সাঁঝক বাতি-পর্ব:১৮

0
430

-‘সাঁঝক বাতি-‘
নূরজাহান আক্তার (আলো)
[১৮]

দিগন্তকে হাসতে দেখে স্বপ্নীল স্বজোরে এক লাথি বসাল। পা বাঁধা না থাকায় সম্ভব হয়েছে। অদূরে থাকায় দিগন্তেরও লেগেছে; হাঁটু বরাবর। দিগন্তও রেগে স্বপ্নীলের বুক বরাবর লাথি দিলো। স্বপ্নীল
চেয়ারসহ মেঝেতে পড়ে পেল। আর মুখে থেকে বেরিয়ে এলো, ‘মা।’ মধুর এক ডাক। মনে আর মুখে সর্বদা ‘মা’ ডাকের বিচরণ। তাই সামান্য ব্যথা পেলেও আগে ‘মাকেই’ স্মরণে আসে।’মা’ অতি আপন কি না তাই। স্বপ্নীলের দু’হাত বাঁধা চেয়ারের সাথে। শত চেষ্টা করেও বাঁধন খুলতে পারছে না। দিগন্ত সেই অবস্থাতেই লাথি দিয়েই
যাচ্ছে। যেন ফুটবলকে কিক মারছে। রাগে ওর শরীরের রক্ত ফুটছে। এত বড় কলিজা দিগন্তের শরীর স্পর্শ করেছে! যেটা আজ অবধি কারোরই
সাহসে হয় নি। আর চুনো পুটিঁ! এজন্য শাস্তিও প্রাপ্য। দিগন্ত মারতে মারতে বিশ্রীসব গালি দিয়ে বলল,

-‘মা***তোকে পুঁতে ফেলব। জানিস আমি কে? হিরোগিরি দেখাস আমার সাথে! ঝলসে দিবো, শালা হারামজাদা।’

স্বপ্নীলের নাক মুখ দিয়ে গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে। লাল রক্তে মুখটাও লাল হয়ে আছে। রক্ত গড়িয়ে মেঝেতে টপটপ করে পড়ছে। দেখতে খুব
ভয়ংকর লাগছে। তবুও দিগন্ত থামছে না। রাগে সে কাঁপছে। স্বপ্নীল তখন অনেক কষ্ট বলল,

-‘এক বাবার ছেলে হয়ে থাকলে তুই বাঁধন খুলে দেখ। কাপুরুষ একটা।’
-‘ খুললে কী করবি, কুত্তার**?’
-‘খুলে তো দেখ।’
-‘ধৈর্য্য ধর, কালকেই তোর সব শখ মিটাবো।’
-‘এখন কি সাহস নেই?’

দিগন্ত সত্যি সত্যি’ই বাঁধন খুলে তাৎক্ষণিক মার শুরু করল। হকিস্টিক দিয়ে। স্বপ্নীল উঠে দাঁড়াতে পারল না। সেই সুযোগটুকুও দেওয়া হলো না।সে মাথা ধরে বসে পড়ল। দিগন্ত প্রচন্ড রেগে বলল,

-‘আমাকে চ্যালেঞ্জ? তোর কলিজা কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলব, ব্লাডি বিচ! অজানা কারণে
বেঁচে যাচ্ছিস। নয়তো বুলেট গিলিয়ে দিতাম।’

-‘মেরে দে। দেখি, তোর বুকে কেমন পাটা।’

স্বপ্নীলের কথায় দিগন্ত চুপ হয়ে গেল। কিছু ভেবে শিফাকে ফোন দিলো। রাত তখন সাড়ে তিনটা।
শিফা কল রিসিভ করল না। হয়তো গভীর ঘুমে মগ্ন। স্বপ্নীল রক্তাক্ত অবস্থায় হাসছে। দিগন্ত ওর হাসির কারণও বুঝেছে। তবে এখন কথা বাড়াল না। কালকেই জবাবটা দিয়ে দিবে। বুঝিয়ে দিবে সে কয় বাবার ছেলে! সে কে? আর ঠিক কেমন ধাঁচের? সুখু এসে দিগন্তকে অনেক কষ্ট সরালো।
নয়তো মেরেই ফেলতো। দিগন্ত ভয়ানক রাগী।
রাগ উঠলে হুশ থাকে না। নিঃশেষ করেই ক্ষান্ত হয়। স্বপ্নীল তবুও হাসছে। দিগন্তকে দেখেই হাসি পাচ্ছে। স্বপ্নীলের চালাকি দিগন্তও ধরে ফেলেছে।
রাগিয়ে দিয়ে’ই সে বাঁধন খোলার বুদ্ধি এঁটেছে।
তা তো হয় না। সে অন্যকে ঘোল খাইয়েই চলে।
এত সহজ নয় বোকা বানানো। সে সুখুকে ইশারা করল, বাঁধতে। তারপর দিগন্ত জোরে আরেকটা কিক মেরে স্থান ত্যাগ করল। মুখে ফিচেল হাসি। খুব শীঘ্রই ওদের দেখা হবে।স্বপ্নীল জ্ঞান হারাল। দিগন্ত পুনরায় ওর বুকে কিক মেরেছে। একটুপরে
সুখু ভয় পেয়ে দিগন্তকে ফোন করে বলল,

-‘ছ্যার, পোলাডা নড়তাছে না। মইরা গেলে?’
-‘মরলে ভালো, তবে না মরলে আরো ভালো।’
-‘এহন কি করতাম ছ্যার?’
-‘ ফোন রাখ। নয়তো নিজের কবর খুঁড়ে রাখ।’

সুখু তাৎক্ষণিক কল কেটে দিলো। তারমানে ওর রাগ কমে নি। এই রাগ কমাতে না জানি কত কী করবে! দিগন্ত বাসায় ফিরে দেখে ওর বাবা পানি খাচ্ছেন। অন্য হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। আঙ্গুলের ফাঁক থেকে সিগারেটের ধোঁয়া উড়ছে। রুমজুড়ে সিগারেটের গন্ধ। সেন্টার টেবিলে অর্ধেক খাওয়া নাস্তা। হয়তো স্পেশাল কাউকে অাপ্যায়ন করে বিদায় করেছেন। উনি চরম মেয়েবাজ। বলারও অপেক্ষা রাখে না। এই লোককে দেখলে ওর রাগ হয়। মন বলে, পেটভর্তি বুলেট গিলাতে। নয়তো তৃপ্তি করে এসিড খাওয়াতে। উনি ওর বাবা নন।
এজন্যই হয়তো এমনটা মনে হয়। উনি সম্পর্কে ওর খালু আর প্রশান্তর মা আপন খালা। আর প্রশান্ত খালাতো ভাই। একথা এখানকার কেউ’ই জানেন না। জানার সুযোগও দেওয়া হয় নি।এর
কারণও আছে। দিগন্তের নিজের বাবা ওদেরকে
রেখে নিখোঁজ হয়েছিলেন। কোনোভাবে সন্ধান মিলে নি। এই শক ওর মা সহ্য করতে পারেন নি। ব্রেন স্টোক করে মারা গিয়েছিলেন। দিগন্ত তখন চার বছরের। অবুজ একটা বাচ্চা। তখন
থেকে সে প্রশান্তে মায়ের কাছে বড় হয়েছে। বুঝে নি ; দিগন্ত উনার ছেলে নয়। পরে একদিন ওর খালা সব জানিয়েছিল। যাতে হঠাৎ কোনোদিন জেনে কষ্ট না পায়। খালাকে প্রচুর ভালোবাসত;
‘আম্মু’ বলেই ডাকত। খালা জীবিত থাকতে ওর খালু অমানুষই ছিল। তবে চাপা ছিলো। এখন এরুপ উন্মোচন হয়েছে। উনি দিগন্তকে অপছন্দ করেন তবে সেটা প্রকাশ করে না। দিগন্তও বুঝে।
তবে কিছু বলে না। সে নিজের মর্জিমতো চলে।
লোকসম্মুখে বাবা বলে ডাকলেও, অন্য সময়ে ফিরেও দেখে না। ঘৃণা হয়। বাবা ডাকটা উনার সঙ্গে যায় না। কলংকিত করেছে এই ডাকটাকে।
উনি প্রশান্ত ও দিগন্তকে অপকর্মের দিকে ধাবিত করেছেন। টাকার লোভ ধরিয়েছেন। মেয়ের প্রতি আসক্ত করেছেন। আর মাঝে মাঝে নিজে ফেঁসে গেলে, ছেলেদের ঘাড়ে দোষ চাপিয়েও দিয়েছেন। ছেলে মরুক। নিজে বাঁচলেই হলো। ঠিক এমন জাতের বাবা উনি। উনি ঘুরে দিগন্তকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বিরক্ত হয়ে বললেন,

-‘ভূতের মতো দাঁড়িয়ে আছো কেন? দূর হও।’
-‘জানোয়ারের মতো ব্যবহার কবে ছাড়বেন?’
-‘দিগন্ত!’
-‘আমার নাম দিগন্ত, মনে আছে। আপনাকে মনে করাতে হবে না।’
-‘খুব বার বেড়েছে তোর? দাঁড়া কাল সকালেই তোর হচ্ছে, জানোয়ার একটা।’
-‘সকাল পেলে তো।’

কথাটা বলে দিগন্ত উনার গলা চেপে ধরল। এক পর্যায়ে ধস্তাধস্তিও শুরু হয়ে গেল। দিগন্ত উনাকে গেস্ট রুমে নিয়ে গিয়ে মুখ বেঁধে ফেলল। তারপর প্যান্টের বেল্ট খুলে বেধড়ক মারতে লাগল। ওর রাগ তুলছে। অনেকদিনের জমিয়ে রাখা রাগ।
মাকে অর্থাৎ ওর খালাকে সে খুব ভালোবাসত। এই লোকই খালাকে বালিশ চাপা দিয়ে মেরেছে। দিগন্ত একথা পরে জেনেছে। তাও আবার উনিই মাতাল অবস্থায় এসব বলেছিলেন।আর দিগন্ত চুপ করে শুনেছিল। খালাকে মারার কারণ, উনি সবাইকে পাতালঘরের অপকর্মের কথা জানিয়ে দিতে চাচ্ছিলেন। পাপকর্ম থেকে বেরিয়ে আসার কথা বলেছিলেন। এজন্য উনি খালাকেই সরিয়ে দিয়েছেন। বেল্টের মার খেয়ে উনি ছটফট করতে লাগলেন। অর্ধনগ্ন দেহে কালশিটাও পড়ে গেছে। দিগন্ত উনাকে মারতে মারতেই অবচেতন করে ফেললো। তারপর ধরে ওর রুমে যাওয়ার পথে সাবিনা খালা দেখে নিলেন। দিগন্ত মুচকি হেসে বলল,

-‘খালা আপনার কিডনী দুইটা, তাই না?’
-‘জ্বে ভাইজান।’
-‘আমাকে দিবেন?’
-‘ন ন না ভাইজান।’
-‘তাহলে বলুন, আপনি কিছু দেখেছেন?’
-‘না ভাইজান।’
-‘ভয় পাবেন না খালা। ভয়ে আপনি ভুলভাল
ডাকছেন। অন্যসময়ে বাপজান ডাকেন। এখন ভয়ে ভাই বলে ফেলেছেন। লাগাম ঠিক রাখুন, আপনিও ভালো থাকবেন।’
-‘জ্বে আচ্ছা।’

দিগন্ত কথাগুলো বলে রুমে গিয়ে দরজা আটকে দিলো। তারপর গোপনঘরের সিঁড়ি বেয়ে খালুর পাতালঘরে চলে গেল।খালুর পাতালঘরেই কাজ সমাপ্ত। যেখানে শুরু সেখানেই শেষ। আহা,কত্ত চমৎকার বুদ্ধি। দিগন্ত পানি ছিঁটিয়ে উনার জ্ঞান ফিরালো। নয়তো মেরেও মজা পাবে না। অথচ মজার পাওয়ার জন্যই এতকিছু করা।মরার ভয় চোখে না থাকলে কিভাবে হবে? সব কষ্টই বৃথা।
দিগন্ত উনার পাশে হাঁটু গেড়ে বসে বলল,

-‘খালুজান ভালো আছেন? আপনি নিজে তো অমানুষ; আমাকেও বানিয়েছেন অমানুষ। কেন বলুন তো?’

-‘সোনা আব্বা আমাকে ছেড়ে দাও। আমি আব্বু হই না তোমার? আমার ভুল হয়ে গেছে; আব্বা। ভুলেও আর এমন ব্যবহার করব না।’

দিগন্ত হাসল। আর হাসতে হাসতে বসেও পড়ল।
আজকে দিনটা হাসতে হাসতে গেল। চারপাশে এত শয়তান ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তাদের কর্মে না হেসেও পারছে না। খালু ওকে আঘাত করতে
গিয়েও ব্যর্থ হলো। খালু হাল ছাড়লেন না।চেষ্টা করতে থাকলেন বাঁচার। দিগন্ত ওর পকেট থেকে ইনজেকশন বের করে উনার কাঁধে পুশ করল।
উনি আঁকুতি মিনতি করতে লাগলেন। তবে ওর মন গলল না। উনি ধপ করে পড়ে গেলেন। হুশ নেই। দিগন্ত উঠে একটা বক্স আনল। সেখানে সার্জারির যন্ত্রপাতি আছে। চকচক করছে। যেন সদ্য কিনে আনা।দিগন্ত সময় নিয়ে উনার চোখ, কিডনী, লিভার বের করল। মুখে তার মিটিমিটি হাসি। প্রশান্ত আর দিগন্ত দু’জনেই এসব কাজ পারে। শিখেছে। কালকে সুখুকে দিয়ে একজনের কাছে পাঠাতে হবে। টাকা পরিমানও বেশি পাবে। আপন খালুজানের পার্টস্ বলে কথা। দিগন্ত সব প্রয়োজনীয় পার্টস নিয়ে মৃত বডি এসিডের কূপে ফেলে দিলো। সেকেন্ডেই কঙ্কাল ভাসতে লাগল।
দিগন্ত রড দিয়ে তুলে দেওয়ালেই ঝুলিয়ে রাখল। নিচে নাম ঠিকানাও লিখল। তারপর সুইচ বাটন চেপে হাসল। মেঝেতে পড়ে থাকা সব রক্ত ধুয়ে যাচ্ছে। পাতালঘর এই পদ্ধতিতে বানানো। রক্ত ধোঁয়ার ঝামেলাও নেই। ঘড়িতে তখন চার’টা।
দিগন্ত সব কাজ সেরে রুমে চলে গেল। আজকে ঘুম হলো না। ধ্যাত, কালকে চোখের নিচে কালি না পড়লেই হয়। বিছানায় শরীর এলিয়ে দিতেই, শিফার কথা মনে হলো। কিছু একটা ভেবে হেসে চোখ জোড়া বন্ধ করে নিলো।

গভীর স্পর্শে শিফার ঘুম হালকা হলো। প্রথমে না বুঝলেও, পরে বুঝে স্বজোরে ধাক্কা দিলো। তবুও মানুষটাকে সরাতে পারল না। শিফা চোখ খুলে দিগন্তকে দেখে হতভম্ব। দিগন্ত এখানে? সে ঠিকানা জানল কিভাবে? কখনই বা এলো? ওর এখানে আসার কারণ কি? মুহূর্তে শিফার মাথায়
এসব প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে লাগল। ঘড়িতে কেবল পাঁচটা সাত বাজে। সে পুনরায় দিগন্তকে সরাতে ব্যর্থ হলো। দিগন্ত তখন কাঁধে নাক ঘষতে ঘষতে বলল,

-‘বাবা হওয়ার সুযোগ করে দাও। আমি খারাপ স্বামী হলেও ;একজন ভালো বাবা হবো।’

To be continue………!!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here