সাঁঝক বাতি-পর্ব:২১

0
437

-‘সাঁঝক বাতি-‘
নূরজাহান আক্তার (আলো)
[২১]

রুমজুড়ে সুনশান নিরাবতা। দুপুর গড়িয়ে এখন বিকেল। দিগন্ত শিফার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে। প্রায় ঘন্টা খানিক হলো। দুপুরে খায় নি।
শিফার ওড়না হাতে পেঁচিয়ে কোমর ঝাপটে ধরে আছে। খুব শক্ত বাঁধনে। শিফা যেন পালাতে না পারে। অথবা স্বপ্নীলকে খুঁজতে না পারে।এজন্য
এই বুদ্ধির প্রয়োগ। শিফা খাটে হেলান দিয়ে চুপ করে বসে আছে।দৃষ্টি ঘূর্ণায়মান সাদা সিলিংয়ের দিকে। গভীর ভাবনায় মগ্ন। দিগন্ত ঘুমের ঘোরে ওর পেটে নাক ঘষে পুনরায় ঘুমে তুলিয়ে গেল। তবে হাতের বাঁধন নরম করল না। শিফার চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে গেল। এই মানুষটার সঙ্গে সে
বৈধ সম্পর্কে আবদ্ধ। তার স্বামী! এছাড়াও জাত
শত্রু। মামার খুনি। বান্ধবীর খুনির ভাই।পাপী।
অসংখ্য অপকর্মে লিপ্ত। যা মাফেরও অযোগ্য।
এর পরিণতিও ভয়ংকর। শিফা দিগন্তের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। নিদারুণ মুখের গড়ন।এই মানুষটা এত জঘন্য বোঝার উপায়ও নেই। যাকে
বাবা বলে ডাকত, তাকেও নিজের হাতে মেরেছে।
তাও নৃশংসভাবে। বুক কাঁপে নি। মায়াও হয়নি।
এত খারাপ হয়েও, সে বাবা হওয়ার স্বপ্নও দেখে।
তাও শিফার গর্ভের বাচ্চার। যে সম্পর্কের ভীত নেই। প্রণয়ের ছিঁটেফোঁটাও নেই। সেই সম্পর্কের
জোরে নিষ্পাপ প্রাণকে আনা বোকামি। তার তো দোষ নাই। শিফা দিগন্তের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবে দিবে না। সম্ভবও না। কারণ, দিগন্তের যে রাগ, বাচ্চাকে মারতেও দু’বার ভাববে না। স্বার্থে লাগলে ভুলে যাবে তার বাচ্চা।

দিগন্তের কামড়ে শিফার ভাবনার ছেদ ঘটল। সে গভীর ভাবনায় ডুবে ছিলো। দিগন্ত হাসছে! যেন খুব মজা পেয়েছে। শিফা বিরক্তিতে মুখটা কুঁচকে নিলো। হাতে কামড়ের দাগ বসে গেছে। জ্বলছে।
দিগন্ত শিফাকে পুনরায় জাপটে ধরে বলল,

-‘ভাগ্যে কি আছে জানি না। তবে যতক্ষণ বেঁচে আছি, খুব বিরক্ত করব, খুব।’
-‘বাসায় যাব, সরুন।’
-‘উহুম, এখন না।’
-‘অতিরিক্ত কোনোকিছুই ভালো নয়।’
-‘সহমত। আমরা এখন গোসল সেরে, খাবো।’
-‘না, আমি বাসায় যাবো।’
-‘দিবো না যেতে। ইমাজেন্সি পিল আর কতবার খাবে? কি, ভেবেছ আমি কিছু জানি না। আমার সঙ্গে চালাকি! যেতেও দিবো না, ইমাজেন্সি পিল খেতেও পারবে না। এটাই ফাইনাল ডিসিশন।’

শিফা রেগে দিগন্তকে সরাতে চাইলেও পারল না।
বরং উঠে বসে শিফাকে বুকে জড়িয়ে নিলো।খুব শক্ত করে। ঠোঁটের কোণে ফিচেল হাসি। দিগন্ত
চোখজোড়া বন্ধ করে কিছু বলল। খুব’ই আস্তে।
শিফা ওর কথা বুঝল না। বোঝার চেষ্টাও করল না। ফোনে কল আসায় দিগন্ত সেভাবে জড়িয়ে ধরেই কথা বলল।শিফাকে সরালোও না, যেতেও দিলো না। বরং খুব যতনে আগলে রাখল, ওর
বক্ষপিঞ্জারায়। যেখানে হৃদপিন্ডের অবস্থান। সে শিফাকে হৃদপিন্ডের কাছে স্থান দিয়েছে।স্বজ্ঞানে!
স্ব-যতনে! তখন সুখু দরজা নক করল। দিগন্ত সাড়া দিলো না। কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। সময়টাকে থামিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। ঘড়ির কাঁটাকে স্থির করার সাধ জাগছে। এ আলিঙ্গনে শতযুগ পেরিয়ে যাক। জীবনও থমকে যাক। এই অবস্থায় মৃত্যু আসুক। নিয়ে যাক ওর প্রাণপাখি। অাফসোস থাকবে না। অনুশোচনাও হবে না।চারদিকে অফুরন্ত সুখ আর সুখ। এতবছর পর, জীবনে যেন সুখের সন্ধান মিলেছে।স্বস্তি পাচ্ছে।
শিফা নিশ্চুপ! এ প্রথম কোনো ছেলের বক্ষঃস্থলে
মাথা রেখেছে। হৃদপিন্ডের শব্দ শুনছে। খুব দ্রুত হার্টবিট চলাচল করছে। অদ্ভুত শব্দ।যেন ছিঁটকে
বেরিয়ে আসার উপক্রম। নিঃশ্বাসের গতিবিধি’ও অনুসরণ করছে।তবুও শরীরে শিহরণ বইছে না। কোনো অনুভূতি কাজ করছে না। মন অকেজো,
অনুভূতিশূন্য। শিফাকে চুপ থাকতে দেখে দিগন্ত ওর কপালে আদর দিয়ে বলল,

-‘ভালোবাসি না। একটুও না, একফোঁটাও না।’
-‘আচ্ছা।’
-‘যেতেও দিবো না।’
-‘আপনার চোখ অন্য কথা বলছে।’
-‘এ চোখের মায়ায় অনেকেই পড়েছে। তবে কেউ চোখের ভাষা পড়তে সক্ষম হয় নি। এমনকি সে, তুমিও না।’
-‘আপনার চোখ প্রণয়ের স্বপ্ন বুনছে। বিনাশকে আহ্বান করছে। সাবধান, পরে সামলানো দুষ্কর হয়ে যাবে।’

দিগন্ত শিফার গালে ঠোঁট ছুঁইয়ে সরে গেল। সুখু
ডাকছে। হয়তো বিশেষ কাজে। নয়তো এতবার
ডাকত না। তাও শিফার সঙ্গে থাকাকালীন। ওর এত সাহসও নেই। দিগন্তকে প্রচুর ভয় করে। যেন
ওকেই গিলে খাবে। দিগন্ত শার্ট ঠিক করে সামনে
পা বাড়াল। শিফাও বের হচ্ছে। এই তো সুযোগ।
দিগন্ত ব্যস্ত হলে সেও বেরিয়ে যাবে। কিন্তু, দিগন্ত বাইরে থেকে দরজা আঁটকে চলে গেল। তাও খুব দ্রুত। শিফা দৌড়ে গিয়েও বের হতে পারল না।
চেঁচিয়ে দরজা ধাক্কালো। লাভ হলো না। শিফার ডাক দিগন্ত শুনেও শুনল না। যেন বধির! বরং
মুখে শীষ বাজাতে বাজাতেই দো’তলায় নামল।
ফোনে কথা বলতে বলতে কর্ণারের একটা রুমে প্রবেশ করল। এখানেই স্বপ্নীলকে রাখা হয়েছে।অদূরে বসে সুখু গাঞ্জার পুরিয়া বানাচ্ছে।আজই
কাস্টমারকে সাপ্লাই দিতে হবে। দিগন্তকে ঢুকতে দেখে সুখু গাঞ্জার পুরিয়া লুকিয়ে ফেলল। দিগন্ত গাঞ্জা দেখতে পারে না। সবচেয়ে সস্তা নেশাদ্রব্য এটা। সুখুকে নিষেধ করে এসব না করতে। তবুও এতদিনের ব্যবসা সুখু ছাড়তে রাজি না।ব্যবসায়
নাকি মায়া পড়ে গেছে। তাই সে বিশেষ অনুরোধ করেছে, কাজটা যেন করতে দেওয়া হয়। এজন্য
দিগন্তও আর কিছু বলে না। স্বপ্নীলের প্রচন্ড জ্বর এসেছে। জ্ঞান নেই। মার খেয়ে জ্বরে ভুগছে।ওর শরীরে কালশিটে দাগ স্পষ্ট। দিগন্ত ওকে একটা ইনজেকশন পুশ করল। একটুপরেই, শরীর ঘেমে জ্বর ছাড়বে। জ্ঞানও ফিরবে। বেচারা অনেক কষ্ট পাচ্ছে। মুক্তি দিতে হবে। চির-মুক্তি। ওর সময়ও ঘনিয়ে এসেছে। বেশিদিন অপেক্ষা করাবে না।
সুখুকে খেয়াল রাখতে বলে দিগন্ত বেরিয়ে গেল।
এখন ওর বউকে সামলাতে হবে। আদরের বউটা খুব রেগে আছে।

ওইদিকে, শিফার পুরো পরিবার দিগন্তের সম্পর্কে সব জেনে গেছে। সবার মাথায় যেন মস্ত আকাশ ভেঙ্গে পড়েছে। দিগন্ত আর শিফা নিখোঁজ। ওরা কই? গতকাল, কেউ মাথা কাটা লাশ দিগন্তদের বাসার সামনে ফেলে গেছে। লাশের মাথা নেই। শুধু রক্তাক্ত দেহ। প্রতিবেশীরা দেখে পুলিশকে খবর দিয়েছে। পুলিশ এসে, প্রশান্ত বা দিগন্তের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে নি। এমনকি অন্য সদস্যেদেরও না। যেহেতু ওদের’ই বাসার সামনে।
তাই ওদের প্রয়োজন ছিল। যদি লাশটা শনাক্ত করতে পারে। পরে, প্রতিবেশীদের তথ্যানুসারে দিগন্তের বাবা-মা, প্রশান্ত-নিহা, দিগন্ত-শিফা ও সাবিনা খালার সম্পর্কে জানা গেছে। এরা সবাই উধাও। কাউকেই খুঁজে পায় নি। তারপর বাড়িটা তল্লাসি করে পাতালঘরের সন্ধান মিলেছে।এত
কঙ্কাল এবং তাদের ঠিকানাও। টিভিতে এটাই ব্রেকিং নিউজ। প্রতিটা চ্যানেলে ওই পাতালঘর, কঙ্কালের স্তুপ আর এসিডের কূপটাকেই বার বার দেখানো হচ্ছে। সব জেনে শিফার পুরো পরিবার হতবাক। পাড়া-প্রতিবেশি ,আত্মীয়-স্বজন এসে নানান কথা বলছেন। স্বান্ত্বণা দিচ্ছেন। কেউ বা খোঁচা মারছেন। শিফার বাবা-মা, ভাই, শিফার
চিন্তায় কাঁদছে। শিফা উনাদের প্রাণ।তমার এসব অজানা নয়। তাই শক’ও খায় নি। শুধু শিফার জন্য চিন্তিত। লাশটা কার? আর কে বা মারল?
মারল তো দিগন্তের বাসার সামনে রাখল কেন?
শিফা নয় তো! কিন্তু সে কোথায়? হাসিবও নেই।
কোনো খবরও পাচ্ছে না। দিগন্তের সঙ্গে শিফা নেই তো? তমা এসব চিন্তায় অস্থির।

শিফা রেগে দিগন্তের দিকে তাকিয়ে আছে। যেন
চোখ দিয়েই ভষ্ম করে দিবে। দিগন্ত হাসছে। তাও উচ্চশব্দে। দিগন্ত গোসল সেরে খাবার এনেছে।
শিফা খাবে না। সে এই মুহূর্তেই বাসায় যাবে।ওর কথা দিগন্ত পাত্তা না দিয়ে দুই হাত ওড়না দিয়ে বেঁধে দিলো। শিফার দুই পায়ের পাতার উপর পা রাখল। জোরে চাপ দিচ্ছে। তবুও সে খাচ্ছে না। দিগন্ত শিফার গাল চেপে খাবার ঢুকিয়ে দিলো।
তারপর নাক চেপে ধরল। শিফা শ্বাস আটকে
যাচ্ছে। অর্থাৎ নিঃশ্বাস নিতে গেলে খেতে হবে।
নয়তো খাবার ফেলতে হবে। দিগন্ত মুখও চেপে ধরেছে। উপায়ান্তর না পেয়ে শিফা দ্রুত খাবার গিলে নিলো। দিগন্তও নাক, মুখ, ছেড়ে দিলো। শিফা জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। চোখ দিয়ে অঝরে পানি ঝরছে। সে রেগে দিগন্তকে থাপ্পড় দিতে গেল। অমানুষ একটা। দিগন্ত ওর হাতটা ধরে হাতের উল্টো পিঠে আদর দিলো। বেহায়া পুরুষ! শিফার জেদ, ওর হাতে খাবেই না। আর দিগন্তের জেদ, খেতেই হবে। এই নিয়েও কিছুক্ষণ যুদ্ধ চলল। দিগন্ত নিজে খেয়ে আরাম করে শুয়ে টিভিতে সংবাদ দেখছে। রুমের দরজায় তালা।
শিফা সোফায় বসে গজগজ করছে। রাগে পুরো শরীর কাঁপছে। তখন দিগন্ত শীষ বাজিয়ে ওকে টিভি দেখার ইশারা করল। শিফা একবার দেখে
স্তম্ভিত হয়ে গেল। সবাই এসবকিছু জেনে গেছে!
নিউজে পাতালঘরটা দেখাচ্ছে। কঙ্কালগুলোও।
তাহলে ওর বাব-মা, ভাইরাও জেনে গেছে। ওদের কি অবস্থা? শিফা অবাক দৃষ্টিতে দিগন্তের দিকে তাকাল। ওর কোনো হেলদোল নেই। এসব যেন স্বাভাবিক। হওয়ারই কথা ছিল। দিগন্ত শিফাকে পানি এগিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

-‘ টেনশনের কিছু নেই। আমি আছি, পাগলি।’
-‘এসবের মানে কী? ওই মৃত লোকটা কে?’
-‘তোমারই খুব চেনা কেউ।’
-‘আমাকে মারছেন না কেন? আপনার পায়ে পড়ি আমাকে মারুন, প্লিজ।’
-‘নিজের হৃদপিন্ডকে কেউ মারে? ব্যথা যে নিজে পাবো।’

শিফা অবাক চাহনি তাকিয়ে আছে। দিগন্ত ওকে ভালোবাসে! ওর ধারণায় সঠিক। বিপরীত মেরু আকষর্ণ করা চুম্বুকের কাজ। তেমনি বিপরীত লিঙ্গের মানুষ খুব দ্রুত আকৃষ্ট হয় একে-অন্যের প্রতি। কিন্তু এমন হওয়া কথা ছিলো না। দিগন্ত! যে কি না ওকে সহ্য’ই করতে পারত না। সম্পর্কও তৈরি হয়েছিল শত্রুতার জোরে। যাকে মারতে সে মরিয়া হয়ে উঠেছে। সে নাকি তাকে ভালোবাসে!
ব্যাপারটা হাস্যকর হলেও হাসতে পারছে না।সব ওর কাছে ধোঁয়াশা লাগছে। দিগন্ত ওকে উঠিয়ে বিছানায় বসাল। তারপর দুই গালে হাত রেখে আদুরে কন্ঠে বলল,

-‘দেশের বাইরে চলে যাবো। সবকিছু নতুনভাবে শুরু করব। শুধু তোমাতে বিলীন হতে দাও।’

কথাটা বলে দিগন্ত উঠে চলে গেল। শিফা হাঁটু মুড়ে মুখ গুঁজে বসে রইল। সে সমীকরণ মিলাতে
ব্যস্ত। দিগন্ত আর রুমে আসল না। সন্ধ্যার পর, শিফা উঠে বাইরে বের হলো। কেউ নেই। নিচে নেমে হঠাৎ সুখুকে দেখে ডায়নিং টেবিলে বসল। আপেল তুলে খেতে লাগল।যেন আপেল খেতেই এসেছে। সুখু কিছু না বলে হেসে চলে গেল। ওর কাস্টমারকে গাঞ্জা দিতে। শিফা উঠে আশেপাশে কাউকে না দেখে ম্যানহলের দিকে গেল। প্রথম
সিঁড়িতে পা দেওয়ার দিতেই কেউ পেছন থেকে বলল,

-‘জান, পালাচ্ছো? যেতে না নিষেধ করলাম।’

দিগন্তের কন্ঠে রাগ স্পষ্ট। শিফা নির্বাক।আবার ধরা পড়ে গেল। তবুও স্বাভাবিকভাবে দাঁড়িয়ে রইল। অথচ দিগন্তকে দেখে ভয়ে বুকটা কাঁপছে।
দিগন্ত এগিয়ে এসে শিফার গাল শক্ত করে চেপে ধরে বলল,

-‘বেইমানীর জন্য ভাইকেও ছাড়ি নি। দেহ থেকে গলাটা আলাদা করে দিয়েছে। এখন তুইও একই পথেই হাঁটছিস!’

To be continue………!!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here