#সায়াহ্নের_প্রণয় 🦋🦋
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান (ছদ্মনাম)
#একাদশ_পর্ব ( রহস্য-১)
৩০.
পাত্রপক্ষের সামনে মাথা নিচু করে বসে আছে প্রাচী। নাকের ডগা, আর চোখ লালচে বর্ণ ধারণ করেছে। একটু আগেই ঘরের দরজা বন্ধ করে নিরবে অজানা গুমোট অনুভূতি গুলো কান্নার মাঝে প্রকাশ করেছে সে। পরনে ল্যাভেন্ডার কালারের শাড়ি। রাগে ক্ষোভে এখনো পাত্রের দিকে মাথা তুলে তাকায় নি প্রাচী।
– “আমরা তো অনেক কথাই বললাম, এবার না হয় ছেলে মেয়ে দুজনকে আলাদা করে কথা বলতে দেয়া যাক।”
– “হ্যাঁ, অবশ্যই। চলুন ওদিকটায় যাওয়া যাক।”
আনোয়ার সাহেবের কথায় মাঝবয়সী ভদ্রলোক ও তার স্ত্রী সহ সকলেই ধীরে ধীরে বেরিয়ে যেতেই চারপাশে থমথমে পরিবেশের সৃষ্টি হয়। সামনাসামনি দুজন মুখোমুখি হয়ে বসে থাকলেও কারো মুখে কোনো কথা নেই।
– “কি করব? এভাবে মাথা নিচু করে বসে থাকলে তো হবে না। কিছু একটা করতে হবে নাহলে এই লোকটার সাথে তোর বিয়ে ঠিক হয়ে যাবে। কি করলে বিয়েটা ভেঙে যাবে? কিছু একটা কর প্রাচী।
লোকটাকে সরাসরি না করে দিব? না আমি বিয়েটা করতে পারব না।”
মাথা নিচু করে নিজের সাথেই মনে মনে বিড়বিড় করে উঠে প্রাচী।
– “মিস প্রাচী?”
রুক্ষ কন্ঠস্বর, তবুও পরিচিত। সামনে থাকা ব্যক্তিটির কন্ঠ শুনে তড়িৎ গতিতে মাথা তুলে তাকায় প্রাচী। চেনা পরিচিত মুখ দেখতেই আরেক দফা অবাক হয় সে।
– “রাইয়্যান স্যার, আপনি!!”
খানিকটা অবিশ্বাস্য সুরেই বলে উঠে প্রাচী।
প্রাচীর থমথমে অবাক মুখশ্রী দেখে স্মিত হাসে রাইয়্যান।
– “হ্যাঁ, আমি। কেন অবাক হয়েছো?”
রাইয়্যানের প্রশ্নে থতমত খেয়ে বসে প্রাচী। তবুও মুখটাকে বেশ গম্ভীর করে শান্ত গলায় বলে ওঠে,
– “এসব কি রাইয়্যান স্যার? আমি আপনার কাছ থেকে অন্তত এসব এক্সপেক্ট করি নি।”
– “কাম ডাউন, মিস প্রাচী। ইটস এ নরমাল ম্যাটার। আর রইল এসব করার কারণ সেটা হলো আই ফল ইন লাভ উইথ ইউ মিস প্রাচী। আর সেটা হুট করেই না, ভার্সিটির প্রথম ক্লাসে দেখার পর থেকেই। আ’ম ম্যাডলি লাভ উইথ ইউ প্রাচী। আর সেটার জন্যই আমি আজকে এখানে এসেছি।”
রাইয়্যানের বলা কথায় পুরো থ বনে যায় প্রাচী। কি বলছে এসব রাইয়্যান? অতি আশ্চর্যতার কারণে চোখ দুটো ছানাবড়া হয়ে এসেছে ইতোমধ্যে।
– “হোয়াট!! কি বলছেন এসব আপনি? আর ইউ ফাইন মিস্টার রাইয়্যান?”
– “লিসেন প্রাচী। ডোন্ট বি হাইপার!
আগে আমার পুরো কথা তো শুনো। আমি সত্যিই তোমাকে ভালোবাসি আর সারাজীবনের জন্য ভালোবাসতে চাই, নিজের করে পেতে চাই। আই ওয়ান্ট টু ম্যারি ইউ মিস মেহরিশ আয়াত প্রাচী।”
রাইয়্যানের বলা শেষ কথাটি শুনে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় প্রাচী। রাগে ক্ষোভে চোখ দুটো বন্ধ করে নেয় সে। কিন্তু চোখ বন্ধ করার পরক্ষণেই অন্ধকারে থাকা সেই চোখ দুটো ভেসে উঠে।
– “মেহু পাখি, তুমি শুধু আমার!”
কল্পনার জগতে কথাটি কানে ভেসে আসতেই ঝট করে চোখ মেলে তাকায় প্রাচী। না তার পক্ষে রাইয়্যানকে বিয়ে করা সম্ভব না। রাইয়্যানের দিকে তাকিয়ে মুখ ফুটে কিছু বলতে যাবে তার পূর্বেই রুমে কড়া নাড়েন আনোয়ার সাহেব।
ফজলুল সাহেব, রুবি বেগম, আনোয়ার সাহেব, জেবা বেগম সকলেই হেসে হেসে কথা বলতে বলতে রুমে প্রবেশ করেন।
– “ভাইসাহেব, আজ তো অনেক হলো। বাচ্চারাও নিশ্চয়ই তাদের মাঝে কথা বলে নিয়েছে। আর আমরাও আশা করি ফলাফল ভালোই হবে। আজ উঠি তাহলে সবাই। আমি রাইয়্যানের সাথে কথা বলে সবটা জানিয়ে দিব।”
সবার সাথে কুশল বিনিময় করে রুম থেকে ধীরে ধীরে প্রস্থান করে রাইয়্যান ও তার পরিবার। এদিকে এই বিষয় নিয়ে চিন্তায় চোখ মুখ শুকিয়ে এসেছে ইতোমধ্যে প্রাচীর। তাহলে কি সবকিছুই তার হাতছাড়া হয়ে গেল?
৩১.
পুরো খাট জুড়ে ছোট বড় চিরকুট দিয়ে ভরপুর। তার থেকে ঠিক কিছুটা দূরেই দেয়ালের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রাচী।
– “এতদিন এসব করার কি মানে ছিল? কি দরকার ছিল এসব চিরকুট লিখার, আমাকে এসবের প্রতি দুর্বল করার; যেখানে বর্তমানে আপনার কোনো অস্তিত্বই নেই।
আর যদি অস্তিত্ব থাকতো তাহলে এভাবে আড়ালে লুকিয়ে থাকতেন না, নিজেকে প্রকাশ করতেন আমার সামনে। আমি চাই না আর এসব লুকোচুরি। এসব লুকোচুরি খেলা বাদ দিয়ে সামনে আসুন আমার। আমিও দেখতে চাই কে আপনি; কি আপনার পরিচয় যাকে ঘিরে এত রহস্য!”
বাইরের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দৃঢ় কন্ঠে প্রলাপ বকে প্রাচী।
– “কি মনে করেছো, এসব হুট করেই হয়েছে? নো মিস প্রাচী। ইউ আর টোটালি রং! এসব তোমার কাছে হুট করে মনে হলেও আসল রহস্য তোমার অজানাই। এই খেলার সামান্য মাত্র একটা গুটি তুমি, যাকে কাজে লাগিয়ে আমি আমার বানানো প্ল্যান এক্সিকিউট করব আর সেটা তুমি টেরও পাবে না।
ভালোবাসা? বিয়ে করা? সেটাতো জাস্ট একটা গেইম। এই রাইয়্যান আহমেদের কাছে ভালোবাসা বলে কিছু ছিল না, না কিছু আছে আর না কখনো হবে!
আর বাদবাকি রইলো তোমার হিডেন লাভার, ওর সাইকো লাভার হোয়াটেভার সেও আমাকে আটকাতে পারবে না। বি রেডি মিস প্রাচী ফর ইউর স্যাক্রিফাইস।”
ক্লাবের এক কর্ণারে বসে ওয়াইনের গ্লাস হাতে নিয়ে বিড়বিড় করে উঠে রাইয়্যান। সামনেই ফোনের স্ক্রিনে প্রাচীর একটি হাস্যোজ্জ্বল ছবি ভেসে রয়েছে। কি এমন রহস্য; যাকে ঘিরে এতকিছু?
পরদিন সকালে,,
যথারীতি সময়ে সকালের নাস্তার টেবিলে এসে বসতেই জেবা বেগম বলে উঠেন,
– “যাক তাহলে এসেছিস, এই নে ঝটপট নাস্তা খেয়ে নে।”
মিনিট পাঁচেক বাদে রুম থেকে আনোয়ার সাহেব ও বের হন। মুখে যথেষ্ট হাসি হাসি ভাব। এগিয়ে গিয়ে চেয়ার টেনে বসতে বসতেই তিনি বলে উঠেন,
– “শুনছো নাকি জেবা, একটু আগেই রাইয়্যানের বাবার সাথে কথা হয়েছে ফোনে। তাদের নাকি প্রাচীকে পছন্দ হয়েছে। আর রাইয়্যানের সাথে কথা বলে এটাও জানিয়েছে যে তারা খুব দ্রুতই বিয়ের ডেট ফিক্সড করতে চায়।”
– “আলহামদুলিল্লাহ্। এ তো দেখছি বেশ ভালো খবরই পাওয়া গেল সকাল সকালই।”
সবে মাত্র এক লোকমা খাবার মুখে তুলেছিল প্রাচী। কিন্তু বাবার কথা শুনে সেটাও যেন গলায় আটকে গিয়েছে।
– “কিন্তু বাবা, এটা একটু বেশিই তাড়াতাড়ি হয়ে যাচ্ছে না? সবে তো রাইয়্যান দেখে গিয়েছে প্রাচীকে; এর মাঝেই এত তাড়াতাড়ি বিয়ের ব্যাপারটা কি আদৌ ঠিক হবে?”
আনোয়ার সাহেবের দিকে তাকিয়ে শঙ্কাজনক কন্ঠে বলে উঠে ইশরাক।
– “হ্যাঁ, বাবা ভাইয়া তো,,”
প্রাচীর কথাকে ইশারায় থামিয়ে দেয় জেবা বেগম।
– “আমি জানি বিয়েটা খুব তাড়াতাড়ি হচ্ছে, তবে এমন ভালো ছেলে হাতছাড়া করা কি ঠিক হবে? দেখতে ভালো, ইস্টাবলিশড্, আর সবচেয়ে বড় কথা হলো আমাদের প্রাচীকে ভালো রাখবে।
আর আমিও চাই বিয়েটা খুব শীঘ্রই হয়ে যাক। আশা করি আমার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কেউ উপনীত হবে না।”
নিজের বাবার এমন পরিবর্তনশীল আচরণ ঠিক মেনে নিতে পারছে না প্রাচী। কেন যেন মন সায় দিচ্ছে না এই বিয়েটা করতে। অন্যদিকে আনোয়ার সাহেবের কথায় ইশরাক ও আর কথা বাড়ায় না। অপেক্ষা এখন শুধু সময়ের।
– “মা, আমি আসছি।”
– “কিন্তু পুরোটা না খেয়ে কোথায় যাচ্ছিস?”
– “খিদে নেই। আকাশ আর হৃদিতা ওয়েট করছে আমার জন্য।”
বলেই ব্যাগ নিয়ে উঠে দ্রুত পায়ে বাইরের দিকে হাঁটা শুরু করে প্রাচী।
৩২.
– “আচ্ছা বাবা, তুমি আমাল সাথে সবসময় থাকো না কেন?”
ল্যাপটপে কাজ করতে ব্যস্ত ছিল সমুদ্র। পিহুর করা প্রশ্নে থেমে যায় সে। ল্যাপটপ থেকে দৃষ্টি সরাতেই খেয়াল করে পিহুও তার করা প্রশ্নের উত্তর পেতে উৎসুক হয়ে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
– “হঠাৎ এ প্রশ্ন কেন পিহু মামনি?”
– “সবাল বাবা, মাই তো একসাথে থাকে। কই তুমি তো আমাল সাথে সবসময় থাকো না। আর মা কোথায় বাবা?”
পিহুর প্রশ্নের কি উত্তর দিবে তা খুঁজে পায় না সমুদ্র। কি করে বোঝাবে এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে তাকে ছুটে চলতে হবে সেই সুদূর অতীতে।
– “বলেছি তো পিহু মামনি, আর কয়েকটা দিন। আর কয়েকটা দিন পার হলেই বাবা তোমার সাথেই থাকবে। আর তোমার মা ও থাকবে। বলেছিলাম না তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে। সেই সারপ্রাইজ টা তুমি খুব শীঘ্রই পেয়ে যাবে পিহু মামনি।
মিস অর্পিতা?”
সমুদ্রের ডাকে কিচেন থেকে ছুটে আসে অর্পিতা। সমুদ্র চোখের ইশারা দিতেই অর্পিতা এসে পিহুকে কোলে তুলে নিয়ে চলে যায়।
ল্যাপটপ স্ক্রিনে ভেসে থাকা ইমেইল ফাইল ওপেন করতেই ঠোঁটের কোণে হাসির চিহ্ন ফুটে ওঠে সমুদ্রের।
– “গেইম ইজ অন।”
কফিশপের কর্ণারের দিকে থাকা সিটে বসে রয়েছে আকাশ, হৃদিতা আর প্রাচী। আকাশ আর হৃদিতা দুজনের দৃষ্টিই বর্তমানে প্রাচীর দিকে স্থির।
– “এসবের মাঝে এতকিছু হয়ে গেল অথচ তুই আমাদের জানানোর প্রয়োজন ও মনে করিস নি?”
শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করে উঠে হৃদিতা। অন্যদিকে প্রাচীর দৃষ্টি নিচের দিকে স্থির।
– “তোর সাথে এত কিছু হয়েছে আর তুই একটাবারও বলিস নি। আর রইল রাইয়্যান স্যারের কথা, ব্যাটা যে এত পরিমাণ লুচু হবে তা কে জানতো!”
– “কেন বলিনি সেটার কারণ তোদের একটু আগেই বলেছি।”
– “তো এখন কি করতে চাস তুই? তুই কি সত্যিই রাইয়্যান স্যারকে বিয়ে করতে যাচ্ছিস?”
আকাশের করা প্রশ্নে মুখ তুলে তাকায় প্রাচী।
– “যেমনটা চলছে তেমনটাই চলতে দে। এই বিয়েতেই সেই অজানা আগন্তুকের পরিচয় পাওয়া যাবে। সে নিজে থেকেই আমার সামনে এসে দাঁড়াবে এন্ড ইটস্ মাই প্রমিজ। আর তার জন্য যদি আমাকে মিস্টার রাইয়্যানের সাথে বিয়েও করতে হয় তাতেও আমি রাজি।
বি রেডি মিস্টার ইনভিজিবল, ব্যস অনেক হয়েছে গেইম। এবার আপনাকে আমার সামনে আসতেই হবে।”
খানিকটা দৃঢ়তার সাথে বলে উঠে প্রাচী। আসলেই কি তাই? তবে কি এবার আসলেই বেরিয়ে আসবে মিস্টার ইনভিজিবলের পরিচয়?…………..
#চলবে 🍂