#সর্বনাশিনী
#সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি
৯।
দিলশাদ ছাড়লো না আরো কাছে টেনে নিলো। এতটা কাছে যে একটা সুতো পরিমাণ জায়গায় দু’জনের ঠোঁটের মাঝে…. যে একটা চিত্র। ভালোবাসায় মগ্ন দুটি নর-নারী। ঠিক সেই সময় বড়সর আওয়াজ করে দরজা খুলে গেলো। আর দেখলো…. মারিয়া দাঁড়িয়ে আছে। ছল ছল করছে তার মেকাপে ঢাকা চোখ জোড়া।
” এখানে কি হচ্ছে দিলশাদ?”
ধরা গলায় বলল মারিয়া। কিন্তু দিলশাদের কোনো ভাবাবেগ পরিবর্তন হলো না। তা দেখে মারিয়া আরো ভরকে গেলো। এদিকে স্নেহা দিলশাদের মুষ্টিবদ্ধ হালকা হতেই দূরে সরে গেলো। স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,
” আমি আসচ্ছি!”
দিলশাদ প্রতি উত্তরে কিছু বলল না। স্নেহার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো শুধু। ভাবতে লাগলো,
“মেয়েটির সব কিছু কেন তার সাথে মিলে যায়?”
তার ভাবনার ফোঁড়ন পড়লো শরীরের মৃদু কম্পনে,
” দিলশাদ এই মেয়েটি আবার কে? তুমি আবার নতুন করে ডেটিং করছো? আমার কি হবে দিলশাদ?”
দিলশাদ ভ্রু কুচকে বলল,
” গো টু হেল!”
মারিয়ে ফুপিয়ে উঠলো,
” দিলশাদ? আমার ভালোবাসা তোমার চোখে পরে না? কখন সেহের কখনো স্নেহা আর এখন অন্য কেউ?”
দিলশাদ উত্তর দিলো না। মারিয়া আর ধৈর্য ধরে রাখতে না পেরে চেচিয়ে বলল,
” আমাকে কেনো ভালোবাসো না তুমি?”
দিলশাদ আমরিন তার ডীপ ব্লু চোখ জোড়ায় তাকালো। মারিয়া ভয়ে দু কদম পিছিয়ে পড়লো। দিলশাদ আমরিন তার ঝংকার তোলা গম্ভীর কন্ঠে বলল,
” কারণ তুমি স্নেহা না!”
তারপর ধমকে উঠে বলল,
” গেট আউট! ”
মারিয়ার অপমানিত হলো। মনের দুঃখে পা মারিয়ে স্থান ত্যাগ করলো কাঁদতে কাঁদতে। এক দৌঁড়ে নিচে নেমে এলো সে। ঠিক তখনি দরজার কাছে আকৃতাকে জুতো পরতে দেখে তেলে বেগুনে ভাজা ভাজা হয়ে আকৃতার কাছে গেলো। বলল,
” তোমার মোটিভ আমি ঠিক বুঝতে পারছি মিস।”
মারিয়ার গলা শুনে পিছনে ফিরে তাকালো স্নেহা,
” এক্সকিউজ মি? ”
মারিয়া দু হাত বুকের উপর আড়াআড়ি ভাবে বেঁধে দাঁড়ালো। একজন সেলেব্রিটি হিসেবে সবসময় নিজেকে মেকাপের আড়ালে লুকিয়ে রাখে। ওয়েস্টার্ন ড্রেস আর হাই হিলের জন্য মেয়েটিকে আরো দু তিন ইঞ্চি লম্বা করে তুলেছে। এই মেয়েটি তার বাচ্চার হত্যাকারী। শত্রুর মধ্যে দ্বিতীয় নাম্বারে আছে সে। স্নেহার ভাবনার মাঝেই মারিয়া বলল,
” এমন ইনোসেন্ট মার্কা লুকে ধনী ব্যক্তিদের পটলাতে সক্ষম তাই না?”
স্নেহা বিরক্তি কন্ঠে বলল,
” কি আজেবাজে বকছেন?”
মারিয়া বলল,
” তোদের মতো দু টাকার এমপ্লয়ের জীবন নরক বানাতে আমার দু’ মিনিট সময় লাগবে না! রঙ ঢং করতে হলে অন্য কোথাও গিয়ে কর। আমার দিলশাদ থেকে দূরে থাক।”
স্নেহা হাসলো। বলল,
” আমি যতটুকু জানি, দিলশাদ স্যার তো সেহেরের। আপনার কিভাবে হলো মিস মারিয়া? আর রইলো আমার কথা? আমি আপনার মতো এত কুরুচিপূর্ণ মানুষ নই, যে এক বিবাহিত লোকের পিছনে লাগবো। ও টা আমার স্টেটাস নয় বরং আপনার মতো বি ক্লাস অ্যাক্টর দ্বারাই সম্ভব। ”
মারিয়া দাঁত কিড়মিড় করে থাপড় মারার জন্য হাত তুললো,
” তোকেতো আমি….!”
হাওয়ার মাঝেই হাতটি থেমে গেলো মারিয়ার। মারিয়া আর স্নেহা দুজনেই খানিক চমকালো। পিছন থেকে ভেসে এলো দিলশাদের কন্ঠ। বলল,
” তুমি কি মরতে চাইছো?”
মারিয়া, স্নেহা দুজনেই বুঝলো না কথাটি কাকে উদ্দেশ্য করে বলা হলো। দুজনেই প্রশ্ন বিদ্ধ চোখে তাকালো। দিলশাদ মারিয়ার হাত ঝাড়া মেরে ফেলে দিয়ে বলল,
” মারিয়া সে সরি!”
মারিয়া অবাক হয়ে বলল,
” আমি সরি কেন বলবো? বলবো না সরি, দু টাকার মেয়েকে তো মোটেও না!”
দিলশাদ ভাবলেশহীন ভাবে বলল,
” আমার আর কিছু বলার নেই।”
মারিয়া আবার কিছু বলবে তার আগেই স্নেহা বলে উঠলো,
” মিস মারিয়া… আশা করছি খুব দ্রুত আপনার অ্যাটিটিউড চেঞ্জ হবে।আসচ্ছি!”
বলেই বাঁকা হেসে চলে গেলো সে। দিলশাদ স্নেহা যেতেই বলল,
” তুমি জানো না কার সাথে এবার পাঙ্গা নিয়েছো! এর পর যা হবে, তার জন্য তুমিই দায়ী থাকবে!”
বলে দিলশাদ উপরের দিকে পা বাড়ালো। মারিয়া শুধু ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো। মনে মনে ভাবলো,
“, কে এই মেয়ে?”
————–
হসপিটালের করিডোরে তেমন কেউ নেই বললেই চলে। রাতের সাথে সাথে ভীড় কমে আসে, শূন্য হয়। আধার আলোয় ভয়ংকর গা ছমছম ভাব। তবে মাঝে মাঝে নার্স কিংবা ডাক্তারদের একটি দল আনা গোনা করে এই ১০ তলায়। এখানে শুধু ভি আই পি ভাগ রোগীদের
জন্য কেবিন করা হয়েছে। আপাতত দু’টো কেবিনে দুটো রোগী। আর এই দুটি কেবিনের বাহিরে দু’জন বডিগার্ড মাথা উঁচু করে পাহাড়া দিতে ব্যস্ত। একটি ভর্তি আছে দিলশাদের মা বিন্দু আমরিন। আরেকটিতে একদিন আগেই ভর্তি করানো হয়েছে সেহেরকে৷ সেহেরের সাথে ঘটে যাওয়া সেই ঘটনাটি এখনো ভুলতে পারেনি সেহের অর্ধনগ্ন বিচ্ছিরি দেখতে লোকটি হলদে দাঁতের ভয়ানক হাসি এখনো তারা করে সেহেরকে। এই যে এখনো ঘুমের মাঝে সেহের স্বপ্ন দেখছে, লোকটি আপত্তিকর ভাবে তার বুকে, পেটে, ঠোঁটে স্পর্ষ করছে। এক পর্যায় সে প্যান্ট খুলতে নিচ্ছে, ঠিক তখনি সেহের চিৎকার করে ঘুম থেকে উঠে যায়। তখন রাত গভীর হু হু করে বইছে শীতল ঠান্ডা বাতাস। কেবিনের মাঝে মৃদু আলো জ্বলছে। বেলকনির দরজাটা খোলা সাদা পর্দা ফর ফর করে উড়ছে। এক মুহূর্ত মনে হলো বেলকনিতে সাদা শাড়ি পড়ে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে। বড় বড় লম্বা চুল গুলো বাতাসের তালে তালে উড়ে যাচ্ছে। সেহের তালুকদার ছোট থেকেই ছিলো ভিরু প্রকৃতির। ভুতের ভয় তার ছিল বহুত। ঠুস ঠাস বেহুশ হওয়ার মতো। আর এই গভীর রাতে ভুতুরে হসপিটালে একা একটি রুমে তার উপর এমন একটি ছায়া মুর্তি? সেহেরের হাড়কাঁপানো ভয়ে ধর ধর করে কাঁপতে শুরু করলো। কিছু মুহূর্তে থমথমে হয়ে উঠলো পরিবেশ। সেহের গলা ছাড়লো,
” ককক কে? কে ওখানে?”
অবয়বটি এবার যেন নড়ে উঠলো। হেঁটে এসে দাঁড়ালো বেলকনির দরজার সামনে। পর্দা উড়া আর মৃদু আলোতে সেহের একটি চেহেরা দেখতে পেলো। চেহারার মাঝে চাকুর দাগ। চাকু দিয়ে চামড়া উঠিয়ে ফেলেছে যেন কেউ। সেহের ভয়ে গুটিয়ে গেলো।
” ক ক কে তুমি?”
ঘর কাঁপালো একটি আওয়াজ ভেসে এলো তখন,
” দিদিভাই তোমার ছোট বোনকে ভুলে গেলে?”
সেহেরের ভয়ে এবার চিৎকারে উঠলো,
” মা মা মা, ভুত ভুত ভুত। ”
স্নেহা হেসে বলল,
“দিদি ভাই আমি ভুত না। আমি তোমার বোন স্নেহা!”
” নাহ্ নাহ্। স্নেহা মরে গেছে, মরে গেছে।”
” হে দিদিভাই তুইতো আমাকে মেরেছো, এই দেখো? আমার সুন্দর চেহারা-ও তুমি নষ্ট করে দিছো। কেন দিদি ভাই?”
সেহের বলল,
” আমি আমি কিছু করি নি। করি নি কিছু! প্লীজ চলে যাও। প্লীজ!’
স্নেহা বলল,
” আমার একা ভালো লাগে না দিদিভাই তুমি চলো আমার সাথে, এসো এসো, দিদি ভাই।”
বলেই হাত দুটি মেলে কাছে যেতে লাগলো স্নেহা। সেহের আর সইতে না পেরে ঘেমে নেয়ে একাকার হয় চোখ উল্টে জ্ঞান হারিয়ে ফেললো। তার পরেই স্নেহা তার মুখোশ খুলে ফেললো। হেসে হেসে বলল,
” আমার চেহারা তো তুমিই নষ্ট করেছিলে, আর এই চেহারা দেখে এখন এত ভয়?”
ঠিক সেই মুহূর্তে কতগুলো পায়ের শব্দ ভেসে আসচ্ছে। স্নেহা সঙ্গে সঙ্গে চলে গেলো অন্য সাইট দিয়ে। স্নেহা যেতেই উপস্থিত হলো কয়েক জন। একজন বলল,
” স্যার মেম হঠাৎ চিৎকার করে উঠছে আবারো।”
দিলশাদ মাথা নাড়লো। তার পিছন থেকে একটি সুদর্শন যুবক এসে দাঁড়ালো । বলল,
” আমার মনে হচ্ছে সেহেরের সেই ঘটনাটি খুব খাবে মস্তিষ্কে আঘাত করেছে। তাই এমন করছে।”
দিলশাদ একবার সেহের দিকে তাকিয়ে বরাবারের মতোই বলল,
” আরিয়ানা ওর চিকিৎসার জন্য যা প্রয়োজন। তাই কর!”
আরিয়ান মাথা নাড়িয়ে বলল,
” সেহেরকে তুই একটু-ও পছন্দ করিস না, তবে এত কেয়ার কেন করছিস?”
দিলশাদ হালকা শ্বাস ছেড়ে বলল,
” ও আমার মাকে বাঁচিয়ে ছিলো, তাই আমি চাই না এর কোনো ক্ষতি হোক। ”
আরিয়ান দিলশাদের কাঁধে হাত রেখে বলল,
” স্নেহাকে ভুলতে পারিস নি এখনো?”
দিলশাদ শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। কোনো উত্তর দিলো না।
———-
রাজা-রানি সিরিয়ালের সুট চলছে। একটা ১৬ বছর বয়সের হারিয়ে যাওয়া রানির লিড রোলের ক্যারেক্টারে নিজেকে ফুটিয়ে তুলেছে মারিয়া। মেয়েটি সত্যি অনেক সুন্দর। ঠিক তেমনি সুন্দর তার অভিনয়। বোঝায় যায় না সে কখন অভিনয় আর কখন বাস্তবে কাজ করে চলে। আশেপাশে অনেক মানুষ ভীড় করে আছে। মারিয়ার ফ্যান ফলোয়ারের অভাব নেই। স্টুডিওতে প্রতিদিন ভীর করে মিডিয়া।
মারিয়া সুট শেষ করে এসে বসতেই। ডিরেক্টর হুড়মুড় করে এসে দাঁড়ালো। ডিরেক্টরের চোখে মুখে ভয়। কঁপাল জুরে ঘাম। এসেই বলল,
” সরি মিস মারিয়া। আপনি আর এই সিরিয়ালে থাকছেন না।”
মারিয়া এমন একটি কথা শুনে আকাশ থেকে পড়লো যেন। কিছু দূর থাকা রিপোর্টার-ও এমন একটি সংবাদ লুফে নিলো। এদিকে মারিয়ার চোখ মুখ শুকিয়ে গেল। ফিকে হেসে বললো,
” স্যার এসব কি বলছেন? মজা করছেন বুঝি?”
ডিরেক্টর বললেন,
” আ’ম সরি মিস আপনি আসতে পারেন…”
মারিয়ার চোখের কোনে জল টলমল করে উঠলো,
” স্যার এমন করবেন না? আমার এই রোল হারিয়ে গেলে আমার যে কোনো জায়গায় কাজ পেতে সমস্যা হবে।”
ডিরেক্টর বলল,
” আমি এ বিষয়ে কিছু করতে পারছি না। সরি। তবে হ্যাঁ তুমি খুব বড় কারো সাথেই হয়তো শত্রুতা করে বসেছো যার জন্যই তোমার এই সিরিয়ালে জায়গা নেই।”
মারিয়া কিছুই বুঝতে পারছে না। কে তার পিছনে লেগেছে? কেই বা তার এত বড় শত্রু? অনেক ভাবার পরেই মারিয়ার কিছু মনে পড়লো। বিড়বিড় করে বলল,
” আকৃতা শেখ?”
চলবে,