#সর্বনাশিনী
#সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি
১।
অর্ধ নগ্ন অবস্থায় একটি মেয়ে দৌঁড়ে যাচ্ছে। আলু থালু অবস্থা। পড়নের এক টুকরো কাপড়ের মাঝে-ও হাজারটা ছিদ্র। মেয়েটির একটি হাত ঝুলে গেছে হয়তো ভেঙ্গে গেছে, পা ছেছড়িয়ে যতটুকু পালানো যায়… তাই চেষ্টা। রাতের আঁধার হৈ হৈ করে বাঁড়ছে। তাল মিলিয়েছে গগনবিদারী চিৎকার আকাশের, মেয়েটির চোখের জলের মতো অঝড়েই ঝরে যাওয়ার তীব্র ইচ্ছে। চারিদিকে হা হা কার। ডাক শুধু ঝিঁঝি পোকা আর রাস্তার ধারের নেকড়ে কুকুরদের। মেয়েটি বার বার পিছু ফিরে চাইছে, কেউ আসচ্ছে না তো? ভেবেই আরো ছুটে চলেছে। ঠিক তখনি বাজ পড়লো, পৃথিবী জুড়ে হলো আলোর ফলক। মেয়েটির মুখের আদল খানি এবার দেখা গেলো, কি ভয়ানক সেই চেহারা যেনো কোনো হিংস্র মানুষের ক্ষোভ মিটিয়েছে ছুরির প্রতিটি আঘাতে। হঠাৎ কিছু আওয়াজ ভেসে এলো,
” ওই, ওই ওইতো, দেখ পালাচ্ছে ধর ধর জলদি কর, কারো হাতে পড়লে, বস আমাদের মেরে ফেলবে!”
রাস্তার নেকড়েদের চেয়ে ভয়ানক সেই কন্ঠগুলো ভেসে আসচ্ছে থেকে থেকো, মেয়েটি চিৎকার করতে চাইছে। কিন্তু হায়…. চাইলেও তো পাড়ছে না একটি শব্দ করতে… কাউকে বলতে,
” বাচা-ও আমাকে, আমি মরতে চাই না। আমি বাঁচতে চাই। আমাকে মেরো না। আমি বাঁচতে চাই!”
কিন্তু পারলো না। কন্ঠের ভোকাল কর্ড যে নষ্ট করে দিয়েছে । মেয়েটি ফুপিয়ে উঠলো। কালো পোশাকধারী লোকগুলো একে বাড়ে কাছে-ই চলে এলো । মেয়েটি সাহস সঞ্চয় করলো। ডান হাত দিয়ে ঝুলে যাওয়া বাম হাতটি ধরে আরো ছুটতে লাগলো। মাঝ রাতের এই হাইওয়ে রোডে বড় বড় গাড়ি শাই শাই করে চলে যাচ্ছে। বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটা শরীরের মাঝে পড়তেই মেয়েটি শিউরে উঠছে, যেন বরফ। ঠিক তখনি ধাম… করে শব্দ হলো। একটি গাড়ি দাঁড়িয়ে গেলো। মেয়েটি ছিটকে গিয়ে পড়লো রাস্তার অপর প্রান্তে…. গড় গড় করে রক্ত গড়িয়ে ভেসে গেলো রাস্তা…..
একটি লোক গাড়ি থেকে দৌড়ে বের হলো, মেয়েটির কাছে এসে চেচিয়ে বলল গাড়ির ভিতরের লোকটিকে,
” স্যার একটি মেয়ে, বেঁচে আছে!”
কালো কাচের জানালাটি নেমে গেলো। ভিতরে বসে থাকা সুদর্শন এক যুবক বলল,
” নিয়ে এসো!”
লোকটি মাথা নাড়ালো। কোলে তুলে নিলো মেয়েটিকে। লোকটির কেন জানি মায়া হলো, এতো হালকা পাতলা মেয়েটি, এত আধারে রক্ত মাখা মুখটি ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেলো না। মেয়েটিকে গাড়ির পিছনের সিটে শুয়ে দিলো। এবং জায়গায় ত্যাগ করলো। রাতের আঁধারে মিলিয়ে গেলো কালো বিএমডব্লিউটি….! পিছনে রয়ে গেলো কিছু জঘন্য অতীত। কিছু দলা পাকানো রক্ত, কিছু কুৎসিত মানুষ। মেয়েটির পিছনে দৌঁড়ে আসা লোকগুলো সবটুকু ঘটনা দেখলো। তারপর ফোন বের করে একটি কল করলো,
” বস। মারা গেছে।”
ওপাশ থেকে স্বস্তির শ্বাস ফেলার আওয়াজ ভেসে এলো। দুটি শব্দ বের হলো ওপর প্রান্তের মুঠোফোনধারী ব্যক্তির মুখ থেকে,
” মরলো তাহলে সর্বনাশিনী …!”
কিছুক্ষণ পর…..
হসপিটালের বাহিরে এম্বুলেন্সের চিৎকার, কারো কান্নার আহাজারি, নতুন মেহমানের আগমনে খুশির ঝলক তো অপর দিকে পরলোকে চলে যায় চিরতরে মানুষের জন্য কান্না। একটি আলাদা-ই পরিবেশ, দুনিয়া। একটি কালো বিএমডব্লিউ উপস্থিত হলো এমন একটি দুনিয়ায়। লম্বা লম্বা পা ফেলে কোলে নিয়ে ছুটলো সেই যুবকটি। পিছন থেকে ভেসে এলো একটি কন্ঠ,
” তরুন স্যার এখানে!”
তারুন মাথা নাড়িয়ে শায় দিলো। দৌঁড়ে গেলো সে রুমটিতে। বিছানার মধ্যে শুয়ে দিতেই মেয়েটির চেহারা ভেসে উঠলো। চেহারা দেখে আতকে উঠলো, ডাক্তার, তরুন আর তার অ্যাসিস্ট্যান্ট মুরাদ। যেন কেউ চাকু দিয়ে কেঁটেছে মুখের চামড়া। পুরো ধংস করে দিয়েছে মুখে আদল। ডাক্তার মেয়েটির এই হাল দেখে আহত হলো, সঙ্গে সঙ্গে অপারেশনের কথা বলল,
” তরুন স্যার মেয়েটির অবস্থা বেশি ভালো না। তার উপর চেহারার যেই অবস্থা আই থীংক প্লাস্টিক সার্জারি করা লাগবে। তার জন্য একটি চেহারা লাগবে আমাদের!”
তরুন কিছু ভাবলো। মেয়েটিকে দেখে তার বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে উঠলো। কিছু একটা ভেবে ফোন বের করে একটি ছবি এগিয়ে দিলো। ডাক্তার মাথা নাড়িয়ে কাজে লেগে পড়লো। তরুন অপারেশন থিয়েটার বাহিরে বসার জায়গায় চোখ বুঝে বসলো। সারা গায়ে রক্তে মাথা। তরুনের কাছে এগিয়ে এসে মুরাদ বলল,
” স্যার আপনি যে মেডামের ছবি দিলেন!”
তরুন কিছু বলল না। চুপ রইলো। মুরাদ বুঝলো হয়তো তার স্যার কোনো কিছু নিয়ে গভীর ভাবে ভাবছে।
ঘন্টা তিনেক পর…..
” স্যার পেশেন্ট আউট ওফ ডেঞ্জার। তবে..! ”
” তবে?”
” তার বাম হাত আর বাম পা ভেঙে গেছে। তার মাথায়-ও অনেক ব্যথা পেয়েছে। হতেই পারে সে সব ভুলে গেছে, আবার না!”
তরুন শুধু মাথা নাড়ালো। মুখের মাঝে এখনো ভাবলেশহীন ছাপ। যেন এতে তার কিছু যায় আসে না…। এক ঝলক কবিনের দিকে তাকালো তরুন। বড় বড় সরঞ্জামের ভি আই পি কেবিনটিতে সাদাচাদরে মোড়ানো মেয়েটির দিকে। পুরো শরীরে বেন্ডেজ। তরুনকে এভাবে অপলক চুপ করে থাকতে দেখে ডাক্তার জিজ্ঞেস করলেন,
” স্যার হো ইজ সি?”
” মাই ইয়ঙ্গার সিস্টার। ”
ডাক্তার অবাক হয়ে শুধু তাকিয়ে রইলো। পরবর্তী আর একটি কথা-ও বলল না। যদি-ও অনেক প্রশ্ন সে জানতে চাইছিলো… তবু-ও চুপ রইলো।
তার কিছু দিন পর…।।
মেয়েটি খানিকটা সুস্থ হলেও হাতে পায়ের বেন্ডেজ খুলবে আরো মাসখানেক পর। আজ মেয়েটির মুখের বেন্ডেজ খুলতে যাচ্ছে। তরুন কেবিনের ভিতর বসে আছে। পাশেই দাঁড়িয়ে আছে মুরাদ। কিছুটা ইতস্তত বোধ করছে সে। ডাক্তার মেয়েটির মুখের বেন্ডেজ খুলে দিলো। মেয়েটি ধীরে ধীরে চাইলো। সামনের আয়নায় নিজের আদল দেখে-ও চুপ করে বসে রইলো। যেন নিথর দেহখানি। কিছুক্ষণ পর ভেসে এলো একটি পুরুষলী কন্ঠ,
” তোমার নাম কি?”
” স্নেহা।”
একটি কর্কস কন্ঠ ভেসে এলো যেন। তরুন ডাক্তারের দিকে তাকালো। ডাক্তার বলল,
” অনেক বেশি ঝাল জাতীয় কিছু উনার কন্ঠনালীর ভোকাল কর্ড খুব খারাপ ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যা ঠিক হতে কিছুটা সময় লাগবে।”
তরুন মাথা নাড়ালো। আবার প্রশ্ন করলো,
” তোমার এই অবস্থা কিভাবে হলো!”
স্নেহা ফিকে হাসলো। বলল,
” কাউকে অতিরিক্ত ভালোবাসার ফল!”
তরুন সহ রুমের ভিতরে থাকা সকলেই শিউরে উঠলো। কাউকে ভালোবাসার জন্য কেউ কি এতটা নির্মম ভাবে নির্যাতন? তরুন দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। বলল,
” আমি তোমাকে সাহায্য করতে চাই।”
স্নেহা হাসলো। তরুন স্নেহার হাসি দেখে ভ্রু কুচকালো। বলল,
” হাসছো যে?”
স্নেহা চকিতে বলল,
” আমার কাছে কি চাই আপনার?”
তরুন বলল,
” তুমি কিভাবে বুঝলে আমার কিছু চাই?”
স্নেহার ঠোঁটের কোনের হাসি চওড়া হলো। তারপর ছোট একটা শ্বাস টেনে বলল,
” এই দুনিয়ায় কেউ কাউকে বিনামূল্যে সাহায্য করে না স্যার। স্বার্থ ছাড়া কেউ কাউকে খোঁজে না। ঠিক তেমনি স্বার্থ আছে বলেই আপনি এখানে!”
তরুন মাথা নাড়লো। বলল,
” গুড আইকিউ। বাই দ্যা ওয়ে। তোমার মুখে যার আদল সে আমার বোনের”
চমকালো স্নেহা। ঠিক তখনি পাশের টিভি বিশ্রী শব্দ করে কোলোহল নষ্ট করলো। শুরু হলো চ্যানেল ৭১ এর সংবাদ। ভেসে উঠলো একটি মুখ। ভেসে এলো সজ্জিত রমণীর সংবাদ বার্তার কোমল কন্ঠ,
” রিচেস্ট এলিজিব্যাল ব্যাচেলর দিলশাদ আমরিন সম্পর্কে নতুন রিউমারস, বিয়ে করতে চলেছেন খুব শীঘ্রই। ”
এই টুকু শুনেই স্নেহার চোখ ছলছল করে উঠলেও তাচ্ছিল্যের হাসি ঠোঁটে ফুঁটে উঠলো। স্নেহার চোখের দিকে তাকিয়ে তরুন সেদিকে তাকিয়ে বলল,
” হোয়াট হ্যাপেন্ড?ইউ নো হিম?”
স্নেহা ঠোঁটের কোনের হাসিটি আরো তুচ্ছতাচ্ছিল্য মাখিয়ে বলল,
” ইয়েস। আই নো হিম। হি ইজ মাই সো কোল্ড হাসবেন্ড! ”
তরুণ কিছুটা অবাক হলো।কিন্তু কিছু বলল না। বলল শুধু স্নেহা,
” দিলশাদ নাম হলেও এই ব্যক্তির ভিতরে দিল, হৃদয় বলতে কিছু নেই। এই ব্যক্তি হৃদয়হীন, এক হিংস্র মানব পশু।”
তরুন কাছে এসে দাঁড়ালো স্নেহার। মাথার চুলের মাঝে পরম যত্নে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। শক্ত পক্ত হয়ে থাকা স্নেহার চোখের জল গড় গড়িয়ে পড়তে লাগলো। না পেরে হুহু করে কেঁদে উঠলো। ঝাপটে ধরলো তরুণকে। তরুন টিভির দিকে তাকিয়ে রইলো। সুদর্শন দীর্ঘ আর চওড়া বুক, মাসকুলার বডি৷ তরুন বলল,
” ডোন্ট ক্রায়। আই ইউল হেল্প ইউ। বাট…!”
স্নেহা মাথা তুলে তাকালো। তরুন স্নেহার চোখের জল টুকু মুছে দিয়ে বলল,
” তোমাকে আমার বোন হয়ে থাকতে হবে। এবং নাটক করে যেতে হবে!”
স্নেহা কিছু বুঝলো না। শুধু তাকিয়ে রইলো। তরুন আবার বলল,
” তোমার গল্প শুনতে চাই।”
স্নেহা তরুনের বুক থেকে মাথা তুললো। চোখের জলটুকু মুছে বলল,
” একজন অনাথের আবার গল্প হয় নাকি?”
” অনাথ!”
” হে! অনাথ।খুব ছোট থাকতেই আমার মা-বাবা মারা যায়।”
তরুনের বুকের মাঝে ব্যাথা অনুভব করলো। স্নেহার হাতে হাত রেখে বলল,
” আজ থেকে তোমার বাবা-মা এবং ভাই সবাই হবে!”
স্নেহা তরুনের দিকে তাকালো। তরুন মাথা নাড়লো। তার ঠিক দু দিন পর…..স্নেহা একটি বড় বাংলো বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো। গাড়ি থেকে নামতেই…..
চলবে,
আপনাদের সাড়া পেলে লিখবো। নতুন থীম মাথায় আসলো তাই আর কি লিখা…