#সর্বনাশিনী
#সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি
১৬।
স্নেহার জীবনের কষ্ট শুরু হয়েছিলো, যেদিন তার বাবা এক কার এক্সিডেন্টে মারা যায়। যদিও অনাথ আশ্রমের সুপার ভাইজার এটিই তাকে বলেছে,,
” বড় রাস্তার ধারের বড় একটা ট্রাকের সাথে ধাক্কা খায় স্নেহার বাবা-মার গাড়ি, এবং খাইয়ে পড়ে যায়। তুমি জানি কিভাবে গাড়ি থেকে ছিটকে পড়। আমরা সেখানেই কুড়িয়ে পেয়েছি তোমাকে।”
স্নেহা ছোট থেকেই এই সত্যিটা শুনে এসেছে। বাবা-মার স্মৃতি বলতে তার চোখে আবছায়া দুজন নর-নারীর প্রতিছবি ঘোলা হয়ে ভেসে উঠে। স্নেহা তাতেই সন্তুষ্ট ছিলো। অনাথ আশ্রমের কষ্টের মাঝেও মিষ্টি অনুভূতি ছিলো, ছিলো আনন্দময় মুহুর্ত। স্নেহার সেখানে সব থেকে প্রিয় আপু ছিলো। নাম ছিলো ইরিনা। ঠিক বড় বোনের মতো আগলে রাখতো স্নেহাকে।অথচ স্নেহার থেকে দুব বছরেরই বড় সে। স্নেহাকে নিয়েই ছিলো ইরিনার শুরু আর শেষ। কিন্তু সেও একদিন অনাথ আশ্রম ছেড়ে চলে যায়। স্নেহা এর পর আর তার কোনো খোঁজ পায়নি। তবে একবার তাদের সুপার ভাইজার তার ছবি দেখিয়েছিলো। বলেছিল অনেক বড় ঘরের এক মাত্র সন্তান হিসেবে আছে সে। হয়তো প্রিয় মানুষ গুলো এভাবেই হারিয়ে যায় স্নেহার জীবন থেকে। প্রথমে বাবা-মা, তারপর ইরিনা আর তারপর.. দিলশাদ। স্নেহার বুক চিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো। লাভ ফ্যারি রেস্টুরেন্টের সুইমিং পুল এড়িয়াতে নির্জন একটা টেবিলে বসে আছে স্নেহা। হাত একটি জুসের মগ। জীবনের ২০ টা বছর পাড়ি দিয়ে আজ ২১ এ পড়েছে। নিজের জন্মদিনের সময়টুকু একাই বসে কাটিয়ে দিচ্ছে। টিক টিক করে ঘড়ির কাঁটা ১২ টায় এসে ঠেকলো। টেবিলের সামনে থাকা ছোট একটি কেকের উপর টিমটিম করে জ্বলা হলদে আলো ফু দিয়ে নিভিয়ে দিলো স্নেহা। কান্নারত কন্ঠ নিজেকে নিজেই সমর্থণ করলো,
” হ্যাপি, হ্যাপি বার্থ ডে স্নেহা!”
বলেই মুখের ভিতর ছোট একটি কেকের পিস তুলে নিলো। নিজের পেটের মাঝে হাত বুলিয়ে বলল,
” বেবি, আপনি জানেন? আজ আমার বার্থডে।আম্মুর সাথে তুমিও উপভোগ করো কেক। খুব মজা তাই না,? বেবি, তুমি আমাকে ছেড়ে কখনো যেও না, তাহলে এই শূন্য পৃথিবীতে আমি মৃত লাশ হয়ে যাবো! আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসবো। বাবা-মা দু’জনের ভালোবাসা দিবো।”
স্নেহা হাসলো। সেই মুহূর্তে একজন ওয়েটার এসে একটি ট্রে নিয়ে দাঁড়ালো তার টেবিলের সামনে। স্নেহা প্রশ্ন চোখে তাকাতেই, ওয়েটার হাসি মুখে বলল,
” ম্যাম আজ একজন কাস্টমারের ওয়াইফের বার্থ ডে তাই উনি সবার সাথে কেক খাচ্ছেন। ”
স্নেহা অবাক হলো। সাথে খুশি। এমন ভাগ্যবান ক’জন হয়? স্নেহা গ্রহণ করলো। সেই যুগলকে দেখার প্রবল ইচ্ছে লুকাতে না পেরে বলল,
” আপনি কি বলতে পারেন? উনারা কোন টেবিলে বসে? আমি এমন একজন মানুষকে ধন্যবাদ আর শুভকামনা দিতাম।”
ওয়েটার ভিতরের একটি টেবিলের দিকে ইশারা করলো। স্নেহা সেদিকে তাকাতেই তার চোখ যেন ছানাবড়া। ধক করে উঠলো। একাকি বসে আছে দিলশাদ। হাতে ছোট একটি ছবি। যার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে। স্নেহা না চাইতেও কিছুটা কাছে গিয়ে থেমে গেলো। দিলশাদের মৃদু কথা শুনে,
” হ্যাপি বার্থডে স্নেহা। আই মিস ইউ, আই লাভ ইউ, প্লিজ কাম ব্যাক!”
দিলশাদ চোখ বুঝলো। চোখের কোনে তার চিকচিক করছে জলো রাশি। স্নেহার বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো। আজ পাঁচ দিন পর দেখছে দিলশাদকে। মনে হচ্ছে তার বয়স ১০ বছর বেশি হয়ে গেছে। গোছালো মানুষটা আজকে এলোমেলো। দাঁড়ি হয়তো বেড়েছে কিছুটা। চুল গুলোও পড়েছে কঁপালে। স্নেহার বুকের ভিতরটা ভাড় হয়ে গেলো। সেদিন সেহেরকে উনি সকলের সামনে এক লাথি বসিয়েছিলো পেটে। তারপর টেনে হিছড়ে মাটিতে ফেলে এলো পাথাড়ি মেরেই চলেছিলো। সেহেরের ফর্সা শরীর ক্ষত বিক্ষত করতে ২ সেকেন্ড ভাবেনি দিলশাদ। দিলশাদের এমন কাজে সবাই হতভম্ব হয়ে গেছিলো। দিলশাদকে টেনে তার বাবা আর কিছু গার্ডস সরিয়ে নিয়ে ছিলো। সেই আধমরা অবস্থাতেই সেহেরকে পুলিশের হাতে তুলে দেয়া হয়। মেয়ের এত শত পাপ কর্ম দেখে তালুকদার বংশ হতভম্ব। চেয়েও মেয়েকে বাঁচাতে পারেনি। স্নেহার কানে সব এসেছিলো। স্নেহা হা করে শ্বাস নিলো। এবং পিছনে ফিরে চলে যেতে নিতেই, কারো বুকের সাথে ধাক্কা খেলো। মাথা তুলে তাকাতেই, মাহাদের ফেকাসে মুখটি ভেসে উঠলো। স্নেহা নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
“মাহাদ আপনি এখানে?”
” আন্টি পাঠিয়েছেন তোমায় খুঁজতে। টেনশন করছেন উনি!”
তারপর মাহাদ পিছনে ফিরে দিলশাদকে এক পলক দেখলো। লোকটি থেকে সেতো কম কিছু না। তাহলে কেন তার আকৃতা তাকে এক বার ভালো করে চেয়েও দেখে না। এতটা ইগনোর কেনো? মাহাদের হিংসে হয়, বড্ড হিংসে হয়। মাহাদ কিছুটা শক্ত কন্ঠে বলল,
” আকৃতা পাস্ট ইজ পাস্ট। তুমি তোমার অতীতে স্নেহা হলেও এখন কিন্তু তুমি আকৃতা। কেন নিজের অতীত ভুলে এগিয়ে যাচ্ছো না?”
স্নেহা বলল,
” আমার চেহারা পাল্টেছে মাহাদ। দেহো টা না, মনটা না। কিছু অনুভূতি, কিছু স্মৃতি, কিছু মানুষ কখনো ভুলা যায় না। ”
মাহাদের শরীরে রাগে রি রি করে উঠলো। স্নেহার বাহু ডোড়ে চেপে ধরে বলল,
” আকৃতা তুমি এখন শুধুই আকৃতা। বুঝলে?”
স্নেহা ব্যথায় কুঁকড়ে উঠলো। আশ্চর্যবোধক চিন্হটা মুখে ঝুলিয়ে বলল,
” মি: মাহাদ? করছেনটা কি? ছাড়ুন? আমি ব্যথা পাচ্ছি। কি চাইছেন টা আপনি বলুন তো? প্লিজ লেট মি গো!”
মাহাদ ছেড়ে দিলো। নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলো,
“আকৃতা ? আমি তোমার বাচ্চার বাবা হতে চাই, দিবে কি একটা সুযোগ? ”
স্নেহা চমকালো। মাহাদের আকুলতা ভরা কন্ঠ শুনে স্নেহা মাহাদের দিকে তাকালো। মাহাদের চোখ ভরা আশা দেখে স্নেহার কষ্ট লাগলো। আজ যদি সত্যি আকৃতা থাকতো? তাহলে মাহাতে এই কেয়ারিং সাইডটা দেখে বোধহয় খুব খুশিই হতো। কিন্তু স্নেহা ভাবলেশহীন ভাবে রইলো। ওকে দেখে এই মুহুর্তে বোঝা যাচ্ছে না! কি উত্তর দিবে? তাকে কি মাহাদকে একটা সুযোগ দিয়া উচিত? নাকি নিজের সন্তানকে নিয়েই বাকিটা জীবন পাড় করে দিয়া উচিত?
—————–
ঘন কালো কুচকুচে একটি অন্ধকার ঘর, আলো বলতে কিছুই নেই। সেহের চেচিয়ে উঠলো,,
” হেল্প, প্লিজ হেল্প। কেউ আছো?”
কোনো সাড়াশব্দ নেই। সেহের ভয়ে কাচুমাচু হয়ে যাচ্ছে। হুট করেই কিছু একটা তার কোলে উঠে পড়তেই সেহের আবারো চিৎকার করলো। পরক্ষণেই বুঝতে পারলো এই ঘরটিতে অনেক গুলো ইঁদুরের বসবাস। সেহের ছুটাছুটি করতে শুরু করলো। আঁধারের মাঝে এদিক সেদিক বেজে থুমথাম পড়ে যাচ্ছে। সেহের কিছুতেই বুঝতে পারছে না, সে তো জেলে ছিলো, এমন একটি কামড়ায় কিভাবে এলো সে? ঠিক কিছুক্ষণ পর সেহেরের ভাবনা চিন্তার বাহিরে গিয়ে দরজাটি খুলে গেলো। আলোর ঝলক আসতেই সেহের চোখ বুঝে নিলো। তখনি কিছু নেকড়ে কুকুরের ডাক শুনে সেহের ঘাবড়ে গেলো। লোকটিকে কিছু বলার পূর্বেই কুকুর ঘুলোকে ছেড়ে দিয়ে আবারো দরজা বন্ধ করে দিলো লোকটি। ভিতর থেকে ভেসে আসতে লাগলো সেহেরের গগনবিদারী চিৎকার। বাহিরেই রোলিং চেয়ারে বসে দিলশাদ এই চিৎকার শুনে তার কানকে আরাম দিচ্ছে। আশেপাশে দাঁড়ানো লোক গুলো তাদের বসের ভাবলেশহীন মুখ দেখে অবাক হচ্ছে। লোকটি কতটা নির্দয়? এভাবে একটি মেয়েকে শাস্তি দিচ্ছে, অথচ কঁপালে এক ফোঁটা ভাজ নেই। দিলশাদের অ্যাসিস্ট্যান্ট মনে মনে ভেবেই পাচ্ছে না, এই হিংস্র মানুষটিকে, কিভাবে মেয়েরা ভালোবাসে, কিভাবে তার প্রেমে হাবুডুবু খায়? কিভাবে?
—————
তারুন আজ দেশে ফিরেছে। লোকটির গম্ভীরতা একে বারেই দিলশাদের মতো। এই দুই ব্যাক্তির ভিতরে কি চলে বোঝা বড় মুশকিল। স্নেহা তারুনের রুমের সামনে গিয়ে নক করলো,
” ভাই, আসবো?”
তারুনে হ্যাঁ বলতেই স্নেহা ভিতরে চলে গেলো। তারুনকে দেখে স্নেহার খারাপ লাগলো, যাকে ভালোবাসলো, সেই ব্যক্তিটির জন্য এখনো বসে আছে। শেখ বাড়ির মানুষ জন চেয়েও ছেলেটিকে বিয়ে করাতে পারেনি। এবার তো সকলেই হাড় মেনে বসে আছে। অথচ লোকটি তার পরিবারকে কতটাই না ভালোবাসে। স্নেহা গলা ঝাড়লো,
” ভাই আকৃতা এখন কেমন আছে?”
তারুন ফাইলে মুখ গুঁজে ছিলো। স্নেহার মুখটির দিকে তাকালো এবার। ঠিক যেন তার বোনটি দাঁড়িয়ে আছে। তারুন এবার জানালার দিকে তাকালো। কলমটি ফাইলের উপর রেখে বলল,
” সে এখন ভালো আছে, তবে..!”
” তবে?”
তারুন সুপ্তপর্ণে শ্বাস লুকিয়ে ফেললো,
” ও আমাদের কাউকে চিনতে পারছে না।”
স্নেহা বলল,
” ভাই আকৃতাকে নিয়ে আসো এখানে, দেখবে পরিবারের মাঝে থাকলে সব ঠিক হবে!”
তারুন বলল,
” তুমি কি তাই চাও।” জানো তো? ও আসলে কি হবে?”
স্নেহা মাথা নাড়লো,
” আমি বাবা-মাকে সব সত্য বলে দিতে চাই।”
তারুন মাথা হেলিয়ে চোখ বুঝলো। বলল,
” তাহলে তুমি সত্যি দেশ ছাড়ছো?”
স্নেহা খানিক চুপ রইলো। এই পরিবারের মানুষ গুলো তাকে কতটা ভালোবেসেছে, সে কখনো ভুলবে না, তবে নিজের অস্তিত্বটা কি তা সে কিভাবে ভুলে যাবে? দীর্ঘ পাঁচ বছর পর আকৃতা চোখ খুলেছে। কখনো না কখনো সে তো চাইবে তার পরিবারকে? তারুন এত দিন সত্যিটা লুকিয়ে গেছে, কারণ আকৃতা কখনোই নাকি কোমা থেকে বের হবে না বলেছিলো ডাক্তাররা। তাই তো এতদিন সবাইকে মিথ্যা কাহিনি বলেছে তারুন। কিন্তু এখন? স্নেহা তো পরগাছা। প্রতিবারের মতো এবারো, তার প্রিয় মানুষ গুলোকে ছেড়ে দিতে হবে। স্নেহা নিজেকে শক্ত করলো। হাসি মুখে বলল,
” একদিন তো যেতেই হতো। ”
তারুন বলল,
” স্নেহা, এভাবে বলো না। মনে রেখো, এই পরিবার তোমার। এই পরিবারের মেয়ে হয়েই থাকবে আজীবন। ”
স্নেহা প্রতি উত্তরে আসলো। বলল,
” মনে থাকবে!”
তারুন স্নেহার যাওয়ার দিক তাকিয়ে রইলো। তাহলে কি এখানেই শেষ হচ্ছে সর্বনাশিনীর কাহিনী?এখানেই কি শেষ স্নেহা আর দিলশাদের ভালোবাসার। স্নেহা কি সত্যি চলে যাচ্ছে সব কিছু থেকে দূরে? দিলশাদ কখনো কি জানবে? তার বাচ্চার কথা? নাকি স্নেহার মতোই অনাথ ভাবে মানুষ হবে তার বাচ্চাটা? কি হবে এর পর??