#সর্বনাশিনী
#সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি
৫।
একটা বছর… ১২ টি মাস, ৩৬৫ টি দিনের মাঝে ছটি মাস-ও সুন্দর করে সংসার করা হয়নি স্নেহার। বিয়ের দ্বিতীয় দিন শরীরের তীব্র ব্যথা নিয়ে জাগ্রত হয়। মরীর পরিত্যক্ত রক্তের শুকিয়ে যাওয়া গন্ধ আর ঘরটির ভিতরের বাতাবরণ ভেপসা গরমের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। স্নেহা বিছানা থেকে ধীরে পায়ে গায়ে চাদর টেনে উঠে দাঁড়ালো। বিছানার চাদরের রক্তাক্ত অবস্থা দেখে ভয়ে আত্মকে উঠলো স্নেহা। হু হু করে কেঁদে উঠলো। পা দুটি সমানে কেঁপে যাচ্ছে তার। তল পেটের তীব্র ব্যথা আর শরীরের জখমের জালাতন স্নেহা সামলাতে পারছে না কোনো রকম বিছানার চাদরটা টেনে নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো। গরম পানির নিচে স্নেহার ধবধবে সাদা উদম শরীরটা নিয়ে দাঁড়িয়ে গেলো। গরম পানির প্রতিটি ফোঁটা মনে করিয়ে দিচ্ছে গত রাতে মর্মান্তিক মুহূর্ত গুলোকে। যাকে অন্য মানুষরা বলে,
” ভালোবাসার রাত!”
কিন্তু স্নেহার কাছে, ভীতিকর, ভয়ানক, এক কাল রাত্রী কেঁটে গেছে যেন। স্নেহা চোখ বুঝলো। সাধারণত রাতটুকু সময় মত তার রূপ পরিবর্তন করে আলোকিত করে চারিদিক। কিন্তু কালকের রাতটি স্নেহার মনে হচ্ছিলো, আর শেষ হবার নয়। টিপ টিপ করে পড়া পানি স্নেহার শরীরে লাল কালসিটে দাগগুলোকে ছুঁয়ে যেতেই স্নেহা শিউরে উঠছে। কঁপালটা তার এতোই পোড়া? না বাবা-মা পেলো, না পেলো সমাজে মর্জাদা আর না পেলো ভালোবাসা। পৃথিবী নাম এই অদ্ভুত পৃথিবীতে কষ্ট ছাড়া আর কোনো অনুভূতির মিষ্টি স্বাদ পায়নি স্নেহা। এসব ভেবেই ভিজে চোখ জোড়া মুছে নিলো। নব বধূর সাজে সজ্জিত হয়ে নিচে নেমে এলো। বড় ডাইনিং হলে দিলশাদের মা বিন্দু কাজের মেয়ে শেফালিকে কাজ বুঝিয়ে দিচ্ছে। সিঁড়ির কোঠায় স্নেহাকে দেখে বিন্দুর ঠোঁটে চওড়া হাসি ফুঁটে উঠলো। বরাবরই স্নেহাকে তার পছন্দ ছিল। সেহেরের অহংকারী ভাব বিন্দুর দু চোখে সইতো না। তবুও ছেলের পছন্দ বলে চুপ ছিলো। কিন্তু এখন যে ছেলের বুদ্ধি হলো। পরম যত্নে নিজের কাছে এসে বসালেন তিনি। খাবারের প্লেট এগিয়ে দিয়ে একে একে বেরে দিলেন রুটি সবজি ডিম ভাজা আরো কত কি। স্নেহার এই টুকুতেই জীবনের সব আনন্দ মায়ের ভালোবাসার এক চিলতে ছোঁয়া হৃদয় স্পর্শ করে গেলো। ঠিক সেই মুহূর্তে ভেবে নিলো, এই মধ্যে বয়সী নারীটি তার মায়ের জায়গায় থাকবে সব সময়। স্নেহার বড় বড় চোখে জলের ফোয়ারা। বিন্দু বিঝতে পেরে স্নেহার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
” বাড়ির কথা মনে পড়ছে খুব তাই না? দিল যে কি সকাল সকাল মিটিং আছে বলে বেড়িয়ে গেলো। কাঁদিস না ওই এলে তোকে একবার ঘুরিয়ে আনতে বলবো!”
স্নেহা মাথা নাড়লো। বিন্দু স্নেহার দিকে জুস এগিয়ে দিলো। মেয়েটি দেখে তার মনে সব সময় মায়া সৃষ্টি হয়। অদৃশ্য টান অনুভব হয়। বিন্দু হা করে শ্বাস ফেললো। স্নেহার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
” আমি জানি তোদের মাঝে সম্পর্কের আনাবোনা আছে। সময়ের সাথে সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে দেখিস। আর একবার তোদের বাচ্চা এসে গেলে তো কথাই নেই!”
স্নেহার মুখ লজ্জায় লাল হয়ে গেলো। বিড়বিড় করে বলল,
” বাচ্চা? ”
সেদিন দুপুরে দিলশাদ বাড়ি ফিরলো। বিন্দু ততখন রেডি হয়ে হল ঘরটিতে বসা। বিন্দুকে তৈরি দেখেই দিলশাদ ভ্রু কুচকে বলল,
” আম্মু চলে যাচ্ছো যে? কেউ কিছু বলেছে?”
বিন্দু হেসে বলল,
” ধুর পাগল ছেলে, আমায় কে কি বলবে, আমায় তো যেতেই হতো, তোর আব্বু বাসায় একা। ”
দিলশাদ হ্যা বোধক মাথা নাড়লো। বিন্দুকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিলো দিলশাদ আর স্নেহা। যেতে যেতে বলে গেলো,
” খুব জলদি কিন্তু নাতি নাতনির মুখ দেখতে চাই!”
স্নেহা মাথা নইয়ে মুচকি হাসলো। বিন্দু চলে যেতেই পুরো বাড়ি ফাঁকা হয়ে গেলো। ভুতুরে বাড়ির মতো। স্নেহা খাবার টেবিলে খাবার সাজিয়ে শেফালিকে বলল,
” দিলশাদকে খেতে আসতে বলুন!”
শেফালি ভয়ে গুটিশুটি মেরে বলল,
” না মেডাম আপনি জান, আমার ভয় করে!”
স্নেহা চুপ রইলো। ওরো তো ভয় করে, গত রাতের পরে আরো বেশি ভয় করে। দিলশাদের ওই গভীর চোখ জোড়ায় ভয়ংকর কিছু আছে, যা স্নেহাকে নয় শুধু যেকোনো ব্যক্তির রূহ কাপিয়ে তুলতে সক্ষম। স্নেহা কি করবে ভাবছিলো, ঠিক তখনি নিচে নেলে এলো দিলশাদ। বিন্দু যাওয়ার আগে দিলশাদের মন পছন্দ মতো সব খাবার বানিয়ে রেখে গেছে। দিলশাদ টেবিলে এসে বসে পড়লো। স্নেহা কাঁপা কাঁপা হাতে খাবার এগিয়ে দিলো। সকালে বিন্দুর কথায় পেয়েস করেছিলো নিজ হাত। সেটিও এগিয়ে দিলো সে। দিলশাদ খেতে লাগলো। খাবার শেষে গরম গরম পায়েস যখন মুখে দিলো, মুখের ভঙ্গিমা পাল্টে গেলো দিলশাদের। হুংকার ছেড়ে ডাকলো শেফালিকে। শেফালি দৌঁড়ে এসে দাঁড়ালো সামনে। দিলশাদ বলল,
” পায়েস কে বানিয়েছে?”
শেফালির বুকের ভিতর দুরুদুরু শুরু করে দিয়েছে। সে চুপ রইলো। স্নেহারওনেদিকে হাত পা জমে গিয়ে ঠান্ডা বরফ। সে আমতাআমতা করে বলল,
” আমি আমি বানিয়েছি।”
এতটুকু শুনেই না ডানে দেখলো না বামে দিলশাদ গরম পায়েসে বাটি ছুঁড়ে মারলো স্নেহার দিকে।গরম পায়েস গায়ে পড়তেই ফোসকা পড়ে গেলো সঙ্গে সঙ্গে। স্নেহার কাতরানো উপেক্ষা করে দিলশাদ বলল,
” আর কখনো আমার জন্য কিছু করবে না তুমি। তোমার হাতের খাবার থেকে বিষ পান করা ভালো। ”
বলেই বড় বড় পা ফেলে চলে গেলো সে।
তরুনের পার্টিতে খাবারে আইটেমে পায়েস আর একই স্বাদের টেষ্ট পেয়ে পুরোনো স্মৃতির কথা মনে পড়লো দিলশাদের। বিয়ের দ্বিতীয় দিনটিতেই মেয়েটির হাত আর গা পুড়িয়ে দিয়েছিলো দিলশাদ। ভেবেই ভিতর থেকে আহ্ বের হয় এলো। কিন্তু পরিচিত পায়েসের স্বাদ পেয়ে মনে হলো মানুষটি তার খুব কাছে কিছুটা কৌতুহল হয়েই জিজ্ঞেস করলো দিলশাদ,
” পায়েস কে বানিয়েছে?”
তরুন হালকা হেসে বলল,
” আমার বোন। ”
দিলশাদের বুকে ধক করে উঠলো। আচ্ছা কে এই মেয়েটি? যার সাথে সব মিলে গিয়েও অমিল? খাবারের পর হাত ধুতে গেল দিলশাদ। সেখানে আগেই উপস্থিত ছিলো আকৃতা শেখ। দিলশাদকে দেখে সে বেড়িয়ে যেতে নিলো। দিলশাদ হাত ধরে আটকালো। গভীর চোখ জোড়া দিয়ে কিছু খুঁজতে লাগলো। বলল,
” কে তুমি?”
আকুতা তার মিষ্টি কর্কষ কন্ঠে বলল,
” আকৃতা শেখ!”
” আমাদের কি এর আগে কখনো দেখা হয়েছে?”
” দিলশাদ আমরিন দ্যা বিজনেস ওফ টাইকুন। যার এর আগে একবার গোপনে বিয়ে হয়েছে। নিজের বউয়ের বড় বোনের সাথে এখন আপনার ডেটিং চলছে। তালুকদার বাড়ির মেয়েদের উপর ইন্টারেস্ট চলে গেছে নাকি আপনার? এখন পথের মেয়েদের পরিচিত মনে হয়?”
দিলশাদ মোটেও এমন উত্তরের আশা করে নি। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো রোবটের মতো। মেয়েটির তিক্ত কথায় খারাপ লাগলো তার৷ কিন্তু কেন? মেয়েটি কি তাকে ঘৃণা করে?
আকৃতা শেখ স্থান ত্যাগ করলো। তার একটুপর ন্যাকা কান্না করে উপস্থিত হলো সেহের। দিলশাদ আমরিন সেদিকে পাত্তা না দিয়ে হাত ধুতে লাগলো। তা দেখে ক্ষেপে গিয়ে বলল সেহের,
” দিলশাদ তুমি আমার একদম কেয়ার করো না, ভুলেই গেছো একে বারে!”
দিলশাদ ঠোঁট বাঁকা হাসলো। সেই হাসি কতটা ভয়ংকর তা সেহের বুঝতে পেরে পিছিয়ে গেলো। দিলশাদ আমরিন তার দাম্ভিক চকচকে মুখটি নিয়ে তীর্যক চোখে তাকালো সেহেরের দিকে। বলল,
” হো আর ইউ?”
” দিলশাদ?”
বড্ড অবাক হলো সেহের।
” কি বলছো? তুমি আমাকে চিন্তে পারছো না?”
” না তো? ”
” দিলশাদ? আমি তোমার সেহের? যাকে তুমি ভালোবাসতে…!”
দিলশাদ পকেটে দু হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে কঠিন স্বরে বলল,
” তাই না কি?”
সেহের তালুকদার ঘাবড়ে গেলো। ততলাতে ততলাতে বলল,
” আমি… আমি..!”
দিলশাদ থামিয়ে দিলো। বলল,
” ভুলে যে-ও না সেহের তোমার জন্য আমার ভালোবাসা আমি হারিয়েছি। এখন যে দাঁড়িয়ে আছো না আমার সামনে? এক মাত্র আমার আম্মুর জন্য। আমার আম্মুকে না বাঁচালে তোমার মুখ টা-ও আমি দেখতাম না। সো স্টে অ্যায়ে!”
সেহের বরফের মতো জমে গেলো। মরে যাওয়া স্নেহাকে ইচ্ছে মতো গালি দিতে লাগলো। তখনি পিছন থেকে একটি কন্ঠ স্বর ভেসে এলো,
” আজ কাল মানুষ ভুতকে ভয় পায় না.. ভয় পায় মানুষকে। আচ্ছা এমন যদি কখনো হয়? নিজের কর্মের ফল হিসেবে মানুষের রূহানী রূপ টা বেড়িয়ে আসে? তখন কি হবে? অবশ্যই তার করা পাপ কর্ম গুলো গুনে গুনে মনে করিয়ে দিবে।”
তরুনের বলা কথায় সেহের কেঁপে উঠলো। পুরোনা পাপ কথাটি ভাবতেই বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দিলো কঁপালে। ঘাবড়ে যাওয়া মুখ নিয়ে ফিরলো পিছনে। কিন্তু তরুনকে ফোনে কথা বলতে দেখে রেহাই পেলো সেহের এক প্রকার পালিয়ে গেলো সেখান থেকে। সেহেরকে পালাতে দেখে ঠোঁট বাকিয়ে হাসলো,
” পাপ তার বাপকেও ছাড়ে না।”
মধ্যরাত…
বাতাসের মৃদু দোল দোলানি শীতল ভাব। বাংলো বাড়ির বড় বাগানের বিদেশি ফুলের ঘ্রান। আর তীক্ষ্ণ চাঁদের আলোয় ফলকের রাশি রাশি বাহার। চাঁদের এক চিলতে হাসি পড়ছে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে থাকা স্নেহার উপর। হাতে ধোয়া উঠা চা আর রোমাঞ্চকর পরিবেশ।
“কি ভাবছিস?”
তরুন তার বোনকে জিজ্ঞেস করলো। স্নেহার সুন্দর ঢেউ খেলানো চুল গুলো এক পাশে করে নিয়ে গুরুগম্ভীরের মতো বলল,
” ভাবছি, পৃথিবীরটা একটা মায়াজাল, মায়াচক্র। ছোট বেলায় আমরা পুতুল নাচ দেখতাম না… ঠিক তেমন। উপর ওয়ালা আমাদের বানিয়ে ভেদাভেদ ছাড়া পৃথিবীর রঙ্গ মঞ্চে পাঠিয়ে দেয়। আর আমরা… আমাদের ভাগ্য কিছু তুচ্ছ মানুষের হাতে তুলে দি… আর তারা আমাদের সেই ছোট বেলার দেখা পুতুল নাচের মতো… নাচিয়ে যায়।”
তরুন বোনের কাছে এসে দাঁড়ালো। খোলো চুলে হাত বুলিয়ে বলল,
” পুতুল পারে না নিজের ভাগ্য পাল্টাতে। কারণ তাদের মধ্যে প্রাণ নেই, তারা তো মাটির তৈরি, কাঠের তৈরি বা মমের। কিন্তু মানুষ? রক্তে মাংসে গড়া। এরা চাইলেই পারে নিজের ভাগ্য পাল্টাতে। ”
স্নেহা চকিতে বলল,
” ভাই, আমি আমার ভাগ্য পাল্টাতে চাই!”
তরুন হেসে বলল,
” কি চাই!”
” একটা উপকার!”
” হুকুম কর!”
” আমরিন এম্পায়ারে জব! ”
” হুকুম শিরোধার্য ইউর হাইনেস। ”
তরুন বলতেই স্নেহা হেসে ফেললো। হাসলো তরুন ও। দু ভাই বোনকে হাসতে দেখে হাসলো যেন চাঁদনী পসর-ও…..
এদিকে যেমন হাসাহাসির কলকলানি। অন্যদিকে আধার ঘরের এক ফোঁটা চাঁদনী পসর পরছে খোলা জানালার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা দিলশাদের উপর। ক্লিন সেভ মুখ আর শক্ত চোয়াল ঘন কালো চুল গুলো এলো মেলো। রাতের আকাশের মতো গভীর গাড় নীলাভ চোখ মেলে চেয়ে আছে দূরের অম্বরে। হাতের কোনে থাকা একটি তাবিজের লকেটে জ্বলজ্বল করছে দিলশাদ লিখা নামটি। দিলশাদ তাবিজটি উপরে তুললো। স্নেহার ছোট বেলার চেহারাটি মনে করতে চাইলো। ছোট একটি মুখ। বড় বড় চোখ। টমেটোর মতো লাল গাল। খিলখিল করে হাসছে। ভেসে আসচ্ছে তার মৃদু ছন্দ তোলার মতো কন্ঠ,
” দিলশাদ আপনি আমাকে খুঁজে পাবেন না।”
দিলশাদ নিস্প্রভ দৃষ্টি মেলে চাইলো চোখে কোনে চিক চিক করে উঠলো জল। একটি ভুল স্নেহা আর তার জীবনের পরিনীতি এভাবেই হবার ছিলো কি? দিলশাদ পুরোনো স্মৃতিতে ঢুব দিলো……
চলবে,