বার সমীরকে ডেকে অস্থির করে তুলছে এই বুঝি বরযাত্রী এসে গেলো বলে। সমীরের আজ বিশাল দায়িত্ব তাই তো সে একবার ছুটে মায়ের কাছে যাচ্ছে তো আরেক বার মামার ডাকে সাড়া দিচ্ছে। অবশ্য বাড়িতে বিয়ে হলেও সেখানে আলাদা কোনো জাঁকজমকতা নেই। ঘরোয়া ভাবেই রিমার বিয়ের অনুষ্ঠান করা হচ্ছে। করিম সাহেবের যতটুকু জায়গা সম্পত্তি ছিলো তার অর্ধেকটাই নিলুফার আগে বিক্রি করে দিয়েছেন। এখন অবশিষ্ট যা আছে তা দিয়ে আর সংসার সামলিয়ে দুই ছেলে মেয়েকে মানুষ করা যাচ্ছে না। তাই তো তিনি রিমার বিয়ে দিয়ে কিছুটা হালকা হতে চান।পাত্র নিলুফারের বড় ভাই কামরুজ্জামানের শ্যালক এর ছেলে। উচ্চবংশ টাকা পয়সারও তেমন অভাব নেই তাই তো নিলুফার বেগম উঠে পড়ে লেগেছেন মেয়েকে বিয়ে দিতে।

রিমার বিয়ের অনুষ্ঠান ভালোভাবেই সম্পন্ন হলো। ছেলে ইঞ্জিনিয়ার। বিদেশে থাকে, বিয়ের পর রিমাকেও সঙ্গে করে নিয়ে যাবে। নিলুফার বেগম তাতে যেনো খুশিতে আত্নহারা হয়ে পড়েন। আজ রুমাইসার কথা মনে করে মনে মনে তিনি তিরষ্কার করে বলল,

“বাপের মুখে চুনকালি মাইখা কি করলি তুই। পরপুরুষের হাত ধইরা গ্রাম ছাইড়া গেলি এখন কই তোর সেই নাগর তোরে বিয়া করছে? করবো না করবো না। আমার মাইয়ারে দেখ যেমন ঘর পাইছে এমন বরও আর তুই ছিঃ।”
মনে মনে ছিঃ বলে একদলা থুথু ফেললেন তিনি। নিজের মেয়েকে ভালো ঘরে বিয়ে দিতে পেরে যেনো রুমাইসার উপর প্রতিশোধ নিতে পেরেছেন এমনি ভাবভঙ্গি তার।

বিকেলের পর রিমাকে নিয়ে বরযাত্রী চলে গেলো। ধীরেধীরে আত্নীয় স্বজনরাও বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। সন্ধ্যার পর নিলুফার ওযু সেরে জায়নামাজে দাঁড়ালেন। পুরো বাড়ি আজ বড্ড ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। রিমার কথা মনে করে একদপা চোখের পানি ফেলে সেজদায় লুটিয়ে পড়লেন তিনি।

সন্ধ্যার পর হারিকেনের আলোয় পড়তে বসেছে সমীর। গ্রামে বিদ্যুৎ খুব একটা বেশি থাকে না তাই হারিকেনের আলোই তাদের ভরসা। সমীর বই খুলে এদিক ওদিক পাতা উল্টাচ্ছে। পড়ায় কিছুতেই মন বসছে না তার। রিমাকে খুব মনে পড়ছে। গত সন্ধ্যায়ও দুজন এক সাথে বই পড়েছে অথচ আজ? সমীরের চোখ দুটো অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠলো। তাদের ভরা সংসারটা কেমন খালি হয়ে গেলো। আজ অনেকদিন বাদে তার বড় আপার কথাও মনে পড়ছে। এমন সন্ধ্যার সময় তার বড় আপা তাকে আর রিমাকে নিয়ে পড়তে বসতো যদিও সে নিজে খুব একটা পড়ার সময় পেতো না তবুও রোজ সন্ধ্যায় তাদের দুই ভাইবোনকে পড়তে বসাতো। ছোটবেলার স্মৃতিগুলো চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগলো সমীরের। হঠাৎ করেই তার ইচ্ছে হলো আজ আপাকে একটা চিঠি লিখবে কিন্তু মহূর্তে সেই ইচ্ছাটা আবার দমে গেলো কারণ তার আপা কোথায় থাকে সেটা সে জানে না। চিঠিই বা কার ঠিকানায় পাঠাবে? হঠাৎ করেই তার রমিজের কথা মনে পড়লো। আর মনে পড়তেই খুশিতে চোখ দুটো চকচক করে উঠলো। এই গ্রামের কেউ জানে না রুমাইসা কোথায় থাকে একমাত্র রমিজ ছাড়া। শুধুমাত্র রমিজই আছে যে তাকে তার আপার ঠিকানা দিতে পারে। এসব ভাবতে ভাবতে সমীর ভেতরে ভেতরে পুলকিত অনুভব করলো। খাতা কলম নিয়ে বসে পড়ল চিঠি লিখতে।

শ্রদ্ধেয় আপা,
শুরুতেই আমার সালাম নিবা। তুমি কেমন আছো? আল্লাহর রহমতে আমরা সবাই ভালো আছি। আজ ছোট আপার বিয়ে হয়েছে, সন্ধ্যের আগে বরযাত্রী আপাকে নিয়া গেছে। বাড়িটা আজ বড্ড ফাঁকা ফাঁকা লাগছে আপা। তোমারেও খুব মনে পড়ছে। আচ্ছা আপা তোমার মনে পড়ে তখন আমি খুব ছোট? তুমি আমারে আর ছোট আপারে নিয়া সন্ধ্যার পর পড়তে বসাইতা। আব্বা স্কুল থেইকা ফিরা আইসা আমাদের তিন ভাইবোনরে কাছে নিয়া বসতেন। সারাদিন কি হইলো না হইলো সব আব্বারে বলতাম কি সুন্দরই না ছিলো দিনগুলা। আজ আব্বাও নাই তুমিও নাই। দাদীও আমাদের ছাইড়া চইলা গেছে। পুরা বাড়িতে মা আর আমি। আজ সবাইরে খুব মনে পড়তাছে। আচ্ছা তোমরো কি আমার মতো মনে পড়ে? জানো আপা শেহওয়ার ভাই হঠাৎ কইরা কই জানি চইলা গেছিলো বছর ঘুরতে আবার ফিরা আইসা রাত্রি আপারে বিয়া করছে। তারপর আবার রাত্রি আপারে নিয়া গ্রাম থেইকা চইলা গেলো। তোমার মামাও আর আসে না, আম্মার লগে কি নিয়া জানি বনাবনি হয় নাই তার। আম্মার রোজ তারে গালাগালি করে। তিনি নাকি আমাগো জায়গা সম্পত্তি দখল কইরা নিয়া গেছে। তুমি কি আর গ্রামে ফিরা আইবা না? কাইল রমিজ চাচার কাছ থেইকা তোমার ঠিকানা নিমু তাই আইজই তোমারে চিঠি লিখা রাখছি। তুমি যদি চিঠি হাতে পাও তাইলে তার উত্তর দিয়ো। আমি অপেক্ষায় থাকমু তোমার চিঠির।
ইতি তোমার ভাই
সমীর।

চিঠি শেষ করে সমীর হারিকেনের আলো কমিয়ে নিলো। বইয়ের ভেতর সযত্নে চিঠিটা লুকিয়ে রেখে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো।

পুরো বাড়িতে দুটি মাত্র মানুষ। নামাজ শেষে জায়নামাজ ভাজ করে আলনায় রেখে বিছানায় এসে বসলেন নিলুফার বেগম। বিছানার কাছে কাঠের টুলের উপর কুপি জ্বলছে। কেরোসিনের অভাবে কুপির আগুন নিভু নিভু করছে অথচ সেদিকে নিলুফারের খবর নেই। আজ অনেকদিন পর তিনি স্বামীর শূন্যতা অনুভব করছেন। একটা সময় ছেলে, মেয়ে, স্বামী, শ্বাশুড়িকে নিয়ে ভরা সংসার ছিলো তার। আর আজ পুরো বাড়িটা মানবহীন বলে মনে হচ্ছে। মেয়েটাকে বিদায় করার পর থেকে দু-দন্ড শান্তি পাচ্ছেন না তিনি। বুকের একপাশ টা খালি খালি লাগছে। একাকীত্ব যেনো গ্রাস করে নিতে চায় সব।

(৬৯)

সমীরের চিঠি হাতে পেয়ে রুমাইসা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। আজ কত বছর পর সে আপন কারো লিখা চিঠি হাতে পেলো। সমীরটাও অনেক বড় হয়ে গেছে। নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে শিখেছে সে। রিমার বিয়ে হয়ে গেছে শুনে কিছুটা খারাপ লাগলেও খুশি হলো। একমাত্র ছোটবোন টা এখন পরের ঘরে। অজান্তেই রুমাইসার চোখ ভিজে উঠলো। তবে রাত্রির কথা ভেবে খুব খারাপ লাগলো রুমাইসার। শেহওয়ারের মতো একজন মানুষকে সে কিভাবে বিয়ে করলো ভেবে পায় না। লোকটা সত্যি কি তাকে ভালো রাখতে পারবে? কেনোই বা তাকেই রাত্রির বিয়ে করতে হলো সব কিছু জেনেও। এসব প্রশ্নের উত্তর রুমাইসার অজানা। জগতে সব প্রশ্নের উত্তর সব সময় থাকে না তেমনি এই প্রশ্নের উত্তরও তার পাওয়া হলো না।

চিঠি ভাঁজ করে ধীরে ধীরে ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে স্মরণের ঘরের দিকে এগিয়ে গেলো রুমাইসা। নিজের ঘরে বসে কিছু ফাইল ঘাটাঘাটি করছে স্মরণ। রুনাইসার উপস্থিতি বুঝতে পেরে মাথা না তুলেই বলল,

“ভাই কি লিখল চিঠিতে?”

রুমাইসা নির্জীব গলায় বলল,

“রিমার বিয়ের কথা লিখেছে।”

স্মরণ বিজ্ঞের মতো মাথা দুলালো কিন্তু মুখে কিছু বলল না। রুমাইসা অন্যমনষ্ক ভাবে আবারো বলল,

“শেহওয়ার ভাই রাত্রিকে বিয়ে করেছেন সেটা আপনি জানতেন?”

“শুনেছিলাম রমিজের কাছে।”

“আমাকে তো বলেন নি?”

“সব কথা বলতে হয় না মিস রুমাইসা। আর কিছু কথা অজানা থাকাই শ্রেয় বলে মনে হয় না?”

রুমাইসা এবার প্রশস্ত শ্বাস ফেললো। গ্রাম ছেড়ে এসেছে প্রায় চার বছর হয়ে গেলো। এখন সে ডাক্তারী পড়ছে। এই এতগুলো সময় কিভাবে কেটে গেলো যেনো কেউই বুঝতে পারলো না। রুমাইসা এখন আর স্মরণের বাড়িতে থাকে না। স্মরণের সাথে আলাদা একটি বাংলো বাড়িতে থাকে। রুমাইসার মেডিকেল কলেজ থেকে বাড়িটা বেশি দূরে নয় তাই স্মরণ নিজেদের থাকার জন্য এই বাড়িটাই পছন্দ করেছে।

পুরো বাংলো বাড়ির দালানটিতে দুটি মাত্র থাকার ঘর। একটিতে স্মরণ অন্যটিতে রুমাইসা। তাছাড়া পুরো বাড়িটাই খালি। স্মরণ এখনো আগের মতোই আছে। নিজের অনুভূতিগুলো কিছুতে প্রকাশ করতে চায় না রুমাইসার কাছে যদিও রুমাইসার প্রতি তার ভালোবাসা পাহাড়সম। রুমাইসা এখনো স্মরণকে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। লোকটার প্রতি তার ভালোবাসা ক্রমে ক্রমে বাড়ছে অথচ প্রকাশ করার মতো সাহস তার নেই। স্মরণের চোখে চোখ রেখে ভালোবাসার অনুভূতি গুলো বুঝানো তার ক্ষমতার বাহিরে। তবে তাবলে যে স্মরণ সেটা বুঝতে পারে না তা নয়। স্মরণ সেদিনই সব বুঝতে পেরেছিলো যেদিন হলুদের সাজে মাঝরাতে রুমাইসা তার ঘরে গিয়ে উঠেছিলো। অথচ সব বুঝতে পেরেও বারবার সে তাকে ফিরিয়ে দিয়েছে। তবে পাশে থেকেছে সব সময়। আসলে ভালোবাসা জিনিসটা যে সব সময় প্রকাশ করতে হবে এমনটা নয়, মাঝে মাঝে সেটা প্রকাশ না করেও অপর মানুষটাকে মন প্রাণ উজাড় করে ভালোবাসা যায়। অঘোষিত প্রেম গুলো যেমন বড্ড পোড়ায় তেমনি তার গভীরতাও থাকে অনেক। এরা দুজন দুজনকে ভালোবাসলেও কেউ কাউকে বলা হয় নি।

চলবে,,,।
আগামী পর্বে গল্পটা শেষ হয়ে যাবে। গল্পটা আপনাদের কেমন লেগেছে জানাবেন। ভুল ত্রুটি থাকলে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here