সায়াহ্নের 🦋 পর্ব-১৫

0
913

#সায়াহ্নের_প্রণয় 🦋🦋
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান (ছদ্মনাম)
#পঞ্চদশ_পর্ব

৪৪.
কেটে গিয়েছে মাঝ থেকে দুদিন। আজ সকাল থেকেই প্রাচী ব্যস্ত হয়ে পড়েছে লাগেজ গোছানো সহ বিভিন্ন কাজে। খুব সকালে উঠেই বাড়ির সবার পছন্দের ব্রেকফাস্ট তৈরি করে নিয়েছে সে। এই দু দিনে কোহিনুর চৌধুরী আর সাদাত চৌধুরীর আচরণে বরাবরের মতই মুগ্ধ হয়েছে প্রাচী।
বিয়ের পরের নিয়ম রীতি অনুযায়ী আজ তার পুনরায় বাবার বাড়ি অর্থাৎ আনোয়ার হোসেনের বাড়িতে যাওয়ার কথা। এ জন্যই এত আয়োজন আর তাড়াহুড়ো। সব কাজ শেষ করে রুমে প্রবেশ করতেই সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সমুদ্রকে দেখে অতি বিস্ময়ে চোখ বন্ধ করে চিৎকার দিয়ে বসে।
এদিকে প্রাচীর এহেন চিৎকারে চোখ মুখ কুঁচকে নেয় সমুদ্র। সদ্য শাওয়ার করে বেরিয়ে আসায় উন্মুক্ত লোমশ বুকে বিন্দু পানি জমে রয়েছে।
– “কি হয়েছে? এভাবে গলা ফাটিয়ে ষাঁড়ের মত চিল্লাচিল্লি করছো কেন?”
সমুদ্রের কথায় অপর পাশে ঘুরেই চোখ মেলে তাকায় প্রাচী।
– “চিল্লাচিল্লি করব না মানে? আপনি এভাবে জামাকাপড় ছাড়া টাওয়াল রুমে ঘুর ঘুর করছেন কেন? ঠিকই বলেছিলাম; এই ব্যাটার লাজ লজ্জা বলতে কিছুই নেই।”
ঠোঁট দুটো কিঞ্চিৎ প্রসারিত করে প্রলাপ বকে প্রাচী।
– “তো আমার রুম, আমি যেভাবে খুশি থাকব। আর এতে লজ্জার কি আছে? আফটার অল আ’ম‌ ইউর হাজবেন্ড; তাইনা মিসেস প্রাচী?”
– “আপনার সাথে কথা বলে কোনো লাভই নেই। আপনি থাকুন আপনার রুমে। আমি যাচ্ছি।”
বলেই বড় বড় পায়ে রুম ত্যাগ করে প্রাচী। অন্যদিকে প্রাচীর যাওয়ার পানে তাকিয়ে মুচকি হেসে বিছানায় পড়ে থাকা ব্ল্যাক কালারের শার্ট তুলে নেয় সমুদ্র।
কোহিনুর চৌধুরী এবং সাদাত চৌধুরীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে গাড়িতে বসতেই গাড়ি চলা শুরু করে নিজ গন্তব্যে।

হোসেন বাড়িতে বেশ আয়োজন চলছে। আনোয়ার সাহেব আর জেবা বেগম সহ বাড়ির সবার মাঝেই বেশ‌ প্রফুল্লতা‌ প্রাচী ও সমুদ্রের আগমনের বিষয় নিয়ে।
– “কি ব্যাপার জেবা, ওরা কখন বেরিয়েছে এ সম্পর্কে ফোন করে কিছু বলেছে?”
সোফার উপর বসে চা খেতে খেতে বলে উঠলেন আনোয়ার সাহেব।
– “না এখনো তো কিছুই বলে নি। একটু পরেই হয়তো পৌঁছে,,”
জেবা বেগমের কথার মাঝেই বাসার কলিং বেল বেজে ওঠে।
– “ঐ তো। হয়তো প্রাচী আর সমুদ্র এসে পড়েছে।”
– “মা, আপনি বসুন। আমি গিয়ে দেখছি।”
জেবা বেগমকে বলে এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দেয় ফিহা। চেনা পরিচিত মুখশ্রী দেখতেই প্রাচীর ঠোঁটের কোণে প্রশস্ত হাসির রেখা ফুটে ওঠে। নিজের হাত দুটো প্রসারিত করে ফিহাকে জড়িয়ে ধরে সে।
সমুদ্র ও এগিয়ে গিয়ে বড়দের সালাম দেয়। ইশরাক এগিয়ে আসতেই মুচকি হেসে গিয়ে ইশরাককে জড়িয়ে ধরে সমুদ্র।

নানা রকম ব্যস্ততায় দুপুর গড়িয়ে বিকেল। সুবিশাল, সীমাহীন আকাশের মাঝে রৌদ্রের কোনো নাম গন্ধ নেই। মাঝেমধ্যে এক ঝাঁক পাখি উড়ে যাচ্ছে। আর সেটাই রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টে পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে প্রাচী। অবাধ্য চুলগুলো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে বারবার তারপরও তার মাঝে কোনো প্রকার হেলদোল নেই।
– “এটা কি করলি প্রাচী? তুই তো বলেছিলি রাইয়্যান স্যারের সাথে বিয়ের দিন তোর সেই অজানা আগন্তুক বেরিয়ে আসবে সবার সামনে। কিন্তু সেদিন কি হলো? রাইয়্যান স্যার নিজ থেকেই বিয়ে ভেঙে দিলেন; তার উপর সবচেয়ে বড় কথা তোর বিয়ে সমুদ্র ভাইয়ার সাথে হয়ে গেল!”
একনাগাড়ে প্রাচীকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে হৃদিতা। হৃদিতার কথায় আকাশের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে রেলিং ছেড়ে হৃদিতার দিকে ঘুরে তাকালো প্রাচী।
– “রাইয়্যান স্যার নিজ থেকে বিয়ে ভাঙেনি হৃদিতা; আর না নিজ থেকে উধাও হয়েছে। এই বিয়েটা ভাঙানো হয়েছে। আর কে ভাঙিয়েছে সেটাও আমার খুব ভালো করেই জানা আছে।
বাকি রইল, মিস্টার ইনভিজিবলের‌ কথা? সে অলরেডি আমার কাছেই আছে।”
প্রাচীর বলা পুরো কথাই যেন হৃদিতার‌ মাথার উপর দিয়ে গেল। এদিকে হৃদিতাকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকতে দেখে স্মিত হাসে প্রাচী; যেন প্রতিটি চরিত্রই ভীষণ রহস্যময়ী।

৪৫.
রাতের ডিনার শেষে বাড়ির সবাই যখন খোশগল্পে ব্যস্ত তখন নিজের রুমে প্রবেশ করে প্রাচী। মাথা যন্ত্রণা দিন দিন বেড়েই চলেছে। ড্রয়ার হাতড়ে একটা ঔষধের কৌটা বের করে তা থেকে একটা ঔষধ খেয়ে নেয় সে। ইদানিং মাথা যন্ত্রণার সাথে সাথে স্মৃতিশক্তি ও বোধ হয় হ্রাস পাচ্ছে।
অন্যদিকে ফোনের ভাইব্রেশন বেজে উঠায় পাশ ফিরে তাকায় প্রাচী। সমুদ্রের ফোনটা হয়তো ঘরেই ভুলে গিয়েছে। ফোনটা বাজতে বাজতে একসময় নিজ থেকেই কেটে যায়।
মিনিট দুয়েক পর ফোনটা পুনরায় বেজে উঠতেই ভ্রু কুঁচকে নেয় প্রাচী। ধীরে ধীরে উঠে গিয়ে ফোনটা হাতে নিতেই স্ক্রিনে পিহু নামটা ভেসে ওঠে।
– “পিহু? সে আবার কে? এই নামটা তো আগে কখনো শুনিনি।”
আনমনে ভাবতে ভাবতে ফোনটা রিসিভ করতে যাবে তখনি হাত থেকে কেউ খপ করে ফোন কেড়ে নেয়ায় খানিকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় প্রাচী কিন্তু পরক্ষণেই সমুদ্রকে দেখতে পেয়ে স্থির হয় সে।
– “কাউকে জিজ্ঞেস না করে তার পার্সোনাল বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা মোটেও ঠিক না মিসেস প্রাচী।”
হঠাৎ সমুদ্রের এমন পরিবর্তিত আচরণ তেমন একটা ভালো লাগেনি প্রাচীর কাছে। মুহূর্তেই মনটা বিষন্ন হয়। তাহলে কে হয় পিহু সমুদ্রের?
– “আমি তো শুধু দেখছিলাম কে কল করেছে? এতই যখন পার্সোনাল ছিল তখন ফোনটা এভাবে রুমে খামখেয়ালি ভাবে ফেলে রেখেছিলেন কেন?”
সোজাসাপ্টা গলায় বলে উঠে দাঁড়ায় প্রাচী। কন্ঠে অভিমান মিশ্রিত। এগিয়ে গিয়ে ব্যালকনির দরজা খুলে ইজি চেয়ারটাতে বসে পড়ে। সমুদ্র ও আগ বাড়িয়ে মুখ ফুটে কিছু বলে না।
– “আ’ম সরি প্রাচী। আমি এখন চাইলেও তোমাকে পিহুর ব্যাপারে কিছু বলতে পারব না। তবে কিছু সময় পার হতে দাও। আমি নিজেই তোমাকে পিহুর ব্যাপারে সবটা বলব।”
মনে মনে বিড়বিড় করে সমুদ্র। কপালে তার সুক্ষ্ম চিন্তার রেখা। তার ভাবনার মাঝেই ফোনটা বেজে উঠতেই ফোন নিয়ে রুম ত্যাগ করে সে।

আজ ফিহার‌ জন্মদিন। জন্মদিন উপলক্ষে হোসেন বাড়ির সবাই বেশ খুশি। পুরো পরিবারের সদস্যদের মধ্যে জেবা বেগমের সাথে সকাল থেকেই কাজে লেগে পড়েছে প্রাচী। কাজের মাঝে কয়েকবার সমুদ্রের সম্মুখীন হলেও এড়িয়ে গিয়েছে সে। সমুদ্রকে এড়িয়ে যাওয়ার বিষয়টা চোখ এড়ায় না সমুদ্রের। এড়ানোর বিষয়টা বেশ ভাবিয়ে তুলেছে তাকে।
সন্ধ্যায় ছোট খাটো একটা পার্টি রাখা হয়েছে। আর সে উপলক্ষ্যে বাড়ির সব‌ কাপল ই ম্যাচিং করে ড্রেস পড়বে। রুমে বসে হেডফোন কানে গুঁজে গান শুনতে ব্যস্ত ছিল সমুদ্র। তখনই হাতে দুটো মাঝারি আকারের প্যাকেট নিয়ে রুমে প্রবেশ করে প্রাচী। নিজের জন্য রাখা প্যাকেটটা আলাদা করে রেখে সমুদ্রের প্যাকেটটা নিয়ে সমুদ্রের দিকে এগিয়ে দেয় সে।
– “এটা ভাইয়া পাঠিয়েছে। বাড়ির সবাই কাপল ড্রেস পড়বে। আর আপনাকেও এটা পড়তে বলে দিয়েছে।”
গম্ভীর মুখে বলতেই সমুদ্র কান থেকে হেডফোন খুলে তা পাশে রেখে ভ্রু কুঁচকে বলে ওঠে,
– “কি হয়েছে? শুনি নি আমি। আবার বলো।”
বিরক্তিকর দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্যাকেটটা বিছানায় রেখে পুনরায় বলে উঠে,
– “শুনবেন কি করে? কানে তো‌ হেডফোন গুঁজে ছিলেন।”
– “কি করব বলো, বাড়িতে এত সুন্দরী একটা বউ থাকতেও বোর হতে হয়। ভাবলাম কি আর করার; কানে হেডফোন গুঁজে না হয় গান ই শুনি।”
সমুদ্রের মুখে বউ ডাক শুনতেই থমকে যায় প্রাচী। মনের মধ্যে জমে থাকা অভিমান গুলো হুড় হুড় করে পালাতে থাকে।
– “সন্ধ্যায় পার্টিতে পড়ার জন্য এটা ভাইয়া পাঠিয়েছে। রেডি হয়ে নিচে চলে আসবেন।”
আর দাঁড়ায় না প্রাচী। দ্রুত পায়ে গটগট করে রুম থেকে বেরিয়ে পড়ে সে।

বেবি পিংক আর হোয়াইট কালারের কম্বিনেশনের গাউন, গলায় আর কানে পার্লের অর্নামেন্টস্, লম্বা চুলগুলো কার্ল করে বেঁধে রাখা। জন্মদিনের মূল কেন্দ্রবিন্দু যাকে ঘিরে; ফিহাকে দেখতে ভীষণ সুন্দর ও আকর্ষণীয় লাগছে। পাশেই হাস্যোজ্জ্বল মুখে দাঁড়িয়ে আছে ইশরাক‌। তার পরনেও ম্যাচিং করা স্যুট।
অন্যদিকে ডার্ক পার্পেল কালারের শাড়ি, গলায় আর কানে পার্লের অর্নামেন্টস্, চুলগুলো সুন্দর করে স্ট্রেট করে ছেড়ে দেয়া। পার্পেলের‌ সংমিশ্রণ প্রাচীর সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে দিয়েছে আরো কয়েক গুণ। পাশেই ডার্ক পার্পেলের পাঞ্জাবি, পাজামা পড়ে দাঁড়িয়ে আছে সমুদ্র। চোখে প্রতিদিনকার সেই ফ্রেমের‌ চশমা, হাতা ফোল্ড করে রাখা। বাড়ির আকর্ষণীয় কাপলের মধ্যে এরাও অন্তর্ভুক্ত।

কেক কাটিং এর পর ফিহাকে তার জন্মদিনের গিফট হিসেবে একটা আংটি সবার সামনে ফিল্মি স্টাইলে বসে পড়িয়ে দেয় ইশরাক‌। এতে চারপাশ করতালিতে মুখরিত হতে থাকে ক্রমশ।
– “লেডিস এন্ড জেন্টলম্যান। আপনারা সবাই জানেন আজকে আমার ওয়াইফি, আমার ভালোবাসা ফিহার জন্মদিন। আর তার জন্যেই এত আয়োজন। তো এই আয়োজনকে আরো একটু আকর্ষণীয় করতে একটা ডান্স সেগমেন্ট করলে কেমন হয়? এখানে উপস্থিত সকল কাপলকেই এই সেগমেন্টে পার্টিসিপেট করতে হবে।”
কাপল ডান্সের কথা শুনে চোখ দুটো ছানাবড়া হয়ে আসে প্রাচীর।
– “হোয়াট! ডান্স?”……….

#চলবে 🍂

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here