#সায়াহ্নের_প্রণয় 🦋🦋
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান (ছদ্মনাম)
#তৃতীয়_পর্ব
৭.
“ঐ চোখ জোড়ায় কি এমন মায়া আছে বলো তো মায়াবতী?
ইচ্ছে হয় খুব করে ডুবে যাই সেই চোখের গভীরতায়। কিন্তু কি বলো তো যতই সময় পার হচ্ছে ততই তুমি নামক নেশা আরোও তীব্র হচ্ছে। তবে যে নেশায় আমি আসক্ত সে নেশায় অন্য কাউকে আসক্ত হতে দিতে পারি বলো? তুমি শুধুমাত্র আমার নেশা। শুধুই আমার। এই নেশার দিকে যেই হাত বাড়াবে তাকেই নিঃশেষ হয়ে যেতে হবে আর সেটা যে কেউই হোক না কেন!
এটাই তোমার জন্যে আমার লাস্ট ওয়ার্নিং, জানেমান। সো বি কেয়ারফুল, মায়াবতী!
ইতি-
তোমার সাইকো লাভার!”
কাগজে গুটি গুটি অক্ষরে লিখা কথাগুলো পড়তেই পুরো শরীর হিম হয়ে আসে প্রাচীর। এটা কি আদৌ কোনো প্রেম চিরকুট নাকি ইনডাইরেক্টলি ওয়ার্নিং চিরকুট? কপাল থেকে দুশ্চিন্তার ঘাম বেয়ে পড়ছে তার। হাত দুটোও থরথর করে কাঁপছে। কিসের ওয়ার্নিং, অজানা আগন্তুক সম্পর্কে কোনোকিছুই মাথায় ঢুকছে না প্রাচীর। ভয়ার্ত দৃষ্টিতে একবার চিঠিতে চোখ বুলিয়ে পরক্ষণে পাশে ব্যালকনির দিকে তাকায় সে। কোথাও কারো উপস্থিতি নেই। এতদিন বিষয়টাকে খুব একটা পাত্তা না দিলেও অজানা ব্যক্তিটি সম্পর্কে তার কৌতুহল আর আশঙ্কা দিনকে দিন বেড়ে চলেছে। চিঠিটা টেবিলের উপর রেখে মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কাঁচ গুলোকে পরিষ্কার করে নেয় প্রাচী। তবে পরশু রাতের মতো আজও তার চোখে ঘুম জড়ো হবে না এটা সে নিশ্চিত।
বিয়ের পর প্রথম দিন বাড়িতে নানা আয়োজনের মধ্য দিয়েই কাটিয়ে দিচ্ছে ফিহা। তার এবং ইশরাকের রিসিপশনের অনুষ্ঠান হিসেবে নানা ধরনের আয়োজন করা হয়েছে। পরিবার আত্মীয় স্বজন সবার সহযোগিতায় নিজের ভেতরে থাকা অস্বস্তি খানিকটা কমে গিয়েছে। এদিকে সকাল থেকে প্রাচী ও সবার সাথে টুকটাক কাজ করে যাচ্ছে তবে মুখে তেমন একটা হাসি নেই বললেই চলে। কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ। অনেকক্ষণ ধরেই ব্যাপারটা খেয়াল করতেই জেবা বেগম হালকা কপাল কুঁচকে নেন।
– “কি ব্যাপার প্রাচী, এভাবে মুখ গোমড়া করে বসে আছিস কেন? কিছু হয়েছে?”
চিন্তিত গলায় বলে উঠলেন জেবা বেগম। এতে করে হালকা নড়েচড়ে বসে প্রাচী।
– “ক,ক্,কই মা? কি হবে? কিছু হয়নি তো। মাথাটা সকাল থেকেই একটু ধরেছে তাই। ও আর কিছু না।”
– “তাহলে সমস্যা কোথায়? রিসিপশনের অনুষ্ঠান হতে হতে এখনো বিকেল। এখনো তো অনেক সময় বাকি আছে। তুই উপরে গিয়ে কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে নে আর আয়োজন ও তো প্রায়ই শেষের দিকে।”
দেয়ালে থাকা ঝুলন্ত ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে বলে উঠেন জেবা বেগম। প্রাচীও মায়ের কথার প্রত্যুত্তরে কিছু বলে না। কেননা আসলেই তার রেস্ট দরকার। জেবা বেগমের কথায় হাতে থাকা ফুলের ঝুড়ি পাশে রেখে উঠে দাঁড়ালো সে। রুমের বাইরে বের হওয়ার জন্য পা বাড়াবে এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে রুমে প্রবেশ করে ইশরাক। ইশরাকের চোখ মুখ জুড়ে একপ্রকার অস্থিরতা।
– “কি ব্যাপার, ইশরাক? তুই এখানে কি করছিস? আর এভাবে দৌড়ে হাঁপিয়ে গিয়েছিস কেন? কিছু হয়েছে?”
– “কি হয়নি তাই বলো! হসপিটাল থেকে ফোন এসেছে। কাল সন্ধ্যায় যেই ছেলেটা বিয়েতে প্রাচীর সাথে বাজে ব্যবহার করেছিল সে ছেলেটাকে কেউ খুব বাজেভাবে মেরেছে। অবস্থা খুব ক্রিটিক্যাল। আইসিইউতে ভর্তি করা হয়েছে সকালেই।”
ইশরাকের কথা শুনে প্রাচী হতভম্ব। বাকি সবারও এক দশা। ইশরাকের কথায় কাল রাতের সেই অজানা আগন্তুকের কথা মনে পড়ে যায় তার। চিঠিতে লিখা প্রতিটা কথাই যেন এখন খোলাসা হয়ে গিয়েছে প্রাচীর কাছে। গতকাল সন্ধ্যায়,,
৮.
বিয়ের অনুষ্ঠানের মাঝে পানির তৃষ্ণায় ক্লিষ্ট হয়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায় প্রাচী। বিয়ে বাড়িতে সবার দৃষ্টি আর লক্ষ্য বর কনের দিকেই ছিল। রান্নাঘরে প্রবেশ করার কিছুক্ষণ পরেই কারো অপ্রীতিকর স্পর্শ পিঠ সংলগ্ন ছুঁয়ে দিতেই আতকে উঠে প্রাচী। তড়িৎ গতিতে পেছনের দিকে ফিরতেই অচেনা একটা ছেলের মুখশ্রী ভেসে আসে তার চোখে। ছিটকে অনেকখানি পেছনে সরে যায় সে। ছেলেটির মুখে বিশ্রী হাসির রেখা।
– “কে আপনি? এখানে কি করছেন? আর এসব কেমন অসভ্যতামি?”
কপট রাগ দেখিয়ে বলে উঠে প্রাচী। তবুও সামনে থাকা ছেলেটির মাঝে কোনো রূপান্তর নেই। ছেলেটি ধীর পায়ে এগোতে এগোতে বাজে ভঙ্গিমায় বলে উঠে,
– “বিয়ে বাড়িতে এমন সুন্দরী একটা পাখি পেলে সেটাকে কি আর ছাড়া যায় বলো? আর এমনিতেও অনেক দিন হয়ে গিয়েছে কোনো পাখি শিকার করতে পারি নি। আজকে এমন একটা সুযোগ পেয়েও কিভাবে হাতছাড়া করি বলো সুন্দরী!”
ছেলেটির কথার মর্মার্থ বুঝতে পেরে পুরো শরীর ঘিনঘিনে হয়ে ওঠে প্রাচীর।
– “দেখুন ভালোয় ভালোয় বলছি আমার রাস্তা ছেড়ে দিন। নাহলে আমি কিন্তু চিৎকার করে সবাইকে ডাক দেব।”
ঘৃণ্য দৃষ্টিতে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে শাসিয়ে বলে প্রাচী।
– “তাই নাকি, তা কাকে ডাকবি ডাক দেখি! আজ এই বিয়ে বাড়িতে তোর আওয়াজ কারো কান পর্যন্ত পৌঁছাবে না।”
বলেই বাঁকা হেসে প্রাচীর দিকে ছেলেটি হাত এগোতে নিলেই কোনো বলিষ্ঠ পুরুষালী হাত খপ করে ধরে ফেলে। প্রাচীও হালকা ভড়কে যায় কিন্তু পরক্ষণে পাশে সমুদ্রকে দেখতে পেয়ে স্বস্তি ফিরে আসে শরীরে। সমুদ্র রক্তচক্ষু নিয়ে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে কিছু না বলেই মুখ বরাবর একটা সজোরে ঘুষি মেরে দেয়। ফলস্বরূপ ছেলেটি রান্নাঘরের দরজায় ছিটকে পড়ে। এরূপ ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে ইশরাক সহ দুই পরিবারের বড় সদস্যরা ও সেখানে উপস্থিত হয়। প্রাচীও সুযোগ পেয়ে দৌড়ে যায় জেবা বেগমের কাছে। সবার উপস্থিতিতে ছেলেটিকে তার পরিবারের নিকট হস্তান্তর করা হয়। আহত অবস্থায় ছেলেটিকে নিয়ে তার পরিবারের লোকজন বেরিয়ে পড়ে নিঃশব্দে।
গতকাল সন্ধ্যার ঘটনায় ডুবে যায় প্রাচী।
– “কিন্তু ছেলেটাকে কে এত বাজেভাবে মেরেছে সে সম্পর্কে কিছু জানতে পেরেছিস।”
জেবা বেগমের করা প্রশ্নে ভাবনার জগত থেকে বেরিয়ে আসে প্রাচী। সেও কৌতুহল নিয়ে ইশরাকের প্রত্যুত্তরের অপেক্ষা করতে থাকে।
– “না, সেই লোকটার খোঁজ পাওয়া যায়নি তবে পুলিশ নাকি তদন্ত চালাচ্ছে। তবে যেই এই হোক কাজ করুক না কেন, সমাজের কীট গুলোর সাথে এমন হওয়াটাই দরকার।”
ব্যস্ত হয়ে বলে উঠে ইশরাক।
এভাবেই টুকটাক আলোচনার মধ্য দিয়েই কেটে যায় আরো কিছুক্ষণ। তবে প্রাচীর মনে দুদন্ড শান্তি নেই। কিছুক্ষণ বাদে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে চুপটি করে বের হয়ে পড়ে কক্ষ থেকে প্রাচী।
৯.
সন্ধ্যায়,,
ফিহার এবং ইশরাকের উভয়ের পরিবারের লোকজনই উপস্থিত হোসেন ভিলার হলরুমে। রিসিপশনের অনুষ্ঠান উপলক্ষে ফিহা আর ইশরাক দুজনকেই ম্যাচিং করে কালো রঙের লেহেঙ্গা আর শেরওয়ানি পড়ানো হয়েছে। দুজন কাপলকেই বেশ সুন্দর লাগছে। হলরুমে যেখানে স্টেজের মতো সাজানো হয়েছে সেখানেই এক পাশে ইশরাক বসে রয়েছে। তার ঠিক পাশেই সমুদ্র সহ বেশ কয়েকজন হাসি তামাশা করছে ইশরাকের সাথে। সমুদ্রের পড়নে ব্লু রঙের পাঞ্জাবি, হাতা ফোল্ড করা কনুই পর্যন্ত। চোখে সবসময়ের মতো থাকা গোল ফ্রেমের চশমাতে সব মিলিয়ে আকর্ষণীয় লাগছে। বড়রাও এক কোণে দাঁড়িয়ে গেস্টদের স্বাগতম জানাচ্ছে। সবার দৃষ্টি বরাবরের মতই হোসেন বাড়ির নতুন বউয়ের অর্থাৎ ফিহার উপর।
– “এটেনশন প্লিজ লেডিস এন্ড জেন্টলম্যান! আজকের মতো এত সুন্দর একটা সন্ধ্যায় এমন নীরবতা পালন করলে হয় নাকি? ছোট খাটো পারফরম্যান্স তো হওয়াই উচিত, তাইনা?
এখন আমাদের মাঝে পারফরমেন্স করবে আমাদের নিউ কাপল ইশরাক এন্ড ফিহা। আর সেখানেই গান গাইবে আমাদের মাঝে উপস্থিত জুনায়েদ আরহাম সমুদ্র।”
হুট করেই হলরুমের মাঝখানে দাঁড়িয়ে সবার উদ্দেশ্যে বলে উঠে সাদাত ওরফে ইশরাক আর সমুদ্রের সবচেয়ে ক্লোজ ফ্রেন্ড। সাদাতের কথায় আশপাশের উপস্থিত সবাই হাততালি দিয়ে উঠে। এদিকে হঠাৎ সাদাতের এমন আবদারে ভড়কে গেলেও পরক্ষণে নিজেকে সামলে নেয় সমুদ্র। এত বছর পর আবারও সমুদ্রের কন্ঠ শুনতে পারবে ভেবে আনমনে হেসে দেয় প্রাচী। চার পাঁচ বছর আগে যখন খুব ছোট ছিল তখন দু একবার সমুদ্রের কন্ঠস্বর শুনতে পেয়েছে সে তাও সৌভাগ্যক্রমে লুকিয়ে। তার ভাবনার মাঝেই স্পিকার থেকে মোহনীয় কন্ঠস্বর ভেসে এলো।
“……Ishq mubarak, dard mubarak (2)
Teri barishein…bhigayein mujhe…..
Teri hawayein…bahayein mujhe….
Pao tale mere jaminein chal pari..
Aisa to kabhi… huya hi nehin….
Aei mere Dil mubarak ho
Yehi to pyar hai..
Aei mere Dil mubarak ho
Yehi to pyar hai….
Ishq mubarak dard mubarak, Ishq mubarak dard mubarak..(2)
Aisa lagtahe kyu Teri ankhe jeise
Ankhon meri reh geyi..
Kabhi pehle mein e na suni jo
Aisi bateyin keh geyi…
Tu hi tu hai jo har taraf mere
To the pehle mein jaun kaha..
Aei mere Dil mubarak ho
Yehi to pyar hai…
Aei mere Dil mubarak ho
Yehi to pyar hai…
( বাকিটুকু নিজ দায়িত্বে শুনে নিবেন। )
গানের প্রতিটি স্টেপের সাথে স্টেপ মিলিয়ে ফিহা আর ইশরাক ডান্স করে চলেছে। মৃদু নীল লাইটের আলোতে এককোণে দাঁড়িয়ে থাকা সমুদ্রের হাতের উপর হঠাৎ করে চোখ যেতেই ভ্রু কুঁচকে নেয় প্রাচী। সমুদ্রের হাতে থাকা সাদা ব্যান্ডেজের প্রলেপ তার সন্দেহের পরিমাণ কিঞ্চিৎ বাড়িয়ে তোলে।
– “মিস্টার চাশমিশের হাতে ব্যান্ডেজ? কই কাল রাতেও তো তার হাত ঠিক ছিল।”
গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে বিড়বিড় করে উঠে প্রাচী। কিন্তু পরক্ষণেই মস্তিষ্ক জুড়ে এমন সব চিন্তাভাবনা এসে জড়ো হয় যার ফলস্বরূপ আতংকে, বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে যায় সে।
রাতের সব আয়োজন শেষ হতেই সকলেই নিজ নিজ কক্ষে অবস্থান করে। ফ্রেশ হয়ে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করতেই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ পেয়ে নড়েচড়ে উঠে সমুদ্র। একবার ঘড়ির দিকে চোখ বুলিয়ে নেয় সে। রাত প্রায় বারোটা বেজে গিয়েছে। এখন কে আসতে পারে তার রুমে? ভ্রু কুঁচকে এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলতেই অপর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা প্রাচীর উপর চোখ পড়ে তার।
– “তুমি এখানে? এত রাতে, কিছু প্রয়োজন ছিল?”
গম্ভীর গলায় প্রাচীর দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় সমুদ্র।
প্রাচী নির্বাক দৃষ্টিতে একপলক তাকায় সমুদ্রের দিকে। কেন যেন মন বলছে সমুদ্র এ কাজ করতে পারে না।
– “কি ব্যাপার, আমি কিছু জিজ্ঞেস করেছি! উত্তর না দিয়ে এভাবে স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে আছো কেন?”
সমুদ্রের প্রশ্নে ভ্রূক্ষেপ না করে হাতে থাকা কাগজটা সমুদ্রের দিকে এগিয়ে দেয় প্রাচী।
– “এসব কি মিস্টার জুনায়েদ আরহাম সমুদ্র? আপনি কেন ছেলেটাকে এভাবে মেরেছেন? আর এসব চিঠি, হুমকি কিসের জন্য? কি চাই আপনার!”
প্রাচীর কথার ভাবার্থ ঠিক বুঝতে পারে না সমুদ্র। তাই তার দিকে এগোনো চিঠিতে হাতে তুলে নেয় সে। চিঠিতে থাকা লিখা গুলো পড়ে আপনাআপনিই চোখ দুটো ছানাবড়া হয়ে আসে সমুদ্রের।……….
#চলবে 🍂
( আসসালামু আলাইকুম 🌼। সবাই কেমন আছেন? আজকের পর্ব কেমন হয়েছে জানাবেন।)