– তুমি কি করছো?
হঠাৎ করে ছোট্ট কন্ঠের এমন প্রশ্নে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় আসমা বেগম। বিকেল বেলায় ইফতার বানাচ্ছিলো, একা হাতে সব সামলাতে ব্যস্ততার শেষ নেই। অন্যদিন মেয়েটা তবু একটু আধটু হেল্প করে কিন্তু আজ কি এক এ্যাসাইনমেন্টের কাজ করছে দরজা বন্ধ করে। ছেলেটার বাইরে কাজ আছে। ইফতার সেখানেই করবে। ওদের বাবা ফিরবে আরেকটু পরে। এমন সময় এই প্রশ্নে চমকে গেলেও সামলে নেয়।
– ডিম চপ বানাচ্ছি বাবা। তুমি কে? কোথায় থাকো?
– আমি খোকা, সে কি তুমি আমাকে চেনো না? আমি ঐ যে ঐ বাসায় থাকি।
হাত দিয়ে পাশের ফ্লাট দেখায় ছেলেটা। কতোইবা বয়স হবে, এই পাঁচ ছয়।
আসমা বুঝতে পারে পাশের ফ্লাটে নতুন ভাড়াটে এসেছে তাদেরই বাচ্চা। কাজের বুয়াটা কাজ শেষ করে বের হয়ে গেছে। আসমার দরজা বন্ধ করতে মনে নেই। সেই ফাঁকেই এই খোজার আগমন।
– খোকা, তুমি ডিম চপ খাবে?
– হুম খাবো তো!
জামার বোতাম খুঁটতে খুঁটতে খোকা জবাব দেয়।
এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে ঢোকে জয়া, খোকার মা।
– এ কী খোকা, তুই এখানে আর আমি তোকে খুঁজে হয়রান হচ্ছি। আর বলবেন না, খুব দুরন্ত ছেলেটা। আমি সামলাতেই পারি না।
বিব্রত হয়ে আসমা’কে বলে জয়া। চুলা বন্ধ করে জয়ার দিকে ঘোরে আসমা। পূর্ণদৃষ্টিতে তাকে দেখে। বেশ ভরা ভরা গোল মুখ, সিঁথিতে চওড়া করে সিঁদুর দেয়া। হাতে শাখা। দেখতে অনেকটা দেবীর মতো। কিন্তু খোকার মা হিসেবে বয়স’টা বেশ কম।
– খোকার তো কোন দোষ নেই, দোষ আমাদের। পাশের ফ্লাটে কে আসলো, সেটার খোঁজ নেয়া অবশ্যই উচিৎ ছিলো। আমরা সেটা করি নি কিন্তু খোকা এসে ঠিকই পরিচিত হয়েছে।
– আসলে আমরা কালই উঠেছি, এখনো গোছগাছ করে উঠতে পারি নি। এই খোকা চল, বাসায় চল।
– না আমি ডিম চপ খাবো। এই মাসিমা আরো কি কি বানাচ্ছে আমি খাবো।
জিদ ধরে দাঁড়িয়ে থাকে খোকা, জয়া আরো বিব্রত হয়। এতোদিন ও শ্বশুর শাশুড়ির সাথেই একত্রে থাকতো। স্বামীর পোস্টিং এর জন্য এখানে আসা। ঠাকুরদা আর ঠাম্মির আদরে খোকা বড্ড একরোখা।
– খোকা তো ঠিকই বলেছে। ও এখন ডিমচপ খাবে, পেঁয়াজু খাবে, জিলাপি খাবে। এখন কেন যাবে?
খোকার মাথায় সস্নেহে হাত বুলাতে বুলাতে বলে উঠে আসমা। এরপর জয়ার হাত ধরে আশ্বস্ত করে, কোন সমস্যা নেই। ইফতারের পরে আসমা রেখে আসবে।
সেদিন আসমাদের টেবিলে নতুন একটা চেয়ার যোগ হয়, যেখানে কথার তুবড়ি ছুটায় একজন।
আসমার ছেলে মেয়ে দু’টোয় বড় হয়ে গিয়েছে। নিজ নিজ কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। আর ঘরেই তো থাকে না সারাদিন, নীরব ঘরে একাই থাকে আসমা। সেই নীরব ঘর দিনে দিনে সরব হতে শুরু করে খোকার নানা রকম কথায়।
– মাসিমা তুমি লাড্ডু বানাতে পারো?
– না বাবা পারি না।
– তাহলে কি পারো?
– বিরিয়ানি বানাতে পারি, খাবা?
– খাবো, আজই আমার জন্য বিরিয়ানি বানাও।
বাদশাহী হুকুম যেন। বাচ্চাটা গম্ভীর মুখে আদেশ করে। আসমা হেসে ফেলে। নিজের ছেলে মেয়ে দু’টো খুব তাড়াতাড়িই যেন বড় হয়ে গেলো! নাকে মুখে দু’টো গুঁজে বের হয়ে পড়ে। কোন কোন দিন খায়ও না, বাইরে কি সব ছাইপাঁশ খায় কি জানে! এখন ওদের কতো বন্ধু বান্ধব হয়েছে। বাইরে হোটেল রেস্তোরাঁ তো কম নেই! কোন খাবারের জন্য বায়না ধরে না এমনকী কোন খাবার ভালো হলো কি মন্দ সেটাও বলা বন্ধ করে দিয়েছে। খেতে হয় তাই খায় যেন! মাঝে মধ্যে খুব মন খারাপ হয় আসমার।
– ছেলে মেয়ে দুটো বড্ড কেমন হয়ে যাচ্ছো দেখেছো? ডেকে ডেকে খাওয়াতে হয়। কোন রকম মুখে দিয়ে চলে যায়। দুটো ভালো মন্দ কথা বলে না। কি এমন ব্যস্ততা বুঝি না!
স্বামীর সাথে মাঝে মাঝেই ক্ষোভ প্রকাশ করে আসমা।
– এটাই জীবন আসমা। ওরা বড় হচ্ছে, ওদের গন্ডি বড় হচ্ছে। আমরা বুড়ো হচ্ছি, ওদের চোখে অবুঝ, সেকেলে হয়ে যাচ্ছি। মেনে নিতে হবে, যতো তাড়াতাড়ি মানতে পারবে, ততোই ভালো।
বাস্তবতা বোঝায় আসমার স্বামী রাশেদ।
আসমার তবু মন মানতে চায় না। এই সেদিন পর্যন্ত ছেলেটা আঁচল ধরে ঘুর ঘুর করতো। আর এখন একটা দুটো কথায় বলে উঠে- ও তুমি বুঝবে না!
আসমার চোখ ফেটে জল আসতে চায়। যখন ওরা কথা বলতে পারতো না, তখন ওদের ক্ষুধা, ঘুম, কষ্ট সব বুঝতো আসমা আর এখন মুখে বললেও আসমা বুঝবে না সে এমন কী কঠিন কথা!
(চলবে)
#সম্পর্ক