সায়াহ্নের 🦋 পর্ব-১৭

0
924

#সায়াহ্নের_প্রণয় 🦋🦋
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান (ছদ্মনাম)
#সপ্তদশ_পর্ব (ধামাকা স্পেশাল‌)

৪৯.
সময় বহমান। মনুষ্য জীবনের নানান রকম ব্যস্ততা ও সময়ের পরিক্রমায় অনেক পরিবর্তন এসে পড়ে। তেমনই হোসেন বাড়ি থেকে আসার পর সমুদ্রের অফিস জয়েন শুরু থেকে প্রাচীর অনার্স থার্ড ইয়ারের ক্লাস জয়েন‌ করায় সময় অচিরেই কেটে গিয়েছে।
সময়ের সাথে সাথে সমুদ্র আর প্রাচীর সম্পর্কেও বেশ পরিবর্তন এসেছে। দুজনের মাঝেই বন্ডিং বেশ গাঢ় হয়েছে। তবে এই কয়েক মাসে সমুদ্রের বেশ কিছু আচরণ প্রাচীকে বারংবার ভাবিয়ে তুলেছে। কিন্তু সমুদ্রকে জিজ্ঞেস করা হয়ে ওঠেনি এই ভেবে সমুদ্র নিজ থেকে তাকে সবটা বলবে।
আজ সকালে,,
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে টাই বাঁধায় ব্যস্ত ছিল সমুদ্র। তখনই রুমে ব্যাগ আর ফোন হাতে তুলতে তুলতে সমুদ্রের উদ্দেশ্যে প্রাচী বলে উঠে,
– “আজ আপনি ফ্রি আছেন?”
প্রাচীর হঠাৎ আবদারে‌ ঘাড় ঘুরিয়ে পেছন ফিরে তাকায় সমুদ্র।
– “আজ একটা ইম্পর্ট্যান্ট মিটিং আছে প্রাচী। অফিসের প্রজেক্ট নিয়ে অনেক কাজ পড়ে আছে।
কিন্তু কেন?”
সমুদ্রের উত্তরে মন খানিকটা বিষন্ন হয় প্রাচীর।
– “না এমনিতেই। আজ একটু ঘুরতে যেতে মন চেয়েছিল তাই ভেবেছিলাম আপনাকে বলব। ইটস ওকে। আমি ক্লাস শেষে হৃদিতার‌ সাথে কফিশপে চলে যাব।”
বলেই সমুদ্রকে পাশ কাটিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে পড়ে প্রাচী‌ আর অন্যদিকে প্রাচীর যাওয়ার পানে তাকিয়ে ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সমুদ্র।

আজকে অফ পিরিয়ড থাকায় দুটো ক্লাস করেই ক্যাম্পাসের দিকে বেরিয়ে পড়ে প্রাচী। পাশেই হৃদিতা আকাশ দুজন কথা বলছে আর হাঁটছে। ক্যাম্পাস থেকে খানিকটা বের হতেই দূরে হাওয়াই মিঠাই আর আইসক্রিম স্টল‌ চোখে পড়তেই থমকে দাঁড়ায় প্রাচী। আজ থেকে কিছুটা দিন আগেও এমনই একটা জায়গায় বেশ সুন্দর মুহূর্ত কাটিয়েছে সে সমুদ্রের সাথে। কিন্তু ইদানিং সমুদ্রের ব্যস্ততা আর পরিবর্তনশীল আচরণের জন্য তা আর হয়ে ওঠে না খুব একটা।
– “কি ব্যাপার, দাঁড়িয়ে পড়লি যে আয়াত? কোনো সমস্যা?”
– “না না কোনো সমস্যা নেই। ভাবছিলাম এখানে যখন এসেই পড়েছি তখন ওখানে গিয়ে আইসক্রিম খাওয়া যাক। এমনিতেও শীতের জন্য আইসক্রিম খাওয়া মিস করেছি খুব।”
প্রাচীর কথায় হৃদিতা আর আকাশ ও সায় দেয়। স্টল টা নতুন বসেছে বোধ হয়। এগিয়ে গিয়ে তিনজনের জন্যেই পছন্দ মতো আইসক্রিম কিনে নেয় প্রাচী। আইসক্রিমের বিল পরিশোধ করা শেষে তিনজন পুনরায় হাঁটা শুরু করে বাইরের দিকে।

এদিকে মিনিট বিশেক পর ক্যাম্পাসের বাইরে এসে গাড়ি থামায় সমুদ্র। সকালে প্রাচীর করা আবদারটি প্রত্যাখ্যান করতে পারে নি সে। কাজের ব্যস্ততায় প্রাচীকে তেমন একটা সময় দিতে পারে না সমুদ্র। গাড়ি পাশেই পার্কিং করে বেরিয়ে পড়ে সে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে সঠিক সময়েই পৌঁছেছে সে। এখনি তো প্রাচীর ক্লাস শেষ হওয়ার কথা।
ফোনের কললিস্ট ঘেঁটে প্রাচীর নাম্বারে ডায়াল‌ করতেই অপর পাশ কোনো রেসপন্স আসে না বরং সুইচড অফ করে রাখা। এতে সামান্য পরিমাণ খটকা লাগলেও তা এড়িয়ে যায় সমুদ্র। সেখানে আরো দশ পনেরো মিনিট দাঁড়িয়ে থাকলেও তেমন কোন প্রত্যাশিত ফলাফল পায় না সে।
– “তবে কি প্রাচী আগেই বেরিয়ে গিয়েছে আকাশ আর হৃদিতার সাথে? কিন্তু সেটা হলে তো আমাকে একবার ফোন করে জানাতে পারত। ফোনটাও বন্ধ করে রেখেছে।”
আশপাশে তাকিয়ে বিড়বিড় করে সমুদ্র। কিছু একটা ভেবে ক্যাম্পাসের বাইরের দিকে পা বাড়ায় সে।
কিছুটা পথ যেতেই দূর পশ্চিমে থাকা বড় বট গাছের নিচে থাকা আকাশ আর হৃদিতার‌ দিকে চোখ পড়ে সমুদ্রের। দুজনের অবস্থাই বেশ নাজেহাল। হৃদিতা আর আকাশ যদি এখানে থেকে থাকে তবে প্রাচী কোথায়?

৫০.
– “আকাশ, হৃদিতা তোমরা এখানে? প্রাচী কোথায়? আর তোমাদের এই অবস্থা কেন?”
আকাশ আর হৃদিতার‌ দিকে সন্দিহান চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় সমুদ্র।
মাথা ঝিমঝিম সহ ব্যাথায় মাথা ছিঁড়ে যাচ্ছে আকাশ আর হৃদিতার‌। সামনে থাকা সবকিছু ঝাপসা ঝাপসা দৃশ্যমান। দুজনের এহেন পরিস্থিতি দেখে ঘাবড়ে যায় সমুদ্র। পাশে থাকা পানির বোতল থেকে পানি নিয়ে দুজনের মুখশ্রীতে ছিটিয়ে দিতেই খানিকটা হুঁশ ফিরে আসে।
– “বোথ অফ ইউ ফাইন? আকাশ, হৃদিতা তোমাদের দুজনের সাথে তো প্রাচীর থাকার কথা তাই না? প্রাচী কোথায়?”
– “প্রাচী? প্রাচী তো আমাদের সাথেই ছিল। আমরা তো আইসক্রিম খেতে খেতে কফিশপের দিকে যাচ্ছিলাম। কিন্তু হঠাৎ করেই মাথাটা এত চক্কর দিয়ে উঠলো, তার পরে আর কিছুই মনে নেই। যখন জ্ঞান ফিরে আসে তখন নিজেদের এখানে আবিষ্কার করি।”
হৃদিতার বলা কথা শুনে সমুদ্রের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ ফুটে ওঠে। কিঞ্চিৎ পরিমাণ ভয় ও হচ্ছে। আর কিছু জিজ্ঞেস করতে যাবে তখনই হাতে থাকা ফোনটা তার নিজস্ব রিং টোনের শব্দে বেজে ওঠে।
অর্পিতা ফোন করেছে। এই ভরদুপুরে অর্পিতার ফোনকল আসাটা মোটেও সুবিধার মনে হয় নি সমুদ্রের কাছে। রিসিভ করতেই ফোনের অপর পাশ থেকে অর্পিতার কান্নাভেজা কন্ঠস্বর ভেসে আসে,
– “স্,স্য্,স্যার পিহু!”
পিহুর‌ নাম শুনে আঁতকে উঠে সমুদ্র।

– “পিহু? পিহুর কি হয়েছে? পিহু কোথায় মিস অর্পিতা, টেল মি!”
– “পিহুকে ওরা কিডন্যাপ করে নিয়ে গিয়েছে স্যার! প্লিজ আপনি পিহুকে বাঁচান।”
অর্পিতার কথা কর্ণপাত হতেই মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার উপক্রম সমুদ্রের। একদিকে প্রাচী আর অন্যদিকে পিহু। কাকে ছেড়ে কাকে বাঁচাবে সে?
– “কি হলো ভাইয়া? কিছু জানতে পেরেছেন প্রাচী কোথায় আছে?”
সমুদ্রের ভাবনার মাঝেই জিজ্ঞেস করে আকাশ।
– “না এখনো কিছু জানতে পারিনি। তবে তোমরা লাস্ট কোথায় ছিলে? আই মিন‌ সেই আইসক্রিম স্টল‌ কোথায় ছিল?”
আকাশ আর হৃদিতার‌ সহযোগিতায় ফের সেই জায়গায় পৌঁছাতেই অবাক হয় আকাশ, হৃদিতা।
কেননা যেই আইসক্রিম স্টলের সামনে তারা তিনজন দাঁড়িয়ে ছিল সেই স্টল পুরোটাই উধাও।
– “কি হয়েছে আকাশ, কোথায় স্টল?”
– “এখানেই ছিল স্টল টা। একটু আগেও তো ছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই কোথায় গায়েব হয়ে গেল? ”
আকাশ অবাক চাহনিতে প্রলাপ বকে। সমুদ্র একদৃষ্টে নিচের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। তার বুঝতে দেরি হয় না এসবের মূলে কে?

৫১.
মস্তিষ্কের অগ্রভাগে প্রচন্ড ব্যাথা অনুভূত হয়ে নড়েচড়ে উঠে প্রাচী। চোখ পিটপিট করে তাকালেও ঝাপসা ঝাপসা দেখতে পায় চারপাশে। মিনিট দুয়েক পর সবকিছু আবছা আবছা থেকে পরিষ্কার হতে থাকে। চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিতেই খেয়াল করে সে কোনো গোডাউন নয় বরং সুবিশাল রুমের মধ্যে অবচেতন অবস্থায় পড়ে ছিল।
কাঁচের দেয়াল ভেদ করে বাইরের সুবিশাল আকাশ দেখা যাচ্ছে। সে তো সকালে ভার্সিটিতে ছিল আর এখন তো সেই সকাল পেরিয়ে রাত। তার মানে এতক্ষণ ধরে সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিল?
হাত পায়েও কোনো বাঁধন নেই। বিছানা থেকে নেমে পড়তেই বাইরে থেকে সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো আওয়াজ কানে এসে পৌঁছায়। তার মানে কি সে এখন বর্তমানে কোনো সমুদ্র অঞ্চলে অবস্থান করছে।
মস্তিষ্ক জুড়ে নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খায় প্রাচীর। এখন তো তার সমুদ্রের সাথে থাকার কথা। সমুদ্র কোথায়? সমুদ্রের কথা মনে পড়তেই নিজের মোবাইল ফোন খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে প্রাচী। পুরো রুমে কোথাও ফোন খুঁজে না পেয়ে হতাশ হয় প্রাচী। তখনই পেছন থেকে গম্ভীর পুরুষালী কন্ঠ ভেসে আসে।

– “এটা খুঁজছো‌ মিসেস মেহরিশ‌ আয়াত প্রাচী?”
রুক্ষ কন্ঠস্বর। তড়িৎ গতিতে পেছনে ফিরে তাকায় প্রাচী। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিটির মুখশ্রী চিনতে বিন্দু মাত্র বিলম্ব হয় না প্রাচীর। বরং একরাশ বিস্ময়তা নিয়ে বলে উঠে,

– “রাইয়্যান স্যার, আপনি?”
– “ইয়েস মিসেস প্রাচী, আমি! কেন অন্য কাউকে খুঁজছিলে নাকি?”
খানিকটা তাচ্ছিল্যের সুরে বলে উঠে রাইয়্যান‌।
– “এসব কি? আমাকে কোথায় নিয়ে এসেছেন আপনি? আর আমাকে এভাবে আটকে রেখেছেন কেন?”
কর্কশ কন্ঠে জিজ্ঞেস করে প্রাচী।
– “আহা হাইপার হচ্ছো কেন? কাম ডাউন! সব তো পড়ে জানা যাবে। আগে রাতের ডিনার করে নাও। পড়ে সব বলছি।”
– “রাইয়্যান স্যার! আমি শেষ বারের মত জিজ্ঞেস করছি আপনি কোথায় নিয়ে এসেছেন আমাকে। আমি তো ভার্সিটিতে ছিলাম আকাশ আর হৃদিতার‌ সাথে। ওরা দুজন কোথায়? আমি সমুদ্রের কাছে যাব।”

– “বললাম তো সব বলব। আগে খেয়ে নাও।”
বলেই খাবারের প্লেট প্রাচীর দিকে এগিয়ে দিতেই রাগে ক্ষোভে খাবারের প্লেট পাশে ছুঁড়ে ফেলতেই তা কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে ভেঙে চৌচির হয়ে যায়।
– “আমি কি জিজ্ঞেস করছি আপনি তা শুনতে পারছেন না? আমি এখানে থাকব না। সমুদ্রের কাছে যাব আমি।”
বলেই দ্রুত পায়ে দরজার কাছে গিয়ে দরজা খুলতেই বাইরের দৃশ্য চোখে পড়ে। ভেতরে সুবিশাল আভিজাত্য বাড়ি মনে হলেও বাইরে থেকে খেয়াল করলে মাঝারি আকারের কুটিরের মত লাগে। দরজা খুলে বাইরে বের হতেই আরো এক ধাপ অবাক হয় প্রাচী। দূর দূরান্তেও কোনো বাড়িঘরের চিহ্ন নেই। চারপাশে শুধু সমুদ্রের নীলচে পানির ছড়াছড়ি আর বিশাল বিশাল গাছগাছালি‌। দেখে তো মনে হচ্ছে একটা পুরো দ্বীপের মাঝে রয়েছে সে।
– “বলেছিলাম না, এতো হাইপার হয়ে লাভ নেই। তুমি এখান থেকে কোথাও পালাতে পারবে না প্রাচী। তুমি এমন একটা জায়গায় আছো যার দূর দূর সীমানাতেও কোনো মানুষের বসবাস নেই। আর রইলো সমুদ্রের কথা? তার কথা এখন থেকে ভুলতে শুরু করে দাও; কারণ তোমার নাগাল সে আর কোনোদিনই পাবে না।”
কথাগুলো পেছন থেকে কর্ণপাত হতেই অবাকের চরম সীমানায় পৌঁছে যায় প্রাচী। কি বলছে এসব রাইয়্যান? তাহলে কি আসলেই সে আর সমুদ্রের সাথে দেখা করতে পারবে না?……….

#চলবে 🍂

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here